#বুকভরা ভালোবাসা
#পর্বঃ৫
#লেখিকাঃদিশা মনি
মেহুল ভয়ে ভয়ে বলে তার বাবাকে বলে,
‘এসব তুমি কি বলছ ড্যাডি?’
মনির চৌধুরী মৃদু হেসে বলে,
‘এমনি মজা করছিলাম।’
বাবার কথায় মেহুল স্বস্তি পায়। তারপর ভ্রু কুচকে বলে,
‘ড্যাডি তুমিও না। এরকম মজা করে আমায় ভয় পাইয়ে দিলে একদম।’
মনির চৌধুরী স্নিগ্ধর সাথে কথা বলতে থাকে। মেহুল এই সুযোগে রান্নাঘরে চলে যায়। মোহনার মা স্নিগ্ধর জন্য কফি করছিল। মেহুল সেখানে গিয়ে বলে,
‘মামনী তোমায় করতে হবে না। আমাকে দাও আমি কফি করতে চাই।’
‘তুমি পারবে তো?’
‘চেষ্টা করে দেখি।’
মেহুল নিজের হাতে কফি বানায়। আগে অনেকবার কফি বানাতে দেখেছে সে কিন্তু নিজে কখনো করেনি।
কফি তৈরি হওয়ার পর মেহুল খুব যত্ন করে নিয়ে আসছিল। মোহনা মেহুলকে এভাবে কফি নিয়ে আসতে দেখে ইচ্ছা করে তাকে ধাক্কা দেয়। যার কারণে কফি নিচে পড়ে যায়। মেহুলের হাতেও কিছু কফি পড়ে। গরম কফি হাতে পড়ে জন্য মেহুলের হাত জ্ব’লতে থাকে। মেহুল সহ্য করতে না পেরে চিৎকার করে দেয়। মোহনা নাটক করে বলে,
‘সরি। আমি আসলে দেখতে পাইনি।’
মেহুল খুব ভালোভাবে বুঝতে পারে মোহনা ইচ্ছা করেই এমনটা করেছে। তাই সেও কফির কাপ তোলার বাহানা করে মোহনার পায়ে গরম কফি ঢেলে দেয়।
মোহনার মা ছুটে এসে এই অবস্থা দেখে বলে,
‘কি হয়েছে?’
মোহনাঃকিছু হয়নি আম্মু। আমাদের ধাক্কা লেগে কফি পড়ে গেছে।
কথাটা বলে মেহুলের দিকে ভ্রু কুচকে তাকায় মোহনা। মেহুলও মোহনার মতোই একই কথা বলে। আর মনে মনে মোহনার উদ্দ্যেশ্যে বলে,
‘আমি এতদিন তোমার সব অন্যায় মেনে নিয়েছি মোহনা কিন্তু আর না। এবার তুমি বেশি বাড়াবাড়ি করছ। এখন থেকে তুমি আমার সাথে যেমন ব্যবহার করবে আমিও ঠিক তেমন ব্যবহারই করব।’
৯.
‘কোথায় গিয়েছিলি তুই ভাইয়া?’
মুগ্ধর প্রশ্নটা শুনে স্নিগ্ধ খুব শান্তভাবেই বলে,
‘আমি মেহুলের বাড়িতে গিয়েছিলাম ওর বাবার সাথে দেখা করতে।’
মুগ্ধ আর কিছু না বলে চুপচাপ নিজের রুমের দিকে চলে যায়। মুগ্ধর এরকম শান্ত ব্যবহারে স্নিগ্ধ বেশ অবাক হয়। স্নিগ্ধ ভাবতে থাকে,
‘মুগ্ধ তো এভাবে চুপ থাকার ছেলে নয়। সবসময় একটু বেশিই বলে ফেলে। আমি তো ভেবেছিলাম আমার মেহুলের বাড়িতে যাওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে ও অনেক রাগারাগি করবে। তাহলে এভাবে চুপ আছে কেন? কি চলছে আমার দুষ্টু ভাইটার মাথায়?’
এসব ভাবতে ভাবতেই স্নিগ্ধ নিজের রুমে চলে যায়। রুমে গিয়ে মেহুলের কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে। মেয়েটাকে আজকাল খুব ভালো লাগছে তার। সে জানে না এটা ভালোবাসা কিনা। শুধু জানে মেহুল নামের মেয়েটাকে আর আগের মতো অসহ্য লাগছে না।
সকালে ঘুম থেকে উঠে মেহুল বাগানে হাটতে বের হয়। তার প্রতিদিনের অভ্যাস এভাবে বাগানে হাটা। মোহনা সকালে উঠে বই নিয়ে বসে পড়ে। মোহনারা মেহুলদের বাগানের পাশেই একটি রুমে থাকে। মেহুলকে দেখে মোহনার মাথায় রাগ উঠে যায়। গতকালকের ঘটনাটা মনে পড়তেই বলে,
‘কালকের প্রতিশো’ধ তো আমি নিয়েই ছাড়ব। এই মেয়েটার এত সুখ আর আমার সহ্য হচ্ছেনা। বড়লোকের ঘরে জন্ম নিয়েছে তাই এত নিশ্চিন্তে আরাম করতে পারছে। আর এদিকে আমার দূর্ভাগ্য কাজের লোকের মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়েছি সারাদিন বই পড়তে হচ্ছে। যাতে নিজের সুন্দর ভবিষ্যত গড়তে পারি।’
মোহনা আর মেহুল দুজনেই ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে যায়। মেহুল যায় গাড়িতে আর মোহনা বাসে। মেহুল অবশ্য অনেক আগে থেকেই চাইত মোহনা যাতে তার সাথে গাড়িতে যায়। কিন্তু মোহনা তেজ দেখিয়ে বলে,
‘আমার কারো দয়ার দরকার নেই। আমি বাসে করেই যেতে পারব।’
মোহনার শুধু একটাই অনুতাপ সে নিজেকে অসুখী মনে করে। মেহুলের মা-বাবা মোহনাকেও অনেক সুযোগ সুবিধা দিয়েছে। মেহুলকে যা খাইয়েছে মোহনাও তাই খাইয়েছে,দুজনকেই ভালো জামা-কাপড় কিনে দিয়েছে,ভালো স্কুল-কলেজে পড়িয়েছে। এত সবকিছুর পরেও মোহনার কোন কৃতজ্ঞতা বোধ নেই। সে সবসময় শুধু মেহুলকে হিংসাই করে গেছে।
গাড়ি থেকে নেমে ভার্সিটির গেইট দিয়ে ঢোকার সময় মেহুল দেখতে পায় তারই ক্লাসমেট আশা লুকিয়ে লুকিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছে। আশা খুব ধনী পরিবারের মেয়ে। তার বাবা-মা সবসময় তাকে শাসনে রাখে। তার উপর নজরদারি করার জন্য লোকও ঠিক করে রেখেছে। সেই মেয়েকে এভাবে লুকিয়ে কোথাও যেতে দেখে মেহুলের মনে সন্দেহ জন্ম নেয়।
স্নিগ্ধ,মুগ্ধ দুই ভাইও সেইসময় ভার্সিটিতে চলে আসে। স্নিগ্ধর ক্লাসের টাইম হয়ে যাচ্ছিল তাই সে মেহুলের খোজখবর নিয়েই চলে যায়। মুগ্ধ তখনো সেখানে দাড়িয়ে থাকে। মেহুল ভ্রু কুচকে বলে,
‘এভাবে হ্যাব’লার মতো দাড়িয়ে আছেন কেন?’
মুগ্ধঃতুমি কাল কোন সাহসে আমার ভাইয়াকে নিয়ে গিয়েছিলে।
মেহুল মুগ্ধর কথার কোন উত্তর না দিয়ে তাকে ইগনোর করে সেখান থেকে চলে যায়। মুগ্ধ রাগে ফুসতে থাকে।
ইতির জন্য অনেকক্ষণ থেকে অপেক্ষা করে আছে মেহুল। এদিকে ইতির কোন নামগন্ধ নেই। ইতি এসেছে কিনা দেখার জন্য গেইটের কাছে যেতেই দেখতে পায় কয়েকজন ছেলে জোর করে আশাকে গাড়িতে তুলে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে।
মেহুল সেদিকে এগিয়ে যায়। মুগ্ধ দূরে দাড়িয়ে থেকে মেহুলকে এভাবে ছুটে যেতে দেখে নিজেও গেইটের বাইরে ছুটে আসে। মেহুল গাড়িটার পেছনে দৌড়াতে থাকে। তাকে এভাবে দৌড়াতে দেখে মুগ্ধ ছুটতে ছুটতে বলে,
‘এভাবে দৌড়াচ্ছ কেন?’
মেহুল তখন সমস্ত ঘটনা খুলে বলে। মুগ্ধ তখন তার বাইক নিয়ে এসে বলে,
‘বসে পড়ো। আমরা কিডন্যাপারদের ধরে ফেলব। আর তুমি পুলিশকেও সব জানাও। তারা আমাদের সাহায্য করতে পারবে।’
কথাটা বলা শেষ করে বাইক চালাতে শুরু করে মুগ্ধ। মোহনা এতক্ষণ দূরে দাড়িয়ে সব দেখছিল। মেহুলের উপর প্রতিশো’ধ নেওয়ার উপায় পেয়ে যায় মোহনা।
১০.
আশার কোন খোঁজ পাওয়া না গেলে আশার বাবা-মা এসে ভার্সিটিতে হুলস্থুল শুরু করে দেয়। আশার বাবা একজন প্রফেসরকে হু’মকি দিয়ে বলেন,
‘আমার মেয়ের কিছু হয়ে গেলে আমি আপনাদের কাউকে ছাড়ব না। সবার বিরুদ্ধে আমি স্টেপ নেব।’
প্রফেসর রেগে গিয়ে বলেন,
‘আপনার মেয়ে ভার্সিটিতে এসে কি করবে না করবে তার উপর নজরদারি করার জন্য কি আমরা বসে আছি? আমাদের দোষ দিচ্ছেন কেন?’
পাশে থাকা একজন লেকচারার প্রফেসরকে বলে,
‘উনি কিন্তু খুব পাওয়ারফুল লোক। ওনার সাথে পা’ঙ্গা নেওয়া ঠিক হবে না।’
মোহনা এই সুযোগটাই খুঁজছিল। সবার সামনে সে বলে,
‘আমি দেখেছি আশা একটি গাড়িতে করে কোথায় যেন যাচ্ছে। তার পিছন পিছন মুগ্ধ আর মেহুলকেও যেতে দেখেছি। আমার তো মনে হয় ওরা দুজন আশাকে পালাতে সাহায্য করেছে।’
আশার বাবা রেগে গিয়ে বলেন,
‘মুগ্ধ, মেহুল! এরা যেই হোক আমার মেয়ের কোন ক্ষতি হলে দুজনকেই আমি শে’ষ করে দেব।’
মোহনার তো ইচ্ছে করছিল আনন্দে নাচতে। শেষপর্যন্ত মেহুলকে একটি বড় বিপদে ফেলতে সক্ষম হয়েছে সে।
তবে তার এই খুশি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়না। কিছুক্ষণ পরেই আশাকে নিয়ে ফিরে আসে মুগ্ধ আর মেহুল। তাদের সাথে পুলিশও আসে। আশাকে দেখে তার দিকে ছুটে আসে আশার বাবা।
আশাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘কোথায় গিয়েছিলি তুই আশা? ঠিক আছিস তো?’
আশা কাদতে কাদতে বলে,
‘সরি আব্বু। আমি ভুল করেছি। আমি ভেবেছিলাম তোমরা কেউ আমায় ভালোবাসোনা তাই সবসময় আমায় শাসনে শাসনে রাখো। তাই আমি তোমাদের থেকে লুকিয়ে বান্ধবীদের সাথে সিনেমা হলে যাওয়ার প্ল্যান করি। কিন্তু রাস্তায় কয়েকজন আমায় তুলে নিয়ে যায়। তখন মুগ্ধ ভাইয়া আর মেহুল আপু আমায় সাহায্য করে।’
আশার বাবা বলেন,
‘এই ভয়েই তো আমি তোকে আগলে রাখি মা। এই শহরে আমার শত্রুর শেষ নেই। তুই আমার একমাত্র মেয়ে, আমার দূর্বলতা।’
আশাঃসরি আব্বু। আর কখনো এরকম ভুল করব না।
একজন পুলিশ অফিসার বলেন,
‘মুগ্ধ আর মেহুল তোমাদের সাহসের প্রশংসা কিন্তু করতেই হচ্ছে। তোমরা না থাকলে আমরা আশাকে উদ্ধার করতে পারতাম না।’
আশার বাবা তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলে,
‘আমি তোমাদের কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব। কখনো কোন প্রয়োজন হলে আমায় জানিও। আমি নিজের সবটুকু দিয়ে হলেও তোমাদের সাহায্য করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।’
স্নিগ্ধও এসব খবর পেয়ে দ্রুত ছুটে আসে। মেহুলকে দেখতে পেয়ে তার দিকে এসে বলে,
‘তুমি ঠিক আছো তো? এভাবে রিস্ক নেওয়া কিন্তু ঠিক হয়নি। বড় কোন বিপদ হতে পারত।’
মুগ্ধঃএই যে ভাইয়া। আমাকেও দেখ আমি তোমার নিজের ভাই আমারও তো বিপদ হতে পারতো।
স্নিগ্ধঃতোকে তো দেখে বোঝাই যাচ্ছে তুই একদম ঠিক আছিস।
মুগ্ধঃএখন আমার থেকে মেহুল বেশি আপন হয়ে গেল?
স্নিগ্ধঃনা ভাই। আমার তোদের দুইজনকে নিয়েই চিন্তা হচ্ছিল।
সবাই মুগ্ধ আর মেহুলের প্রশংসা করতে থাকে। যা শুনে মোহনা আরো বেশি রেগে যায়। এত চেষ্টা করেও সে মেহুলের কোন ক্ষতি করতে পারছে না।
এসবের মাঝে আশার চোখ যায় মুগ্ধর দিকে। আজ মুগ্ধই সব গু’ণ্ডাদের সাথে ফাই’ট করে আশাকে বাচিয়েছে। আশার মনে মুগ্ধর প্রতি জন্ম নিয়েছে অন্যরকম এক অনুভূতি যার নাম ভালোবাসা।
আশা আনমনে বলে দেয়,
‘আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি মুগ্ধ ভাইয়া। আমার আব্বুর পর এই প্রথম কোন পুরুষ আমায় প্রোটেক্ট করল। আপনিই আমার হিরো।’
চলবে কি?