#বিষাদময়_নিষাদ
পর্বঃ ১০
জাহান আরা
কতোক্ষণ কেটে গেছে নিষাদ জানে না।ভিজতে ভিজতে কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছে নিষাদ।
ভীষণ শীত লাগছে নিষাদের।অনেকক্ষণ ধরে ভিজার কারনে শরীরে কেমন জড়তা চলে এসেছে।বসা থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না নিষাদের,বুকের মধ্যে এসে জমে আছে একরাশ হতাশা।বুক ফেটে কান্না আসছে কিন্তু পারছে না কাঁদতে।
মন কিছুতেই মানতে চায় না চন্দ্র তাকে ছেড়ে চলে গেছে।কেনো চলে যাবে চন্দ্র?
এতোদিনেও কি চন্দ্র বুঝতে পারে নি নিষাদের ভালোবাসা।
আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায় নিষাদ।ছাদের বাতি জ্বালিয়ে দেয়।
বৃষ্টি থেমেছে অনেকক্ষণ আগে।আকাশ এখন পরিষ্কার। আকাশের দিকে তাকালে বুঝা যায় না এতোক্ষন ধরে কি তাণ্ডবলীলা চলেছে।
ছাদে লাগানো ফুলগাছ উল্টেপাল্টে পড়ে আছে ছাদে।শীতল হাওয়া এসে কাঁপিয়ে দিচ্ছে নিষাদকে।নিজেকে ব্যস্ত রাখতে নিষাদ সবগুলো গাছ সোজা করে দাঁড় করায়।নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চাচ্ছে নিষাদ এই মুহুর্তে।
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে নিষাদ,যেভাবেই হোক দেখা হলে,চন্দ্রর থেকে জেনে নিবে কেনো এরকম চোরের মতো পালিয়ে গেলো,নিষাদকে বললেই তো হতো।নিষাদ সসম্মানে চন্দ্রকে যেখানে চাইতো সেখানে দিয়ে আসতো।
নিষাদ তো চন্দ্রকে আটকে রাখে নি।
সিড়ির দরজার পাশের গোলাপ গাছটা সোজা করে তুলে দিতে গিয়ে নিষাদ কিছুটা চমকে উঠে।গোলাপ গাছের কাটার সাথে আটকে আছে চন্দ্রর শাড়ির একটুকরো।
মুহুর্তেই নিষাদের বুকের ভিতর রক্ত ছলাৎ করে উঠে।
এই শাড়িটা আজকে চন্দ্রর পরনে ছিলো।কিন্তু কিভাবে গাছে আটকালো এটা!
নিষাদ তুলে নেয় হাতে,তারপর রুমে চলে যায়।ওয়াশরুমে ঢুকে গরম পানি দিয়ে দীর্ঘসময় নিয়ে গোসল করে নিষাদ।তারপর রুমে এসে পোশাক পরে নেয়।
কফিমেকারে এক মগ কফি বানিয়ে ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসে চন্দ্রর শাড়ির টুকরো নিয়ে।
তারপর কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকে নিষাদ।অনেক হিসেব বাকী নিষাদের,হিসেব মেলাতে হবে এখন।
কফি শেষ করে দারোয়ান চাচার রুমে যায় নিষাদ।অনিচ্ছাসত্ত্বে ও দারোয়ান চাচাকে ঘুম থেকে তুলতে হয়।
নিষাদকে রুমের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মাসুদ আলী কিছুটা অবাক হলেন।
নিষাদ সোজাসুজি কথায় চলে গেলো,”চাচা,ভেবেচিন্তে আমাকে জানান,আপনি কি আজকে চন্দ্রকে বাসা থেকে বের হতে দেখেছেন বিকেল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে?”
“না স্যার,ম্যাডাম আইজকা তো বাইর হয় নাই বাসা থাইকা।”
“আপনি বাসায় কাউকে আসতে দেখেছেন?”
“না,কেউ তো আসে নাই।”
“দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একবার ও কি গেইট ছেড়ে গেছেন কোথাও?”
“না স্যার,কই যামু আমি গেইট ছাইড়া?”
“চাচা,ভালো করে ভেবে দেখেন একটু।”
মাসুদ আলী কিছুটা চিন্তায় পড়ে যায়।রাত ৯টা পর্যন্ত তার ডিউটি। তারপর সে ঘুমাতে চলে যায়।রাতের ৯টা থেকে ডিউটি থাকে কাদেরের।সকাল ৯টা পর্যন্ত।
সপ্তাহে ১ দিন ছুটি থাকে ২ জনের।সেদিনের জন্য একজন দারোয়ান আছে।গেইট ছেড়ে কোথাও যাওয়া লাগে না মাসুদ আলীর।প্রতিদিন রুটিনবাঁধা কাজ তার।
হঠাৎ করেই মনে পড়ে মাসুদ আলীর,উত্তেজিত হয়ে বলে,”মনে পড়ছে স্যার,তুফানের সময় একটা পাগল আইছিলো গেইটের সামনে,ভিতরে ঢুকবার চাইছিলো,আমি গেইট খুলি নাই দেইখা অনেকক্ষণ ধইরা লাথি মারছিলো গেইটে,পরে আমি বাইর হইয়া যাই পাগলরে খেদানোর লাইগা,হেরপর আবার চইলা আসছি গেইটে,এই ধরেন ৩-৪ মিনিট।
৫ মিনিট পর আবারও আইছিলো হেই পাগল,আমি আবারও খেদাইয়া দিছি তখন আবার গেইট ছাইড়া গেছি ৩-৪ মিনিটের মতো।”
নিষাদের চেহারার দিকে তাকিয়ে মাসুদ আলী ভয় পায় ভীষণ। ফর্সা চেহারা কেমন লাল হয়ে গেছে,কান দুটো,গাল দুটো টকটকে লাল,যেনো টোকা দিলেই রক্ত বের হবে।
চোখে কেমন ঘোর লাগা দৃষ্টি নিষাদের। চেহারায় অসন্তোষ।
সাহসে কুলোয় না মাসুদ আলীর কিছু জিজ্ঞেস করতে।
কিছু না বলে নিষাদ রুমে চলে যায়।মাথায় রক্ত উঠে গেছে নিষাদের।
মনে মনে কসম করে নিষাদ,চন্দ্রর যদি একফোঁটা ক্ষতি হয়,তো রক্তের বন্যা বইয়ে দিবে সে।
পাতাল থেকে হলেও চন্দ্রকে খুঁজে বের করবে কালকে দিনের মধ্যে।চন্দ্রকে না দেখতে পেলে নিষাদ মরেই যাবে।
—————————
চন্দ্রর চোখের বাঁধন,মুখের বাঁধন,হাতের বাঁধন খুলে দিয়েছে কেউ একজন এসে,ছেলে নাকি মেয়ে কিছুই বুঝা যাচ্ছে না।চাদরে ঢাকা শরীর।
চন্দ্র হাতের দিকে তাকায়,দাগ কেটে বসে গেছে নাইলনের শক্ত দড়ি চন্দ্রর হাতে।
রক্ত জমে আছে।
চন্দ্র উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে,শরীর ভীষণ দুর্বল লাগছে চন্দ্রর,মাথা ঝিমঝিম করছে।
একটু পরেই ১০-১২ বছরের একটা বাচ্চা এসে খাবার দিয়ে যায় চন্দ্রর সামনে।
খাবারের দিকে তাকাতেই চন্দ্রর নাড়িভুঁড়ি উলটে আসে।বিচ্ছিরি দেখতে কি একটা তরকারি,সাদা সাদা,যেনো হলুদ ই দেয় নি,ভাতের মধ্যে লম্বা একটা চুল।
বমি এসে যায় চন্দ্রর।
পিচ্ছিটা চন্দ্রর দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,”খাইবেন না?”
মাথা তুলে তাকায় চন্দ্র,তারপর মাথা ডানেবামে নাড়িয়ে অসম্মতি জানায়।
পিচ্ছিটা অবাক হয়ে চন্দ্রকে দেখে,তারপর বলে,”আপনে মেলা সুন্দর ”
মুচকি হাসে চন্দ্র শুনে,তারপর অনেকটা আপন মনেই বলে,”আমার ভালোবাসার মানুষ আরো বেশী সুন্দর,আর তার মনটা সবচেয়ে বেশি সুন্দর। ”
খাবার নিয়ে ফেরত যেতে নেয় পিচ্ছিটা,চন্দ্র পিছন থেকে জিজ্ঞেস করে,”এটা কোন জায়গা?”
“ঢাকা।”
“ঢাকা তো বুঝলাম,কিন্তু নির্দিষ্ট নাম নেই এখানকার? ”
“তা তো জানি না আপা,আমি জানি এইডা ঢাকা।”
চন্দ্র আর কিছু জিজ্ঞেস করে না।বুঝতে পারে এই বাচ্চাটা তেমন কিছুই জানে না।বাচ্চাটা বের হতেই বাহির থেকে দরজা আটকে দেয় কেউ,তালা মারার শব্দ হয় খট করে।
চন্দ্র চারদিকে তাকায় রুমের,একপাশে কতোগুলো পুরোনো স্যু পরে আছে,অন্যপাশে অনেকগুলো কার্টুন।
চন্দ্র উঠে সবগুলো কার্টুন দেখে,সবই খালি।কিছুই নেই।
ধপ করে বসে পড়ে চন্দ্র।ভীষণ ইচ্ছে করছে এই মুহুর্তে নিষাদকে দেখতে।
একবার যদি নিষাদকে ভালোবাসি বলতে পারতো,তবে চন্দ্রর আর কোনো আক্ষেপ থাকতো না।
মরে যেতেও আপত্তিও থাকতো না।
বুকের ভিতর কিসের তৃষ্ণা অনুভব করে। কাউকে প্রচণ্ড ভালোবাসার তৃষ্ণা।
কিছুই বুঝতে পারছে না চন্দ্র এরা কারা,কেনো এভাবে তাকে আটকে রেখেছে,কি চায়!!!
এখান থেকে কি মুক্তি পাবে চন্দ্র?
চলবে…???