#বিষাদময়_নিষাদ
পর্বঃ ০৯
জাহান আরা
তুমুল বর্ষণে ভেসে যাচ্ছে চারদিক।বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে প্রতিমুহূর্তে।
আমড়াগাছের ডাল ভেঙে পড়লো বাগানে।একটু পরে পড়লো আম গাছের বিশাল এক ডাল।ছড়িয়ে পড়েছে গাছের কাঁচা আম সব।নিষাদ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে কোথায় গেলো চন্দ্র এই দুর্যোগের রাতে।
হঠাৎ মনে পড়লো নিষাদের ছাদে তো যায় নি সে।চন্দ্র হয়তো ছাদে আছে।
খুশীতে ভরে যায় নিষাদের মন।দৌড়ে যায় ছাদের দিকে।
ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়েই চন্দ্রকে জড়িয়ে ধরে।সিঁড়ির প্রতিটি ধাঁপ যেনো আজ ভীষণ বিশালাকার মনে হয়।নিষাদ পারছে না যেতে দ্রুতগতিতে।ছাদটা যেনো আজ ভীষণ দূরে।
ছাদের দরজা হাট করে খোলা,দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নিষাদ হা করে নিশ্বাস নেয়।তারপর ছাদে যায়।
মুহুর্তেই একরাশ হতাশা,যন্ত্রণা,ব্যথা এসে আছড়ে পড়ে নিষাদের বুকে।অন্ধকার নেমে আসে চোখে মুহুর্তে।নেই,নেই,কেউ নেই ছাদে।
শূন্য ছাদ।কোথাও কেউ নেই।
বৃষ্টি বাড়ছে,পাথরের মতো শিল এসে পড়ছে নিষাদের গায়ে।বৃষ্টির বড়বড় ফোঁটা এসে এফোঁড়ওফোঁড় করে দিচ্ছে নিষাদকে।
মাথার রগ দপদপ করছে রাগে।কার উপর রাগ?
নিজের উপর?
নাকি চন্দ্রর উপর?
জানা নেই নিষাদের।
———————-
অন্ধকার চারদিকে,চন্দ্রর চোখ বেঁধে রেখেছে কেউ।চন্দ্রর জ্ঞান ফিরেছে এইমাত্র।এখনো কিছু বুঝে উঠতে পারছে না চন্দ্র।সে কোথায় আছে?
পিছমোড়া করে ২ হাত বেঁধে রেখেছে কেউ।কে রেখেছে এভাবে?
কেনো রেখেছে?
আস্তে আস্তে মনে পড়ে চন্দ্রর।
নিষাদের উপর রাগ করে চন্দ্র ডাইনিং এ যায়,নাশতার টেবিল থেকে ফল কাটার ছুরি তুলে কোমরে গুঁজে নেয় শাড়ির মধ্যে।আজ খুন চেপেছে চন্দ্রর মাথায়।নিজেকে একটা বড় শাস্তি দিবে চন্দ্র।অনেক বড় শাস্তি।তারপর ছাদে চলে গিয়েছে।তারপর ছাদে দাঁড়িয়ে ভিজেছিলো বৃষ্টিতে।বৃষ্টির বড়বড় ফোঁটায় কেঁপে উঠছিলো চন্দ্র বারবার।
বাহিরে ঝড়ে যেমন ভেঙে পড়ছে গাছপালা সব তেমন ঝড় হচ্ছে চন্দ্রর মনে।সেই ঝড় লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে চন্দ্রর ভিতরে জমিয়ে রাখা সব স্বপ্ন।নিষাদের জন্য গড়ে উঠা ভালোবাসা। কিন্তু নিষাদ তো তাকে কাছে টেনে নেয় নি।
কেনো?
এতো অভিমান কেনো নিষাদের?
এই বাদলা দিনে তো নিষাদ পারতো ভালোবাসার বৃষ্টিপাত করে ২ জনের মধ্যকার সব দূরত্ব ঘুচিয়ে দিতে।তবু কেনো নিষাদ মুখ ফিরিয়ে নিলো?
কান্না পায় ভীষণ চন্দ্রর।বসে পড়ে ছাদে পা মেলে,তারপর কাঁদতে থাকে ফুঁপিয়ে।সে যে ভিতরে ভিতরে মরে যাচ্ছে তা কিভাবে বুঝাবে চন্দ্র নিষাদকে?
এই যে এতো যত্ন করে সাজলো নিষাদের জন্য,নিষাদ কি একটু ও বুঝতে পারে নি চন্দ্রর মনের কথা?
এই যে যত্ন করে রান্না করলো,কই তবুও তো নিষাদ বুঝে নি কিছু।
এই যে নিষাদ বাসায় ফেরা পর্যন্ত চন্দ্র প্রতিদিন বসে থাকে কখনো কি নিষাদ অনুভব করে নি চন্দ্র কেনো বসে আছে এতোরাত পর্যন্ত?
বুকের ভিতর কতো অভিযোগ জমে আছে নিষাদের নামে।
নিষাদ কি বুঝবে না কখনো?
নিজের উপর নিজের খুব রাগ হয় চন্দ্রর।ইচ্ছে করে আবার নিজেকে খুন করে ফেলতে।কেনো এতটা হতভাগ্য সে?
কেনো সময় থাকতে বুঝে নি নিষাদের গভীর ভালোবাসা আজ কেনো ভিখিরিনীর মতো নিষাদের ভালোবাসা ভিক্ষা করছে তবে?
কোমরে রাখা ছুরি নিতে যাবে তার আগেই কি হলো হঠাৎ করে যেনো।কেউ যেনো ছাদে এলো,ঝড়ের বেগে এসে চন্দ্রর মুখ চেপে ধরে ক্লোরোফর্ম দেওয়া একটা রুমাল।খামচি দিয়ে ধরে চন্দ্র অজ্ঞাত ব্যক্তির হাত।চন্দ্রর হাতে চলে আসে তার হাতের থেকে কিছু একটা।ব্রেসলেট জাতীয় কিছু।তারপর নিস্তেজ হয়ে যায় চন্দ্রর শরীর।
আর কিছু মনে নেই চন্দ্রর।
শরীর কেমন অসাড় লাগছে চন্দ্রর।ঠান্ডায় পুরো শরীর অবশ হয়ে আসছে।নড়াচড়া করতে পারছে না চন্দ্র।নাইলনের শক্ত দড়ি যেনো হাতের মাংস কেটে বসে যাচ্ছে চন্দ্রর শরীরে।চিৎকার করতে চাচ্ছে কিন্তু গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না,মুখ বেঁধে রাখা বলে।
কোথায় আছে চন্দ্র এখন তাও বুঝতে পারছে না। কেমন অসহায় লাগছে চন্দ্রর হঠাৎ করে।নিষাদ কি কখনো জানতে পারবে কি বিপদে আছে চন্দ্র?
পর মুহুর্তেই হেসে উঠে চন্দ্র।ভালোই হয়েছে।নিষাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেলেই তো ভালো। নিষাদ বেঁচে যাবে চন্দ্রর হাত থেকে।কখনোই নিষাদ জানবে না চন্দ্র কোথায় আছে,কেমন আছে।কখনো নিষাদ জানবে না চন্দ্র নিষাদকে ভালোবাসে যে!
——————–
সিঁড়িতে ধপ করে বসে পড়ে নিষাদ।কি করবে এখন সে?
চন্দ্র কোথায় চলে গেলো হঠাৎ করে।।মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়েছে।
ঘটনা সাজাতে থাকে নিষাদ মাথায় পরম্পরায়।
নিষাদ বাসায় ফিরে সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় চন্দ্রর মুখোমুখি হয়।তারপর নিজে থেকেই খাবার বেড়ে দিয়েছিলো চন্দ্র। খাবার সেরে নিষাদ বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। চন্দ্র এসে নিষাদের সোফায় শোয়।নিষাদ গিয়ে শোয় বিছানায়।
চন্দ্র উঠে আসে আবার বিছানায়,নিষাদের পাশে।এই প্রথম নিষাদের গায়ে হাত রাখে চন্দ্র।
তখন কেমন কেঁপে উঠেছিলো নিষাদ,ইচ্ছে করছিলো এই হাত আজীবন এভাবে রাখতে।
কিন্তু পারে নি নিষাদ রাখতে,অভিমানে উঠে যায় নিষাদ বিছানা থেকে।
তারপর ঘুমিয়ে পড়ে নিষাদ কখন!
ঘুম ভাঙে নিষাদের অজানা এক ব্যথায়।তবে কি চন্দ্রর কোনো বিপদ হয়েছে?
এজন্যই নিষাদের ঘুম ভেঙে গেছে?
তারপর ই নিষাদের মনে পড়ে,চন্দ্র সেজেছিলো কালো শাড়ি পরে,ঠোঁটে লিপস্টিক,চোখে কাজল।তবে কেনো সেজেছে চন্দ্র আজ হঠাৎ করে?
তবে কি চন্দ্রর কোথাও যাওয়ার ছিলো?
এজন্যই কি চন্দ্র আজ নিজ থেকে নিষাদের গায়ে হাত রেখেছে?
চলে যাওয়ার কথা বলতেই?
মোচড় দিয়ে উঠে নিষাদের বুকের ভিতর।সত্যি তো!
চন্দ্র তো কখনোই এভাবে সাজে নি।আজ এরকম এক দুর্যোগময় দিনে কেনো সাজবে হঠাৎ করে কোথাও যাওয়ার প্ল্যান না থাকলে।
বুকের ভিতর কেমন ভার ভার লাগে নিষাদের।চন্দ্র চলে গেছে তাকে ছেড়ে!
পরক্ষণেই মনে পড়ে বের হলে তো দারোয়ান চাচা দেখতো।
আবার মনে পড়ে,হতে পারে চন্দ্র দারোয়ান চাচার চোখ ফাঁকি দিয়েই চলে গেছে।
হতাশায় ছেয়ে যায় নিষাদের মন।ছাদে গিয়ে বসে পড়ে নিষাদ ঝুম বৃষ্টিতে। মনের যতো কষ্ট তা মুছে নেয় যেনো বৃষ্টি।নিজের অজান্তেই চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে কয়েক ফোঁটা জল।
নিষাদ ভেঙে পড়ে খুব।
নিষাদ জানতেই পারে না ঠিক এই জায়গায় বসে কিছুক্ষণ আগে চন্দ্র বসে কেঁদেছে অঝোরে।
কেউ দেখে নি,কেউ সাক্ষী ছিলো না চন্দ্রর কান্নার।সাক্ষী ছিলো এই ঝুম বৃষ্টি,এই ঝড়ো হাওয়া।
কি আকুতি নিয়ে চন্দ্র নিষাদকে চেয়েছিলো তার সাক্ষী এই দুর্যোগময় দিন।
চলবে…???