#বিষাদময়_নিষাদ
পর্বঃ ০৮
জাহান আরা
হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরার পর অনেকদিন কেটে গেছে।
চন্দ্রর অবস্থা হয়েছে গলাকাটা মুরগির মতো।নিষাদের অসীম ভালোবাসা চন্দ্রকে পাগল করে দিয়েছে।
নিষাদ কে হাসপাতাল থেকে বাসায় আনার ২ দিন পর চন্দ্র নিষাদের আলমারি তে প্রেসক্রিপশন রাখতে গিয়ে একটা গিফট বক্স পায়।
উপরে লিখা “আমার ভালোবাসা”
কেমন সন্দেহ হয় চন্দ্রর।চুপিচুপি বক্সটা খুলে ফেলে নিষাদের অলক্ষ্যে।
সেদিন চন্দ্র কেঁদেছিলো অঝোরে।
বক্স থেকে বের হয়েছে চন্দ্রর একটা পুরোনো জুতা।
সেই কবে এই জুতা চন্দ্রর পা থেকে খুলে পড়ে যায় কোথায়।অথচ নিষাদ সেই জুতা কি যত্নে আগলে রেখেছে।
পৃথিবীতে কেউ কেউ অসীম ভালোবাসার ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়।আর কেউ কেউ জন্মায় ভালোবাসা উপেক্ষা করার জন্য।
নিষাদ আলাদা ঘুমায় এক সোফায় আর চন্দ্র বিছানায়।
চন্দ্রর রাত কাটে এক অজানা ভালোবাসার তৃষ্ণায়।সামনে ভালোবাসা ভর্তি সমুদ্র অথচ চাইলেই সেই ভালোবাসার জল পান করা যায় না।এর চাইতেও তীব্র কষ্ট কি আর অন্য কিছুতে হতে পারে!
বুকের ভিতর তিল তিল করে জমিয়ে রাখছে নিজের কষ্ট,ভীষণ ইচ্ছে করে চন্দ্রর নিষাদকে ভালোবাসতে,কিন্তু এক অদৃশ্য বাঁধা রয়েছে চন্দ্রর।চন্দ্রর সেই সাহস হয় না।
চন্দ্র চাইলেও পারে না নিষাদকে ভালোবাসতে।
নিষাদের ব্যস্ত সময় কাটছে।সামনে নির্বাচন এগিয়ে আসছে।নিষাদ ইলেকশনে দাঁড়াবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।আগামী বছর নির্বাচন এই বছর থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছে নিষাদ।
সেই ঘটনার পর থেকে চন্দ্র কেমন চুপ হয়ে গেছে।না যাচ্ছে ভার্সিটিতে,না যাচ্ছে নিজেদের রাজনৈতিক কোনো কাজে।
একেবারে থমকে গেছে চন্দ্র।নিষাদ অবশ্য চন্দ্রর কোনো বিষিয়ে আর হস্তক্ষেপ করে নি,না বলেছে একটা কথা চন্দ্রর সাথে।ইচ্ছে করেই অবহেলা করছে চন্দ্রকে।
নিষাদ বুঝে গেছে ভালোবাসা সবার জন্য আসে না।কারো কারো জন্ম হয় ভালোবাসা দেয়ার জন্যই শুধু,পাওয়ার জন্য না।
চৈত্র মাসের শেষের দিকে একদিন।
আকাশে ঘন কালো মেঘ জমেছে। দুপুর বেলায় অন্ধকার হয়ে এসেছে চারদিক।হাসনাত সাহেব মনোয়ারা বেগম বাসায় নেই।হাসনাত সাহেব মনোয়ারা বেগম কে নিয়ে কক্সবাজার গিয়েছেন।
চন্দ্র অবাক হয়ে দেখে এই বয়সেও শ্বশুর শাশুড়ির মধ্যে কি গভীর ভালোবাসা।
এখনো প্রতি সপ্তাহে শুক্রবারে ২ জন ঘুরতে বের হয়,শপিং করে,সিনেমাহলে যায় মনোয়ারা বেগমের মুড অফ হলেই বের হয়ে যান হাসনাত সাহেব ঘুরতে।
জীবন কি আনন্দময় তাদের কাছে।
চন্দ্রর বুক ছিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বের হয়।সে কখনো দেখে নি এরকম ভালোবাসা বাবা মায়ের।
কখনো কি বাবা কে দেখেছে চন্দ্র!
মনে নেই চন্দ্রর।
বাবার কথা ভাবলেই আবছা আবছা লাগে।একটা দীর্ঘাকার ছায়া।আর কিছু মনে পড়ে না।
নিষাদের জন্য আজ নিজের হাতে রান্না করেছে চন্দ্র।রান্না শেষ করে রুমে যায় চন্দ্র।গোসল সেরে একটা কালো শাড়ি পরে নেয়।
আজ কয়েকদিন ধরেই চন্দ্রর ভীষণ ইচ্ছে করছে নিষাদের ছোঁয়া পেতে।
নিজেকে মাঝেমাঝে বেহায়া মনে হয়।আবার মনে হয়,আমারই তো স্বামী,না হয় একটু বেহায়া হলাম।
বাহিরে মেঘ জমেছে দেখে নিষাদ আজ তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে।বাসায় চন্দ্র একা আজ।
নিষাদ বাসায় ফেরার ১০ মিনিট পরেই ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়,আকাশে মেঘের গর্জন।যেনো লড়াই করছে কয়েকশ দানব।
এখন দুপুর নাকি রাত বুঝার উপায় নেই।
বাসার সার্ভেন্টরা সবাই নিজ নিজ কোয়ার্টারে।
নিষাদ বাসায় ঢুকতে দেখে চন্দ্র রুমে ঢিকে যায়। তারপর ঠোঁটে লাল কালার লিপস্টিক লাগায়,চোখে হালকা কাজল।কোমরে শাড়ি গুঁজে ব্যস্ত ভঙ্গীতে বের হয় রুম থেকে।
সিঁড়িতেই নিষাদের মুখোমুখি হয় চন্দ্র।
চন্দ্রকে এরকম রূপে দেখে নিষাদ কিছুটা চমকে উঠে।
বুকের ভিতর কাঁপন ধরে যায় নিষাদের। অনেকদিন ধরে বুকের ভিতর চেপে রাখা আগুন হঠাৎ করেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠে।
চন্দ্র দাঁড়ায় না একটুও,দ্রুত নেমে যায় সিঁড়ি থেকে।নিষাদের কিছুটা সময় লাগে ধাতস্থ হতে।তারপর একটা বড় করে শ্বাস নেয় নিষাদ।
রুমে গিয়ে হাতমুখ ধুঁয়ে ডাইনিং এ আসে নিষাদ।খাবার প্লেট এগিয়ে দেয় চন্দ্র নিষাদের দিকে।কিছু না বলে নিষাদ চুপচাপ খেয়ে নেয়।
টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে চন্দ্র।ভীষণ ইচ্ছে করছে নিষাদের সাথে কথা বলতে তার।কিন্তু নিষাদের এরকম গম্ভীর মুখ দেখে কিছু বলতে সাহস পাচ্ছে না চন্দ্র।
চুপচাপ খেয়ে উঠে যায় নিষাদ।সব গুছিয়ে রেখে চন্দ্র রুমে যায়।
নিষাদ বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে চন্দ্র গিয়ে নিষাদের সোফায় শুয়ে পড়ে।নিষাদ কে দিয়ে কথা বলাতে হলে এর চাইতে কার্যকরী কোনো উপায় নেই চন্দ্রর।
রুমে ঢুকে চন্দ্রকে সোফায় শুয়ে থাকতে দেখে নিষাদ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে।
চন্দ্র উঠে আবার বিছানায় আসে,নিষাদ অন্যদিকে ফিরে শোয়।
চন্দ্র নিজেই এবার এক দুঃসাহসিক কাজ করে বসে।নিষাদের দিকে এগিয়ে গিয়ে নিষাদকে জড়িয়ে ধরে।
আলগোছে চন্দ্রর হাত সরিয়ে দেয় নিষাদ।তারপর উঠে গিয়ে সোফায় শুয়ে পড়ে।
ভীষণভাবে অপমানিত হয় চন্দ্র।কান্না আসে বুক ফেটে।বুকের ভিতর কিসের ভাঙন শুরু হয় চন্দ্রর।বুঝতে পারে না চন্দ্র।
কান্না আসে পুরো শরীর ঝাঁকি দিয়ে।
ধীর পায়ে বের হয়ে যায় রুম থেকে।
সোফায় শুতেই নিষাদের ঘুম চলে আসে।কতোক্ষন ঘুমিয়েছে জানা নেই নিষাদের,ঘুম ভাঙে হঠাৎ করেই।বুকের ভিতর কিসের যেনো বিপদ সংকেত বেজে উঠে নিষাদের।
তাড়াতড়ি উঠে চন্দ্র কে ডাক দেয় নিষাদ।
চন্দ্র নেই রুমে।নিষাদ রুম থেকে বের হয়ে নিচে চলে যায়।কোথাও নেই চন্দ্র,না ড্রয়িংরুমে,না বাগানে।
বাতাসে বাগানে গাছের ডালপালা ভেঙে পড়ছে।তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে।নিষাদের বুক কাঁপে অজানা ভয়ে।চন্দ্র কোথায় গেছে?
একদৌড়ে গেইটের সামনে যায়,দারোয়ান বসে আছে তার রুমে।
নিষাদকে ভিজতে ভিজতে আসতে দেখে বের হয়ে আসে।
ব্যস্তভাবে জিজ্ঞেস করে নিষাদ,”চাচা,চন্দ্র কি বের হয়েছে বাহিরে?”
“না তো স্যার,ম্যাডাম যায় নি কোথাও বাহিরে।”
নিষাদ আবারও বাসায় যায়।উপর নিচ সবখানে খোঁজা শেষ,চন্দ্র কোথাও নেই।
তবে চন্দ্র গেলো কই?
চলবে….???