#বিষাক্তফুলের আসক্তি
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্ব-১৫+১৬
বিয়েটা আজ আর এখনই হবে।
রায়হান কথাটা শেষ করতেই সজোরে থা*প্প*ড় পরলো তার গালে। সেই আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হলো বার কয়েক। মহিবুল আর রেহেনা স্তব্ধ হয়ে আছে নিজের মেয়ের কাজে।
রায়হান রক্তচক্ষু করে তাকালো মৌয়ের দিকে, মৌ ?
মৌ নিজের ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে শান্ত গলায় বললো, চুপ একদম চুপ। তোর ঐ নোংরা মুখে আমার নামও নিবি না রায়হান।
মহিবুল মেয়েকে ধমক দিয়ে বললো, এটা কেমন ব্যবহার মৌ ?
মৌ বাবার দিকে টলমলে চোখে তাকিয়ে বললো, এই বি*কৃ*ত মস্তিষ্কের লোকটা এই ব্যবহারটাও ডিজার্ভ করে না বাবা।
মহিবুল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো মেয়ের দিকে, এসব কেনো বলছিস মা ?
এখনই দেখাচ্ছি বাবা।
মৌ ড্রয়িংরুমের স্মার্ট টিভির সাথে নিজের ফোন কানেক্টেড করে নিলো। যে ভিডিওতে তিতির সব সত্যিটা স্বীকার করেছে সেটা প্লে করলো সবার সামনে। মহিবুল আর রেহেনা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেটা দেখে।
মহিবুল আফসোসের সুরে বললো, ছেলেটা সেদিন আবার আবার বলেছিলো সে নিদোর্ষ কিন্তু আমরা কেউ বিশ্বাস করিনি তাকে।
রাগে চোখমুখ লাল টকটকে হয়ে গেছে রায়হানের। এই মুহুর্তে তিতিরকে সামনে পেলে কোনো চিন্তা ভাবনা ছাড়া খু*ন করে ফেলতো। মেয়েটা তাকে শেষ করে দিয়েছে একদম। কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই রায়হান কোমর থেকে পি*স্ত*ল বের করে মহিবুলের মাথায় ঠেকালো। চমকে উঠলো মৌ আর রেহেনা। ঘৃণায় মৌয়ের মুখ ভরে থু থু এলো।
মৌ ক্ষিপ্ত গলায় বললো, আর কত নিচে নামবি রায়হান ?
রায়হান রেগে ফুসফুস করছে, একদম বা*জে বকবক করবি না। তুই বিয়েটা না করলে তোর বাবা-মাকে এক সেকেন্ডে উপরে পাঠিয়ে দিবো। এই বরযাত্রী ভেতরে আয় তো সবাই।
রায়হানের বলার সাথে সাথে তার দল-বল ভেতর প্রবেশ করলো কাজি নিয়ে। সে সব ব্যবস্থা করেই এসেছে। সে জানতো তিতির হাত গুটিয়ে পালিয়ে যাওয়ার মেয়ে নয়। কিছু একটা করবে মনে করেই প্রস্তুত হয়েই এসেছে রায়হান। মহিবুল আর রেহেনার হাতমুখ বেঁধে রুমের এক কোণে বসিয়ে দিলো রায়হানের লোকজন আর তাদের মাথায় পি*স্ত*ল তাক করে আছে দুজন। রায়হানের একটা ইশারায় সব শেষ করে দিবে তারা। মৌ নিজের বাবা-মায়ের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রায়হানের দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকালো। রায়হান আরাম করে সোফায় বসে মৌকে সরাসরি সামনের সোফায় বসার ইশারা করলো।
মৌ না বসলে ধমকে উঠলো রায়হান, কী সমস্যা বসতে বলেছি তো ?
রায়হানের ধমকে কেঁপে উঠলো মৌ। ধপ করে বসে পরলো সামনের সোফায়, মুখোমুখি দুজন।
রায়হান হাতে পি*স্ত*ল ঘুরাতে ঘুরাতে বললো, তোকে পাঁচ মিনিট সময় দিলাম ভাবার জন্য। ভেবে নে কী করবি ? কোনো ঝামেলা ছাড়া আমাকে বিয়ে করবি নাকি একসাথে বাবা-মায়ের লা*শ দেখবি।
মৌ কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, তুই এমন কী করে করতে পারিস রায়হান ?
রায়হান মুচকি হেসে বললো, আমি কী কী করতে পারি সেটার ধারণা তিতির খুব সুন্দর করে বর্ণনা করেছে তো। তিতিরপাখির সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক, আমার বোন হয়। নিজের স্বার্থ হাসিল করার জন্য নিজের বোনদের ব্যবহার করতে একবার ভাবিনি, তাদের খু*ন করা লাগলে তাই করতাম। সেখানে তোর বাবা-মা আমার কেউ না, কী মূল্য আছে তাদের বল। বিয়ে তোকে করতে হবে মৌ, সেটা তোর নিজের ইচ্ছেতে কিংবা কিছু বিধ্বংসী মুহূর্ত উপভোগ করার পর বাধ্য হয়ে।
মৌ ডুকরে কেঁদে উঠলো এবার। এখন বেশ ভালো করে উপলব্ধি করতে পারছে তিতিরের অসহায়ত্ব। মেয়েটা দীর্ঘ দেড় মাস এই যন্ত্রণা ভোগ করেছে। যেখানে কয়েক মিনিটে মৌয়ের দম বন্ধ হয়ে আসছে। মৌ কী করবে ভেবে পাচ্ছে না।
হঠাৎ রায়হানের এক লোক এসে জানালো তাজ এসেছে নিচে। মৌ যেনো আশার আলো খোঁজে পেলো একটু। কিন্তু রায়হানের কথা শুনে ধপ করে নিভে গেলো সেটাও।
রায়হান বাঁকা হেসে বললো, ভালো করে খাতির যত্ন করে উপর নিয়ে আয়। মিস্টার তাজওয়ার খান তাজ তোর সাথে তো অনেক বছরের হিসাব করা বাকি আছে আমার।
মৌ ব্যস্ত গলায় বললো, তাজকে কিছু করিস না প্লিজ।
রায়হান ঘাড় কাত করে বাঁকা চোখে তাকালো মৌয়ের দিকে, কত ভালোবাসা ? এর অর্ধেক ভালো যদি আমাকে বাসতি আজ এসব কিছুই হতো না।
রায়হান চোখমুখ শক্ত করে বললো, যা নিয়ে আয় ম্যাডামের আশিককে।
মৌ গুটিশুটি মেরে বসে আছে সোফায়। কাঁদতে ভুলে গেছে সে। কী করবে বুঝতে পারছে না। রায়হান গত দশ মিনিট ধরে তাকিয়ে আছে মৌয়ের দিকে আর মৌ নিজের বাবা-মায়ের দিকে তাকাচ্ছে আর চোখ মুছছে। তখনই তাজকে টানতে টানতে রায়হানের সামনে ধাক্কা দিয়ে ফেললো রায়হানের লোকজন। তাজকে দেখে পিলে চমকে উঠলো মৌয়ের।
চিৎকার করে বললো, তাজ।
তাজ নিভু নিভু চোখে তাকালো সামনে বসে থাকা রায়হানের দিকে। সারা মুখে র*ক্তে মাখামাখি তার। নাক থেকে র*ক্ত বের হচ্ছে, ঠোঁটের কোণ আর কাপাল কে*টে ফিনকি দিয়ে র*ক্ত বের হচ্ছে।
রায়হান তাজের গাল চেপে ধরে উপরে তুলে দেখে বললো, খাতির যত্ন কম হয়ে গেছে তো।
আসলে উনার ফ্যান ছিলাম তো তাই একটু কনসিডার করেছি। স্যার এটা কেমন হিরো বলুন তো। মুভিতে দেখি একাই একসাথে কতজনকে মে*রে কাত করে দেয় আর একটা ঘু*ষি পর্যন্ত দিতে পারলো না আমাদের। ধুর আমি বুঝে গেছি মুভিতে যা দেখায় সব বানানো। আমি আর মুভিই দেখবো না।
রায়হান ছেড়ে দিলো তাজের গাল বাঁকা হেসে বললো, তা যা বলেছিস সব বানোয়াট। কিন্তু তাজ তুই নাকি ক্যারেটে শিখেছিস, বক্সিং করিস, এক্সারসাইজ করে কী বডি বানিয়েছিস। এতসব করে কী লাভ ভালো নিজেকেই তো রক্ষা করতে পারলি না। শেম অন ইউ ইয়ার, এত দূর্বল প্রতিপক্ষ নিয়ে খেলা জমে না।
তাজ ভাঙা গলায় বললো, কেনো করছিস এসব ?
রায়হানের চোখমুখ লাল হয়ে উঠলো আর তাজের গাল চেপে ধরলো, সেই ছোটবেলা থেকে মৌয়ের জন্য একটার পর একটা সেক্রিফাইস করে এসেছি। ওর মুখে হাসি ফোটানোর জন্য ইচ্ছে করে তোকে ক্লাস টপার হতে দিয়েছি। প্রায় কম্পিটিশন তোকে জেতানোর জন্য নিজে সরে এসেছি। কেনো শুধুমাত্র মৌ খুশি হবে বলে। এমন কী গান রেকর্ডিংয়ের মতো সুযোগ ছেড়ে দিয়ে তোকে সুযোগ করে দিয়েছিলাম।
তাজ অবাক হয়ে বললো, মানে ?
তোর প্রথম গান যে রেকর্ড করেছে সে প্রথমে আমাকে সিলেক্ট করেছিলো। বাবার সাথে এক পার্টিতে গিয়ে তুই আমি দু’জনেই গান গেয়েছিলাম মনে আছে ?
তাজ একটু ভেবে বললো, হ্যাঁ মনে আছে। আমার প্রথম গানের মিউজিক ডিরেক্টর বলেছিলো সেই পার্টিতেই সে আমার গান শুনেছে।
রায়হান তাচ্ছিল্যের সুরে বললো, মিথ্যা বলেনি। সেই পার্টিতে দুজনের গান শুনে প্রথমে আমাকে রেকর্ডিংয়ের অফার দেয়। আমি খুশি হয়ে জানিয়েছিলাম মৌকে।
কিন্তু মৌ শুনে বললো, তোকে একা বলেছে তাজকে বলেনি ?
আমি যখন বললাম, না তাজকে বলেনি।
মৌয়ের হাসিখুশি মুখে আধার নেমে এলো। সেটা তীরের মতো বিঁধল আমার বুকে। বাড়ি ফিরে সেই লোককে জানিয়ে দিলাম আমি গানটা গাইতে পারবো না সে যেনো তোর গান রেকর্ড করে। যে মুভিতে আমার গান মুক্তি পাওয়ার কথা ছিলো সেই মুভিতে তোর প্রথম গান মুক্তি পেলো। তারপর আর তোকে ফিরে তাকাতে হয়নি। গানের সাথে একসময় মুভির অফারও পেয়ে গেলি। আর সেদিনের পর আমি পুরোপুরি সরে আছি নিজের স্বপ্ন থেকে। আমারও স্বপ্ন ছিলো বড় সিঙ্গার হওয়ার, অভিনেতা হওয়ার। শুধুমাত্র মৌকে খুশি রাখার জন্য, যার জন্য আমি এত এত সেক্রিফাইস করলাম শেষে তুই তাকেও নিজের করতে চাইলি। এবার কীভাবে চুপ থাকবো আমি তাজ ? সব ছেড়ে দিয়েছি তোর জন্য কিন্তু যাকে পাওয়ার জন্য এসব করলাম তাকে কীভাবে দিয়ে দেই তোকে ?
তাজ একবার ঘুরে তাকালো মৌয়ের দিকে, এসবের মাত্র কয়েকটা ঘটনা জানা ছিলো তাজের। কিন্তু সবটা জানার পর কী রিয়াকশন দেওয়া উচিত ভুলে গেছে। তার এতদিনের গড়া ক্যারিয়ারে শুধু তার পরিশ্রম ছিলো না, ছিলো কারো আত্মত্যাগ। তাজের হঠাৎ নিজেকে অনেক ছোট মনে হতে লাগলো, তার ক্যারিয়ার অনেকটা দান করেছে রায়হান। ভাবতেই চোখমুখ কুঁচকে গেলো তাজের।
তাজ নিজেকে সামলে বললো, তিতিরকে কেনো আনলি এসবের মাঝে ?
রায়হান সোফায় হেলান দিয়ে আরাম করে বসলো, তিতিরকে আনা অনেকটা এক ঢিলে দুই পাখি মা*রার মতো। তিতিরপাখি আমার মামাতো বোন। আজ থেকে প্রায় ষোল বছর আগে তিতিরের বাবা মানে আমার মামা আবির মাহমুদের থেকে তার সম্পত্তি দখল করার জন্য, আমার বাবা খু*ন করে মামা-মামী দুজনকেই। কিন্তু মামার বিশ্বস্ত বডিগার্ড নুরুল তিতিরপাখিকে নিয়ে পালিয়ে যায়। বাবা প্রোপার্টি দখল করতে গিয়ে জানতে পারে সব তিতিরের নামে উইল করে রেখেছে মামা। তিতির হওয়ার পর মামী আর কনসিভ করতে পারেনি। তাই তিতিরের নামে সব উইল করে দিয়েছিলো কিন্তু তিতিরের যখন আট বছর তখন আবার কনসিভ করে মামী। যে রাতে পাখির জন্ম হয় সেই রাতেই বাবা মামা-মামীকে খু*ন করে, কীভাবে যেনো নুরুল পালিয়ে যায় তিতিরপাখিকে নিয়ে। কিন্তু প্রোপার্টি দখল করতে গিয়ে বাবা যখন জানতে পারে সব তিতিরের নামে তখন তার মাথায় আকাশ ভেঙে পরে। পুরো শহর তন্নতন্ন করে খোঁজেও পায়নি। কিন্তু দু’বছর আগে তিতিরকে খোঁজে পাই আমি। বাবা চেয়েছিলো তিতিরের সাথে আমার বিয়ে দিয়ে সম্পত্তি পুরোপুরি নিজের নামে করতে। কারণ বিয়ের আগে তিতির সেই প্রোপার্টি কাউকে দিতে পারবে না আর তিতিরের সন্তান জন্ম নিলে অটোমেটিক সব তার নামে হয়ে যাবে এমনই উল্লেখ ছিলো উইলে। কিন্তু আমি তো তিতিরকে কখনোই বিয়ে করবো না আর নুরুল মা*রা যাওয়ায় তখন তিতিরের আর্থিক অবস্থা খারাপ। সংসার চালিয়ে পাখির দেখাশোনা সব মিলিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। কিছুদিন নজর রাখার পর বুঝতে পারলাম তিতিরের প্রাণ ভোমরা পাখি। পাখির জন্য ও যেমন নিজের জীবন দিতে পারবে, তেমন কারো জীবন নিতেও দু’বার ভাববে না। দুধের শিশুকে ছোট হাতে মায়ের মতো বড় করেছে তো। তখনই আমার মাথায় প্ল্যান চলে আসে। তিতিরের সাথে তোর বিয়ে দিয়ে প্রোপার্টিও দখল করা হয়ে যাবে আর মৌয়ের জীবন থেকে তোকেও সরানো হয়ে যাবে। ব্যাস আমার প্ল্যান সাকসেসফুল করতে কৌশলে তিতিরকে তোর পি.এ হিসাবে পাঠিয়ে দেই। তুই ক্যারিয়ার ছাড়া সবকিছুতে উদাসীন সেটা আমি জানি, এতবছরে মৌকে ভালোবাসতে পারিসনি তিতিরকেও পারবি না সেটা জানতাম। তাই লোক লাগিয়ে রাখি তোদের সাথে, এক্সিডেন্টলি কাছে আসা মুহুর্তের ছবি তুলে প্রমাণ হিসাবে জমাতে থাকি আর একজন ডাক্তার হিসাবে একটা রিয়াল প্রেগন্যান্সি রিপোর্ট জোগাড় করা কঠিন কিছু নয়। মোক্ষম সময়ে এসব সামনে এনে তোর ক্যারিয়ার আর মৌ দুটোই কেড়ে নিলাম। যেসব প্রমাণ সামনে এনেছিলাম একটাও ফেইক ছিলো না শুধু একটু বুদ্ধির খেলা ছিলো। শহরের প্রতিটা হসপিটালে আমার লোক আছে তাই তুই সঠিক তথ্য বের করতে পারিসনি, প্রতিটা হসপিটাল থেকে একই রিপোর্টের কপি দেওয়া হয়েছে তোকে।
কথাগুলো শেষ করে রায়হান বি*শ্রিভাবে হাসতে লাগলো। প্রথমে রায়হানের করা সেক্রিফাইজের কথাগুলো শুনে তাজের কষ্ট হয়েছিলো তার জন্য। কিন্তু পরে তার কৃতকর্মের বর্ণনা শুনে ঘৃণায় গা গুলিয়ে এলো। তিতিরের সাথে করা ব্যবহারের জন্য নিজের প্রতি রাগ হতে লাগলো, আফসোসও হচ্ছে খুব। তাজ সোজা রায়হানের নাক বরাবর ঘুষি বসিয়ে দিলো। মুহুর্তে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে লাগলো। রায়হানের লোকজন এগিয়ে আসতে নিলে রায়হান হাতের ইশারায় থামিয়ে দিলো।
রায়হান বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে রক্ত মুছে নিলো, আরে থাক থাক কিছু বলিস না। নায়ক সাহেব ক্যারিয়ার হারানোর দুঃখে এটুকু করতেই পারে। অনেক হয়েছে ড্রামা এবার বিয়ে হবে আর আমাদের বিয়ে সাক্ষী হবে সুপারস্টার তাজওয়ার খান তাজ।
মৌ চিৎকার করে বললো, তোর মতো বি*কৃ*ত মস্তিষ্কের মানুষকে কখনো বিয়ে করবো না আমি।
রায়হান মৌয়ের বাবা-মায়ের মাথায় পি*স্ত*ল তাক করে রাখা ছেলেকে বললো, জুয়েল এ মনে হচ্ছে সোজা কথায় কাজ করবে না। তোর আঙ্গুলটা বাঁকা করতেই হবে।
রায়হান মৌয়ের বাবা-মায়ের মাথায় পি*স্ত*ল তাক করে রাখা ছেলেকে বললো, জুয়েল এ মনে হচ্ছে সোজা কথায় কাজ করবে না। তোর আঙ্গুলটা বাঁকা করতেই হবে।
তাজ মাথা নিচু করে হাসছে। রায়হান ভ্রু কুঁচকে তাকালো তাজের দিকে।
কী রে মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেলো নাকি ?
তাজ পেছনের টি-টেবিলে হেলান দিয়ে রায়হানের দিকে তাকালো, ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা।ডানহাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে ঠোঁটের কোণের রক্ত মুছে সেদিকে তাকালো।
একদিন নিজের শরীরের রক্ত দিয়ে তোকে বাঁচিয়েছিলাম। ভালো প্রতিদান দিলি কিন্তু রায়হান। আচ্ছা একটা কথা বল তো রায়হান। আমার ভুলটা কোথায় ছিলো ? না তোকে বলেছি আমার জন্য কিছু ছাড় দিতে আর না মৌকে বলেছি তোকে রেখে আমাকে ভালোবাসতে। কিন্তু সবদিক থেকে ক্ষতি তুই আমিই করেছিস। ভালোবাসা শব্দটার উপর ঘৃণা ধরে গেছে আমার।
রায়হান শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাজের দিকে। না সে চোখে রাগ দেখা যাচ্ছে আর না অনুশোচনা।
তাজ রায়হানের পাশে সোফায় নিজের পা তুলে দিয়ে টি-টেবিলে হেলান দিয়ে বসলো।
থাক সেসব কথা, তোকে একটা শো দেখাই। আমার ফেবারিট শো।
রায়হান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে তাজের দিকে। তাজ টি-টেবিল থেকে রিমোটটা নিয়ে টিভি অন করলো। টিভি স্কিনে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো রায়হান। তাজ টিভির উল্টো দিকে মুখ করে রায়হানের দিকে তাকিয়ে আছে। তাজ একটার পর একটা চ্যানেল চেঞ্জ করে লাগলো। প্রত্যেকটা চ্যানেলে লাইভ দেখা যাচ্ছে রায়হানকে। তাজ মনের সুখে শিস বাজাতে লাগলো। টিভিতে শোনা যাচ্ছে তাজের শিস বাজানোর শব্দ।
রায়হান রেগে তাজের কলার ধরে দাঁড় করিয়ে বললো, কী হচ্ছে এসব ?
তাজ নিজের কলার থেকে রায়হানের হাত ছাড়িয়ে বললো, সারাদেশের মানুষের সামনে যে দাগ আমার চরিত্রে লাগিয়েছিলি সেই দাগ সারাদেশের মানুষের সামনেই মুছে ফেললাম। তোর কী মনে হয়, তাজওয়ার খান তাজ ঘাসে মুখ দিয়ে চলে ? এতো কষ্ট করে কারাটে, বক্সিং শিখলাম তোর চুনোপুঁটি লোকের হাতে মার খেতে ? সত্যিটা সবার সামনে তোর নিজের মুখে স্বীকার করানোর জন্যই এই চুনোপুঁটি মেরে হাত গন্ধ করতে চাইনি।
রায়হান রেগে আবার কলার চেপে ধরলো তাজের আর তাজ হাহা করে হাসতে লাগলো।
রায়হান তাজকে মারার উদ্দেশ্যে হাত উঁচু করতেই পেছন থেকে আওয়াজ এলো, দ্যা গেইম ইজ ওভার মিস্টার রায়হান চৌধুরী ওরফে ডার্ক ডেভিল।
রায়হান বিস্ফোরিত চোখে ঘুরে তাকালো পেছনে। তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে র্যাবের একটা টিম। রায়হানের প্রত্যেকটা লোকের মাথায় গান তাক করে রেখেছে। চোখের পলকে সবাইকে হাতকড়া পরিয়ে ধাক্কাতে ধাক্কাতে নিয়ে গেলো।
রায়হান ঢোক গিলে বললো, ডার্ক ডেভিল মানে ?
ভয়ে রায়হানের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের আনাগোনা দেখা দিলো। তার কোড নেইম এরা কীভাবে জানলো বুঝতে পারছে না রায়হান।
র্যাবের টিম ইনচার্জ এএসপি মাসুদ আহমেদ মুচকি হেসে বললো, সেটা তো আমাদের সাথে গেলেই বুঝতে পারবেন।
মাসুদ তার সাথের একজন অফিসারকে ইশারা করলো রায়হানকে হাতকড়া পড়াতে, সে তাই করলো।
রায়হান তাজের দিকে তাকিয়ে শাসিয়ে বললো, তোকে আমি ছাড়বো না তাজ। তবে যাওয়ার আগে একটা কথা বলে যাই তোকে।
রায়হান তাজের কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, তিতির যাওয়ার আগে তোর জীবন থেকে আবারও কিছু কেড়ে নিয়ে গেছে। তুই ভাবতে ভাবতে পাগল হয়ে যাবি সেটা কী ? কিন্তু এর উত্তর তুই কোনদিন পাবি না আর না পাবি কোনোদিন তিতিরের দেখা।
রায়হানও যেতে যেতে শিস বাজিয়ে কোনো গানের সুর তুললো। কিন্তু তাজের চেনা চেনা লাগলেও বুঝতে পারলো না সেটা কোন গানের সুর। হয়তো সেই সুরে তাজ উত্তর পেয়ে যেত আবার কী কেঁড়ে নিয়েছে তিতির। রায়হান মৌয়ের দিকে একটা কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বের হয়ে গেলো র্যাবের সাথে। তাজ ধুপ করে বসে পড়লো সোফায়। রায়হানের সামনে নিজেকে কঠিন দেখালেও ভেতরে ভেতরে সে ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। তিতির সাথে করা অন্যায় তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। মৌ দৌড়ে গিয়ে বাবা-মায়ের হাত মুখের বাঁধন খুলে দিলো। রেহেনা ছাড়া পেয়ে কাশতে লাগলো।
মৌ ব্যস্ত হয়ে বললো, বাবা তুমি মাকে নিয়ে ভেতরে যাও।
মহিবুল রেহেনাকে নিয়ে নিজেদের বেডরুমে চলে গেলো। মৌ ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো তাজের দিকে অনেক দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে কাছে দাঁড়ালো তাজের।
তাজ নিজের মাথার চুল খামচে ধরে ধীর গলায় বলছে, How could I do that ? I r*a*p*ed her.
তাজের কথা শুনে মৌ যেনো জমে গেলো। কী বলছে এসব তাজ ?
মৌ কাঁপা গলায় বললো, এসব কী বলছো ?
তাজে গর্জে উঠলো, শুনতে পাসনি কী বলছি ? আমি রে*প করেছিলাম ঐ মেয়েটাকে। যেখানে সকলে পরিস্থিতির স্বীকার সেখানে কেবল তাকেই শাস্তি দিয়েছি আমি। হিং*স্র জা*নো*য়ারের মতো আচরণ করেছিলাম সেই রাতে। রাগে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম আমি আর এই সবকিছুর জন্য দ্বায়ী তুই।
মৌ দু’কদম পিছিয়ে গেলো তাজের থেকে, আমি ?
তাজ রাগে থরথর করে কাঁপছে, হ্যাঁ হ্যাঁ তুই। তোর জন্য রায়হান এমন ডেস্পারেট হয়ে উঠেছে। তুই স্বার্থের জন্য ব্যবহার করেছিস ওকে।
মৌয়ের চোখে পানি টলমল করছে, আমি তো শুধু তোমাকে ভালোবেসে এসব করেছি।
তাজ দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে বললো, কে চেয়েছে তোর এমন ভালোবাসা ? তুই ভালোবেসে এসব করে থাকলে রায়হানও তোকে ভালোবেসে এতো অন্যায় করেছে। ভালোবাসার শাস্তি যদি রায়হান পায় তাহলে তোরও পাওয়া উচিত। কারণ তুইও কম অন্যায় করিসনি রায়হানের সাথে।
মৌ কাঁপা গলায় বললো, কী শাস্তি ?
তাজ নিজের চোখ মুছে গম্ভীর গলায় বললো, রায়হান যেমন ওর ভালোবাসা পায়নি ঠিক তেমনই তুই কোনোদিন পাবি না তোর ভালোবাসা। আজকের পর আর কোনোদিন তুই আমার সামনে আসবি না আর এটাই তোর শাস্তি।
তাজ হনহনিয়ে বের হয়ে গেলো মৌদের বাসা থেকে। নিজেকে তার পাগল পাগল লাগছে। একবার হলেও তিতিরের দেখা পাওয়া দরকার। সেরাতের আচরণের জন্য সরি বলতে হলেও তিতিরের দেখা পাওয়া দরকার। এখানে নির্দোষ তো কেউ নেই, তবে শাস্তি কেনো একা তিতিরের ভাগ্যে লেখা। অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছে তাজের হৃদয়। চোখের সামনে ভাসছে তিতিরের সাথে করা জঘন্য সেই ব্যবহারগুলো।
“বুঝবে তুমি বুঝবে
যেদিন সব বুঝবে
হারিয়ে আমায় খুঁজবে
তবে দিনশেষে শূণ্য হাতে
নিজের নীড়ে ফিরবে
বিষাক্তফুল নেই আপন করতে
তার ঘ্রাণেও যে হবে প্রাণনাশ”
তিতিরের বলা ছন্দের মানে আজ বুঝতে পারছে তাজ। তবে কী আর কোনোদিন দেখা হবে না বিষাক্তফুলের সাথে তাজের ? জানা হবে না সে হয়ে উঠেছিলো আর জীবনের বিষাক্তফুলের আসক্তি। মেয়েটা আসক্ত হয়েছিলো তাজ নামক মানুষের।
১৯.
প্রেমে পড়া বারণ
কারণে অকারণ
আঙুলে আঙুল রাখলেও হাত ধরা বারণ
প্রেমে পড়া বারণ
কারণে অকারণ
আঙুলে আঙুল রাখলেও হাত ধরা বারণ
প্রেমে পড়া বারণ
তোমায় যত গল্প বলার ছিল…
তোমায় যত গল্প বলার ছিল
সব পাপড়ি হয়ে গাছের পাশে ছড়িয়ে রয়েছিল
দাওনি তুমি আমায় সেসব
কুড়িয়ে নেওয়ার কোনো কারণ
প্রেমে পড়া বারণ
কারণে অকারণ
ওই মায়া চোখে চোখ রাখলেও ফিরে তাকানো বারণ
প্রেমে পড়া বারণ
শূন্যে ভাসি রাত্রি এখনও গুনি
তোমার আমার নৌকা বাওয়ার শব্দ এখনও শুনি
শূন্যে ভাসি রাত্রি এখনও গুনি
তোমার আমার নৌকা বাওয়ার শব্দ এখনও শুনি
তাই মুখ লুকিয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে
বসন্তের এই স্মৃতিচারণ
প্রেমে পড়া বারণ
কারণে অকারণ
মনে পড়লেও আজকে তোমায় মনে করা বারণ
প্রেমে পড়া বারণ
প্রেমে পড়া বারণ
গানটা শেষ করতেই তিতিরের বন্ধ চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে গেলো নোনাজল। আহান তাকিয়ে আছে তার তুতুলের দিকে। এভাবে তো সে দেখতে চায়নি তার তুতুলকে। যুদ্ধে পরাজিত হওয়া সৈনিক হিসাবে দেখতে চায়নি তাকে। সে চেয়েছিলো ছোটবেলার মতো চঞ্চল আর প্রাণোবন্ত মেয়েটাকে ফিরে পেতো।
ছদ্মবেশে সিলেটের ছোট একটা কটেজে উঠেছে তারা, সকালে এসে সিলেট পৌঁছেছে। কিছু খেয়ে নেওয়ার জন্য তিতিরকে ডাকতে এসেছিল। তিতির কটেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে গানটি গাইছে দেখে সেখানেই দাঁড়িয়ে যায়।
মনে মনে বললো, কিছু বারণ মানতে ইচ্ছে করে না তুতুল। কিছু বারণ উপেক্ষা করে নিজেকে পোড়াতে ইচ্ছে করে কারো প্রেমের আগুনে। তাই তো মানুষ জেনে শুনে প্রেম নামক আগুনে ঝাঁপ দেয়।
গতরাতে তিতির যখন বলেছিলো সে প্রেগনেন্ট। আহান কিছু সময়ের জন্য পাথর হয়ে গিয়েছিলো যেনো। কোনমতে নিজেকে সামলে শুধু বলেছিলো ঘুমিয়ে নে। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত তিতিরের সাথে আর কথা হয়নি। আহান অনেক ভেবে ঠিক করেছে বাচ্চাটাকে প্রয়োজনে নিজের পরিচয়ে বড় করবে তবু তিতিরকে আর একা ছাড়বে না।
কিছু খেয়ে নিবি চল। এই অবস্থায় বেশি সময় না খেয়ে থাকা ঠিক না।
তিতির চমকে উঠে পেছনে ফিরে তাকালো, খেতে ইচ্ছে করছে না।
নিজের জন্য না হলেও ভিতরে বেড়ে উঠা প্রাণটার জন্য খেতে হবে।
পাখি কোথায় ?
তোর জন্য অপেক্ষা করছে। আজ সে আপুনির হাতে ছাড়া খাবে না।
তিতির কথা না বাড়িয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো। আহান দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে তিতিরের পিছনে গেলো। তিতির যত্ন করে খাইয়ে দিচ্ছে বোনুকে। তিতির নিজে খাচ্ছে না দেখে আহান একটু খাবার নিয়ে তিতিরের মুখের সামনে ধরলো। তিতির তাকালো আহানের দিকে তবে কিছু বললো না। চুপচাপ খাবারটা মুখে নিলো।
আহান নিজের মুখেও খাবার তুললো, ভাইয়াকে র্যাব ধরে নিয়ে গেছে।
তিতিরের হাত থেমে গেলো তাকালো আহানের দিকে, তবে আমরা এবার স্বাধীন।
আহান ছোট করে বললো, হুম।
তিতির আবার পাখিকে খাওয়ানোতে মনোযোগ দিলো, তোকে গতকাল একটা প্রশ্ন করেছিলাম। উত্তরটা এখনো দিসনি। আমার বোনুকে দেখে রাখবি বিনিময়ে সব প্রোপার্টি আমি তোর নামে করে দিবো আহু।
আহানের হাত থেকে গেলো। চামচটা প্লেটে রেখে দিলো একটু শব্দ করে, তুই কী আমাকেও রায়হান চৌধুরীর মতো মনে করিস তুতুল ?
সেটা হতে যাবো কেনো ? তোকে রায়হান চৌধুরীর মতো মনে করলে তার সাথে আসতাম না বরং তোর থেকে পালানোর চেষ্টা করতাম।
তবে কেনো মনে করছিস, প্রোপার্টির স্বার্থে আমি পুতুলের খেয়াল রাখবো।
তিতির দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, রাখতে না চাইলে থাক। আমি অন্য ব্যবস্থা করে নিলো।
আহান তিতিরের এক হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে বললো, তুই চাইলে আমি নিজের জীবনটাও দিতে রাজি তুতুল।
তিতির প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকালো আহানের দিকে আহান বললো, আজ থেকে পুতুল আর তোর সব দ্বায়িত্ব আমার। তোর এই বন্ধুকে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত পাশে পাবি। একবার হারিয়ে গিয়েছিলি আর হারাতে দিবো না।
তিতিরের চোখে টলটল করছে নোনাজল। নুরুল মারা যাওয়ার পর যেনো অথৈ সাগরে পড়েছিলো বোনুকে নিয়ে৷ পাশে পায়নি কাউকে তারপর জবটা হলো। সেখানেই হয়তো সবচেয়ে বড় ভুল করেছিলো জীবনের, জবটা নিয়ে।
আহু রে আমার জীবনটা এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। আমি চাইনা আমার বোনুর জীবনটা এলোমেলো হোক। বড্ড বেশি ভালোবাসি ওকে।
আহান চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করলো তিতিরকে, আগামীকাল ওসমানী বিমানবন্দর থেকে লন্ডন যাচ্ছি আমরা।
তিতির ভয় পেয়ে বললো, রায়হান চৌধুরী যদি আবার কিছু করে।
আহান বললো, ভয় পাস না রায়হান চৌধুরী জেলে, সে কিছুই করতে পারবে না আর লন্ডনে আমি নিজের ঠিকানা পরিবর্তন করে ফেলেছি। সেখানে আমাদের এতো সহজে খোঁজে পাবে না ভাইয়া বা অন্য কেউ।
আর তোর বাবা ?
আহান তাকালো তিতিরের দিকে। মেয়েটার চোখমুখে এখনো আতংক।
চলবে,,,,