#বিষাক্তফুলের আসক্তি
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্ব-১৩+১৪
গাইনোকোলজিস্ট সাবিত্রী দেবীর চেম্বারে থম মেরে বসে আছে তিতির। যে মিথ্যা দিয়ে গল্পের শুরুটা হয়েছিলো, সেই মিথ্যাটা এখন সবচেয়ে কঠিন সত্যি হয়ে দাঁড়িয়েছে তিতিরের সামনে।
সাবিত্রী দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, তিতির তুমি আমার মেয়ের বয়েসী। তাই নিজের মেয়ে মনে করেই বলছি তুমি এবরশন করে ফেলো। এই বাচ্চাটা তোমার শরীরের শত্রু হয়ে দাঁড়াবে।
মনে হচ্ছে কেউ শক্ত করে তিতিরের গলা চেপে ধরেছে। কিছুতেই গলা থেকে আওয়াজ বের করতে পারছে না।
অনেক কষ্টে বললো, কিন্তু ম্যাম ওর কী দোষ ?
দোষ ওর নয় তিতির, দোষ তোমার শারিরীক অবস্থার। তোমার শারিরীক অবস্থা বাচ্চা জন্ম দেওয়ার জন্য উপযুক্ত নয়।
কিন্তু পঁচিশ বছর তো বাচ্চা জন্ম দেওয়ার জন্য উপযুক্ত বয়স তাহলে ?
উপযুক্ত বয়স হলেও তোমার অনেক কমপ্লিকেশন আছে সেটা রিপোর্টে স্পষ্ট। যত সময় যাবে তুমি তত অসুস্থ হতে থাকবে। ডেলিভারিতে তোমার আর বাচ্চার দুজনেরই লাইফ রিস্ক হয়ে যাবে।
তিতির কী বলবে বুঝতে পারছে না।
তিতির কোনমতে বললো, আমার একটু সময় চাই।
ঠিক আছে, তুমি ভালো করে চিন্তা ভাবনা করে দেখো। তবে বেশি দেরি করো না, তাহলে এবরশনও রিস্ক হয়ে যাবে।
তিতির এলোমেলো পায়ে বের হয়ে গেলো হসপিটাল থেকে। মাঝে আরো দুটো দিন পেরিয়েছে, একটু বেশি অসুস্থ ফিল করায় হসপিটালে এসেছিলো তিতির। এখানে এসে এসব জানতে পারবে কল্পনাও করেনি। এবার কী করবে সে ? বাচ্চাটাকে বাঁচাতে গিয়ে যদি সেও মা*রা যায় তাহলে পাখিকে কে দেখবে। বাচ্চাটা এখনো একটা ভ্রুণ মাত্র কিন্তু পাখিকে সে কোলেপিঠে করে বড় করেছে ষোল বছর ধরে। নিজের সন্তানের থেকে কোনো অংশে কম নয় পাখি। কাকে বেছে নিবে তিতির সন্তান, নাকি বোন। আর তাজ সে কখনো এই বাচ্চা মেনে নিবে না। সবাই যদি এই বাচ্চার কথা জানতে পারে তাহলে মৌ ফিরে পাবে না তাজকে। নাহ তিতির কাউকে জানতে দিবে না এই বাচ্চার কথা। তিতির নিজের পেটে হাত রেখে অনুভব করার চেষ্টা করলো। অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে তিতিরের, এখানে ছোট একটা প্রাণ আছে।
তিতির কাঁদতে কাঁদতে বললো, মাকে মাফ করে দে সোনা। তোর মা যে বড্ড স্বার্থপর। শুধু যদি নিজের জীবনের ঝুঁকি থাকতো তাহলে কখনো তোকে মে*রে ফেলার কথা ভাবতাম না। কিন্তু তোর এই স্বার্থপর মায়ের জীবনের সাথে আরো একটা জীবন জড়িয়ে আছে যে সোনা। তোর স্বার্থপর মা তোকে পৃথিবীর আলো দেখাতে পারবে না। তুইও ঘৃণা কর তোর মাকে, প্রচন্ড ঘৃণা।
কাঁদতে কাঁদতে ফুটপাতে বসে পড়লো তিতির। এদিকটায় নিরিবিলি, খুব একটা মানুষজন নেই। তিতিরের কান্নার আওয়াজে ভারী হয়ে উঠলো আশপাশটা। নিজের সন্তান খু*নের দ্বায় মাথায় নিয়ে কীভাবে বাঁচবে সে ? সারাজীবন এই যন্ত্রণা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাবে। কিন্তু এছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই তার সামনে।
তুমি এখানে কী করছো ?
গম্ভীর আওয়াজে মাথা তুলে তাকালে তিতির। সামনে তাজকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাড়াতাড়ি নিজের চোখের পানি মুছে ফেললো।
তাজ তাচ্ছিল্যের সুরে বললো, এখানে বসে কান্না করছো কেনো ? চোখের পানি জমিয়ে রাখো, খুব তাড়াতাড়ি এই পানির প্রয়োজন হবে।
তিতির না বুঝে ভাঙা গলায় বললো, মানে ?
খুব তাড়াতাড়ি জানতে পারবে সেটা। এখন এখানে বসে সিনক্রিয়েট না করে গাড়িতে গিয়ে বসো। তোমার নাটক দেখতে দেখতে আমি নিজেই অভিনয় ভুলে গিয়েছি।
তিতির কথা না বাড়িয়ে উঠে তাজের গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো, যেটা রাস্তার অপর পাশে পার্ক করা। তিতিরকে দেখে তাজ গাড়ি থামিয়েছে। তিতির রাস্তায় পা রাখতেই তাজ হাত ধরে টান দিলো। দ্রুত গতিতে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো একটা প্রাইভেট কার।
কী করছিলে এখনই উপরে চলে যেতে।
তিতির তাকালো চলে যাওয়া গাড়ির দিকে তারপর তাজের দিকে তাকালো, আমি বড্ড ক্লান্ত হয়ে গেছি স্যার। উপরে চলে গেলে একটু বিশ্রাম অন্তত পেতাম।
তাজ ভ্রু কুঁচকে তাকালো তিতিরের দিকে। তিতির তাজের দৃষ্টি উপেক্ষা করে হাতের দিকে তাকালো। সাথে সাথে হাত ছেড়ে দিলো তাজ। তিতির রাস্তার এপাশ ওপাশ দেখে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। তাজও তার পিছনে গেলো। গাড়িতে উঠে সিট বেল লাগিয়ে সিটে মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো তিতির। তাজ একবার তিতিরের দিকে তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো। তাজের হঠাৎ খেয়াল হলো গত দেড় মাসে তিতির শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গেছে। চোখের নিচে গাড়ো কালো দাগ পড়েছে, ফর্সা মুখে যেটা খুব বাজে লাগছে। মুখটা কেমন ফ্যাকাশে সাদা হয়ে আছে, মনে হচ্ছে কেউ শরীরের সব রক্ত শুষে নিয়েছে।
তাজ সামনে তাকিয়ে বললো, এদিকে কোথায় গিয়েছিলে ?
তিতির স্বাভাবিক গলায় বললো, আরো একটা পাপ করার প্রস্তুতি নিতে।
তাজ বাঁকা চোখে তাকালো তিতিরের দিকে। মেয়েটা সবসময় এমন এমন কথা বলে রাগে তাজের মাথায় রক্ত উঠে যায়। যেমন এখন রাগে ইচ্ছে করছে গাড়ি থেকে লা*থি দিয়ে ফেলে দিতে। আ*ব*জ*র্নাটাকে গাড়িতে উঠানো ভুল হয়েছে তার। নাকমুখ কুঁচকে গাড়ি চালানোয় মনোযোগ দিলো তাজ। তিতির আঁড়চোখে তাকালো তাজের দিকে। তিতিরের হাতটা আপনাআপনি চলে গেলো নিজের পেটে।
মনে মনে বললো, ওর কথা আপনি কোনদিন জানতে পারবেন না। যেদিন জানতে পারবেন সেদিন হয়তো ও থাকবে না কিংবা আমি। সেদিন হয়তো আরো একটু বেশি ঘৃণা করবেন আমাকে।
তিতির বললো, আমাকে একটু আমার ফ্ল্যাটের সামনে নামিয়ে দিয়েন।
তাজ সরু চোখে তাকিয়ে বললো, কেনো ?
তিতির বললো, আজ রাতটা সেখানেই থাকতে চাই।
তিতির কোথায় থাকলো না থাকলো তাতে কিছু যায় আসে না তাজের। তাই সে আর কথা বাড়ালো না। তিতির আগের মতো লুকিয়ে দেখছে তাজকে, প্রাণ ভরে দেখে নিচ্ছে। কোনো জানি মনে হচ্ছে আর দেখতে পাবে না এই মানুষটাকে। শেষবারের মতো নিজের আসক্তিকে প্রাণ ভরে দেখে নিচ্ছে তিতির। তাজ তিতিরের দিকে তাকালে দেখতে পেলো সে চোখ বন্ধ করে আছে, কিন্তু তার মনে হচ্ছিল তিতির তাকে দেখছে। বা*জে চিন্তা বাদ দিয়ে গাড়ি চালানোয় মন দিলো তাজ। তিতিরের ফ্ল্যাটের সামনে গেলে তিতির চুপচাপ নেমে যায়। তাজ তাকিয়ে থাকে তার যাওয়ার পানে। আজ একটু বেশি বিধস্ত দেখাচ্ছে তিতিরকে কিন্তু কারণটা বুঝতে পারছে না তাজ।
তাজ নিজের উপর বিরক্ত হয়ে বললো, এতো কী ভাবছিস তাজ ? দেখ গিয়ে এটা আবার নতুন কোন নাটক শুরু করেছে।
১৫.
রাত নেমেছে পৃথিবীর বুকে। রুমের এক কোণে গুটিশুটি মেরে বসে আছে তিতির। গায়ের শাড়িটা এখনো চেঞ্জ করা হয়নি তার। নিজের পেটের উপর হাত রেখে চুপচাপ বসে আছে।
আজ রাতটা শুধু তোর আর আমার। আজ সারারাত মা ছেলে মিলে গল্প করবো ঠিক আছে সোনা বাচ্চা আমার। ইশ তুই ছেলে নাকি মেয়ে সেটা তো জানিই না।
চোখে পানি চলে এলো তিতিরের, আর কোনোদিন জানতেও পারবো না। তুই আমার ছেলে কারণ ছেলেরা যে মাকে বেশি ভালোবাসে। কিন্তু তোর মাকে তো কেউ ভালোবাসে না, তুইও বাসবি না আমি জানি। তবে বিশ্বাস কর তোর মা তোকে খুব ভালোবাসে কিন্তু সে অসহায়, নিরুপায়।
হু হু করে কেঁদে উঠলো তিতির। কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে তার, খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে আজ।
কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে বললো, আই লাভ ইউ সোনা।
হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে চমকে উঠলো তিতির। এতরাতে এখানে কে আসবে। তাজ ছাড়া তো কেউ জানে না সে আজ এখানে আছে, তাহলে কী তাজ ? কিন্তু সে কেনো এখানে আসতে যাবে ? তিতির ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। অনেক সাহস নিয়ে দরজা খুললো। ঝড়ের বেগে কেউ জাপ্টে ধরলো তাকে। ঝোঁক সামলাতে না পেরে দু’কদম পিছিয়ে গেলো।
ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেউ বললো, আপুনি।
হুঁশ ফিরলো তিতিরের ভেঙে ভেঙে বললো, বোনু তুই ?
পাখিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তিতির। ছেড়ে দিলে আবার হারিয়ে যাবে যেনো। বেশ অনেকটা সময় লাগলো তিতিরের নিজেকে সামলে উঠতে। পাখিকে নিজের বুক থেকে সরিয়ে সারামুখে চুমু খেতে লাগলো। আবার বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। তিতিরের কান্নায় পাখিও কাঁদছে। দীর্ঘ দেড় মাস পর বোনুকে পেয়েছে তিতির। গত ষোল বছরে একটা দিনও বোনুকে দূরে রাখেনি সে।
তিতির কাঁদতে কাঁদতে বললো, কোথায় চলে গিয়েছিলি বোনু ? কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলি তুই ? আর কখনো একা ছাড়বো না তোকে।
আহান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তিতিরের দিকে। এটাই তার তুতুল বিশ্বাস করতে পারছে না। কী বিধস্ত অবস্থা চেহারার। ছোটবেলায় নাদুসনুদুস চেহারার মেয়েটার এই হাড্ডিসার দেহ, গলার হাড়গুলো যেনো চামড়া ভেদ করে বেরিয়ে আসতে চাইছে, ফ্যাকাশে মুখে চোখের নিচে গাড়ো কালো দাগ।
আহান অস্পষ্ট আওয়াজে বললো, তুতুল।
এতক্ষণে তিতিরের চোখ পড়লো পাখির পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা আহানের দিকে। তার আওয়াজ শুনতে পায়নি তিতির, তবে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা দেখে একটু থমকালো।
পাখিকে নিজের থেকে একটু সরিয়ে, আপনি কে ?
আহান কাঁপা গলায় বললো, তুতুল তুই আমাকে চিনতে পারছিস না ?
কেঁপে উঠলো তিতির। আজ কতগুলো বছর পর এই নামে কেউ ডাকলো তাকে। নামটা তো সে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলো। তিতির ভালো করে দেখতে লাগলো সামনে দাঁড়ানো অচেনা ছেলেটাকে। তিতিরের চোখ আঁটকে গেলো ছেলেটার ডানপাশের ভ্রুর কাটা দাগে। ধূলোপড়া স্মৃতি হাতড়ে উঠিয়ে আনলো সেই দিনটা।
তিতির ভাঙা গলায় বললো, আহু ?
আহান বাচ্চাদের মতো ঠোঁট কামড়ে কান্না আঁটকে মাথা উপরে নিচে নাড়িয়ে বুঝালো হ্যাঁ সে আহু। তুতুলের খেলার সাথী আহু।
তিতির দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো আহানকে। আহানও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তার তুতুলকে। এত বছরের হাহাকার করা বুকে যেনো এক পশলা বৃষ্টি হলো আহানের।
কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলি তুই তুতুল। সেদিন ঘুম থেকে উঠে তোদের বাড়ি গিয়ে দেখি কেউ নেই। মামা-মামী, তুই কেউ নে। বেলা গড়িয়ে মামা-মামীর লা*শ বাড়িতে এলো তারপর আর কোনোদিন তোকে খোঁজে পায়নি আমি। পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম, বাবা বাধ্য হয়ে লন্ডন পাঠিয়ে দেয়।
বাবা শব্দটা শুনে ছিটকে দূরে সরে গেলো তিতির। এত বছর পর নিজের ছোটবেলার খেলার সাথীকে দেখে কিছু সময়ের জন্য ভুলে গিয়েছিলো অতীতের ভয়ংকর সেই রাতের কথা। তিতির দৌড়ে পাখির কাছে এসে বুকে জড়িয়ে নিলো পাখিকে।
ভীত গলায় বললো, তোকে রায়হান চৌধুরী পাঠিয়েছে তাই না ? পাখিকে ফিরিয়ে দিতে পাঠিয়েছে, কাজ হয়ে গেছে এবার চলে যা।
আহান কঠিন গলায় বললো, আমাকে রায়হান চৌধুরী পাঠায়নি, আমি রায়হান চৌধুরীর চোখ ফাঁকি দিয়ে পাখিকে তোর কাছে নিয়ে এসেছি। কত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তোর ঠিকানা পেতে, জানিস তুই ?
তিতির অবাক হয়ে বললো, রায়হান চৌধুরী জানে না তুই পাখিকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিস ?
নাহ্ রায়হান চৌধুরী কিছুই জানে না।
তিতির চমকে উঠলো আহানের কথা শুনে। ব্যস্ত গলায় পাখির দিকে তাকিয়ে বললো, আমাদের এখনই এখান থেকে চলে যেতে হবে বোনু। রায়হান চৌধুরী জানতে পারলে তোকে আবার কেড়ে নিবে আমার থেকে।
আহান বলল, কী বলছিস এসব ?
তিতির তাকালো আহানের দিকে কিছু ভেবে আহানের সামনে হাত জোর করলো, পাখিকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়ে অনেক বড় উপকার করেছিস। এখান থেকে দূরে কোথাও নিয়ে গিয়ে আর একটা সাহায্য কর আহান। এর বিনিময়ে তুই যা চাইবি তাই দিবো আমি। শুধু রায়হান চৌধুরীর নাগালের বাইরে নিয়ে চলে।
আহান মনে মনে বললো, তুই চাইলে তো নিজের জীবনটাও দিয়ে দিবো রে তুতুল।
চল আমার সাথে।
তিতির যেতে গিয়েও থেমে গেলো, এক মিনিট দাঁড়া।
তিতির দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেলো। ব্যস্ত হাতে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। আর কখনো দেখতে পাবে না এই রুমটাকে। জীবনের দীর্ঘ ষোলটা বছর কাটিয়েছে এখানে, কতশত স্মৃতি এখানে। এসবের মায়া করলে হবে না এখন, পাখিকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যেতে হবে তাকে, অনেক অনেক দূরে। আহান তিতির আর পাখি গাড়িতে গিয়ে বসতেই আহান গাড়ি নিয়ে ছুটতে লাগলো ব্যস্ত ঢাকা শহরের বাইরে৷
তিতির চোখ বন্ধ করে মনে মনে বললো, ভালো থাকবেন স্যার। ভালো থেকো মৌ আপু, তোমার ভালোবাসা ফিরিয়ে দিয়ে গেলাম তোমাকে। মাফ করবেন স্যার যাওয়ার সময়ও আপনার জীবন থেকে কিছু কেড়ে নিয়েই গেলাম। তবে আজ আপনার জীবন থেকে বিষাক্তফুলের বিদায় হল তার বিষাক্ততা নিয়ে।
তিতির গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরে তাকালো, আবার কী আসা হবে এই শহরে ? হয়তো না।
১৬.
এতরাতে ফোনের আওয়াজে বিরক্ত হলো রায়হান। সারাদিন হসপিটালে থেকে, বিয়ের কেনাকাটা করে ক্লান্ত হয়ে শুয়েছে। এখন আবার কে বিরক্ত করছে তাকে।
ফোন রিসিভ করে ঘুমঘুম গলায় বললো, হ্যালো।
স্যার দুদিন ধরে আহান স্যার তার ফ্ল্যাটে নেই আর মেয়েটাও।
এক ঝটকায় ঘুম উড়ে গেলো রায়হানের, ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো।
ধমকে উঠলো, ফ্ল্যাটে নেই মানে কী ?
স্যার, দু’দিন আগে আহান স্যার মেয়েটাকে নিয়ে বাইরে আসে। আমরা ভেবেছিলাম অন্যদিনের মতো ঘুরতে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা নজর রেখেছি কিন্তু আমার চোখ ফাঁকি দিয়ে হঠাৎ উধাও হয়ে যায়। ভেবেছিলাম খোঁজে পেয়ে যাবো তাই আপনাকে জানায়নি। কিন্তু আজ জানতে পারলাম আহান স্যার মেয়েটাকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে গেছে।
চমকে উঠলো রায়হান, হোয়াট ?
ভীত গলায় উত্তর এলো, ইয়েস স্যার।
প্রচন্ড বেগে গাড়ি ড্রাইভ করছে রায়হান। সে ছুটে চলেছে তিতিরের ফ্ল্যাটের দিকে।
একহাতে ফোন কানে কাউকে চিৎকার করে বলছে, ঢাকার মধ্যেই আছে ওরা প্রত্যেকটা অলিগলি তন্নতন্ন করে খোঁজ। সকালের মধ্যে আহান আর পাখিকে আমি আমার আস্তানায় দেখতে চাই। খোঁজে বের করতে না পারলে তোদের একটাকেও বাঁচিয়ে রাখবো না আমি।
ফোন রেখে দিলো রায়হান। রাগে চোখমুখ লাল হয়ে উঠেছে তার। মৌকে পাওয়ার আনন্দে এতোই মত্ত ছিলো যে আহান, পাখি কিংবা তিতির কারো উপরেই আগের মতো নজর রাখেনি। নিজের উপর রাগ হচ্ছে রায়হানের। এতোটা কেয়ারলেস সে কীভাবে হতে পারলো ? ওরা যদি একবার তিতিরের কাছে পৌঁছে যায় তাহলে সব খেলা শেষ হয়ে যাবে। তার এতদিনের সাজানো প্ল্যান সব ন*ষ্ট হয়ে যাবে। সেটা সে কিছুতেই হতে দিবে না। মৌকে পাওয়ার সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে তাকে হারিয়ে ফেলার কষ্ট সহ্য করতে পারবে না রায়হান। ঝড়ের বেগে তিতিরের ফ্ল্যাটের সামনে এলো। কিন্তু ফ্ল্যাটের দরজায় দাঁড়িয়ে মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো। তলা ঝুলছে দরজায়, কিন্তু রায়হান ভালো করেই খোঁজ নিয়েছে তিতির আজ এখানে এসেছে আর তাজের বাড়িতে লাগানো ক্যামেরা বলে দিচ্ছে তিতির সেখানে ফিরে যায়নি। রায়হান দু-হাতে নিজের চুল খামচে ধরে চিৎকার করে উঠলো।
আহান তুই আমার নিজের ভাই হয়ে এতবড় ক্ষতি করে দিলি। আমারই ভুল হয়েছে, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম তুতুলের জন্য তুই নিজের ভাইকে খু*ন করতেও দু’বার ভাববি না। সে জন্য তিতির আর পাখির পরিচয় গোপন রেখেছিলাম। কিন্তু তুই সব জানলি কী করে ? আমারই ভাই তো তাই মাথার ব্রেনও আমার মতোই। কিন্তু ভাই, তুই যদি চলিস ডালে ডালে আমি চলি পাতায় পাতায়। বাংলাদেশের যে প্রান্তেই তুই থাকিস আমি খোঁজে বের করবো। আর তিতির আমার কথার অবাধ্য হওয়ার চরম মূল্য দিতে হবে তোকে। শুধু একবার হাতের নাগালে পাই।
রায়হান তিতিরের ফ্ল্যাটের বন্ধ দরজায় লাথি দিয়ে বের হয়ে গেলো। যে করেই হোক এই তিনজনকে খোঁজে বের করতে হবে তাকে। একবার মৌ বা তাজের কাছে পৌঁছে গেলে সব শেষ হয়ে যাবে। সিকিউরিটি রুমে গেলো ফুটেজ দেখতে, যে গাড়িতে গেছে তার নাম্বার পাওয়া যায় কিনা।
১৭.
আমরা কোথায় যাচ্ছি আহান ?
আপাতত ঢাকার বাইরে চলে এসেছি। ভাইয়ার সম্পর্কে যতটা জেনেছি সারাদেশে তার লোক আছে। তবে ঢাকায় তার পাওয়ার বেশি। এখন বড় কোনো শহরে যাওয়া যাবে না। সেখানে ধরা পরে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। পুরোপুরি গ্রামেও যাওয়া যাবে না, সেখানে আমরা সবার নজরে পড়বো সহজে আর ভাইয়ার লোক থাকলে বিপদ হয়ে যাবে। ছোটখাটো কোনো শহরে গা ঢাকা দিতে হবে।
তিতির আহানের দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকালো, আহু তুই আর রায়হান চৌধুরী এক মায়ের পেটের ভাই তো ?
আহান জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো, এ কথা কেনো বলছিস তুই ?
তিতির দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, যেখানে রায়হান চৌধুরী নিজের স্বার্থ হাসিল করার জন্য এতটা নিচে নেমে গেছে। নিজের বোনদের ব্যবহার করতেও তার বিবেকে বাঁধেনি। সেখানে তুই তারই ভাই হয়ে নিজের জীবন বাজি রেখে আমাদের সাহায্য করছিস।
আহান তিতিরের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো, তুই যদি একবার বুঝতে পারতি আমার জীবনে তোর জায়গাটা কোথায়। রায়হান চৌধুরীর সাথে এই একটা জায়গায় আমার মিল আছে রে তুতুল, ভালোবাসা। তবে আমার ভালোবাসার ধরণটা তার থেকে আলাদা। সে ভালোবাসার মানুষকে পাওয়ার জন্য এতো নিচে নেমেছে আর আমি আমার ভালোবাসার মানুষটাকে ভালো রাখতে সব করতে পারবো। সে আমার কাছে ভালো থাক বা অন্যকারো কাছে।
কথাগুলো মুখে বলা হলো না আহানের। সামনে তাকিয়ে ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ দিলো। তিতির নিজের ব্যাগ থেকে আবার ফোনটা বের করলো।
অন করার আগেই আহান বললো, কী করছিস ?
তিতির মলিন হাসলো, রায়হান চৌধুরীর কথায় দুটো জীবন এলোমেলো করে দিয়েছি রে আহু। সেগুলো আমাকেই ঠিক করতে হবে। নাহলে সারাজীবন সেই পাপের বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে।
আহান ব্যস্ত গলায় বললো, তোর ফোন অন করলে ভাইয়া লোকেশন ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে জেনে যাবে আমরা কোথায় আছি।
তিতির চিন্তিত হয়ে পড়লো, কিন্তু কাজটা করা যে খুব বেশি জরুরি।
আহান একটু চিন্তা করে বললো, আমার ফোনটা দিয়ে করতে পারবি ?
তোর ফোন অন করলে বুঝবে না ?
নাহ্ এটা সম্পূর্ণ নতুন ফোন। ঢাকায় এসে প্রথমেই একটা ফোন কিনেছি।
আহানের ফোনটা নিলো তিতির। নিজের ফোনের এসডি কার্ড খুলে আহানের ফোনে লাগিয়ে নিলো। নিজের ফোনটা জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলো।
আহান এসডি কার্ড উদ্দেশ্য করে বললো, এটা দিয়ে কী কাজ ?
এটাতে রায়হান চৌধুরীর সব পাপের প্রমাণ আছে। এগুলো স্যারের কাছে পৌঁছে দিলেই হয়ে যাবে।
আহান কৌতূহল নিয়ে বলে, স্যার কে ? আমার কাছে এখনো সবটা পরিষ্কার না তুতুল। ভাইয়া পাখিকে কি*ড*ন্যা*প কেনো করেছিলো আর কীভাবে করেছিলো ? আর গাড়িতে উঠে কী সব বলে একটা ভিডিও বানালি তাও বুঝলাম না।
আহানের কথা শুনে তার দিকে তাকালো তিতির, অনেক কিছুই তুই জানিস না আহু। সব এখনই তোকে বলা সম্ভব নয়। এখন যেটুকু বলা সম্ভব সেটুকুই বলছি।
তিতির পাখির কি*ড*ন্যা*প হওয়া থেকে শুরু করে, রায়হানের হু*ম*কি, তিতিরের তাজকে ব্ল্যা*ক*মে*ই*ল করে বিয়ে করা, সব একে একে খুলে বললো আহানকে। তিতিরের বিয়ের কথা শুনে মাথা শূন্য শূন্য লাগছে আহানের। তার তুতুল অন্যকারো হয়ে গেছে এটা মানতে পারছে না।
তিতির বললো, এবার সত্যিটা সবাইকে জানিয়ে স্যারকে নির্দোষ প্রমাণ করে নিজেকে কিছুটা পাপ মুক্ত করতে চাই।
তিতির আহানের ফোনের সাহায্যে তাজের কাছে সব প্রমাণ পাঠিয়ে দিলো। তিতিরের ফোনে কল রেকর্ডের অপশন অন করে রাখা ছিলো আগে থেকেই। সেখানে রায়হানের সমস্ত কথা রেকর্ড হয়েছে। সে কীভাবে তিতিরকে বাধ্য করেছে তাজের নামে মিথ্যা বলতে সব আছে। তিতির একটা ভিডিওতে নিজে সবটা স্বীকার করেছে সেটাও পাঠালো। তিতির সমস্ত প্রমাণ তাজ আর মৌ দুজনের ফোনেই পাঠিয়ে দিলো।
আহান নিজেকে সামলে বললো, ফোনটা দে আমি পুলিশের কাছে সব পাঠাচ্ছি। আমার বন্ধুর বাবা পুলিশ কমিশনার। সেই বন্ধুর সাহায্যে তোকে খোঁজে বের করেছি। ওর কাছে পাঠালে ওর বাবা একশন নিতে পারবে।
আহান ফোনটা নিয়ে সব প্রমাণ পাঠিয়ে দিলো ওর বন্ধুর কাছে। সকালের মধ্যে রায়হানের কাছে পুলিশ পৌঁছে যাবে।
মিস্টার খানকে ভালোবাসিস তাই না রে তুতুল ?
আহানের কন্ঠটা কেমন অসহায় শোনালো। তিতির আহানের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো, স্যার আমার জীবনের অনাকাঙ্ক্ষিত একটা অধ্যায় আর আমিও তার জীবনে। সে অন্যকারো ছিলো আর অন্যকারোই থাকবে।
আর তুই ?
তিতির তাকালো আহানের দিকে। বুঝার চেষ্টা করলো তার কথার মানে। আহান চোখ সরিয়ে সামনে তাকালো। তুতুলের চোখে চোখ রাখার সাহস হচ্ছে না আহানের। যদি সে চোখে অন্যকারো জন্য ভালোবাসা দেখে, তবে সেটা সহ্য করতে পারবে না। তিতির কিছু না বলে পেছনে তাকিয়ে পাখিকে দেখে নিলো। সে পিছনের সীটে ঘুমিয়ে পড়েছে।
বোনু তোকে অনেক জ্বালিয়েছে না রে ?
আহান মুচকি হেসে বললো, ছোটবেলায় তুই যেমন দুষ্টু ছিলি পুতুল তেমন হয়েছে।
তিতির প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকালো আহানের দিকে, পুতুল ?
তুই হয়তো ভুলে গিয়েছিস, আমি বলেছিলাম ওকে আমি পুতুল বলেই ডাকবো। তবে দেখতেও কিন্তু পুতুলের মতোই হয়েছে রে মাশাআল্লাহ। থাক এসব বাদ দে, তুই একটু ঘুমিয়ে নে, নাহলে শরীর খারাপ করবে।
শরীরের কথা শুনতেই তিতিরের মুখ কালো হয়ে গেলো। মনে পরে গেলো নিজের ভেতরে বেড়ে উঠা আরেকটা অস্তিত্বের কথা। তিতির ফট করে তাকালো আহানের দিকে। আহানকে তিতির বিশ্বাস করে নিজেকে যতটা বিশ্বাস করা যায় ঠিক ততটা। যদিও সময়ের সাথে মানুষ বদলে যায়, তবে গত কয়েক ঘণ্টায় তিতির যতটুকু বুঝেছে আহান ঠিক আগের মতোই আছে।
তিতির নিজের পেটে হাত রেখে বললো, আমার কিছু হয়ে গেলে আমার বোনুটাকে একটু দেখে রাখতে পারবি আহু ?
তড়িৎ গতিতে ব্রেক কষলো আহান। সীট বেলের জন্য বেঁচে গেছে তিনজনই। পাখি ঘুমের মধ্যে সামনে হেলে পড়েছে।
তিতির পেছন ফিরে পাখির দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত গলায় বললো, পাগল হলি এভাবে কেউ ব্রেক করে ?
আহান তাকালো তিতিরের দিকে, এখনই কী বললি তুই ?
বললাম এভাবে কেউ ব্রেক করে ?
এটা নয়, তার আগে কী বললি ?
পাখিকে হাত বাড়িয়ে সোজা করার চেষ্টা করছিলো তিতির। এবার তিতির তাকালো আহানের দিকে অসহায় দৃষ্টি তার, বলেছি আমার কিছু হয়ে গেলে আমার বোনুকে একটু দেখে রাখবি ? এই পৃথিবীতে তোকে ছাড়া বিশ্বাস করার মতো আমার আর কোন জায়গা নেই আহু। দেখ বেশি কিছু করতে হবে না, তিনবেলা একটু খাবার আর পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম মানুষদের হাত থেকে রক্ষা করবি, এটুকুই।
আহান সীট বেল খুলে এগিয়ে এলো তিতিরের দিকে। তিতিরের দুগালে নিজের হাত রেখে অসহায় গলায় বললো, এসব কেনো বলছিস তুতুল ? তোর কেনো কিছু হতে যাবে ?
তিতির আহানের হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিলো, জীবনটা অদ্ভুত রে আহু। কখন কোন দিকে মোড় নেয় বলা মুসকিল। এই দেখ না সকালে ঘুম থেকে উঠার সময় আজকে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনার জন্যও আমিও প্রস্তুত ছিলাম না। কিন্তু তাতে কিছু আঁটকে থেকেছে কী, যা হওয়ার ঠিক হয়েছে।
অশান্ত হয়ে উঠলো আহান, না এভাবে কথা ঘুরাবি না তুই। কিছু তো একটা হয়েছে, আমাকে বল কী হয়েছে তোর ? নাহলে আমি এখনই হসপিটালে নিয়ে যাবো, তোকে দেখতেও অনেক অসুস্থ মনে হচ্ছে। আমার কাছে লুকাতে পারবি না তিতির, এখনো ডাক্তার না হলেও ডাক্তারি পড়ছি আমি।
অবস্থা বেগতিক দেখে তিতির মুখ খুলতে বাধ্য হলো, আহু আমি প্রেগনেন্ট।
বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো যেনো আহানের মাথায়, হোয়াট ?
তিতির আর কিছু বলতে পারলো না। আহান ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সে প্রেগনেন্ট এটা বললেও ডক্টরের বাকি কথা সে কিছুতেই কাউকে জানতে দিবে না। তিতির ঠিক করে নিয়েছে এই বাচ্চাটা সে কিছুতেই মে*রে ফেলতে পারবে না। এতোটা নিষ্ঠুরতম কাজ তার দ্বারা সম্ভব নয় আর একটা অদৃশ্য মায়ায় জড়িয়ে গেছে এই বাচ্চার সাথে। সাথে সাথে তখন এটা উপলব্ধি করতে না পারলেও ধীরে ধীরে পেরেছে। সে পারবে না বাচ্চাটাকে নিজের জীবন থেকে সরিয়ে দিতে। আর এই বাচ্চাটাই তার জীবনে তাজের একমাত্র চিহ্ন। এদিকে আহান একের পর এক ঝটকা সামলে উঠতে পারছে না। নিজেকে অনুভূতি শূন্য মনে হচ্ছে তার। আরো তো অনেককিছু জানা বাকি, সব সহ্য করবে কীভাবে ?
১৮.
সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে টাওয়েল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে নিজের ফোন হাতে নিলো তাজ। এতোগুলো নোটিফিকেশন দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। নোটিফিকেশন অপেন করে দেখলো একটা অচেনা নাম্বার থেকে অনেকগুলো অডিও ভিডিও আরো কী সব ডকুমেন্টস আছে। ভিডিওটা প্লে করে দেখে হাতের টাওয়েল ফ্লোরে পড়ে গেলো তাজের। ভিডিওতে তিতির নিজের মুখে সব স্বীকার করছে, সে কেনো রায়হানের কথায় সব করতে রাজি হয়েছে। কীভাবে কীভাবে রায়হান প্ল্যান করে তাজের নামে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তাকে এবাড়িতে পাঠিয়েছে সব স্বীকার করছে তিতির।
ভিডিও শেষে তিতির বললো, স্যার নিদোর্ষ তার কোন ভুল নেই। দু’বছর আমি তার সাথে কাজ করেছি সে কখনো আমার দিকে বা*জে নজরেও তাকায়নি। তার জীবনটা এভাবে ন*ষ্ট করার দ্বায় আমারও আছে, সেটা আমি অস্বীকার করছি না। তবে আমি পরিস্থিতির স্বীকার। ভালো থাকবেন স্যার, যেভাবে হুট করে আপনার জীবনে এসেছিলাম আবার সেভাবে হুট করেই চলে গেলাম। পারলে মাফ করবেন আমাকে।
তিতিরের ঠোঁটের কোণে ঝুলছে মলিন হাসি। শেষে ভেসে উঠলো তিতিরপাখি দুই বোনের হাসোজ্জল কিছু ছবি। কত হ্যাপি মনে হচ্ছে তাদের দেখে। তাজ পাখির বিষয়ে কিছুই জানতো না। তাজ একে একে সব প্রমাণ ভালো করে দেখে নিলো। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য এর থেকে বেশি আর কিছুরই প্রয়োজন হবে না তাজের। তাজ তাড়াতাড়ি কল দিলো তিতিরকে কিন্তু বন্ধ বলছে।
তাজ চিন্তিত গলায় বললো, এসব কে পাঠালো, তিতির ? তিতির পাঠালে নিজের নাম্বার থেকেই পাঠাতে পারতো। তবে কে পাঠালো আর তিতিরই ফোন ধরছে না কেনো ? তবে কী সত্যি চলে গেছে তিতির ?
তাজ কোনমতে চেঞ্জ করে ছুটলো তিতিরের ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে। কী হচ্ছে কিছুই মাথায় ঢুকছে না তার। এদিকে মৌ নিজের বেডে থম মেরে বসে আছে। সবগুলো প্রমাণ সে নিজেও দেখেছে। রায়হান এতোটা নিচে নেমে গেছে ভাবতে পারছে না সে। হঠাৎ করেই তিতিরের জন্য কষ্ট হচ্ছে মৌয়ের। শেষের ভিডিওটা আবার প্লে করলো মৌ। এটা মৌকে পাঠালেও তাজকে পাঠায়নি তিতির।
কেমন আছো মৌ আপু ? হয়তো ভালো নেই কারণ তোমার ভালো থাকার কারণ কেড়ে নিয়েছিলাম আমি। সব প্রমাণ দেখে এতক্ষণে হয়তো জেনেও গেছো আমি বাধ্য ছিলাম। আমার জায়গায় অন্যকেউ হলে কী করতো আমার জানা নেই ? তুমি কী করতে আপু ? যদি তোমার বাবা-মার জীবন বাঁচাতে এমন কিছু করতে বলা হতো ? আপু আমার জীবনে আপন বলতে ঐ বোনটা ছাড়া আর কেউ নেই। খুব খুব বেশি ভালোবাসি বোনুটাকে। আপু আমার বোনুটা বুদ্ধি প্রতিবন্দী, এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর কিছুই বুঝে না ও।
তিতির ক্যামেরা ঘুরিয়ে ঘুমন্ত পাখিকে একবার দেখালো। মৌয়ের নিজেরও মায়া হলো ঘুমন্ত মেয়েটার উপর, সেখানে তিতির তার বোন।
তিতির আবার ক্যামেরা নিজের দিকে করে বললো, থাক সেসব কথা। আজ থেকে তুমি ভালো থাকবে আপু, তোমার ভালো থাকার কারণ তোমাকে ফিরিয়ে দিয়ে গেলাম। কখনো হয়তো দেখা হবে না আর, আমি চাইও না আমার বিষাক্ত ছায়া তোমাদের জীবনে আবার পড়ুক। স্যার সত্যি বলে আমি বিষাক্তফুল। ভালো থেকো আপু আর স্যারকেও অনেক ভালো রেখো। পারলে মাফ করে দিও এই খা*রা*প মেয়েটাকে, আল্লাহ হাফেজ।
মৌ বুঝতে পারলো তার চোখে নোনাজলের বৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু আজ তো তার খুশি হওয়ার কথা তবে এতটা কষ্ট কেনো হচ্ছে, কেনো তিতিরের মলিন মুখটা চোখে ভাসছে ? বাইরে চেঁচামিচির আওয়াজ শুনে মৌ দরজা খোলে ড্রয়িংরুমে এলো।
রায়হান উঁচু গলায় বলছে, বিয়েটা আজ আর এখনই হবে। পরে অনুষ্ঠান করা যাবে কিন্তু বিয়ে এখনই হবে।
চলবে,,,,