#বিষাক্তফুলের আসক্তি
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্ব-২৫+২৬
কাঁধে কারো হাতের স্পর্শে পেছনে ফিরে তাকালো তাজ, আহান দাঁড়িয়ে আছে তার পেছনে। সেদিন আহানও তো কেঁদেছিল, এভাবেই কেঁদেছিল তুতুলকে হারিয়ে।
নিজেকে সামলান তাজ ভাইয়া। এভাবে কাঁদলে কী তিতির ফিরে আসবে ? আসবে না, আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। আসলে প্রবলেমটা কোথায় জানেন ? আমরা মানুষরা নিজের কাছের জিনিসটার মূল্য দিতে জানি না। যখন সেটা চিরতরে হারিয়ে যায় তখন তার মূল্য বুঝে হাহাকার করতে থাকি।
আহানের কথায় তাজের চোখের পানির পরিমাণ বাড়লো বই কমলো না। বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে নিলো ধ্রুবকে।
আহান ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে বললো, ভেতরে চলুন বাইরে অনেক ঠান্ডা পড়েছে। ধ্রুবর ঠান্ডার প্রবলেম আছে।
তাজ তাকালো ঘুমন্ত ধ্রুবর দিকে। এই মুখটার দিকে যতবার তাকাচ্ছে ততবার বুকটা পোড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে তাজের। তাজ উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলে আহান তাকে দাঁড়াতে সাহায্য করলো। তাজ এলোমেলো পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলো বাড়ির দিকে। আহান তাকালো তিতিরের দিকে।
ধরা গলায় বললো, তুতুল তুই সত্যি খুব বেশি স্বার্থপর। এতগুলো মানুষের চোখের পানি তোর হৃদয় একটু নাড়াতে পারলো না।
কথাগুলো তিতির শুনতে পেলে হয়তো বললো, রাতের পর রাত আমার কান্নার আওয়াজ তো কেউ শুনতে পায়নি আহু। আমার চোখের পানিগুলো তো বরাবর সবার কাছে নাটক মনে হয়েছে। আমার আত্মচিৎকার তো পারেনি কারো হৃদয় স্পর্শ করতে। তবু দিনশেষে স্বার্থপর উপাধিটা কেনো আমার জন্যই থেকে যায় ? সত্যি কী স্বার্থপর শুধু আমি একাই ছিলাম ? মৌ আপু তাজকে ভালোবেসে রায়হানের সাথে অন্যায় করেও সে স্বার্থপর হয়নি। রায়হান মৌকে ভালোবেসে একটা নোংরা খেলা খেলে সবার জীবন এলোমেলো করে সেও স্বার্থপর হয়নি। অন্ধের মতো শুধু নিজের ক্যারিয়ারের দিকে দৌঁড়ে স্বার্থপর হয়নি তাজও। স্বার্থপর শুধু তিতির কারণ এই জীবন গল্পে বিষাক্তফুলের নাম যে তিতির। এই বিষাক্তফুল তার স্বার্থপরতার শাস্তি পেয়ে গেছে, এবার বাকি সবার পালা।
কী জানি আহান তিতিরের না বলা কথাগুলো শুনতে পেলো কিনা তবে চোখ থেকে তার নোনাজল ঠিকই গড়িয়ে পড়লো। আহান আর দাঁড়ালো না, তাজের পিছনে পিছনে ভিতরে চলো গেলো।
তিতির মনে হয় পেছনে থেকে বললো, এবার পালিয়ে যাচ্ছিস কেনো আহু ?
আহান তাজকে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসিয়ে দিলো। দৌঁড়ে এগিয়ে এলো ইরিনা আর ইকবাল। তাদের আহান বলে গিয়েছিল সে তাজকে নিয়ে আসছে।
ইরিনা বললো, কোথায় গিয়েছিলি বাবা ?
তাজের মুখে কোনো উত্তর নেই, সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ধ্রুবর দিকে। বিড়বিড় করে কিছু বলছে মনে হয়।
আহান ধ্রুবর দিকে হাত বাড়িয়ে বললো, দিন রুমে শুইয়ে দিচ্ছি বাবাইকে।
তাজ ফট করে ধ্রুবকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিলো, না না ওকে কারো কাছে দিবো না আমি। ও আমার কাছে থাকবে। নাহলে ও তিতিরের মতো ফাঁকি দিয়ে চলে যাবে আমাকে একা রেখে।
ধক করে উঠলো আহানের বুক। তবে কী এবার যার আমানত তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার সময় হয়ে গেছে ? কিন্তু এই ধ্রুবতারাটা ছাড়া আহানও যে দিকভ্রষ্ট হয়ে যাবে। পথ হারিয়ে ফেলবে জীবন চলার। তাজ ধ্রুবকে বুকে জড়িয়ে কিছু বিড়বিড় করছে। তাজের আচরণ অস্বাভাবিক লাগছে আহানের কাছে। ধ্রুবকে আর নিলো না তাজের বুক থেকে।
৩১.
দেখতে দেখতে কেটে গেলো কয়েকটা দিন। তাজ কেমন চুপ হয়ে গেছে। ধ্রুব ছাড়া কারো সাথে কথা বলে না তেমন। পুকুর পাড়ের সিঁড়িতে বসে তিতিরের কবরের দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। আহান গিয়ে বসলো তাজের পাশে।
তাজ আনমনে বলে উঠলো, মুসকান এভাবে সবার হাসি কেড়ে নিয়ে চলে গেলো কেনো আহান ?
আহান চমকে উঠলো তাজের কথায়। তিতিরকে মুসকান বলে একমাত্র তিতিরের বাবা ডাকতো। তখন তিতিরের মুখে সারাদিন হাসি লেগেই থাকতো। পাঁচ দিনের নবজাত শিশুর হাসি দেখেই আবির মাহমুদ তার নাম রেখেছিল মুসকান আর তিতির নাম রেখেছিল তিতিরের মা। সবার কাছে তিতির নামটা বেশি পরিচিত হয়ে গেলেও আবির মাহমুদ মুসকান বলেই ডাকতো, তার হাসিতে যেনো আবির মাহমুদের দুনিয়া হাসতো। এটা মামির কাছেই শুনেছিল আহান। আহান ছিলো তিতিরের মাত্র পনেরদিনের বড়। তিতিরের সাথে এই মাহমুদ ভিলাতেই কাটতো তার সারাদিন।
আহান মলিন হেসে বললো, জানেন ভাইয়া তুতুলের জীবনের সুখের সময়ের মেয়াদকাল ছিলো খুবই কম। তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ছিলো শৈশবের নয় বছর। রাজা রানির সাত বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ঘন কুয়াশা ঘেরা এমনই এক শীতের সকালে নাকি জন্ম হয়েছিল এই মাহমুদ ভিলার রাজকন্যা তুতুলের। সবাই খুব ভালোবাসতো মেয়েটাকে। বাড়ির কাজের লোকগুলোরও চোখের মণি ছিলো তুতুল। তার হাসির আওয়াজে যেনো পুরো মাহমুদ ভিলা খিলখিলিয়ে হাসতো। রাজা, রানি, রাজকন্যা আর একটা সুখের সাম্রাজ্য। কিন্তু সেখানেই নজর লাগে আব্দুর রহমান চৌধুরী নামক লোভী অমানুষের। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনি আমার জন্মদাতা পিতা। মামার মেডিকেল ইকুইপমেন্টের বিজনেস ছিলো সাথে একটা হসপিটাল। সেখানেই ইন্টার্নি চিকিৎসক হিসাবে জয়েন করে আমার বাবা। আমার মা আনিতা মাহমুদের সাথে সেখানেই পরিচয় হয় আমার বাবার। পরিচয় থেকে ভালোলাগা একসময় তা ভালোবাসা। মামা সব জেনে গেলে অমত করেনি, বোনের সুখের কথা চিন্তা করে বিয়ে দিয়ে দেয়। আমার নানা-নানি ছিলো না, মায়ের বিয়ের পর মামা একা হয়ে যায়। এরপর মা নাকি মামিকে পছন্দ করে মামার সাথে বিয়ে দেন, সব ভালোই চলছিল। বাবা-মার বিয়ের এক বছরের মাথায় ভাইয়ার জন্ম। কিন্তু মামির বাচ্চা হচ্ছিল না, অনেক চিকিৎসা করেও লাভ হয়নি, শেষে আশা ছেড়ে দেয়। ভাইয়া বড় হতে থাকে, তার যখন পাঁচ বছর তখন আবার আমার আগমনের বার্তা পায় মা। এর মাস খানেক পর মামী বুঝতে পারে সেও মা হতে চলেছে। সেদিন নাকি মামা পুরো শহরের অসহায় মানুষদের পেট ভরে খাইয়েছিলো খুশি হয়ে। সবাই খুশি হলেও খুশি হতে পারেনি আমার বাবা। সে ভেবেছিলো মামার কোনো সন্তান না হলে সমস্ত সম্পত্তি তার হয়ে যাবে। যখন তুতুল হলো তখন বাবা ভাবলো যেভাবেই হোক তুতুলের সাথে ভাইয়ার বিয়ে দেবে আর সমস্ত সম্পত্তি দখল করবে। সে তার পরিকল্পনা অনুযায়ী চলতে থাকে। তুতুল হওয়ার পর মামী আর কনসিভ করতে পারেনি তাতে আমার বাবা খুশী হন। চলতে থাকে দিন ভালোভাবে। বড় হতে থাকি আমি আর তুতুল। আমি তুতুলকে ছাড়া কিছুই বুঝতাম না।
তাজ তাকালো আহানের দিকে। আহানের চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে। যেনো আহান হারিয়ে গেছে সোনালী সেই অতীতে। আহানের চোখের ভাষা বুঝতে পারলো তাজ। মনে মনে প্রশ্ন জেগে উঠলো আহান ভালোবাসতো তিতিরকে ?
আহান মুচকি হেসে বললো, ভাইয়া আর আমার ছোটবেলা থেকে বনিবনা হতো না। ভাইয়া মাঝে মাঝে তুতুলকে বকতো তাতেই হাতাহাতি লেগে যেতো আমাদের দুজনের। আমাকে আর ভাইয়াকে একসাথে রাখা দিনদিন অসম্ভব হয়ে যাচ্ছিল। শেষে বাবা-মা বাধ্য হয়ে ভাইয়াকে ঢাকা পাঠিয়ে দেয় আমার ফুপুর কাছে। আমি ছোট ছিলাম তাই বাবা-মা আমাকে কাছে রাখে। সময়ের সাথে বড় হতে থাকি আমি আর তুতুল। নিজের বাড়ি রেখে আমি পরে থাকতাম তুতুলের কাছে। মাহমুদ ভিলায় আবার খুশীর সংবাদ আসে নয় বছর পর। তুতুলের ভাইবোন আসতে চলেছে, তুতুলের খুশী দেখে কে। সব মেয়েরা ভাই চায় কিন্তু তুতুল সবসময় বোন চাইতো। সে নিজের বোনকে কত ভালোবাসবে তা বলে বলে কান পঁচাতো আমার। আমি তাকে রাগানোর জন্য বলতাম তার বোনকে বিয়ে করবো, মাঝে মাঝে সেটা মেনেও নিতো তুতুল। সব ভালো লাগলেও এটা ভালো লাগতো না। ছোটবেলা থেকে তুতুলের সাথে বর বউ খেলে এখন অন্য কাউকে বউ বানাবো শুনেও তুতুল যখন রাগ না করে খুশী হতো আমার মুখ কালো হয় যেত।
আহান সত্যি হারিয়ে গেছে অতীতে। তাই সব যে তাজকে বলে দিচ্ছে সেদিকে তার খেয়াল নেই। তাজ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আহানের দিকে। কথাগুলো শুনতে তার ভালো লাগছে নাকি খারাপ সে নিজেই বুঝতে পারছে না।
আহানের কথাতেই আবার ঘোর কাটলো তাজের, দু’দিন ধরে টানা বৃষ্টি চলছিল সিলেটে। বিকেলে বৃষ্টিতে ভিজে তুতুলের সাথে খেলে বাড়ি চলে যাই আমি৷ পরদিন যখন এই বাড়িতে আসি চারদিকে কেমন নিস্তব্ধতা। একরাতে আমার চেনা জীবন বদলে গেলো। বেলা গড়াতেই অ্যাম্বুলেন্স করে বাড়ি ফিরলো মামা মামির র*ক্তা*ক্ত লা*শ।
গলা ধরে এলো আহানের। তাজ বুঝতে পারছে আহানের বলতে কষ্ট হচ্ছে।
তাজ আগ্রহ নিয়ে বললো, তারপর ?
জানাজানি হলো মামার বিশ্বস্ত বডিগার্ড নুরুল মামা মামিকে খু*ন করেছে আর তুতুলের কোনো খোঁজ নেই।
একটু দম নিলো আহান তার চোখ টলমল করেছে পানিতে, আসলে বাবা নাকি মামাকে মজার ছলেই ভাইয়া আর তুতুলের বিয়ের কথা বলেছিলো। কিন্তু মামা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলো বাবা যেনো এসব মাথায় না আনে। তার কাছে ভাগ্নে ভাগ্নের জায়গায় আর মেয়ের জামাই তার জায়গায়। বাবা বুঝতে পেরে যায় তার পরিকল্পনা কাজ করবে না। এদিকে ভাবতে থাকে এবার যদি ছেলে হয় তাহলে তো সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। তাই পথের কাটা সরিয়ে দিয়েছিলো। তুতুলকে হারিয়ে তখন আমি পাগল প্রায়। একসময় অতিষ্ঠ হয়ে বাবা আমাকে পাঠিয়ে দিলো দূরদেশ লন্ডন।
টপটপ করে পানি পড়ছে আহানের চোখ থেকে। ছেলেদের কাঁদতে হয় না আরো একবার মিথ্যা প্রমাণ করলো এই কথা।
তাজ নিজের জিহবা দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে বললো, এসব তুমি কীভাবে জানলে ?
আহান শান্ত গলায় বললো, বাবা বলেছে নিজের মুখে।
তাজ চমকে উঠলো আহানের কথায়, তোমার বাবা ?
আহান নিজের চোখ মুছে বললো, ভাইয়া তুতুলের খোঁজ পাওয়ার কয়েক মাসের মাথায় বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ে। বাবা কিংবা ভাইয়া কারো সাথেই আমার তেমন ভালো সম্পর্ক নয়। তাই তাদের সাথে আমার যোগাযোগ হয়ে উঠতো না খুব একটা। বাবা অসুস্থ এই খবরও আমি জানতাম না। আন্ডারওয়ার্ল্ডের সাথে জড়িত ছিলো বাবাও। সেখানেই এক ঝামেলায় বাবার হাতে গুলি লাগে। ডায়াবেটিকস ছিলো বাবার, ক্ষত স্থানে পচন ধরে যায়। একসময় কেটে ফেলতে হয় হাত, তবে সুস্থ হয় না পুরোপুরি বরং বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে শরীরে ছড়িয়ে পরে এটা, অবস্থা খারাপের দিকে যায়। দীর্ঘ দুই বছর ধুঁকে ধুঁকে নিজের পাপের ফল ভোগ করে বাবা। যখন নিজের ভুল বুঝতে পারে তখন তুতুলের সাথে দেখা করতে চায়। তুতুল আমার সাথে যাওয়ার এক মাস পরেই বাবার অসুস্থতার কথা জানতে পারি। তিতির কখনো আমার বাবার পাপের কথা আমাকে বলেনি। ও চায়নি আমি আমার বাবাকে ঘৃণা করি। কিন্তু বাবা নিজের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য তুতুলের কাছে মাফ চায় আর সব সত্যি স্বীকার করে। সবচেয়ে খারাপ লেগেছে কী জানেন ভাইয়া ?
তাজ কাঁপা গলায় বললো, কী ?
আহান তাচ্ছিল্যের সুরে বললো, আমার মাকেও খু*ন করেছিলো আমার বাবা। যাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো তাকেও সম্পত্তির লোভে শেষ করে দিয়েছে। মামা-মামীকে খু*ন করার বছর দুয়েক পরে মা সব সত্যিটা জানতে পেরে যায়। মা ভেঙে পড়েছিলো প্রাণপ্রিয় স্বামীর এমন জ*ঘ*ন্য রুপ দেখে। পুলিশের কাছে সব বলে দিতে চাইলে মাকে গলা টিপে খু*ন করেছে আমার বাবা নামের অমানুষটা। মায়ের কথাটা ভাইয়াও জানে না। বাবা আমাদের জানিয়েছিলো মা হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছে। নিয়তি দেখেছেন ভাইয়া, আমার বাবা যে হাতে গলা টিপে নিজের ভালোবাসার মানুষের জীবন নিয়েছিলো। মৃত্যুর সময় সেই হাত উনি সাথে নিয়ে যেতে পারেননি। এই পৃথিবীর বুকে থাকতেই সেই হাত পঁচে গলে গেছে। পাপ করে কেউ ছাড় পায় না। আমার বাবাকে এই পৃথিবীর কোনো দেশের আইন শাস্তি দিতে পারেনি কিন্তু উপরওয়ালার আদালতে ঠিক শাস্তি হয়েছে তার। জীবিত অবস্থায় একটু একটু করে পঁচে গলে গেছে তার শরীর। ভ*য়ং*ক*র মৃ*ত্যু হয়েছে তার।
তাজ হাত রাখলো আহানের কাঁধে। ছেলেটার ভেজা চোখদুটো টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। হয়তো রাগে কিংবা কষ্টে।
আহান নিজের চোখ মুছে নিজেকে শক্ত করে নিলো, আগামীকাল দুপুরের ফ্লাইটে আমরা লন্ডন ব্যাক করছি।
বুক কেঁপে উঠলো তাজের। এতগুলো বছর অপেক্ষা করে একজনের দেখা না পেলেও অন্যজনকে ফিরে পেয়েছে। তাকেও কী হারাতে হবে এবার ? তাজ এবার আর বাঁচবে না ধ্রুবকে হারিয়ে ফেললে।
আহান তিতিরের রেখে যাওয়া ডায়েরিটা নিজের সাথে করেই নিয়ে এসেছিলো। যতবার বাংলাদেশে আসে সাথে করেই নিয়ে আসে৷ কখন তাজের সাথে দেখা হয়ে যাবে এই ভেবে। ডায়েরিটা দিতেই এখন তাজের কাছে আসা আহানের।
ডায়েরিটা এগিয়ে দিলো তাজের দিকে, এটা আপনার জন্য রেখে গেছে তুতুল৷ জানি এটা এতে কী আছে, তবে আশা করি অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন। এটাও জানতে পারবেন আপনি ধ্রুবকে পাবেন কী, পাবেন না। আমি কেবল তুতুলের ইচ্ছে পূরণ করবো।
আহান উঠে চলে গেলো তাজের কাছে থেকে। তাজ তাকিয়ে আছে ডায়েরির দিকে। নীল রঙের ডায়েরির উপরে লেখা “বিষাক্তফুলের আসক্তি ”
তাজ আলতো হাতে স্পর্শ করলো লেখাটা। সামনে একবার তিতিরের কবরের দিকে তাকালো। হাত কাঁপছে তাজের, কী লেখা আছে এটাতে ? এই ডায়েরির উপরই কী নির্ভর করছে ধ্রুবকে তাজ পাবে কিনা ?
শুনেছি বেদনার রঙ নীল আবার বিষের রঙ ও নীল। তাই বিষাক্তফুলের কথাগুলো বিষাক্ত রঙেই ফুটিয়ে তুললাম। তাজওয়ার খান তাজ আপনি যদি আমার হতেন না, আমি সত্যি আপনাকে আমার মাথার তাজ করে রাখতাম। কিন্তু আপনি আমার নন, তাই আপনি যার তার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। কেমন আছেন নিজের আসল ভালোবাসার মানুষের কাছে ? নিশ্চয়ই খুব ভালো আছেন। আমিও মন থেকে চাই আপনি খুব ভালো থাকেন। নিজের ভালোবাসার মানুষের খারাপ থাকা কেউ চায় না। অবাক হচ্ছেন আপনাকে নিজের ভালোবাসার মানুষ বলায়, অবাক হবেন না প্লিজ। কারণ আপনি এতোটাও অবুঝ ছিলেন না আমি আপনাকে ভালোবাসি আর আপনি সেটা বুঝতেই পারেননি। তবু যদি না বুঝে থাকেন তাহলে আজ স্পষ্ট করেই বলি। আপনাকে আমি ভালোবাসি, প্রচন্ড ভালোবাসি। ভালোবাসতাম বলবো না, কারণ ভালোবাসার কোনো পাস্ট ফর্ম হয় না। আজ আমার বলতে কোনো বাঁধা নেই কারণ আপনি যখন এই ডায়েরি পড়ছেন তখন আমার অস্তিত্ব মুছে গেছে পৃথিবীর বুক থেকে। আপনি ভালোবাসতে জানেন না তাজ, ভালোবাসতে জানেন না। আপনি জানেন না, আপনি আমার ক্রাশ ছিলেন আগে থেকেই। আপনার গান শুনেই মুগ্ধ হয়েছিলাম আর আপনাকে দেখে ক্রাশড। একটু ফাঁকা সময় পেলেই আপনার গান শুনতাম মুভি দেখতাম। কিন্তু আপনি যখনই কোনো হিরোইনের সাথে ক্লোজ হতেন রেগে টিভি অফ করে দিতাম। শান্ত মেয়েটার মাঝের এমন পাগলামো কেউ জানতো না, কেউ না।
আপনার সাথে আমার প্রথম দেখা হওয়ার দিনের কথা মনে আছে ?
এতদিন যাকে টিভিতে, ফোনে দেখে এসেছি তাকে সামনে থেকে দেখবো। উত্তেজনায় আমার হাত-পা কাঁপছিলো। আপনি এলেন এক ভদ্রলোকের সাথে কথা বলতে বলতে। আমি হা করে তাকিয়ে ছিলাম আপনার দিকে। আপনার হেয়ারস্টাইল থেকে পায়ের শো পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলাম আর মুগ্ধ হচ্ছিলাম। আপনার হাঁটার স্টাইল, হাত নেড়ে কথা বলা, মনে হচ্ছিল আমি জ্ঞান হারাবো। আপনি যখন ঠিক আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। দৃষ্টি ফ্লোরে নিবদ্ধ, যেনো সামনে তাকালে অনেক বড় অপরাধ হয়ে যাবে। আমাকে দেখে আপনার এক্সপ্রেশন দেখার সৌভাগ্য হয়নি আমার। আপনি নাম জিজ্ঞেস করলেন কাঁপা গলায় উত্তর দিলাম। সেদিনের প্রতিটা সেকেন্ড আমার মনে গাঁথা। সেদিন থেকেই হয়তো ক্রাশ ভালোবাসায় রুপ নিতে থাকে। আপনি অন্যদের সাথে কথা বললে আমি আপনার দিকে তাকিয়ে থাকতাম আর যখনই আমার দিকে তাকাতেন আমার দৃষ্টি মাটিতে।
একদিন আপনি আমার জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম মুসকান কে রেখেছে ?
আমি নিচু গলায় বলেছিলাম, বাবা রেখেছে।
মুসকান নামের অর্থ জানো তুমি ?
জী স্যার জানি, মুসকান নামের অর্থ হাসি।
মুসকান মাহমুদ তিতির। মুসকান মানে হাসি আর তিতির মানে পাখি। দু’টো নামের সাথে মিশে আছে চঞ্চলতা কিন্তু তোমাকে আমি যখনই দেখি মাথা নিচু করে গম্ভীর মুখে কাজ করছো, এখন পর্যন্ত হাসতে দেখিনি। অদ্ভুত না ব্যাপারটা, যার নাম হাসি সে হাসতেই জানে না।
সেদিন আপনাকে বলতে পারিনি আমি হাসতে ভুলে গেছি। জানেন তো আমি এমন ছিলাম না। আমার হাসির আওয়াজে মাহমুদ ভিলার প্রতিটা বস্তু যেনো হাসতো। আমার মুখের হাসি আমার বাবার সারাদিনের ক্লান্তি দূর করতো। কিন্তু একটা রাত আমার জীবনের সব হাসি কেঁড়ে নিয়েছে। মাত্র নয় বছর বয়স তখন আমার। আমার বোনুটা কখন আমার কোলে আসবে সেই আশায় প্রহর গুনছিলাম। টানা দু’দিন বৃষ্টি হচ্ছিল সিলেট শহরে। বিকেলে আহুর সাথে বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর উঠেছে আমার গায়ে। মা নিজের ঐ অবস্থায় আমার মাথার কাছে বসে উদ্বিগ্ন হয়ে মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে আর বাবার ফোনে কল করে যাচ্ছে। জ্বরের ঘোরে তখন আমি শুধু বিড়বিড় করে বাবার নাম নিচ্ছি। বৃষ্টিতে আধভেজা হয়ে বাড়ি ফিরলো বাবা সাথে তার বডিগার্ড নুরুল মামা। ছোটবেলা থেকে তাকে মামা বলেই ডাকতাম আমি। আমার জ্বর দেখে মামা নিজের রুমে গেলেন না। মামার কেউ ছিল না, ছোটবেলা থেকে বাবার কাছেই বড় হয়েছে, বাবাকে ভাইয়া বলেই ডাকতো। বাবা-মা দু’জনে মাথার কাছে বসে রইলো আর মামা সোফায় বসে রইলো। মধ্যরাতে সবাই তখন খানিকটা ঝিমাচ্ছে আর আমার জ্বর কমায় আমি ঘুমিয়ে আছি। মায়ের চিৎকারে ঘুম ভাঙলো আমার। বাবা মাকে ধরে জানতে চাইছে কোথায় কষ্ট হচ্ছে। লিভার পেইন শুরু হয়েছিলো মায়ের। ঝুম বৃষ্টি তখন বাইরে। বাবা কী করবে বুঝতে পারছে না। একদিকে অসুস্থ আমি আর অন্যদিকে মা। বাবা ড্রাইভারকে বললো দ্রুত গাড়ি বের করতে। বাবা মাকে নিয়ে গাড়ির পিছনের সীটে বসলো আর মামা আমাকে নিয়ে ড্রাইভারের পাশে। ততক্ষণে আবার ধুম জ্বর উঠেছে আমার। হসপিটালে গিয়ে আমাকে আলাদা কেবিনে নিলো মামা আর মাকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হল। মামা একবার বাবার কাছে যায় একবার আমার কাছে। হঠাৎ আমি মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য বায়না শুরু করলে মামা আমাকে শান্ত করার জন্য আমার কাছেই থেকে গেলেন। মামা আমার কাছে বসে অস্থির অস্থির করছিলো ওদিকে মায়ের কী অবস্থা জানার জন্য কিন্তু আমাকে রেখে যেতেও পারছিলো না। ঘণ্টা খানেক পার হওয়ার আগেই র*ক্তা*ক্ত অবস্থায় তোয়ালে মোড়ানো ছোট পুতুল বুকে জড়িয়ে হুড়মুড়িয়ে কেবিনে প্রবেশ করলো বাবা।
মামা ব্যস্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো, আপনার এই অবস্থা কীভাবে হলো ভাইয়া ?
পাখিকে মামার কোলে তুলে দিলো বাবা, আমি তোর পায়ে পরছি নুরুল আমার মেয়ে দু’টোকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যা। ওরা আমার মেয়ে দুটোকেও মে*রে ফেলবে।
এসব কী বলছেন ভাইয়া ? কী হয়েছে, আপনার এই অবস্থা কে করলো ?
নুরুল আপনজন বিশ্বাসঘাতক হয়ে যায় কেনো রে ? এতো ভালোবাসার বিনিময়ে কীভাবে পিঠে ছু*রি বসালো ? আমার পারুকে কী নিশংসভাবে মে*রে ফেললো রে নুরুল। আমি কিছুই করতে পারলাম না। এবার আমার মেয়ে দুটোকেও মে*রে ফেলবে, আমি কিছু করতে পারবো না। তুই দয়া করে ওদের নিয়ে দূরে চলে যা। আমার বোনটাকে আমি একটা জানোয়ারের হাতে তুলে দিয়েছি নুরুল। জানি না আমার বোনটার কপালে কী আছে।
এবার আর মামার বুঝতে বাকি রইলো না এসবের পেছনে কে আছে। ফুপির কথা শুনে বুকটা খা খা করে উঠে মামার। মনের সুপ্ত অনুভূতিগুলো মনেই কবর দিয়ে বড্ড ভুল করেছে মনে হয়েছিল।
নিজেকে সামলে বললো, আপনাকে এভাবে একা ফেলে আমি কোথাও যাবো না ভাইয়া।
বাবা দেয়াল ঘেঁষে ফ্লোরে বসলো, আমার হাতে সময় নেই নুরুল। তুই যদি আমাকে নিজের ভাই মনে করে থাকিস তবে দয়া করে আমার মেয়েদের বাঁচা আমি তোর পায়ে,,
বাবা কথা শেষ করার আগেই মামা বাবার বাড়িয়ে দেওয়া হাত নিজের হাতে শক্ত করে ধরে কেঁদে দিলো। বাবার জায়গা মামার জীবনে কোথায় সেটা একমাত্র মামাই জানতো।
বাবার অনুরোধে মামা আমাকে আর বোনুকে নিয়ে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে আসে ঐ বিশ্বাসঘাতকের শহর থেকে। দু’জনকে বুকে আগলে বড় করতে থাকে। নয় বছরের ছোট মেয়ের কাঁধে এসে পরে নিজের ছোট বোনুকে বড় করার দ্বায়িত্ব। সেই রাত আমার জীবন থেকে সব হাসি, সুখ, আনন্দ কেঁড়ে নিয়েছিলো।
কিন্তু আপনার জন্য আবার হাসতে শিখেছিলাম আমি। আপনার সেদিনের কথা শুনে বাসায় এসে আয়নার সামনে বসে নিজেকে দেখেছি। আয়নাটা আপনি মনে করে হাসার চেষ্টা করেছি কিন্তু কিছুতেই হয় না। অথচ আপনার কথা চিন্তা করে কত আনমনে হেসেছি তার হিসাব আমার কাছে নেই কিন্তু আপনার দিকে না তাকাতে পেরেছি, না হাসতে। আসলে মেয়েরা যাকে ভালোবাসে তার চোখে চোখ রাখতে পারে না। আপনার দিকে তাকাতেই লজ্জা লাগলো, সেখানে হাসি অসম্ভব।
আপনার সাথে আমার প্রতিটা মুহূর্ত কাটতো মুগ্ধতায়। এতো মেয়ে আপনার জন্য পাগল কিন্তু আপনি তাদের প্রতি আগ্রহ দেখান না। আমি মাঝে মাঝে ভয় পেতাম যদি আমার দুর্বলতা টের পেয়ে যান আর চাকরি থেকে বের করে দেন। চাকরিটা ভীষণ প্রয়োজন ছিলো আমার। তাই সবসময় নিজেকে একটা কঠিন আবরণে আবৃত করে রাখতাম। তবু মাঝে মাঝে মনের প্রফুল্লতা কচ্ছপের মতো শক্ত আবরণ ভেদ করে বেরিয়ে আসতো কিন্তু আপনি খেয়াল করতেন না।
তাজ এতটুকু পরে ডায়েরি বন্ধ করে দিলো। চোখে ভাসছে তিতিরের সাথে কাটানো হাজার স্মৃতি। আজ স্মৃতিগুলো অনুভব করতে পারছে তাজ। তিতিরের আঁড়চোখে তাকানোর মানে বুঝতে পারছে। মজার ছলে বলা তার সামান্য অ্যাডাল্ট কথায় তিতিরের লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়ার কারণ বুঝতে পারছে। তার প্রতি মেয়েদের এতো ইন্টারেস্ট দেখানো ভালো লাগতো না তাজের। হঠাৎ একদিন সিম্পল সাদা চুড়িদার পড়া, মাথায় রঙচঙে চুলের বদলে সাদাসিধা একটা বেনি করা মেয়ে চোখের সামনে দেখে থমকে গিয়েছিলো তাজ। যেখানে সব মেয়ে তার দিকে ঘন্টা খানেক হা করে তাকিয়ে থাকতো, সেখানে মেয়েটা মাথা নিচু করে ছিলো। ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটে উঠেছিলো তাজের। প্রথম দেখার সেই দিনের কথা তাজেরও খুব ভালো করেই মনে আছে। যেখানে সবাই তাজের সাথে ভাব জমাতে ব্যস্ত হতো সেখানে তিতির প্রয়োজন ছাড়া কথাই বলতো না। তাজ যা বলতো ছোট ছোট উত্তর দিতো। তাজের তাই ভালো লাগতো তিতিরকে কিন্তু সেটা কখনো গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি তাজ। তবে আজ সেই ছোট ছোট স্মৃতিও তাজের চোখে ভাসছে। বুকের বা পাশটায় জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। তাজ আবারও ডায়েরি খুলে পড়তে লাগলো।
আপনার মনে আছে তাজ, একবার আপনার মুভির শুটিংয়ের জন্য আমরা ভারতের কাশ্মীর গিয়েছিলাম। শীতের প্রকোপে কাশ্মীর তখন সাদা বরফে ঢাকা পড়েছে। আপনি শুটিংয়ে ব্যস্ত আর আমি কাশ্মীরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। প্রকৃতির মাঝে এতোটাই ডুবে গিয়েছিলাম কোনো দিকে হুশ ছিলো না।
হঠাৎ আপনার গম্ভীর আওয়াজে চমকে উঠলাম, আচ্ছা কেয়ারলেস মেয়ে তো তুমি মুসকান।
সেদিন প্রথম আমাকে মুসকান বলে ডেকেছিলেন আপনি। কতগুলো বছর পর এই নামে কেউ ডেকেছিলো। আপনি হয়তো খেয়াল করেননি আমার চোখে চিকচিক করতে থাকা পানি। বাবা যখন বাড়ি ফিরে আমার মুসকান মা কোথায় বলতো, আমি যেখানেই থাকতাম এক ছুটে চলে আসতাম। এতগুলো বছর পর কেউ আবার সেই নামে ডাকলো। প্রত্যেক মেয়ে তার নিজের জীবনে বাবার মতো কাউকে চায়। যে তার সব আবদার হাসিমুখে পূরণ করবে, যেমনটা তার বাবা করে। আমি সেদিন আপনার মাঝে আমার বাবার ছায়া দেখতে পেয়েছিলাম। মনে হয়েছিলো আপনি সেই মানুষ যাকে আমার জীবনে প্রয়োজন।
আপনার ধমকেই ঘোর কাটলো আমার, তুমি এই পাতলা ফিনফিনে চাদর গায়ে জড়িয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছো কোন সেন্সে ?
আমি কোনোমতে নিজেকে সামলে বললাম, আমার ঠান্ডা লাগছে না স্যার। আমি একদম ঠিক আছি।
দেখেছো আমি ঠিক জানতাম তুমি একটা রোবট। নাহলে সাধারণ কোনো মানুষের মাইনাস ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ঠান্ডা লাগবে না এটা অসম্ভব। এই মেয়ে হাসে না, কাঁদে না, কথা বলে গুনে গুনে এখন আবার বলছে তার শীতও লাগে না। আস্ত একটা রোবট তো তুমি মুসকান।
আমি মাথা নিচু করে আপনার বকা শুনছিলাম। বাবাও ঠিক এভাবে শাসন করতো যখন আমি কারো কথা শুনতে চাইতাম না। আপনি সেদিন দেখেননি আমার চোখের আনন্দ অশ্রু। তাহলে আর আমাকে রোবট বলতে পারতেন না। আমাকে চরম পর্যায়ে অবাক করে দিয়ে আপনি নিজের গায়ের জ্যাকেট খুলে আমার গায়ে জড়িয়ে দিলেন।
শুনো মেয়ে নিজের খেয়াল রাখো, এখানে অসুস্থ হয়ে পড়লে কে দেখবে তোমাকে ? আমি তো নিজের কাজেই ব্যস্ত হয়ে থাকবো।
কথাগুলো বলে আপনি নিজের রুমে চলে গেলেন আর আমি আপনার জ্যাকেট আঁকড়ে ধরে ঘ্রাণ নিতে লাগলাম। (লেখনীতে তাহমিনা তমা)
তাজ আপনি ভালোবাসতে জানেন না কিন্তু আপনাকে ভালোবাসতে বাধ্য করতে ঠিকই জানেন। কোনো মেয়ে এমন একজন মানুষকে ভালো না বেসে থাকতে পারবে, বলতে পারেন ?
এমন ছোট ছোট অনেক ঘটনার কথা লিখে রেখেছে তিতির। ঘটনাগুলো দৃশ্যমান হচ্ছে তাজের স্মৃতিতে। তাজ অর্ধেক পড়ে-ই ডায়েরি বন্ধ করে ফেলেছে। কেউ কী বিশ্বাস করবে একজন মৃত মানুষকে ভালোবেসে ফেলছে তাজ। এতোটা ভালোবাসা লুকিয়ে রেখেছিলো জেনে ভালোবেসে ফেলছে তিতিরকে। হয়তো অনুভুতিগুলো তাজের মনে আগেই ছিলো কখনো বুঝতে পারেনি। কই মৌও তো কত ভালোবেসেছে কিন্তু সেটা জেনে তার প্রতি তো তাজের অনুভূতির জন্ম হয়নি। কিন্তু তিতিরকে হয়তো প্রথম থেকেই ভালোবেসেও উপলব্ধি করতে পারেনি কিন্তু এখন পারছে, বুকের ভেতর জ্বালাপোড়া করছে। দু’টো বছর তার ছোট থেকে ছোট জিনিসের খেয়াল রেখেছে তিতির। তাজের কখন কী চাই মুখ দেখে বুঝে যেত। এতো ভালোবাসার বিনিময়ে তাজ তাকে কী দিয়েছে ? অপমান, অবহেলা, অপবাদ, ঘৃণা। আচ্ছা একটা ডায়েরি পড়ে কাউকে ভালোবাসা যায় ? তার প্রতি আসক্ত হওয়া যায়, তাও একজন মৃত মানুষের ? তবে তাজ কীভাবে ভালোবেসে ফেলেছে তিতিরকে ? ডায়েরিটা বুকে জড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদলো তাজ।
ফিরে এসো মুসকান, একবার ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ দাও। একবার ভালোবাসি বলার সুযোগ দাও। এতো ভালোবাসার ঋণ মাথায় নিয়ে কীভাবে বাকি জীবন বাঁচবো আমি ? একটু ভালোবাসার সুযোগ দাও, ফিরে এসো।
কে বলে ছেলেরা কাঁদে না। এই তো তাজ কাঁদছে, আশপাশের বাতাস ভারী হচ্ছে তার কান্নায়। কিন্তু আজ আফসোস ছাড়া কিছুই করার নেই তার। কারণ সে নিজের ভালোবাসা অনুভব করতে পেরেছে মানুষটাই চলে যাওয়ার পর।
চলবে,,,,