বিষণ্ণ_শহর পর্ব_৭

0
933

বিষণ্ণ_শহর
#পর্ব_৭

পুনমের বাসায় পৌঁছানোর পর থেকেই হুরায়রা পুনমের অদ্ভুত সব কর্মকান্ড দেখে বেশ অবাক হয়।পুনম এবং পুনমের বাসা দুটাই অদ্ভুত।আবার এর ভিতর ঘটে গেছে একটা মহা প্রলয়ংকরী ঘটনা।
এক বৃষ্টিস্নাত রাতে হুরায়রা এবং পুনম পাশাপাশি দুজন দুদিকে ফিরে ঘুমিয়ে ছিল। পুনম মাঝরাতের দিকে হঠাৎ টের পায়, তার বাসার মেঝেতে কেউ খট খট শব্দ তুলে হাঁটাহাঁটি করছে। বাইরে তখন প্রচন্ড বৃষ্টি। পুনম ঘুমের ঘোরেই ভাবে হুরায়রা কোন কারণে হয়ত জেগে গেছে। কিন্তু খানিক বাদেই তার ভুল ভাংগে, যখন হুরায়রা পুনমের কানের কাছে মুখ নিয়ে জিজ্ঞেস করে, তোর বাসার মেঝেতে চাদর গায়ে হাঁটাহাঁটি করছে কে?
পুনম তাড়াতাড়ি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই মেঝেতে মাঝারি আকৃতির একজনের অবয়ব দেখতে পায় ।
সে চিৎকার করে উঠে,
“কে!!”
জিজ্ঞেস করতেই দৌড়ে বারান্দার দিকে চলে যায় অবয়বটি।
হুরায়রা দ্রুত সুইচ টিপে লাইট অন করে দেয়। দুজনে বারান্দার দিকে ছুটে গিয়ে দেখতে পায় সেখানে কেউই নেই। বারান্দার সাথে লাগানো কোন গাছও নেই যে বেয়ে উপরে উঠে যাবে। বারান্দা ছাড়া আর তো কোন রাস্তাও নেই এ বাসায় প্রবেশ করার,কারণ সব দরজা জানালা একেবারে ভালো করেই বন্ধ করে রাখা হয়েছিল।
হুরায়রা জিজ্ঞেস করে, ” লোকটা শহর আহমেদ নয় তো!
পুনম নিশ্চুপ থাকে। কোন উত্তর দেয়না।
.

শহর আহমেদ নামটা হুরায়রার জন্য আজকাল কিঞ্চিৎ মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। একটা প্রশ্ন মনের ভিতরে চেপে রেখেছিলো হুরায়রা। পুনমকে মনের লুকায়িত প্রশ্নটা করেই ফেলে,
” একটা বিষয় আমার খুব খটকা লেগেছে পুনম। তুই জানতি না, যে আমি হুট করেই তোর বাসায় আসব। তার মানে আমি ধরে নিতে পারি তুই শহর আহমেদ কে আমাকে আনার জন্য পাঠাসনি৷ আমাকে আগে সে কোনদিন দেখেওনি। আমিও তাকে বলিওনি,তোর বাসায় আসব৷সেদিন বৃষ্টিতে ঠিকানা লেখা চিরকুটটাও ভিজে চিড়ে গিয়েছিলো। কিন্তু অদ্ভুতভাবে শহর আহমেদ আমাকে তোর বাসার সামনেই পৌঁছে দেয়। আবার বলেও দিলো দরজায় লাথি মারলেই নাকি তুই বের হয়ে আসবি। ও কিভাবে জানলো এতকিছু!
পুনম ঠোঁটের কোণায় বাঁকা একটা হাসি দিয়ে বলে,
– তুই এসব চিন্তা ছাড়। এখন ফ্রেশ হয়ে খেতে বস। খাওয়াদাওয়া করার পর আরাম করে গল্প করা যাবে।
হুরায়রা ফ্রেশ হওয়ার জন্য টাওয়েল নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়।

.
.
.
.
সকাল সকাল নিজের অফিসে বসে রাগে গজগজ করছেন ইন্সপেক্টর বশির।
প্রায় পনের মিনিট পার হয়ে গেলো, কালু এখনো চা নিয়ে আসে নি। তার বেঁধে দেয়া নিয়ম অমান্য করার সাহস এই ছোটলোক গুলো কোথায় পায় তা ইন্সপেক্টর বশিরের মাথায় কিছুতেই ঢুকে না।
চড়া মেজাজ নিয়েই সিগারেট জ্বালায় সে।খানিক বাদে এক হাতে দুধ চা এবং অন্য হাতে লিকার চা নিয়ে ই. বশিরের কামরায় প্রবেশ করে শহর আহমেদ।
শহরকে দেখে ভ্রুকুটি দিয়ে বশির আহমেদ বলেন,
আরে শিকার যে একদম বাঘের খাঁচায়!! তোমাকে কতদিন ধরে খুঁজে চলেছি জানো তুমি?
– আপনি ব্যর্থ। তাই আমি ই চলে আসলাম।
নিন চা খান।
– আমি রং চা খেতে অভ্যস্ত, সেটাও তুমি জানো?
-রং চা বলে কোনো শব্দ নেই। সঠিক হচ্ছে র(Raw) চা। ইংরেজিতে যাকে বলে “raw tea”
– জ্ঞান ঝাড়তে এসেছ?
– নাহ, একটা প্রশ্ন খুঁজতে এসেছি।
– কি প্রশ্ন?
– শাহীনের মৃত্যুবরণ করার পরে আটক করা হয়েছিলো জাফর সাহেবকে। তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হলেন। কিন্তু পরে শাহীনের মারা যাওয়ার বিষয়টি চাপা পরে গেলো কেনো? কেনই বা তার মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন করার জন্য ইনিভেস্টিগেশন চালানো হচ্ছে না?
এটাই ছিলো আমার প্রশ্ন। তবে আপনার এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হবেনা।
কথোপকথনের এ পর্যায়ে কামরায় প্রবেশ করে লতিফ।
শহরকে দেখেই ভূত দেখার মত প্রতিক্রিয়া ফুটে উঠে তার চোখেমুখে।
একবার শহরের দিকে তাকাচ্ছে, একবার ই.বশিরের দিকে তাকাচ্ছে লতিফ।
শহর আহমেদ লতিফকে দেখে হেসে ফেলে।
বলে,
লতিফ সাহেব? সিগারেট খাবেন?
উত্তরের অপেক্ষা না করেই বুকপকেটে রাখা একটা গোল্ডলিফ সুইচ সিগারেট এগিয়ে দেয় লতিফের দিকে।
লতিফ অনেকটা কনফিউশন নিয়েই শহর আহমেদের হাত থেকে সিগারেটটি নেয়, অস্ফুট স্বরে বলে,
আমি কোন ব্রান্ডের সিগারেট খাই একদম সেটাও জানো দেখছি।
এরপর একটু ধমক দিয়ে বলে,
আর কি কি জানো বলো!!
প্রশ্নটা শুনেই হাহাহাহা করে হেসে ওঠে শহর।লতিফও বুঝতে পারে, সে
বোকার মত একটা প্রশ্ন করে ফেলছে।
শহর আহমেদ লতিফের দিকে তাকিয়ে জবাব দেয়,
কাল পুনমের বাসায় ঢোকার আগে বেশ কয়েকটা সিগারেট খেয়েছিলেন। সিগারেটের গোড়া দেখে জেনে নিয়েছি কোন ব্রান্ডের সিগারেট খান।
লতিফ পাশ থেকে বলতে থাকে, কি বলছ এসব, আমি কেন কারো বাসায় ঢুকতে যাব? এখানে আমার স্বার্থ কি? কাল রাতে তো আমি আমার এক বন্ধুর সাথে মুভি দেখছিলাম..পুলিশের ল্কক হয়ে কেনো ই বা আমি…
লতিফ তার মত করে অনেক কিছু বলতে থাকে, শহর তার কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে ই. বশিরের দিকে তাকিয়ে বলেন,
স্যার আপনাকে একটা কথা বলি,
আমাকে খোঁজার দরকার নেই। মনে মনে স্মরণ করলেই আমি ঠিক উপস্থিত হব।
যাওয়ার আগে আপনাকে একটা ধাঁধা দিয়ে যাই, উত্তর খুঁজে রাখবেন। পরের বার দেখা হলে আমাকে বলবেন।
বস্তুটার আছে এমন এক গুণ,
সব কিছু উল্টো ভাবে করে দেয় দ্বিগুণ।

শহর আহমেদ চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে। এদিকে লতিফ তখনো বলেই যাচ্ছে, আমার কি কোন স্বার্থ আছে যে আমি ঐ বাসায় গিয়ে ঢুকবো! আর এভাবে ঢোকাটা তো বে আইনি। আমি কেন আইনের লোক হয়ে এমন ঘৃণিত কাজ করতে যাব?
শহর আহমেদ লতিফের কোন কথাই শুনছে না এমন ভাব দেখিয়ে বের হয়ে যায়।
.
.
.
রান্না ঘরে টুকটাক কাজ করছে হুরায়রা এবং পুনম। কাল রাতের বিষয়টি নিয়ে দুজনেই চিন্তিত খুব। রান্না বসিয়ে দিয়ে পুনম কি একটা কাজে যেন তার রুমে আসে। এসেই একটা বিশাল চিৎকার দেয়।
যদিও একটু পরেই আবার নিজেকে সামলে নেয়, তবে চিৎকার শুনে ছুটে আসে হুরায়রা। চিৎকার দেয়ার কারণ হলো পুনম তার রুমে এসেই হঠাৎ দেখে শহর আহমেদ সেখানে বসে বসে বই পড়ছে।
কিন্তু সে তো শহরকে ভিতরে ঢুকায় নি। তাহলে আসলো কিভাবে?
প্রশ্নটা করতেই শহর উত্তর দেয়,
” বারান্দা দিয়ে”
-বারান্দা ?
হ্যাঁ । বারান্দায় দিয়েই উঠে এসেছি।
বলতে বলতেই বারান্দার দিকে হাঁটা দেয় শহর। পেছনে তাকে অনুসরণ করে হুরায়রা এবং পুনম।
যেতে যেতে হুরায়রা প্রশ্ন করে,
কাল রাতেও কি আপনি এসেছিলেন?
শহর উত্তর দেয়, না। আমি আসিনি তবে যে এসেছিলো সে একটা মই দিয়েই প্রবেশ করেছিল।
পুনম ও হুরায়রা বারান্দার সান সেট এ উঁকি দিয়ে একটা বিশাল বাঁশের মই দেখতে পায়।
পুনম জিজ্ঞেস করে,
-কেনো এসেছিলো তা কি আন্দাজ করেছ?
– তুই রান্না করতে যা। আমি হুরায়রার সাথে কিছুক্ষন কথা বলি।পুনম মাথা হেলিয়ে ভদ্র মেয়ের মত কিচেনে চলে যায়।
হুরায়রা এবং শহর সামনা সামনি বসা ড্রয়িং রুমে।
শহর আহমেদই প্রথমে কথা বলা শুরু করে,
আপনি যেহেতু বিষণ্ণ শহরে এসেই পড়েছেন, একটা রহস্যর সমাধান করে যান।
– কেমন রহস্য,
– একটা খুনের রহস্য।
– আমি খুনের রহস্য কিভাবে বের করব?
– পারবেন না বলছেন?
– চেষ্টা করব। বলুন শুনি।
– একটা ছেলে, খুন হয়েছে।
খুনী হিসেবে আটক করা হয়েছিলো একজন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার কে। ইনভেস্টিগেশনের পরে বের হলো ঐ ডাক্তার মৃত্যুর জন্য দায়ী না। তাকে ছেড়ে দেয়া হলো।
ছেলেটার ব্যপারে বলা যাক। সে আলালের ঘরের দুলাল টাইপ ছেলে। তবে বাবা ছিলো না। বাবা মারা যাওয়ার পরে মা বিয়ে করেছে অন্যত্র।বাবা মারা যাওয়ার আগে বেশ অনেক অর্থসম্পদের ছেলের নামে রেখে যাওয়ায়, ছেলেটি বখে গিয়েছিলো অনেক। মেয়েদের প্রতি তার বেশি দুর্বলতা ছিল। সোজা কথায় কাজ না হলে ধর্ষণের মত ঘটনাও ঘটিয়েছে সে। তার অপরাধ জগতে বিচরণ পুলিশদের জানাশোনার বাইরে ছিলোনা। তবে টাকা দিয়ে সবার হাত বেঁধে রাখতো ছেলেটি। খুব নিকটস্থ কেউ একজনই ছেলেটিকে খুন করে এবং পুলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে চাইছেনা এই খুনের কোন ইনভেস্টিগেশন হোক।
আপনাকে বের করতে হবে, খুনী কে।
– আপনি জানেন খুনী কে?
– হ্যাঁ জানি।
– আচ্ছা। আমার কাছে ঘটনাটি অনেক ইন্টেরেস্টিং লেগেছে। আমি ট্রাই করবো খুনীকে খুঁজে বের করার।
– বেশ। আপনাকে আরেকটু সহজ করে দেই কাজটা একটা ধাঁধার মাধ্যমে।
– দিন।
– বস্তুটার আছে এমন এক গুণ,
সব কিছু উল্টো ভাবে করে দেয় দ্বিগুণ।
হুরায়রা চিন্তায় পড়ে যায়। কোথা থেকে শুরু করতে হবে সে বুঝতে পারছে না।
তবে একটা ব্যপার তো পরিষ্কারভাবে বলা আছে।ছেলেটির নিকটস্থ কেউ ই খুন টা করেছে। প্রথমে বের করতে হবে কে বা কারা ছেলেটির খুব ক্লোজ ছিলো,
তারপর সবার পক্ষ থেকে একটা করে সম্ভাব্য মোটিভ অফ মার্ডার বের করতে হবে।
আপাতত এ দুটো কাজ দিয়ে শুরু করলে পরে আরো অনেকগুলো ক্লু চলে আসতে পারে। হুরায়রার কেন যেন নিজেকে গোয়েন্দা গোয়েন্দা লাগছে। তবে শহর আহমেদের উপর সে মোটেও সন্তুষ্ট নয়। তার সব কাজ কর্ম একেবারেই উদ্ভট।
.
.
কালুর কান ধরে টেনে একদম যেন ছিড়েই ফেলবে লতিফ। কালু ব্যাথায় প্রাণপণ চিৎকার করছে, সেদিকে লতিফের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।
গত পরশু ফায়ার সার্ভিসে নব্য জয়েন করা সদস্যদের প্রাক্টিসের জন্য দেয়া বাঁশের তৈরি একটা লম্বা মই অনেক রিকুয়েষ্ট করে নিয়ে এসেছিল লতিফ। নিজের কাজ শেষ করার পরে তাদের অফিসের একপাশে কাত করে রেখে দিয়েছিল সে। শহর আহমেদ যাওয়ার সময় কালুকে দিয়ে সেই মই নিয়ে গেছে।
থানার ভিতরে কালুর সচারাচর যাতায়াত থাকায়, মই নিয়ে যাওয়ার সময়ে তাকে আটকায় নি কেউ। কালুকে মারতে দেখে আশপাশে অনেক লোকজনের ভিড় জমে গেছে।
নাক ফেটে রক্ত বের হচ্ছে ওর। কেউই ধরার জন্য এগিয়ে আসছে না। ই. বশিরের কাছে কালুকে মারার খবর এসে পৌঁছাতে একটু দেরী হয়। কিন্তু কালুকে লতিফ বেদম প্রহার করছে, এটা শোনার সাথে সাথেই সে ঘটনাস্থলে গিয়ে উপস্থিত হয় এবং সেদিন প্রথমবারের জন্য লতিফের গালে সজোরে একটা চড় মারে। চড় খেয়ে গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে লতিফ। আশেপাশের লোকজনরাও হাহা করে হেসে ওঠে। ” এক্কেরে ভালো হইসে” বলে সবার সাথে হেসে উঠে কালুও।
.
.
.
– চলবে.
লেখকঃ হাসিবুল ইসলাম ফাহাদ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে