বিষণ্ণ_শহর পর্ব_৬

0
937

বিষণ্ণ_শহর –
#পর্ব_৬
_________________________
রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে রাস্তার ওপারে, কাত করে ফেলে রাখা মেহগনি গাছটার গুড়ির উপরে চোখ রাখে সুপ্তি।
একটা ছোট আগুনের ফুলকি নড়াচড়া করতে দেখে সে।
বুঝতে পারে, রাজন বসে সিগারেট টানছে।
মন খারাপ হয়ে যায় সুপ্তির। রাজন কোন ক্ষতি করেনি তার। এভাবে সারারাত সারাদিন মশার কামড় খেয়ে, বৃষ্টিতে ভিজে,রোদে পুড়ে একটা মানুষ বাইরে পড়ে আছে, বিষয়টি সুপ্তির মনে খুব বেশি অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। রাজন তার মাথার উপর একটা বোঝার মত হয়ে আছে। যদিও সে বিরক্ত করছে না সুপ্তিকে, তবুও সুপ্তি বিরক্ত হচ্ছে এবং এর একটা সমাধান দরকার। বিছানায় শুয়ে বেশ কয়েকবার এদিক সেদিক করেও সে চোখে ঘুম আনতে পারছিলোনা। ফোন টিপে সময় দেখে অনেক কিছু চিন্তা করতে করতে কেটে গেছে বেশ কয়েক ঘন্টা। সময়, রাত ২ঃ৩০.
সুপ্তি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। পা টিপে টিপে নিঃশব্দে দরজা খুলে বাইরে বের হয়।
বাসার সামনের রাস্তা পার হয়ে চলে যায় ওপারে। রাজনের কাছে।
রাজন তখন ধুলোর বিছানায়,গাছের গুড়িকে বালিশ বানিয়ে ঘুম দিয়েছে।
” এইযে শুনছেন?”
বলে কয়েকবার ডাক দেয়ার পরেই হুড়মুড় করে উঠে বসে রাজন।
সুপ্তিকে দেখে সে বেশ অবাক হয়।
কি বলবে বুঝতে না পেরে হা করে তাকিয়ে থাকে।
রাজনের দিকে তাকিয়ে সুপ্তি জিজ্ঞেস করে, বাসা কোথায় আপনার?
– পশ্চিম পাশের মসজিদটার পেছনে।
– বাসায় যান না কেনো? এখানে কি?
– আপনার সাক্ষাৎকারটা পত্রিকায় ছাপাতে চাই। যদি দিতেন, ভালো হত, আমার খুব প্রয়োজন।
– আপনাকে আমি টাকা দিয়ে দিচ্ছি, কত টাকা পাবেন এ সংবাদ ছাপিয়ে, বলুন। তাও এখান থেকে চলে যান।
– আপনি বুঝতে পারছেন না, আমার সংবাদটা করা জরুরি। টাকার প্রতি আমার মায়া নেই।
– সেটা বুঝতেই পারছি। মায়া যদি থাকত, তাহলে এভাবে রাস্তায় ঘুমাতে হত না।
সুপ্তি কি যেন একটু ভাবে, সত্য কথা ধামাচাপা দেয়ার নয়। সুপ্তি ভয় ও পায়না সত্য বলতে। সে ওখানে দাঁড়িয়েই রাজনকে সেদিন রাতের ঘটনা সব কিছু খুলে বলতে শুরু করে।
সুপ্তির পুরো ঘটনা শেষ করার আগেই
হঠাৎ করে কান্না করে উঠে রাজন।
ছেলে মানুষের হঠাৎ কান্না! কি করতে হবে বুঝতে পারছিলোনা সুপ্তি।
রিতীমত আহাজারি করে কান্না শুরু করে রাজন। হঠাৎ করে যেমন শুরু করে আবার হঠাৎ করেই শেষ হয়ে যায়। রাজন থেমে একদম স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করে তারপর?
সুপ্তি একেবারেই অপ্রস্তুত একটা পরিস্থিতিতে পড়ে যায়।
সে সংক্ষিপ্তভাবে তার ঘটনা শেষ করে।
ধন্যবাদ জানায় রাজন। পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে।
গ্যাসলাইটে খস খস করে বেশ কয়েকটা ঘষা দেয়ার পর আগুন জ্বালাতে সক্ষম হয় সে।
সিগারেট ধরিয়ে অন্ধকার রাতে বামদিকের রাস্তা ধরে চলে যায় রাজন।
হুট করেই একটু শূন্যতা অনুভব করে সুপ্তি।
রাস্তা পার হয়ে বাসায় প্রবেশ করে।অতি সাবধানতার সাথে নিঃশব্দে দরজা লাগানোর পর নিজের বিছানার দিকে যাবে,
এমন সময়ে জাফর সাহেবের গলায় শুনতে পান,
” ছেলেটাকে বাসায় এসে আজ রাতটা থাকতে বলতি। ওর জন্য মাঝে মাঝে আমার অনেক মায়া হয়। ”
বাবার কথার উত্তরে কোনো কিছু বলার মত আসছে না সুপ্তির মাথায়। সে চুপচাপ মাথায় অপরাধবোধ নিয়ে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ে।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙার পরেই জানালার পাশে গিয়ে সুপ্তি উঁকি দেয়,
রাজনের উপস্থিতি জানার জন্য। কিন্তু রাজন যেখানে বসা থাকতো, সে জায়গাটি একেবারেই খালি পড়ে আছে।
মন খারাপ থাকলে একেবারেই সময় কাটেনা সুপ্তির।সেদিন রাতে পুনমের বাসায় ডিনারের কথা ভাবতে থাকে সুপ্তি। রাজনকে সেদিন একটু প্রফুল্ল লাগছিল। সে কালু ছেলেটার সাথে হেসে হেসে কথা বলছিল। কখন হাসে কখন কাঁদে ঠিক নেই তার।
সেদিন ইন্সপেক্টর বশির আসে সুপ্তিদের বাসায়।
এসে চারপাশের কাজ দেখে। জাফর সাহেব কে আরো একটু ব্যস্ত করে তোলে ইন্সপেক্টর বশির। হাতে ৫০০ টাকার একটা নোট গুজে দিয়ে বলে মুরগী এনে রান্না করার ব্যবস্থা করতে। রাতে এখানেই খাবে সে।
জাফর সাহেব চলে যান বাজারের দিকে। এই ফাঁকে সুপ্তিকে ডাকেন ই. বশির।
ডেকে জানতে চান, কাল দেয়া লতিফের চিঠিটি সে পড়েছিলো কিনা!!
সুপ্তি অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বলে!
“চিঠি! কিসের চিঠি! আমাকে কোনো চিঠি ই তো লতিফ সাহেব দেয় নি। তবে সে এসেছিল। এসে বাবার সাথে বেশ কিছুক্ষন কথা বলেছে।”
মাথা চুলকায় বশির সাহেব। মন একটু খারাপ করে বলেন, তোমাকে কেউ বিরক্ত করে না তো আর!!
সুপ্তি জানায়, সে একদম ঠিক ঠাক আছে।
– শহরের সাথে আর দেখা হয়েছিলো??
– না হয়নি।
– ওর বাসা কোথায় জানো?
– জ্বী না, স্যার।
– আচ্ছা। আজ তোমার হাতের রান্না খাবো।
মুরগী রান্না করতে পারো?
– জ্বী।
-বাহ, শুনে ভালো লাগলো।
– আচ্ছা স্যার আমি আসি তাহলে।
– ঠিক আছে যাও।
ই. বশির প্রচন্ড ক্ষেপে আছে লতিফের উপর। এমন গুটিবাজি সে করতে পারলো! লতিফ তাকে বলেছিল সুপ্তি চিঠি নিয়েছে, তার সামনেই পড়েছে এবং মুচকি মুচকি হেসেছে। তাহলে সব কিছুই কি মিথ্যা!!
রাতে বেশ জমপেশ খাবারের আয়োজন করা হয়। খাবার খেতে খেতে বশির সাহেব প্রায় বিশ তিরিশবার বলে ফেলেন, সুপ্তিকে যে বিয়ে করবে তার কপাল খুলে যাবে। বৌ হিসেবে সুপ্তি হবে অসাধারণ। বিষয়টি সুপ্তি এবং তার বাবা দুজনেই খেয়াল করে। সেদিন রাতে খেয়ে দেয়ে বিদেয় হন ই. বশির। যাওয়ার আগে ভালো রান্নার জন্য সুপ্তিকে টাকাও দিয়ে যান বখশিশ হিসেবে।
পরদিন সকাল হতে নাই হতেই লতিফের চিল্লাপাল্লাতে ঘুম ভেঙে যায় জাফর সাহেবের।লতিফের সাথে উপস্থিত আছে ই.বশির ও। আজকে সবাই ফর্মাল ড্রেস পরে এসেছে। সাথে আছে আরো কয়েকজন দারোগা। বেশ উত্তেজিত হয়ে ছটফট করছে লতিফ।
জাফর সাহেব বাসায় ঢুকান সবাইকে।সভয়ে কি হয়েছে জানতে চাইলে তার মুখের সামনে একটা খবরের কাগজ তুলে ধরে লতিফ। লতিফের হাত কাঁপছিল, খবরের কাগজের হেডলাইনে বড় বড় করে লেখা,
“আবারো ধর্ষণের চেষ্টা করলো এক পুলিশ অফিসার”
জাফর সাহেব লতিফের হাত থেকে খবরের কাগজটি নিয়ে সম্পূর্ণ পড়ার পরে সুপ্তিকে ডাক দেন। সুপ্তি উপস্থিত হয় সেখানে।পুরো খবরটি পড়ে সেও।
কিছুক্ষনের জন্য স্তম্ভিত হয়ে যায় সে।
কাল রাজনকে যে ঘটনা বলেছিল, সেটা সামান্য বিকৃত করে, আলতাফের জায়গায় লতিফের নাম যোগ করে দিয়েছে।
রিপোর্টটির শেষের দিকে, স্পষ্ট উল্লেখ করা,
প্রতিবেদকঃ রাজন চাখলাদার, নিজস্ব রিপোর্টার।

সুপ্তিকে খবরের কাগজ পড়া শেষ করে, খবরের কাগজ থেকে চোখ উঠিয়ে উপস্থিত সবার দিকে তাকায়।
বশির সাহেব গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করে, এসবের মানে কি সুপ্তি?
সুপ্তি সাফ সাফ জানিয়ে দেয়, এমন কোন স্টেটমেন্ট সে দেয়নি কাউকে। এক্ষেত্রে তাকে দায়ী করা ঠিক হবেনা।
লতিফ তাকে এই কথাটা আবার বলতে বলে,।সে ভিডিও করে রাখবে, এবং পত্রিকার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিবে। সুপ্তি সাবলীলভাবে প্রথম যেভাবে বলেছিলো, সেভাবে ভিডিও ফুটেজে স্টেটমেন্ট দেয় না। কান্না কান্না ভাব এনে অনেকটা ভয় পেয়েছে এমন ভাবে মোবাইলে অন করে রাখা ভিডিও ক্যামেরার সামনে নিজের বক্তব্য তুলে ধরে। সেদিনের মত সবাই চলে যায়।
জাফর সাহেব মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকেন বেশ কিছু সময়। একটার পর একটা ঝামেলা যেন চেপেই আছে তার উপরে।
রাজন এবং পত্রিকার বিরুদ্ধে পরে মামলা দায়ের করা হয়।
পত্রিকার মালিক পক্ষও নিজেদের ডিফেন্স করে। সুপ্তিকে ভয় দেখিয়ে ভিডিও ফুটেজ করা হয়েছে দাবি করে, তারা উচ্চ আদালতে পাল্টা কম্পলেন করে ঘটনার সত্যতা যাচাই করার জন্য৷ উচ্চ আদালত থেকে একটি তদন্ত টিম গঠন করে দেয়া হয়।
আর এতেই একদম কাবু হয়ে যায় লতিফ। এমন হলে ঘটনার দিন রাতে লতিফ কোথায় ছিল, কি করছিলো তার একটা ইনভেস্টিগেশন হবে৷ যেটা লতিফের জন্য একেবারেই সুখকর কোনো কথা নয়৷ কেঁচো খুড়তে সাপ বের হয়ে পড়বে। কি করতে হবে বুঝতে পারছেনা সে।
___________________
শহরের পাশাপাশি বসে আছে রাজন।
রাজনকে আরো একবার ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো থানায়। সেবার শহর গিয়ে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে। লতিফ ও তার দলবল এখন রাজনকে খুঁজছে। তা নিয়ে অবশ্য রাজনের মাথাব্যথা নেই। সে এসেছে বাকি গল্প শুনতে। শুভোর গল্প। শহর জিজ্ঞেস করে,
” কোন পর্যন্ত যেন বলেছিলাম?”
– শুভকে মেরে ফেলেছিলেন সে পর্যন্ত।
– হ্যাঁ। তারপর ওখানে বসে সুইসাইড নোট সহ একটা চিরকুট লিখি। আমার বিচারের খাতায় শুভর মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্য ছিলো। কারণ সে সুপ্তির ভিডিও ফাইল গুলো নিজেই আলতাফকে দেখাতো এবং নেশার টাকা জোগাড় করার জন্য আলতাফ তাকে সাহায্য করতো।
এরপর আলতাফ সাহেবকে তার মেয়েকে ফিরিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিজের প্লান মত কথা বলাই।শুভ তার শাস্তি পেয়ে গেছে। সুপ্তিও যাতে মানসিকভাবে ভেঙে না পড়ে সেজন্য ওকে চিরকুট পাঠাই। তবে আমি যে শুভর বাসায় গিয়েছিলাম সেটার কিছু ক্লু খুঁজে আমাকে তলব করে ই.বশির।
যখন আমাকে নিয়ে যায় ধরে, আমি ইচ্ছে করেই একটা চিরকুট লিখে রেখে আসতে চাই। আমি জানতাম আমার লেখা চিরকুট ওরা ওখানে রাখবে না৷ নিয়ে নিবে। তাই প্লান করেই চিরকুটে হাতের লেখা পাল্টে লেখি। শুভর বাসার সুইসাইড নোট আর সুপ্তিকে দেয়া চিরকুটে আমি ওর হাতের লেখার মত করেই লিখেছিলাম অনেকটা। পরে ই. বশির আমার চিরকুটের সাথে শুভর সুইসাইড নোটের হাতের লেখা মিলায়। মিল খুঁজে না পেয়ে, এবং আলতাফের দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি পেয়ে কনফিউজড হয়ে আমাকে ছেড়ে দেয়।
সবটা শুনে রাজন উচ্চশব্দে হা হা হা করে হাসতে থাকে। তার এখন অনেক বেশি হাসতে ইচ্ছে করছে।
হঠাৎ হাসি থামিয়ে স্বাভাবিক হয়ে যায় সে।
আজ তাহলে নতুন আরেকটা গল্প বলো,।শাহীনের গল্পটা।
বলে পাশে ঘুরতেই দেখতে পায়, সেখানে নেই শহর। হয়ত উঠে চলে গেছে। যাক সমস্যা নেই। অন্যদিন পেলে শুনে নেয়া যাবে। রাজনের মনে অনেক শান্তি লাগছে। সে সিগারেট ধরায় না। মন শান্ত থাকলে রাজন কখনো সিগারেট খায়না, অনেক আগে একটা কবিতা লিখেছিলো রাজন, সেখানের দুলাইন কবিতা মনে পড়ে তার,
ছাইপাঁশ সিগারেটের চেয়ে,
প্রিয়তমার নরম ঠোঁটের স্পর্শ অধিকতর শ্রেয়।
পুড়তে থাকা তামাকের নেশায় তোমায় কখনো ভুলে থাকিনি প্রিয়।
– চলবে,
লেখকঃ হাসিবুল ইসলাম ফাহাদ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে