বিষণ্ণ_শহর
#পর্ব_৪
________________________
সকাল সকাল একটা মোটা গলার ডাকে ঘুম ভাংগে সুপ্তির।
গলার স্বর সুপ্তির কাছে অচেনা হলেও জাফর সাহেবের কাছে খুব বেশি পরিচিত। লাফ দিয়ে উঠে বসে জাফর সাহেব। এক দৌড়ে চলে যায় রান্নাঘরে। হাতে জগ নিয়ে নাকে মুখে পানি ছিটায় সে। তোয়ালে দিয়ে নাক মুখ মুছতে মুছতেই সুপ্তিকে বলে জলদি চা বানা। পরিষ্কার গ্লাসে চা পানি বিস্কুট দে। বড়কর্তা আসছে।
সুপ্তি ঘুম ঘুম চোখে উঠে বসে। সেও নাকেমুখে পানি ছিটায়,ফ্রেশ হয়।
চুলোর উপরে চা দিয়ে কি কথাবার্তা হচ্ছে তা শোনার জন্য সুপ্তি কান পাতে সামনের কক্ষে।
কথাগুল অস্পষ্ট। তবে শহর নাম টা বেশ কয়েকবার শুনতে পায় সে।
বুকের মধ্যে কোন এক অজানা কারণে ঢিপ ঢিপ করে ওঠে সুপ্তির।
এই বড়কর্তাটা আবার কে!
চা হয়ে গেলে বয়াম থেকে বিস্কুট নামিয়ে সুপ্তি একটা পরিষ্কার পিরিচে সুন্দর ভাবে সাজিয়ে, নিয়ে যায় ওর বাবা এবং আগন্তুক মেহমানের উদ্দেশ্যে।
তাদের কক্ষে প্রবেশ করার আগে সুপ্তি পর্দার ফাঁক দিয়ে ভিতরে উঁকি দেয়। দেখতে পায় পুলিশের ইউনিফর্ম পড়া একজন মধ্যবয়সী লোক।
বুকপকেটের উপরে রয়েছে নামফলক।
বশির।
সুপ্তি নিচের দিকে দৃষ্টি দিয়ে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যায়। চায়ের ট্রে টেবিলের উপরে রাখে।। বশির সুপ্তিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
সুপ্তি বসো। তোমার সাথে জরুরি কিছু কথা আছে।
সুপ্তি মনে মনে একটু নার্ভাস হয়ে পড়ে। কিন্তু বাইরে তা প্রকাশিত হয়না। বাবার পাশেই বসে সুপ্তি।
দৃঢ় কন্ঠে বলে, জ্বী বলুন।
ইন্সপেক্টর বশির কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে সুপ্তির দিকে। তারপর নরম গলায় বলে,
শহর নামে কাউকে চেনো?
বশিরের গলার সুর আগের থেকে অনেকটা কোমল আর স্নেহমাখা শোনা যাচ্ছে।
আগের মত করেই সুপ্তি উত্তর দেয়।
– হ্যাঁ চিনি।
– তোমার বাবা যেদিন আমাদের হেফাজতে ছিল, তুমি সেদিন রাতে ওর সাথে ছিলে?
– হ্যাঁ আমার বাসার দরজা ভেংগে গেছিলো। শহর আহমেদ আমাকে একটা বাসায় আশ্রয় দিয়েছিল তখন।
– ও নিজেও কি সে বাসায় ছিল?
– না, আমাকে সেখানে রেখে চলে গেছিল অন্য কোথাও।
– সেদিন রাতে শুভ নামের কেউ একজন মারা যায়। আমাদের তদন্ত টিমের ধারণা, খুনটা হয়ত শহর ই করেছে। ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার। তাই খুঁজছি।
সুপ্তির মুখ হা হয়ে যায়। তার মুখ থেকে আর কোন টু শব্দ বের হয়না।
জাফর সাহেব পাশ থেকে বলেন। শহরকে তো আমি চিনি। ভালো ছেলে। রাতে ঘুরে বেড়ায় এদিক সেদিক। আমার মনে হয় ছেলেটা পাগল। আমি দোকানে বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যাই প্রায় ই।
মাঝে মাঝে ঘুম ভেংগে গেলে তাকে দেখি সামনের চেয়ারে বসে পত্রিকা পড়ছে। আমার ঘুম ভাংতেই সে চলে যায়। এই শহরেই শহরকে খুঁজে পাবেন।মাঝরাতে রাস্তা ঘাটেই হাঁটাহাঁটি করে।
বেশ। আজ তাহলে উঠি।
আসসালামু আলাইকুম স্যার।
সালাম দেয় জাফর সাহেব। মেয়েকেও বলে, এই স্যার কে সালাম দে। সুপ্তি বাবার কথা মান্য করে তাকে সালাম দেয়। সালামের জবাব দিয়ে দরজা পর্যন্ত হেঁটে চলে যান ইন্সপেক্টর বশির।
পরে আবার কি মনে করে যেন ফিরে আসেন। জাফর সাহেব কে বলেন, আপনাকে আমি সামান্য কিছু অর্থ প্রদান করব,বলতে পারেন ধার হিসেবেই। বাসাটা ভেংগে বিল্ডিং করার ব্যবস্থা করেন। দোতালা বাসা করবেন। নিচতলা ভাড়া দিবেন। ভাড়া টাকা থেকে আমি আমার টাকা কেটে কেটে নিয়ে যাব।
জাফর সাহেব একটু ভেবে হ্যাঁ না কিছু একটা জানানোর আগেই হন হন করে হেঁটে বের হয়ে যান বশির।
রাত ১২ টা ত্রিশ মিনিট। এ সময়ে ইন্সপেক্টর বশিরের থাকার কথা ছিলো নিজের বাসার ছাদে। ছাদে বসে সিগারেট খেতে খেতে সে তার দৈনিক ইনকাম গুনে। টাকা গুনতে গুনতেই অর্ধেক রাত পার হয়ে যায় তার। তবে আজকের গল্প ভিন্ন। সে এখনো অফিসেই আছে। ডাম্পইয়ার্ডের সামনের রাস্তায় থাকা একটা বেঞ্চি থেকে শহর আহমেদকে আটক করা হয়েছে। আসার আগে বুক পকেট থেকে একটা কলম ও একটা কাগজের টুকরো বের করে ছোট্ট একটা চিরকুট লিখেছিলো শহর। সেখানে লেখা ছিলো, অন্য একদিন গল্প করব। আজ চলে যাচ্ছি। কবে আসি ঠিক নেই। ভালো থাকিস। ”
বেঞ্চির উপর চিরকুটটা লিখে ইট দিয়ে চাপা দিয়ে এসেছিল সে। কিন্তু এক দারোগা সেই চিরকুট ও নিয়ে এসেছে। এতে কিঞ্চিৎ বিরক্ত শহর আহমেদ। কারণ সে জানে তার অপেক্ষায় কেউ একজন পুরো রাতটাই পার করে দিবে ওখানে বসে।
ই. বশির সিগারেটে টোকা দিয়ে অ্যাঁশট্রে ছাই ফেলে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে শহরের চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে , তুমি খুন করতে পারো??
বশির নিজেও জানে অযাচিত প্রশ্ন, তাও কোন একটা উত্তরের আশায় সে অপেক্ষা করে। একগাল হেসে শহর উত্তর দেয়।
খুন! সেটা কে না করতে পারে!
আপনিও, আমিও।
শহরের উত্তর শুনে কপালে কিছুক্ষনের মধ্যেই বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করে ইন্সপেক্টর বশিরের।
– তারমানে তুমি স্বীকার করছো, যে তুমি একজন খুনী!
– হ্যাঁ। সর্বশেষ আমার হাত রক্তে লাল হয়েছে গত কাল।
– কাকে খুন করেছ?
– কয়েকটা মশাকে।
– মশকরা করছো আমার সাথে?
– আপনার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি।
– শুভকে খুন করেছ?
– শুনেছি সুইসাইড কেস।
– তুমি সেদিন রাতে শুভর বাসায় গিয়েছিলে?
– হ্যাঁ।
– কেনো?
– জিজ্ঞাসাবাদ করতে।
– কিসের?
– সেটা বলা যাবেনা।
– তোমাকে এই মুহূর্তে আমি শারিরীক ভাবে আঘাত দিতে চাচ্ছিনা।
– জাদুতে বিশ্বাস করেন?
– না।
শহর তার নিজ হাতের লেখা চিরকুটটি দারোগার কাছ থেকে চেয়ে নেয়। সেটাকে টেবিলের উপরে ই. বশিরের সামনে রাখে।
পরে দুদিকে দু হাত ফাঁকা করে কাগজের দিকে ইশারা করে।
যেন সে না ছুঁয়েই মন্ত্রবলে কাগজটাকে নাড়াবে এমন। উপস্থিত সব দাঁরোগা এক জায়গায় হয়ে উঁকি মারে।
শহর এক হাত দিয়ে অন্য হাত ঝাড়া দেয়। বার আগের মত কাগজের দুপাশে দুহাত নিয়ে স্পর্শ না করে ধীর গতিতে আংগুল নাচাতে থাকে। হঠাৎ করেই আংগুলেরর সাথে সাথে কাগজটাও নড়ে উঠে।
সবাই ওওওও করে চাপা একটা গর্জন করে।
ইন্সপেক্টর বশির বলেন, থামো।
তোমার নিশ্চয়ই চিরকুটের সাথে কিছু একটা লাগানো আছে।
শহর উপেক্ষার ভংগিতে তার দিকে তাকায়।
টেবিলের উপরে থাকা একটা বই হাতে নিয়ে মাঝ বরাবর খুলে সামনে রাখে সে। বইয়ের দুপাশ থেকে আবার দু হাতের আংগুল নাচায় শহর।
এবার ও ঘটল এক অলৌকিক ঘটনা।
কোন রকম স্পর্শ ছাড়াই ঢেউ খেলে খেলে পৃষ্ঠা উল্টে যাচ্ছে নিজে নিজে।
ইন্সপেক্টর বশির এবার নিজেই বলে উঠেন! ও মাই গড! তোমার ভিতরে সাইকিক পাওয়ার আছে!!
” এবার জাদুবিদ্যায় বিশ্বাস করলেন?”
হ্যাঁ না এর মাঝামাঝি একটা উত্তর দিতে চাইলেও মুখ ফসকে হ্যাঁ বের হয়ে গেল ই. বশিরের।
বাকি সবাই নিজেদের ভিতর ফিসফিসিয়ে কি কি কথা যেন কানা ঘুষা করে চলছে। শহর ই. বশিরের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমরা তা-ই দেখি যা আমাদের চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হয়।
এইযে আমি আপনাকে দেখালাম আমি বইয়ের পাশে হাত নাড়াচ্ছি আপনারা সবাই আমার হাতের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।
আপনাদের চোখ যখন আমার হাতের দিকে তখন আমি সতর্কতার সাথে মুখ দিয়ে আলতো করে ফু দিয়ে আগে চিরকুট নাড়িয়েছি পরে বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টিয়েছি।
কিন্তু আপনারা বুঝতে পারেন নি। জাদুবিদ্যার উপরে আপনার এতদিনের বিশ্বাসে চিড় ধরেছে। নিজ চোখে দেখা ঘটনায় ও অনেক ফাঁক ফোকড় থেকে যায় আর সেখানে আপনারা আমাকে ধারণার ভিত্তিতে ধরে নিয়ে এসেছেন।
এতক্ষন শহরের দিকে ঝুঁকে বসা ছিল ই.বশির। এবার চেহারে হেলান দিয়ে বসেন।এভাবে বসার সময়ে পুরোনো চেয়ারে ক্যাচ করে একটা শব্দ হয়। এ শব্দটা শহরের খুব পরিচিত।
মিনিট দুয়েক যেতে না যেতেই হুড়মুড় করে বশিরের কক্ষে প্রবেশ করে আলতাফ।
দৌড়ে এসে হুমড়ি খেয়ে পরে সে। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে আলতাফ বলতে থাকে,
সব দোষ আমার। শহরের দোষ নেই।
.
.
.
পাশাপাশি বসে আছে শহর এবং আলতাফ।
সামনে ইন্সপেক্টর বশির।
আলতাফ তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি শুরু করে,
“শুভ আলতাফের দোকান থেকে বাকি খেত। মাস শেষে হিসেব মিলিয়ে টাকা পরিশোধ করার সময় শুভ তার ফোনকে ক্যালকুলেটর হিসেবে ব্যবহার করে এবং হিসেব শেষে টাকা পরিশোধ করে বাসায় চলে আসে। মাঝপথে শুভর খেয়াল হয়,সে ফোন ফেলে গেছে। সে তাড়াতাড়ি দোকানে এসে ফোন নিয়ে যায়। এদিকে আলতাফ সুপ্তির দিকে অনেক দিন ধরেই নজর রেখেছিলো। সে জানতো শুভ ও সুপ্তির প্রেমের সম্পর্ক আছে। শুভর ফোনে নিশ্চয়ই সুপ্তির ছবি থাকবে, তাই সুযোগ পেয়ে সে শুভর ফোনের মেমরি কার্ড খুলে রেখে দিয়েছিল।
মেমরি কার্ডে সুপ্তি এবং শুভর শারিরীক মেলামেশার বেশ কয়েকটি ভিডিও পায় আলতাফ। শুরু হয় ব্লাক মেইল। টাকাপয়াসার অভাব আলতাফের ছিল না। আলতাফের চোখ ছিল সুপ্তির প্রতি।সুপ্তির বাসা ফাঁকা থাকলেই শুভ চলে যেত ওর কাছে। আলতাফ শুভকে জানায় এরপর শুভ না। যাবে সে নিজে। বন্দোবস্ত সব শুভর করতে হবে। নইলে ভিডিও চলে যাবে সবার কাছে।
শুভর মত চরিত্রের একটা ছেলের ছোট বোনকে এরপর আর কেউ বিয়েই করতে আসবেনা।
এসব বলেই শুভকে মেন্টালি প্রেসারে রাখে আলতাফ।
শেষপর্যন্ত জাফর সাহেবকে যেদিন ধরে নিয়ে যাওয়া হয়,সেদিন শুভ ইচ্ছে করে সুপ্তির সাথে ব্রেকাপ করে চলে আসে এবং আলতাফ সুপ্তিকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। শহরের জন্য সুপ্তিকে কোন ক্ষতি করতে পারেনি আলতাফ তবে শুভ ভেবেছিল তার ভালোবাসার মানুষকে অন্য কেউ জোর করে ভোগ করছে। এবং সেটার জন্য দায়ী সে নিজে। এজন্য ই আলতাফ কে একটা ঘৃণা ভরা মেসেজ দিয়ে শুভ গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে।
মোবাইল বের করে শুভর দেয়া শেষ মেসেজ দেখায় আলতাফ।
সেখানে লেখা ছিলো,
আমি চলে যাচ্ছি। আমার ভালোবাসার মানুষের শরীর অন্য কেউ অপবিত্র করছে, তাও আমার ভুলের জন্য, এটা মেনে নিতে পারছিনা। আপনাকে আমি সুইসাইড নোট লিখে ফাঁসিয়ে যাব না। নিরবে চলে যাচ্ছি। বিনিময়ে আমার পরিবার ও আমার ভালোবাসা থেকে সরে যাবেন।
ইতি – শুভ।”
শহর আহমেদ চেয়ার ছেড়ে উঠে পরে। মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে ই. বশির। গেট থেকে বের হবে এমন সময় পেছন ফিরে শহর বলে,
আবার দেখা হবে,
মিস্টার রবিন খান। দুঃখিত, বশির খান।
বলেই দরজা থেকে বের হয়ে যায় সে।
ইন্সপেক্টর বশির পকেট হাতড়ে প্রেসার কমানোর ঔষধ খুঁজে চলেছেন।
ঘামে তার শরীর ভিজে গেছে পুরোপুরি। যেভাবেই হোক বের করতে হবে এই শহর আহমেদ কে। দরকার হলে সরিয়েও দিতে হবে। শুভ খুন হয়েছে নাকি সুইসাইড সেটার থেকেও শহর আহমেদের পরিচয় বের করা সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে তার কাছে।
চলবে…
লেখকঃ হাসিবুল ইসলাম ফাহাদ