বিষণ্ণ শহর পর্ব_৫

0
994

বিষণ্ণ শহর ?
#পর্ব_৫
________________
আলতাফ সাহেবকে জেলখানায় আটক করে রাখা হয়েছে। রাতে আর বাসায় যান নি ইন্সপেক্টর বশির।সারারাত ঘুম ও হয়নি তেমন।
কাক ডাকা সকালে চেয়ারে বসে ঝিমোতে ঝিমোতে কাপে রাখা গরম পানিতে টি ব্যাগ চুবিয়ে চলেছেন বেশ কিছুক্ষন ধরে। মুখের কোনায় একটা হাসির রেখা টেনে তিনি তার সামনে বসা ছোকরাটাকে জিজ্ঞেস করলেন,
“জাদু দেখবি?”
বশিরের সামনে যে ছেলেটা জীর্ণশীর্ণ হয়ে বসে আছে তার নাম কালু, সে থানার পাশে থাকা টং দোকানের কর্মচারী। ভি আই পি কাস্টমারদের কাছে চা পৌঁছে দেয়া সহ টেবিল মোছা, পানি আনা নেয়া সহ ছোট খাট কাজ দ্রুতগতিতে করে দেয়া এবং ভুল করে গালিগালাজ শোনাই তার চাকরি।
নাকের নিচের লোমগুলো সবেমাত্র গাড় কালো রঙের হতে শুরু করেছে কালুর। কৈশর থেকে যৌবনে পা দেয়ার প্রথম ধাপে আছে সে।
কালুর অবশ্য আরো একটা ভালো নাম আছে,কাব্য। কিন্তু সেই নামে কেউ তাকে ডাকে না। আমাদের সমাজে যে যত নিম্নমানের জীবনযাপন করে, তার নাম ও তত নিম্নমানের হতে হবে। আকিকা দিয়ে বাবা মা ভালো নাম রাখলেও সমাজের মানুষ নিজ থেকে একটা বিকৃত নাম দিয়ে দিবেই। এটা যেন তাদের নৈতিক কর্তব্য। সেই কর্তব্যের সাথে তাল মিলিয়েই কাব্য হয়ে গেছে কালু।
ই. বশির সাহেবের মুখে জাদু দেখানোর কথা শুনে কালু অতি আগ্রহের সাথে বললো,
“জে স্যার দেখমু। ”
– দাঁড়া আগে চা’ টা শেষ করে নেই।
রং চা খাইলে শরীর চাংগা থাকে। জাদু ভালোভাবে দেখাতে পারবো।
– স্যার, আমি কিন্তু দুধ চা খাই। দুধ চা খাইতে বেশি মজা।
– দুধ চা স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর, বুঝলি?
– তাইলে স্যার আপনে যে সিগারেট খান? ঐটা আরো বেশি ক্ষতিকর।
বশির সাহেব চোখ লাল করে ফেলে। আক্রমনাত্মক ভাবে ধমক দেয়,
” চোপ ব্যাটা!!” এত বেশি কথা বলস ক্যান?ছোটলোক একটা! যা আমার রুম থেকে বের হ এক্ষুনি।
-স্যার জাদু দেখাইবেন না??
-তোকে যাইতে বলছি??
কালু মন খারাপ করে উঠে চলে যায়। ইন্সপেক্টর বশির চা শেষ করে পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরিয়ে টানতে টানতে একটা গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে যায়।
এর মধ্যেই কাচুমাচু করে ই. বশিরের কামরায় প্রবেশ করে লতিফ। নির্ধারিত সময়ের থেকে আধাঘন্টা বেশি দেরি হয়েছে তার। সূর্য যেমন পূর্ব দিকে উঠবেই, দিনের পর যেমন রাত আসবেই, দারোয়ান সিদ্দিক যেমন মার খাবেই, তেমনি লতিফ ও দেরী করবেই৷
এটা যেন চিরন্তন সত্য হয়ে গেছে। লতিফের আলসেমি ভাবের কারণে দুবার হাজত থেকে আসামী পালিয়ে গেছে। তবুও মামার জোরে চাকরীতে টিকে আছে লতিফ। তাকে বেশি টাইট দেয়া যায়না। অফিসের সবাই তাকে একটু আঁড়চোখে দেখে।
ইন্সপেক্টর বশির লতিফকে দেখা মাত্রই নড়েচড়ে বসেন। যেন ওর জন্যই অপেক্ষা করছিলো এতক্ষন। লতিফ এসে বশিরের সামনে বসে। দুজনে গভীর আলাপ আলোচনায় মগ্ন হয়ে যায়।
জাফর সাহেবের বাসা বিল্ডিং করার কাজ শুরু হয়েছে সত্যি সত্যি। কি থেকে কি হচ্ছে জাফর সাহেব নিজেই কিছুই বুঝতে পারছিলেন না । শুধু এটুকুই বুঝছিলো,তার দৈন্যদশার দিন শেষ হয়েছে। চারদিকে তদারকি করে কাজ করাতে হচ্ছে তাকে।
খারাপ খবর বাতাসের মত দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
আলতাফ সাহেবের অপকর্মের খবরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। সুপ্তির পিছনে ঘুরঘুর করছে স্থানীয় একজন কাগজের রিপোর্টার, রাজন। সে কোন নির্দিষ্ট পত্রিকায় কাজ করেনা। খবর সংগ্রহ করে কোন একজায়গায় দিয়ে দেয়, বিনিময়ে যা পায় তাতেই চলে তার ভবঘুরে জীবন। সুপ্তি যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে রাজন কে। কিন্তু সে নাছড়বান্দা। সুপ্তির বাসার সামনে ময়লা পাঞ্জাবি পড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকে। সুপ্তিকে সে মাত্র একবার ই জানিয়েছে যে তার সাক্ষাতকার নিতে চায়। সুপ্তি না করে দিয়েছে।
এরপর রাজন আর সুপ্তিকে কিছু বলে নি। কিছু না বলেই দাঁড়িয়ে থাকে সুপ্তির বাসার সামনে। বাসা থেকে বের হওয়া বা ঢোকার পথে সব সময়েই চোখে পরে রাজন কে।
রাজনের মনে এলটা দৃঢ় বিশ্বাস আছে। বিশ্বাসটা হলো পৃথিবীর সবথেকে বড় শক্তিশালী অস্ত্র হচ্ছে অপেক্ষা।
সুপ্তি রাজনের প্রতি যথারীতি বিরক্ত। যদিও বিরক্ত হওয়ার কোন কারণ নেই তবুও সে হচ্ছে। রাজনের এই লাগামহীন উপস্থিতি সুপ্তির মনে প্রভাব ফেলছে। এইত একটু আগে বাজার করতে আসার আগে দেখে এল রাজন সিগারেট টানতে টানতে গুনগুন করে গান গাইছে, মানুষের জীবন কতটা অনর্থক হলে এভাবে ময়লার মত কোথাও পরে থাকে সেটা ভাবতে ভাবতেই সব্জিওয়ালার সাথে দাম কষাকষি করছিল সুপ্তি।
পেছন থেকে কাঁধের উপরে একটা হাতের আলতো স্পর্শে লাফ দিয়ে উঠে সুপ্তি। কয়েক হাত পাশে সরে যায় সে।
পেছনে ঘুরতেই দেখে পুনম। মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করে কেমন আছো সুপ্তি?
সুপ্তি, পুনমের মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে নেয় একবার।
হাতে বড় বড় মাংসের ব্যাগ, পোলাউ চাল, মাখন, ঘি, ইত্যাদি ইত্যাদি। দেখেই বোঝা যাচ্ছে কোনো ভোজের আয়োজন করা হয়েছে। এতগুলো বাজার একা একা টেনে টেনে একদম ঘেমে নেয়ে গেছে পুনম। ঘর্মাক্ত চেহারাতেও গোলাপি রঙের মুখমণ্ডল ফুলের মত ফুটে আছে যেন। নাকের নিচে,যেখানে ছেলেদের মোচ থাকে সেখানে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হয়ে টকটকে লাল ঠোঁটগুলোর সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছে পুনমের।
সুপ্তি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে মেয়েটির দিকে।পরক্ষনেই শশব্যস্তভাবে জিজ্ঞেস করে আরে! আরে!! এতকিছু বাজার করে তুমি একা নিয়ে যাচ্ছ!!
চলো আমি এগিয়ে দেই।
হাসিমুখে পুনম জানায়, এটা তার নিত্যদিনের কাজ।
তবে যদি সুপ্তি সাহায্য করতে চায় তো করতে পারে। তাহলে আরো কিছু বাজার করে নিবে পুনম। সুপ্তির হাতে তাড়া নেই। সে পুনমকে সাহায্য করার জন্য নিজ থেকেই আগ্রহ দেখায়। পুনম সুপ্তিকে সাথে নিয়ে আরো একগাদা বাজার করে। অর্ধেক বাজার সুপ্তি হাতে নেয়ার পর ও পুনমের হাতে সেই আগের মত ই অনেকগুলো বোঝা থেকে যায়। দুজনে বাজার করে বের হয়ে দুটো একটা পায়ে টানা রিকশা নেয়। এক রিকশায় বাজার দিয়ে অন্য রিকশায় তারা দুজনে উঠে বসে। পুরো রাস্তা জুড়েই সুপ্তি আড়চোখে পুনমের সৌন্দর্য উপভোগ করে যাচ্ছিলো। মাথায় কাপড় টেনে অনেকটা ঘোমটার মত টেনে রাখায় রাস্তার ছেলেদের বাজে কটুক্তি থেকে রক্ষা পাচ্ছিল পুনম।
অন্যথায় নিজের উপর নিয়ন্ত্রন নেই এমন কোন বুড়ো মানুষ পুনমকে দেখলেও অন্তত মুখ দিয়ে কিছু একটা বলে সেটিসফাইড হতে চাইবে।
সুপ্তি হঠাৎ করে পুনমকে জিজ্ঞেস করে, “আচ্চা আপু, ঐদিন শহর আমাকে…. ”
সুপ্তির কথার ভিতরেই পুনম বলে উঠে,
“শহর ভাইয়া…”
” দুঃখিত আপু, শহর ভাইয়া আমাকে তোমার দরজায় লাথি মারতে বললো কেনো?”
” আমার বাসায় কলিংবেল নেই। নিচতলাতে আমি থাকি না। আমি কেনো! কেউ ই থাকে না। যারা থাকে তারা আবার মানুষ না।লোহার গেটে সজোরে আঘাত না করলে আমার পক্ষে শুনতে পাওয়া খুব মুশকিল। আমার কান পর্যন্ত যায় এমন শব্দ তুমি হাত দিয়ে করতে পারতে না। তাই লাথি দিতে বলেছিলো। ”
” তোমাকে ফোন করেও তো নিচে ডাকতে পারতো। ”
” উনি মোবাইল ইউজ করেন না।”
সুপ্তি খেয়াল করে পুনম একটু গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে কথা বলতে বলতে। তাই আর সামনে কথা বাড়ায় না।
রিকশা এসে পুনমের বাসার সামনে থামলে দুজনে ধরাধরি করে বাজার উপরের তলায় উঠায়।
পুনম সুপ্তিকে তার বাবাকে সহ রাতে ডিনারের আমন্ত্রন জানায়।
সুপ্তি আসবে কিনা সে বিষয়ে পাক্কা ওয়াদা করিয়ে তারপর ওকে ছাড়ে।
.
.
নিজের বাসার সামান্য বাজার সেরে দরজার সামনে এসে পৌছাতেই সুপ্তি দেখতে পায় কেউ একজন রাজনকে অবিরত ভাবে চড় থাপ্পড় মেরেই চলেছে। হুট করেই এ দৃশ্য দেখে সুপ্তির মেজাজ বিগড়ে যায়। এই মারামারি ঝৈ ঝামেলা তার ভালো লাগেনা। ব্যাগ হাতে এগিয়ে যায় সুপ্তি। গিয়ে জিজ্ঞেস করে, আপনি ওকে মারছেন কেনো? মেয়েলি কন্ঠ শুনে পেছনে ফিরে তাকায় মারধর করতে থাকা লোকটি। সুপ্তিকে দেখেই বিশাল এক সালাম দেয় সে।
তড়িঘড়ি করে পকেট থেকে একটা খাম বের করে সুপ্তির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, “আমি লতিফ। আমাকে বশির স্যার পাঠিয়েছেন। এটা আপনার হাতে দিতে বলেছেন। ”
” আমি আমার উত্তর পাইনি। তাকে মারছিলেন কেনো!”
” আর বলবেন না ম্যাডাম। এটা হলো গাজাখোর এক রিপোর্টার। টাকা পয়সার লোভে একবার আমার নামে একটা ধর্ষণের খবর ছাপা করছিলো। তিন মাস সাসপেন্ডও ছিলাম। পরে আর ব্যাটাকে খুঁজে পাইনি। আজ অনেক দিন পরে পেলাম। তাই দেখে রাগ কন্ট্রোলে ছিল না। ”
সুপ্তি লতিফের হাত থেকে খামটি নিয়ে বলে, “আপনি এখন যান। আর আমার বাসার সামনে এসে ঝামেলা বাঁধাবেন না। ”
“আমি সিভিল পোশাকে এসেছি তাই আমাকে চিনেন নি হয়ত ম্যাডাম
আমিও কিন্তু একজন পুলিশ অফিসার।”
সুপ্তি চোখ গরম করে তাকায়। লতিফ চলে যায়। রাজন পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে নিজের নাকের রক্ত মুছে পাশেই বসে পরে। সুপ্তি রাজনের দিকে কিছুক্ষন অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে চলে যায়।
.
.

রাতের বেলায় সুপ্তি প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী বাবাকে নিয়ে পুনমের বাসায় হাজির হয় । সেদিন আর দরজায় লাথি দিতে হয়নি। দরজা খুলে দাঁড়িয়ে ছিলো কাব্য, ওরফে কালু।
সে সবাইকে অভ্যার্থনা জানিয়ে ভিতরে ঢুকতে বলে।
উপরে উঠেই তাজ্জব হয়ে যায় সুপ্তি। পুরো বাসা ভর্তি লোকজন। সবার সাথে সেখানে আছে রাজনও। আছে হারু পাগল, লিয়াকত চাচা সহ আরো অনেকে। সবথেকে অবাক হয় কাঠগোলাপ কানে গোঁজা মেয়েটিকে দেখে। সে সুপ্তির দিকে তাকিয়ে সেদিনের মত হাসি দেয়। ছেড়া গেঞ্জির হারু পাগলের পাশেই বসা স্যুটেট বুটেট এক দম্পতি। তাদের সাথে ছোট্ট একটা মেয়ে। মেয়েটিকে জাফর সাহেব সুপ্তি দুজনেই চিনতে পারে। আলতাফ সাহেবের মেয়ে, সাফা।
সবাই খেতে বসে। খাবার দিচ্ছে পুনম এবং লাল শাড়ি পরা লম্বা চুলের মেয়েটি। প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র নিয়ে আসছে কালু।
খাবারের মাঝপথে হঠাৎ নিচতলা থেকে অদ্ভুত সব আওয়াজ আসতে থাকে। যে যার মত খেয়ে যাচ্ছে। শব্দটা বিদঘুটে। জাফর সাহেব কিছু না বললেও সেও অস্বস্তিতে ভুগছেন। সুপ্তি চাপা গলায় পুনম কে জিজ্ঞেস করে,
” আপু, নিচে শব্দ কিসের? তুমি না বললে কেউ থাকেনা?”
পুনম হেসে উত্তর দেয়,
ওখানে তোমার শহর ভাইয়া কাজ করছেন।
.
.
.
চলবে…..
লেখক: হাসিবুল ইসলাম ফাহাদ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে