বিষণ্ণ শহর পর্ব_৩

0
981

বিষণ্ণ শহর ?
#পর্ব_৩
______________________
.
.
সকাল সকাল বাবার ফোন পেয়েই পুনমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সুপ্তি দ্রুত পা ফেলে নিজের বাসার দিকে। পুনমের ব্যপারে বিস্তারিত কিছু জানার কোন সুযোগ পায় নি সুপ্তি।
হাঁটতে হাঁটতে একটু ক্লান্তবোধ করে সে। রাস্তা অনেক বেশি মনে হচ্ছে।
অথচ গত রাতে শহরের পাশাপাশি হাঁটার সময় পথকে এত দীর্ঘতর মনে হয় নি৷ কেকের প্যাকেটের কথা একদম ই ভুলে নি সুপ্তি। আসার পথে ঐ ল্যামপোস্ট এর দিকে কৌতূহল নিয়ে তাকায় সে। তার দৃষ্টি ল্যাম্পপোস্ট থেকে চলে যায় পাশের বাসার এক বারান্দায়। সেখানে এক যুবতী মেয়ে প্রাতঃস্নান সেরে রোদে চুল এলিয়ে দিয়েছে। কানের পাশে দুটো কাঠগোলাপ গোঁজা। দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে পাতলা ফিনফিনে লাল শাড়ির মেয়েটি গুনগুন করে গান গাইছে।এক পর্যায়ে মেয়েটারও চোখ পড়ে সুপ্তির দিকে। সে অদ্ভুত ভাবে একটা মিষ্টি হাসি দেয়। যেন অনেক দিন ধরে চিনে সুপ্তিকে।
সুপ্তি তাড়াহুড়ো করে চোখ সরিয়ে বাসার দিকে হাঁটা শুরু করে। পথে আসতে আসতে, ভুয়া ডাক্তারের মেয়ে কথাটি কয়েকবার কানে এসে লাগে সুপ্তির। কিন্তু মস্তিষ্কে এখন অন্য কোন কথা প্রভাব ফেলছে না।
সুপ্তি লম্বা পথ পেরিয়ে বাসায় ফিরে । এসে দেখে বৃদ্ধ বাবা কোথা থেকে এক কাঠমিস্ত্রী এনে দরজা ঠিক করাচ্ছেন। অফিসের ইন্সপেক্টর রাতে বসে বসে বৃদ্ধ জাফর সাহেবের গল্প শুনে চোখ জলে ভিজিয়েছেন। ইন্সপেক্টর সাহেব বাবা হারা হয়েছেন সেই ছোটবেলায়।জাফর সাহেব কে দেখে তার বাবার চেহারার ছবি কল্পনায় ভেসে উঠেছিল বার বার। নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকার অনুদান করেন তিনি, যদিও খালের পানি খালেই সেচ দেয়া হলো। ঘুষের টাকায় অনুদান। তাও বা ক’জন দেয়! জাফর সাহেব প্রথমে না না করলেও ইতস্ততভাবে টাকাটা পকেটে পুরে ফেলেন।
বাসার প্রাথমিক মেরামত শেষে, ভাল মিস্ত্রী আনিয়ে সুন্দর ভাবে ঘরটা মজবুত করে নিয়ে ইন্সপেক্টর কে দাওয়াত দেয়ার কথা ভাবছিলেন মনে মনে।জাফর সাহেবের ভাবনায় ছেদ পরে তার মেয়ের ডাকে।
“বাবা!!”
মেয়েকে দেখেই প্রাণখুলে এক হাসি দেন তিনি।
হাতে রোল করে রাখা সাদা কালো ছাপের কাতান শাড়িটা মুখভরা হাসি নিয়েই তুলে দেয় মেয়ের হাতে। সুপ্তি শাড়ি টা গ্রহণ করে।
অশ্রুসজল উদাসীন দৃষ্টি জাফর সাহেবের চোখ এড়ায় না।
” কিরে! তুই খুশি হসনাই মা?” জিজ্ঞেস করেন তিনি।
” একটা মানুষ মইরা গেল!! কেমনে খুশি হই আব্বা!”
মেয়ের হাতে শাড়ি তুলে দেয়ার অনন্দে শুভর মৃত্যুর কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলো জাফর সাহেব।
মুহূর্তেই তার চোখ মুখ ও অন্ধকার হয়ে আসে।
শুভ, সব সময় চেষ্টা করত জাফর সাহেবের টুকটাক হেল্প করার। সে হিসেবে একটু খারাপ লাগছে তার।
” তুমি শাড়ি কেনার টাকা কই পাইলা?”
” থানার বড় পুলিশ অফিসার দিলো আমারে। না করছিলাম। তাও দিলো।”
” তোমাকে মানা করছি না! দান খয়রাত আনবা না!”
” আনি নাই রে মা। জোর না করলে নিতাম? তুই বল?”
সুপ্তি শাড়িটা নিয়ে বাসার ভেতরে চলে যায়। বাবা বাইরে তদারকি করছেন। কাঠ, টিন পেটানোর ঠপাস ঠপাস শব্দ!
এ শব্দে চাপা পড়ে যাচ্ছে সুপ্তির বুক ফাটা কান্না। হারানোর ব্যাথা কত কষ্টের তা শুধু সে ই বুঝে, যে হারিয়েছে। কাল ও সুপ্তির এত কষ্ট লাগে নি। শুভ যেখানে যেভাবে থাকুক ভালো থাকুক এটাই চাওয়া ছিল তার। কিন্তু আজ যেন কান্না বাঁধ মানছে না। সুপ্তির ভালোবাসা তো আর মিথ্যা ছিল না!
দরজার মেরামত কাজ শেষে জাফর সাহেব আলতাফ এর দোকানে যান।বাকি টাকা পরিশোধ করেন। এরপর
মন মত আরো বাজার করেন। গালে হাত দিয়ে চিন্তাযুক্ত অবস্থায় বসে থাকেন আলতাফ। কর্মচারী সব মেপে মেপে দিচ্ছে। চোখের কোণায় জল জমে আছে আলতাফের। আজ তার টাকা নেয়ার তাড়া নেই।
.
.
আবহাওয়ার সাথে খাবারের ম্যাচিং হওয়ায় একেবারে সর্বেসর্বা অবস্থা। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি। তার সাথে সুপ্তি তার সুনিপুণ হাতে রান্না করেছে,
ইলিশের ডিম কড়া মরিচ পিঁয়াজ তেল দিয়ে ভাজি করা হয়েছে। সাথে আছে সুস্বাদু খিচুড়ি। ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ির গামলার দিকে গলা ঝুঁকিয়ে নাক ভরে ঘ্রাণ নেয় জাফর সাহেব।তারপর ” আ আ হ হ, বলে একটা প্রশান্তির অনুভূতি ব্যক্ত করেন।
সাদা কালো ছাপ এর শাড়ি পরে বাবার সামনে উদাস হয়ে বসে আছে সুপ্তি। সুপ্তিকে দেখে মনে হল সে মানুষ নয়, হাতে গড়া সুন্দর কোন এক নারীমূর্তি। যার মনের প্রতিটি কাণায় কাণায় বিষণ্ণতার বিষফোঁড়া দিয়ে পরিপূর্ণ হয়ে আছে। একটু ছুয়ে দিলেই ব্যাথা আরো বেশি করে ক্ষতবিক্ষত করে দেয় অনুভূতিকে।জাফর সাহেব কিছু একটা বুঝতে পেরে সুপ্তির মন, কথার হাত দিয়ে স্পর্শ করে দেখতে চাইলেন না।
.
.
সেদিন বিষণ্ণতা ভরা সন্ধ্যা নামে।
সন্ধ্যা না ঠিক বিকেল। তুমুল বৃষ্টি হওয়ায় চারদিকে আগেই সন্ধ্যা নেমেছে।
সব দোকান পার্ট বন্ধ।
শুধু লিয়াকত চাচা বড় ফ্লাক্স ভর্তি চা আর এক বক্স সিগারেট নিয়ে বড় এক দোকানের সানসেটের নিচে কুঁজো হয়ে বসে আছেন। একজন খদ্দের ও তার কাছে অনেক মূল্যবান।
” আংকেল আমরা কোথায় যাচ্ছি”
” এইত মা’মনি তোমার এক কিউট আন্টির কাছে।”
” আংকেল আপনি কে?”
” এইযে তুমি যার বুকে পা ফেলে হাঁটছো, আমি সে, শহর। ”
গায়ের চাদর দিয়ে ছাতার মত বানিয়ে সাফার মাথার উপরে ধরে রেখেছে শহর।
নিজে বৃষ্টিতে ভিজছে। অবশ্য শহরের বৃষ্টিতে ভিজতে খুব ভালো লাগে।

লিয়াকত চাচা কে কাচুমাচু হয়ে বসে থাকতে দেখে তার দিকে এগিয়ে যায় শহর।
” চাচা ! তুমি জ্বর নিয়ে বসে আছো কেন?”
” পেটে দুইটা ভাত পড়লে জ্বর ভালো হয়ে যাবে। ”
” গোলডলিফ সুইচ দাও দুইটা”
লিয়াকত চাচা একটা প্যাকেটে দুইটা সিগারেট ঢুকিয়ে শহরের হাতে দেয়।
বুকপকেটে সিগারেটের প্যাক নিয়ে দু’টা চা এবং দুইটা বিস্কিট চায় শহর।
লিয়াকত চাচা দু’ কাপ চা দেয়। দুইটা বিস্কিট দেয়। শহর বিস্কিট দুটা নেয় না। লিয়াকত চাচাকে বলে, “একটা বিস্কিট তোমার। আরেকটা তোমার পিছনে কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকা কুকুর ভাইয়ের। ”
লিয়াকতের শরীরের জ্বরের উষ্ণ তাপে একটা কুকুর তার পিঠ ঘেষে বসে আরামে ঘুম দিয়েছে। এতক্ষন খেয়াল করে নি লিয়াকত। লিয়াকত কুকুরটার মুখের সামনে বিস্কিট রাখে।
হোপ করে মুখে পুড়ে কুকুরটা বিস্কিট সাবাড় করে দেয়। আবার ঘুমিয়ে পড়ে।
শহর আর সাফা চা হাতে এগিয়ে চলে। বৃষ্টির পানির পড়ছে চায়ে। বৃষ্টির পানি পড়া চা ভিজতে ভিজতে খেতে ভারী অদ্ভুত লাগে।
ওদের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে লিয়াকত। অন্ধকার আরেকটু গাঢ় হয়। লিয়াকত কুকুরটার গা ঘেষেই শুয়ে পড়ে। তার বাড়ি অনেক দূরে। চা ফেরি করতে করতে বহু দূর হাঁটে সে। এখন বাড়ি যাওয়া পসিবল না। অনেক চা রয়ে গেছে ফ্লাক্সে। চোখ বুজে আসে লিয়াকত এর। কুকুরটা আরেকটু মোচড় দিয়ে আরাম করে লিয়াকতের গায়ে সাপ্টে থাকে। ফ্লাক্সে থাকা সত্ত্বেও সময়ের সাথে আস্তে আস্তে জুড়াতে থাকে লিয়াকতের লিকার চা। সময় আসোলে সব কিছুই ধীরে ধীরে অকার্যকর করে দেয়,সময়ের ব্যাপার মাত্র।
দুদিকে ঘন ডাল-পাতা যুক্ত গাছপালা। মাঝের রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলছে শহর ও সাফা। একটুও খারাপ লাগছেনা সাফার। সেও শহরের দেখাদেখি বুড়োদের মত চায়ে চুমুক দিচ্ছে। গাছের পাতায় পড়া ঝুম বৃষ্টির শব্দরাও বড় অদ্ভুত মিষ্টি। খানিক শুনলেই কানে নেশা ধরে যায়। বৃষ্টির সাথে সাথে আছে আবার বাতাস। বাতাস একটানা বৃষ্টির ফোঁটা গাছের পাতায় পড়তে দেয় না, শব্দে একটু হেরফের হয়।কখনো বাড়ে, কখনো কমে।
শহর এর নাম দিয়েছে বৃষ্টি-পাতার গান।
দেখতে দেখতে একটা বাসার সামনে চলে আসে শহর। বড় বাউন্ডারি গেট ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকে সে। সিকিউরিটি গার্ড বা গেটের কুকুর দুটোই চুপচাপ বসে বসে শহর কে দেখে।
কলিংবেল চাপতেই একটা বড় এপার্টমেন্ট থেকে বের হয়ে আসেন আহসান।
তিনি একজন ইঞ্জিনিয়ার। নিঃসন্তান। শহর আহসান কে বলেন সাফাকে কিছুদিনের জন্য তাদের বাসায় রাখতে হবে। আহসানের স্ত্রী ছুটে আসেন। শহর তার জন্য আরেকটা পুতুল দিয়ে গেছে। নিঃসন্তান মায়ের কাছে ছোট বাচ্চাদের পুতুলের মতই মনে হয়।
শহরকে ধন্যবাদ দিতে গিয়ে দেখে নেই শহর। চলে গেছে।
.
.

রাস্তার পাশে পায়ের উপর পা তুলে চিৎ হয়ে ভিজছে হারু পাগল। বুক পকেটে থাকা সিগারেটের প্যাকেটটা শহর হারুর দিকে ছুড়ে মারে। হারু দৌড়ে সিগারেটের প্যাকেট একটা শুকনা স্থানে রেখে এসে আবার পায়ের উপর পা তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে শুয়ে থাকে।
.
.
.
একটা আধভেজা চিরকুট দরজার ফাঁক দিয়ে পড়ে থাকতে দেখে তুলে নেয় সুপ্তি। চিরকুট না। একটা চিঠি। চিঠিটা যার পকেটে ছিল তার গায়ের ঘ্রাণ টা খুব পরিচিত। হ্যাঁ শহর আহমেদের গায়ের ঘ্রাণ এটি।সুপ্তি চিনতে পারে।
চিঠিটা মেলে অনেক বেশি অবাক হয় সে। হাতের লেখা গুলো শুভোর।
সুপ্তি পড়া শুরু করে।
” নিজের ভুলের কারণে ভালোবাসার অপমান আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। আমার ভুল ছিল সুপ্তির ভিডিও ধারণ করা। আমি চাই সুপ্তি আমাকে চিরদিন ঘৃণা করুক। তাই আজ ওর কাছে নিজেকে ঘৃণার পাত্র বানিয়ে এলাম। এবার আর আমার চলে যেতে কোন বাঁধা নেই। ভালোবাসাকে তিলে তিলে অসম্মানিত হতে দেখার চেয়ে মৃত্যু যন্ত্রনা উপভোগ করা আমার কাছে উত্তম মনে হলো। ”
– শুভো…
__________________
চলবে…
লেখকঃ হাসিবুল ইসলাম ফাহাদ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে