বিষণ্ণ শহর পর্ব_২

0
1092

বিষণ্ণ শহর
#পর্ব_২
________________
.
.
সুপ্তি রান্নাঘর থেকে একটা দা নিয়ে আসে। ধর্ষণের চেষ্টা চালালেই দা চালিয়ে মাথা ভাগ করে দিবে। যা হওয়ার হোক না কেনো!!
বিছানার নিচে দা টা রেখে দরজা খুলে দেয় সে। কাঠি দিয়ে দাঁত খুঁচতে খুঁচতে ঘরে প্রবেশ করে আলতাফ।
গা থেকে আঁতরের গন্ধ বের হচ্ছে।
– “কি চাই?” প্রশ্ন ছুড়ে সুপ্তি।
আলতাফ টেনে টেনে জবাব দেয়,
” তোমার বাপজান তো আমার দোকান থেকে অনেক টাকা বাকি খাইছে। তারে তো এখন হাজতে নিয়া গেলো। আমার টাকার কি হইবে!!”
” আপনে এখন চইলা যান, টাকা আমি শোধ করে দিবনে।”
” শোধ করতে আর কতদিন লাগবে মা মনি!!”
বলেই সুপ্তির গাল টেনে দেয় আলতাফ।
সুপ্তি মাথা ঝাটকা দিয়ে একটু পেছনে সরে যায়।
” কত টাকা পাইতেন আপনে?”
” পনের’শ”
সুপ্তি শুভোর ছুড়ে ফেলা যাওয়ার দুটো মলিন কুঁচকানো নোট এগিয়ে দেয় আলতাফের দিকে। ” বাকি ৫ শ’ পরে নিয়েন। ”
” পরে নেয়ার জন্য তো এখানে আসি নি মা’ মনি”
” তুমি এক কাজ করো, এই ১ হাজার টাকাও নিজের কাছে রাইখা দাও। নীল একটা শাড়ি কিনে পইড়ো। আমার বাসায় আজ অতিথি আসছে!তাছাড়া তুমিও একা মাইয়া,এইরকম একটা ঘরে একা থাকবা কেমনে । সব মিলিয়ে ভাবলাম আইজ রাইতে এখানেই থাকি আরকি, হে হে”
সুপ্তির ইচ্ছে করছে একদলা থুথু আলতাফের মুখে ছুড়ে মারতে।
তাও সে অনেক ধৈর্য্য নিয়ে ঠান্ডা মাথায় বলে-
“চাচা আপনি বাসায় চলে যান। অন্যথায় আমি আপনাকে আঘাত করে ফেলতে পারি। শেষবারের মত সম্মান দিয়ে বললাম৷ ”
আলতাফের হাতের পাশেই বাসার লাইটের সুইচ ছিলো।
সুপ্তির হাতের কব্জি চেপে ধরে আলতাফ লাইট অফ করে দেয়।

সুপ্তি চিৎকার করে ওঠার আগেই আলতাফ কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে!
তুই আমাকে যে দুইটা ৫০০ টাকার নোট দিলি! ঐ টাকা আমি ই শুভ কে দিয়েছি। বিনিময়ে ও আমাকে কি দিয়েছে জানিস!! তোর ছবি। না না, সাধারণ ছবি না। তোর সুন্দর খালি দেহের ছবি। আর একটা শব্দ করবি পুরো গ্রামে তোর ছবি ছড়িয়ে দিব আমি।
ফিসফিসিয়ে কথা বন্ধ করে আলতাফ স্বাভাবিক গলায় বলে,” এবার অভিমান করে না থেকে কাছে আস মিষ্টি মেয়ে। ”
শুভর থেকেও তোমাকে বেশি সুখ দিব। পুরো রুম
অন্ধকার থাকায় সুপ্তির ঘৃণাভরা চেহারাটা দেখতে পায়না আলতাফ। মুখে বিশ্রী একটা হাসি দিয়ে সুপ্তির মাথা চেপে ধরে ওর ঠোঁটে ঠোঁট নামিয়ে দেয়।
জদ্দা-পান এর বিদঘুটে একটা স্বাদ এসে লাগে সুপ্তির মুখে। চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে রাখায় এদিক সেদিক নড়তেও পারছে না সে। নিরিবিলি দাঁড়িয়ে অশ্রু বিসর্জন দেয়া ছাড়া কোন উপায় নেই তার। বাবার কাছে সবথেকে পবিত্র,ভালো মনের মেয়েটি আজ নিজেকে সবথেকে কলঙ্কিত একজন নারী মনে করছে। না খেয়ে থাকায় শরীরে একটুকু জোর নেই যে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দা এনে টুকরো টুকরো করে দেবে হারামজাদা কে। ভুল হয়েছিল একটু। দা হাতে নিয়েই দরজা খোলা উচিত ছিল। সুপ্তি এগুলো ভাবতে ভাবতে আলতাফ সাহেবের হাত ওর বুকের উপরে চলে যায়। মুখে একটা কুটিল হাসি দিয়ে নিজের পশুত্বযুক্ত মনবাসনা পূর্ণ করে। ব্যাথায় মৃদ্যু চিৎকার করে উঠে সুপ্তি। বুকের উপর থেকে এক হাত দিয়ে আলতাফ সাহেবের হাত সরিয়ে দেয় সে। সাথে সাথেই অন্ধকারের ভিতর ঠাস করে একটা চড় এসে পরে সুপ্তির গালে। ডুকরে কেঁদে উঠে সুপ্তি। অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করতে করতে সুপ্তির চুলের মুঠি আরো শক্ত করে ধরে বার কয়েক ঝাঁকি দেয় আলতাফ।
সুপ্তির দুর্বল দেহ আর টাল সামলাতে পারে না। ঢলে পরে আলতাফের গায়ের উপরে।আলতাফ তো এটাই চেয়েছিলো।
হঠাৎ করেই সুপ্তির পুরো বাসা টা কেঁপে উঠে।দ্রিম করে একটা আওয়াজের সাথে সাথে আধভাংগা দরজাটা পুরোটাই ভেংগে পড়ে।ভাংগা দরজা থেকে বাইরের চাঁদের আলো ঢুকে আলোকিত করে এক কলঙ্কিত চাঁদ কে। পিটপিটে চোখ খুলে তাকায় সুপ্তি।দরজায় কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে,অবয়ব শুভোর মত। ঘটনার আকষ্মিকতায় সুপ্তিকে ছেড়ে অন্ধকারের ভিতর চলে যায় আলতাফ।
সুপ্তি গায়ের সর্ব শক্তি একসাথে করে কোন মতে ছুটে দরজায় দাঁড়িয়ে লোকটির দিকে ছুটে আসে। এসে একটু অবাক হয় সে।
হুডি পরিহিত একটা ছেলে দরজায় দাঁড়ানো। এর আগে কোনদিন কোথাও সুপ্তি দেখেনি তাকে। একটু পর
ছেলেটি কোন কথা না বলেই হাঁটা দিল রাস্তা ধরে। সুপ্তিও কিছু না ভেবে তাকে অনুকরণ করতে শুরু করলো।পেছন পেছন হাঁটতে হাঁটতেই মনের অনুসন্ধিৎসু ইচ্ছে থেকে প্রশ্ন করে ফেললো, “কে আপনি?”
– শহর আহমেদ।
– কি নাম? শহর?
– আহমেদ।
-অদ্ভুত নাম।
-আপনি আমার সাথে কোথায় আসছেন?
– জানিনা। আপনি আমার জীবন বাঁচালেন আজ।
– আপনার বাবা কাল চলে আসবে।
– আপনি কি পুলিশের লোক?
– নাহ,
– তাহলে জানেন কিভাবে!!
– মনে হলো তাই বললাম। নাও আসতে পারে।
– আচ্ছা। তাই যেন হয়। আপনি আমার বাবা কেও চিনেন? চেনার ই কথা। যেহেতু বাসা চিনেন বাবাকে তো চিনবেন ই।
এরপর আর কেউ কোন কথা বলে না। দুজনের চুপচাপ রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকে। দুপাশে বড় বড় দালানকোঠা। সবাই নিজ নিজ বাসার ভিতরে। বাইরে টা একেবারেই ফাঁকা, কোথাও কেউ নেই।শুধু ল্যাম্পপোস্ট গুলো একা একা দাঁড়িয়ে। এ শহরের বুকের উপরে থাকা একাকি রাস্তা ধরে এগিয়ে চলে শহর আহমেদ। পেছনে তাকে অনুসরণ করে সুপ্তি।
– ক্ষুধা লেগেছে?
শহরের প্রশ্নে কথা থেমে যায় সুপ্তির। সুপ্তি মিথ্যা কথা একেবারে বলে না বললেই চলে কিন্তু ক্ষুধা পেয়েছে এটা স্বীকার করতেও ইগোতে লাগছে তার।
শহর হঠাৎ দাঁড়িয়ে যায়।
সুপ্তিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“ঐ যে রাস্তার ওপাশে একটা রোডলাইট আছে ওটার নিচে গিয়ে দাঁড়ান। ”
সুপ্তি জিজ্ঞেস করে কেন??.
শহর আহমেদ চুপ করে সুপ্তির দিকে তাকিয়ে থাকে। শহরের চোখের দৃষ্টিতে আদেশের সুর- যা বলছি তাই করো।
সুপ্তি চুপচাপ রেডলাইট এর নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। ঠিক এক মিনিট পরেই একটা বাসার বারান্দা থেকে তার গায়ের উপর এসে পড়ে একটা কেকের প্যাকেট।
প্যাকেট টি হাতে নিয়ে আবার শহরের কাছে ফিরে আসে সুপ্তি। শহর সুপ্তির হাত থেকে নিয়ে দু-পিস কেক বের করে ওকে খেতে দেয়। নিজে বাকি আট পিস ই গপাগপ খেয়ে ফেলে।
একটু রাগ হয় সুপ্তির। তাকে দিয়েই কেক আনিয়ে মাত্র দুপিস দিলো তাকে। তাও তো মন্দের ভালো।
পেটে চালান করে দিয়ে হাঁটতে থাকে শহরের পিছন পিছন। এভাবে হাঁটাহাঁটি চলে আরো কিছুক্ষন।
এক পর্যায়ে অন্ধকার একটা গলিতে প্রবেশ করে শহর। পেছনে পেছনে সুপ্তি ও।
আবছা অন্ধকারে আরো কিছুদূর এগিয়ে একটা দ্বিতল বাসার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় শহর।
সুপ্তিকে এগিয়ে আসতে বলে সে। সুপ্তি আসে।
” এই লোহার গেটে, সজোরে লাথি দিন”
– কি??, সুপ্তি বিষ্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
– সজোরে লাথি দিন।
নাহ, তাহলে ঠিক ই শুনেছিল প্রথমবার, অন্য কেউ বললে লাথি দিতনা কোনদিন ও সুপ্তি, কিন্ত শহরকে তার ভয় লাগছে। এটা সম্মানীর ভয়।একটু কনফিউশন নিয়ে ছোট্ট একটা লাথি দেয় সুপ্তি।
শহর সুপ্তির দিকে তাকিয়ে থাকে। সুপ্তি একটু পেছনে এসে দুপা এগিয়ে এবার সত্যি ই অনেক জোরে লাথি দেয়।
ঝন ঝন করে শব্দ হয় দরজাটায়। সুপ্তি শহরের চোখের দিকে তাকায়। চোখের ভাষায় বুঝতে পারে এবার ঠিক আছে।
শহর আহমেদ সুপ্তিকে বলে,” এখানেই দাঁড়িয়ে থাকুন”।
বলে হেঁটে হেঁটে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।
সুপ্তি দাঁড়িয়ে থাকে।
একটু পর লোহার দরজাটা ঝন ঝন শব্দ তুলে খুলে যায়।
ভেতর থেকে বের হয়ে আসে লাল শাড়ি পরিহিত অত্যন্ত সুন্দরী একজন মেয়ে।
সুপ্তিকে দেখেই বলে, আপু! সরি লেট করে ফেললাম। আসলে দোতলায় থাকি তো!
নামতে একটু দেরী হয়। ভেতরে আসুন আপু। সুপ্তি কিছু বলার আগেই টেনে ভিতরে ঢুকিয়ে নেয়া হয় ওকে। লোহার দরজা ঠেলে লাগিয়ে দেয়া হয়। ভেতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। মেয়েটি একটা টর্চ মেরে দোতলার সিঁড়ি ভেংগে উপরে উঠে।
পেছন পেছন সুপ্তিও তাকে ফলো করে।
দোতলায় পৌছেই বেশ অবাক হয় সুপ্তি। নিচে যেমন ঘুটঘুটে অন্ধকার উপরে তেমনি ঝকমনে আলো, লাইটিং। প্রথমেই চোখে পড়ে একটা ডায়নিং টেবিল। টেবিলে সাজানো সুস্বাদু কোরমা, পোলাউ, জদ্দা, বিরয়ানি সহ ছোট বড় অনেক আইটেম। মেয়েটি হেসে সুপ্তিকে জিজ্ঞেস করে, তোমার নাম কি.?
– সুপ্তি।
– আমি পুনম। তোমার পায়ে ব্যাথা লাগেনি তো!!
– জ্বী না।
আচ্ছা ফ্রেশ হয়ে এস, আমরা একসাথে বসে খাবার খাব।
সুপ্তিকে ওয়াশরুম দেখিয়ে দেয় পুনম।
ওয়াশরুমে ঢুকে নিজের চেহারা দেখে অনেকগুলো প্রশ্ন মনে আসে সুপ্তির। আপাতত সবকিছু একদিকে ঝেড়ে রেখে নাখমুখ ধুয়ে বের হয়। পুনম মেয়েটা অনেক মিশুক। কথা বলে অনেকটা ফ্রী হয়ে যায় সুপ্তির সাথে। একত্রে খাওয়া দাওয়া করে দুজন। প্রচন্ড ঘুম হয় সেদিন সুপ্তির। ঘুম ভাংগে সকাল ১১ টায়। বাবার ফোনে। ফোন যে সুপ্তির সাথেই ছিল তা মনে ছিলনা তার এতক্ষন। ভাগ্যিস শাঁড়ির আচলে বিশেষ উপায়ে ফোনটা পেঁচিয়ে রাখার অভ্যেস ছিল তার।
ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে জাফর সাহেবের কন্ঠ।
” তুই কোথায় মা!! ঠিক আছিস!!”
উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে সুপ্তি!
” তুমি কোথায় বাবা!!”
– আমি বাসায়। আমাকে সসম্মানে বাসায় পৌঁছে দিয়ে গেল। আমি নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছি।কিন্তু বাসার দরজা ভাংগা কেন? তুই কোথায়!
– আমি ভালো আছি।
– এদিকে সকালে বাড়ি পৌঁছে দুটা খারাপ খবর শুনতে হলো।
– কি??
– আমাদের বাসায় একটা ছেলে আসতো না! শুভ?
– হ্যাঁ
– ও সুইসাইড করেছে। আর আমরা যে দোকান থেকে সদয় পাতি কিনি, আলতাফ সাহেব, ওনার মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
….

– চলবে..

লেখক – হাসিবুল ইসলাম ফাহাদ
_________________________

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে