বিষণ্ণ শহর পর্ব-০১

0
1786

বিষণ্ণ_শহর
লেখক – ” হাসিবুল ইসলাম ফাহাদ

“স্যার আমার পেট থেকে মেয়েদের লম্বা চুল বের হচ্ছে শুধু”
কথাটা শুনে চশমার ফাঁক দিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকায় জাফর সাহেব।
সামান্য হাই স্কুলের একজন শিক্ষক তিনি। যার সাথে কথা বলছেন, ও এই এলাকারই একজন ছেলে।রাত ১২ টার দিকে শহরের কোন দোকানপাট ই খোলা থাকে না, শুধুমাত্র জাফর সাহেবের হোমিওপ্যাথি ঔষধের দোকানটা ছাড়া। টিম টিমে আলোতে মোটা কাচের চশমা নাকের ডগায় লাগিয়ে রাত জেগে বই পড়েন তিনি। সেই সুবাদে দোকানটাও খোলা থাকে। মাঝে মাঝে বুকের উপরে বই রেখে দোকান খোলা অবস্থায়ই ঘুমিয়ে পড়েন। আজ ও চেয়ারে হেলান দিয়ে হা করে ঘুমাচ্ছিলেন। শাহীনের ডাকে ধরফরিয়ে উঠে বসতে হল তাকে। আর তারপর ই এমন অদ্ভুত এক কথা শুনতে হল। গলায় খাকি দিয়ে তিনি শাহীনের উদ্দেশ্যে বললেন,
” কি হয়েছে!! চুল কোথা থেকে আসবে!! খুলে বলো তো!!”
” ঘুমাতে যাওয়ার আগে বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে ব্রাশ করে ফ্রেশ হয়েছি, হঠাৎ আয়নার উপরে চোখ যাওয়াতে দেখলাম ঠোঁটের কোনা দিয়ে এক টুকরো চুল বের হয়ে আছে। ঠিক বইয়ের ভেতরের ফিতা যেমন বের করা থাকে তেমন ভাবে।”
” আচ্ছা। তারপর?”
“আমি স্বাভাবিক ভাবেই চুলটা ফেলে দেয়ার জন্য টান দিলাম। তখন ই বুঝতে পারলাম এটা খুব লম্বা চুল। গলা থেকে একদম পেটের ভিতর পর্যন্ত লম্বা। যত টানি ততই বের হয়। এর কোন শেষ নেই।
এভাবে টানতে টানতে এক পর্যায়ে চুলের ধারে আমার গলার ভিতর কেটে যায়। কাশি দিতেই বের হয়ে আসে এক দলা রক্ত।
এই বিরক্তিকর চুলটা এখনো আমার মুখে আটকে আছে। কি করি বলুন তো!!
” হুম, যা বলেছ বুঝলাম। তুমি আমার সামনে বসে একটু চুল টেনে বের কর তো তোমার পেটের ভিতর থেকে!!”
শাহীন চুলের মাথাটা ধরে টানতে লাগলো। জাফর সাহেব ও অবাক হয়ে দেখতে লাগলেন চুল বের হচ্ছে তো হচ্ছেই। শেষ হওয়ার নাম গন্ধ ও নেই। মুহূর্তেই তার সামনে জমে গেল এক গাদা চুল। সব মিলিয়ে একটা লম্বা চুল।”
” থামো থামো! বুঝেছি। আমার কাছে সমাধান হয়না এমন কোন রোগ নেই। কিন্তু ঔষধ ফুরিয়ে গেছে। তাই এই রোগটার চিকিৎসা দেয়া এখন আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। তুমি বাসায় চলে যাও, আমি তোমাকে ডেকে পাঠাব ঔষধ আনা হলে। ”
” কিছু একটা করেন স্যার! এইভাবে কি চরম বিরক্তিকর একটা জিনিস নিয়ে থাকা যায় নাকি!!”
” বললাম তো আমি তোমাকে ডেকে পাঠাব। তুমি চিন্তা কোরো না। ”
চেম্বার ছেড়ে উঠে পড়ে শাহীন।
আশাহত ভাবে হাঁটতে হাঁটতে বাসার রাস্তা ধরে।
কিছুদূর এগিয়ে যেতেই সে পেছন থেকে গম্ভীর গলায় একটা ডাক শুনতে পায়।
“শাহীইইন”
পেছনে ঘুরে তাকায় সে।
অন্ধকারের ভেতর হেঁটে হেঁটে একটা লোক শাহীনের সামনে এসে দাঁড়ায়।
” শহর ভাইয়া!! ভালো আছেন?”
” তোর প্রিয় খাবার কি?”
আর প্রিয় খাবার!! আজ হয়েছে কি জানো??
হাত উঠিয়ে শাহীন কে থামিয়ে দেয় শহর আহমেদ।
” আমার প্রশ্নের জবাব দে।”
” আইসক্রিম, বিরিয়ানি।”
“বাসায় আছে? ”
“হ্যাঁ। ”
“গিয়ে খেয়ে নিস।”
“আচ্ছা ভাই। কিন্তু কেন?”
” সাবধানে বাসায় যা।”
বলেই শহর আহমেদ প্রস্থান করে অন্ধকারে হারিয়ে যায়। কিছুক্ষন ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে শাহীন। তারপর নিজের বাসায় চলে যায়।
খণিক বাদে জাফর সাহেবের চেম্বারের সামনে উপস্থিত হয় সুপ্তি।
সুপ্তি, জাফর সাহেবের একমাত্র মেয়ে। রূপে গুনে পুরো এলাকাজুড়েই অতুলনীয়। গুনী মেয়ে হয়ে ওঠার পেছনে অবশ্য একটা কারণ আছে।মা হারা মেয়েরা সব সময় গুনবতী হয়। কত কাজ শিখতে হয় তাদের। ছোটবেলা থেকে মা নেই এমন মেয়েকে বিয়ে করা মানে বরপক্ষের জিতে যাওয়া। বাসার অর্ধেক কাজ একাই সামাল দিতে পারে এমন মেয়েরা। চেম্বারের ঝাপ ফেলে বাবাকে নিয়ে বাসায় ফিরে সুপ্তি। খাবার বেরে দেয়। গরম গরম ভাত আর শোল মাছের ঝোল!
পরম তৃপ্তিতে খাবার শেষ করে জাফর আহমেদ। খাবার শেষে মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলে,
বড় লক্ষ্মী মেয়ে রে তুই মা!!
তোকে ছোটবেলা থেকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছি ঠিক ই,সময় তো দেইনি। তুই চাইলে বিপথে যেতে পারতি। কিন্তু যাস নি। তোর জামাই এই পৃথিবীর সবথেকে ভাগ্যবান একজন মানুষ হবে। কথাটা শুনে মুখে একটু আঁধার নেমে আসে সুপ্তির।
জাফর সাহেব চলে যান ঘুমাতে।
.
.
.
সকাল সকাল লোকজনের চিৎকার চেঁচামেচি তে ঘুম ভাংগে সুপ্তির। দরজাটা বোধ হয় ভেংগেই ফেললো। বাইরের মানুষের ছুড়ে দেয়া গালি এবং উত্তপ্ত বাক্য গুলো বুঝতে কয়েক সেকেন্ড দেরী হয় তার। দৌঁড়ে গিয়ে দরজার ফাঁকা দিয়ে বাইরে দেখে সে। কয়েকজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। আর তার পেছনেই ক্ষিপ্ত জনতা। দরজা না খুললে এখন ই ভেংগে পড়বে, তাই দরজা খুলে দিতে বাধ্য হয় সুপ্তি। সাথে সাথেই বাসায় প্রবেশ করে কয়েকজন পুলিশ। তাদের মধ্যে থেকে কেউ একজন
সুপ্তিকে জিজ্ঞেস করে,
তোমার বাবা কোথায়?
” ঘুমাচ্ছেন”
“ওনাকে থানায় নিয়ে যেতে হবে।”
“কেন কি করেছেন উনি?”ঘাড় বাঁকা জবাব সুপ্তির।
” অভিযোগ – ভুল চিকিৎসা দিয়ে শাহীন নামের একজন ছেলেকে মেরে ফেলেছেন তিনি।
গ্রামবাসী ক্ষেপে আছে। কোন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ওনাকে এখানে রাখা ঠিক হবেনা। লাশ পোস্ট মর্টামের জন্য পাঠানো হয়েছে। ফরেন্সিক রিপোর্ট আসার আগ পর্যন্ত উনি আমাদের হেফাজতেই থাকবে। ”
দুজন পুলিশ বাসার ভেতরে চলে যায়।
টানতে টানতে বের করে আনে মাঝবয়েসী জাফর সাহেব কে।
জাফর সাহেবকে যখন দরজা দিয়ে বের করে নিয়ে যাচ্ছিলো, তখন বার বার মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলছিলেন, বিশ্বাস কর মা! আমি ওকে কোন ঔষধ খেতে দেইনি। ” একটা হাসি দিয়ে মাথা একদিকে কাত করে দেয় সুপ্তি। জাফর সাহেব চোখের আড়াল হয়ে যায় ভিড়ের মাঝে।
সুপ্তি জানে, যদি তার চোখে পানি থাকতো, দুশ্চিন্তা থাকত, তাহলে তার বাবা ভাবতো অন্য সবার মতই তাকে তার একমাত্র মেয়েও অবিশ্বাস করছে। হাজার মানুষের গালি লাঞ্চনা বঞ্চনার কষ্ট জাফর সাহেবের মনে আঘাত করতে পারবে না যখন ই তার মেয়ের হাসিমুখ কল্পনায় ভেসে আসবে।
মাঝে মাঝে
আপন মানুষরা অনেক বছর ধরে কাছ থেকে চিনেও হুট করে কোন কথা বা কাজের ভিত্তিতে একজনকে অবিশ্বাস করে বসে, মানুষটা তখন ই মারা যায়। তাকে আর আলাদা করে ফাঁসিতে ঝুলাতে হয়না। সুপ্তি তার বাবাকে ফাঁসিতে ঝুলার মানবিক কষ্টটা দেয় নি।
বাবার জন্য প্রতিদিন সকালে চায়ের কাপে টুংটাং শব্দ তুলতে হত সুপ্তিকে।
আজ চায়ের কাপের ছুটি।
বিষণ্ণ মন নিয়ে খাটের উপর বসে পুরো ব্যপারটা চিন্তা করছিলো সে।
সিসিটিভি ফুটেজ দেখে শাহীনের মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হয়েছে জাফর সাহেব কে।
কিন্তু অন্য কোন কারণ ও তো থাকতে পারে মৃত্যুর।
হঠাৎ করেই কল আসায় চিন্তায় বিচ্ছেদ পরে সুপ্তির।
কল এসেছে শুভোর।
” বাসায় আছ?”
“হ্যাঁ”
” আমি আসব?”
” মন ভাল নেই।”
“জরুরি কথা আছে।”
” আচ্ছা”
আধভাঙ্গা দরজা দিয়ে মিনিট পনের পর ঘরে ঢুকে শুভ। প্রতিদিনকার মত আজ এসেই আর সুপ্তিকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায় না। আজ সে এসেছে হিসেব নিকেষ চুকিয়ে নিতে।
এমন একটা সময়ে শুভোর উষ্ণ স্পর্শ খুব প্রয়োজন ছিলো সুপ্তির। অসময়ে কেউ পাশে থাকে না বলে একটা প্রবাদ আছে। কিন্তু শুভ তো “কেউ” দের কাতারে পরে না।
সুপ্তিকে বিয়ে করার অংগীকার দেয়া, সুপ্তির ভালোবাসার একজন মানুষ শুভ। মন থেকে শুভকে সে অনেক শ্রদ্ধা ও করে। সেই শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার মূল্য দিতে গিয়ে সুপ্তি শুভোকে দিয়ে বসে আছে আরো অনেক কিছুই। যা কখনো চাইলেও ফেরৎ নিতে পারবেনা সুপ্তি।
” আমি কোন হাতুড়ে খুনী ডাক্তারের মেয়ের সাথে সম্পর্ক রাখতে চাইনা”
রুক্ষ গলায় শুভোর বচন।
সুপ্তি নরম গলায় বলে, কি বলছো তুমি এগুলো?
আগে বসো। ঠান্ডা মাথায় কথা বলি। সুপ্তি প্রতিদিন কার মত শুভোর দিকে এগিয়ে যায় তার ওড়না দিয়ে নিজ হাতে শুভর ঘর্মাক্ত কপাল মুছে দেয়ার জন্য। কিন্তু এক ঝাটকায় সুপ্তিকে কয়েক হাত পেছনে পাঠিয়ে দেয় শুভো। যে চোখে এতদিন ভালোবাসা দেখে এসেছিলো সে চোখে ধিক ধিক করে জ্বলন্ত ঘৃণা দেখে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সুপ্তি।
অভাবের টানাপোড়েনের সংসারেও ভালোবেসে সুপ্তি কতবার কতকাজে শুভোকে আর্থিক সাহায্য করেছে তার হিসেব নেই। অথচ শুভোর পারিবারিক স্টাটাস সুপ্তিদের চেয়েও ঢের ভাল।
শুভো সুপ্তির দিকে ৫০০ টাকার দুটো নোট ছুড়ে দিয়ে চলে যায়।
মা মরা মেয়েরা নিরব হয়ে যায় তো সেই ছোটবেলায় ই। তারপর শুধু মানুষ দেখে তারা। দেখে আর নিরব থাকে।
ভাংগা দরজার ছিটিকিনি লাগিয়ে, এক গ্লাস পানি খেয়ে ঘুম দেয় সুপ্তি। এক ঘুমেই সন্ধ্যা।
সন্ধ্যা বেলা ঘুম ভাংগার পরে কি করবে তা ভেবে পাচ্ছিল না! আজ রান্নাবান্নার ও তাড়া নেই।
হঠাৎ তার বাসার দরজায় কড়াঘাতের শব্দ হয়।
ভেতর থেকে “কে?” বলে ছোট্ট একটা চিৎকার দিয়ে অপরপাশে কে আছে তা জানতে চায় সে।
দরজার ওপাশ থেকে উত্তর আসে,
” আমি আলতাফ”
হুট করেই কলিজা ধুক করে উঠে সুপ্তির।। আলতাফ!
এর আগেও টাকার বিনিময়ে কু-প্রস্তাব দিয়েছিল সুপ্তিকে। হঠাৎ নিজেকে একটা অজানা এক বিপদের মুখে আবিষ্কার করে সে
দরজা খুলতে দেরী হওয়ায় ওপাশ থেকে আবারো আলতাফের কন্ঠ ভেসে আসে,
” শুভোর মত ফ্রী কিছু করব না। যা হবে ক্যাশ টাকা দিয়ে পুষিয়ে দিব”
কথাটা বলা শেষ হলে ফ্যাসফ্যাসে একটা হাসিও কানে এসে লাগে সুপ্তির।
এরকম সমস্যায় পড়লে আগে শুভকে ফোন দিত সুপ্তি। কিন্তু আজ কেউ নেই তার পাশে। তার বাবার কষ্টের উপার্জিত টাকায় তিল তিল করে গড়ে তোলা সুপ্তির সুন্দর শরীরটা আজ কাগজের টুকরোর মত ছিড়ে মূল্যহীন করে দেয়ার জন্য দরজায় দাঁড়িয়ে আছে এক নরপিশাচ।
– চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে