বিশ্বাসঘাতক

0
1005

#শেষ_পর্ব
#তামান্না_ইসলাম
আমার মেয়ের টিউটরের সাথে আমার স্বামীর পরকিয়ার খবর জানার পর আমি ভেবেছিলাম আর না।শেষ করে দিব সব।কিন্তু সৃষ্টকর্তা হয়তো অন্য কিছু চেয়েছিলেন।জানতে পারলাম আমি আবার মা হতে চলেছি।আমার অনাগত সন্তান আর যে আছে দুজনের কথা ভেবে এবারও পারলাম না।হাজার হলেও আমি একজন বাঙালী নারী,একজন মা।আমার একটা ফুটফুটে ছেলে হলো কয়েক মাস পর।আমার এক এক জন বোনকে পালা করে এনে রাখতাম আমার বাসায়।এভাবেই দিন যাচ্ছিল। এর মাঝে ২জন বোনের বিয়েও হয়ে গেল।আমার ছোট বোনকে আমার কাছে একেবারে রাখার জন্য ওকে ভর্তি করালাম কাছেত এক কলেজে।এভাবেই দিন কাটছিল।এর মাঝে উনি কম চেষ্টা করেননি।কিন্তু একটাও চাকরী জোগাড় করতে পারেন নি।
বছর কয়েক পর বোনটার ও বিয়ে হয়ে গেল।এর মাঝে আমার ছেলে মেয়ে বেশ বড় হয়ে গেছে।

বোন চলে যাওয়ার পর আবার সেই রকম দিন শুরু হলো।উনার খবরাখবর রাখার মত কেউ নাই।আমাকে নালিশ করারও কেউ নাই।আমি সকালে উঠে স্কুলে চলে আসতাম।ফিরতাম দিন শেষে।আমার ছেলে মেয়েরা সকালে ভাত খেতে চাইতো না।ওদের নাস্তা বানিয়ে দেওয়ার কেউ ছিল না।ফলে ওরা বেশিরভাগই না খেয়ে থাকতো। আমার সময় হতো না সংসার সামলে,স্কুল সামলে।আর ওদের বাবা!!!থেকেও নেই।
এর মাঝে ওনার এক স্টুডেন্ট এর পরিবারের সাথে ওনার খুব ভাল সম্পর্ক গড়ে উঠলো। মহিলার স্বামী পুলিশের চাকরি করেন।বাইরে পোস্টিং।মহিলা ৩ মেয়ে নিয়ে বাসা ভাড়া করে থাকেন।এরই মাঝে মহিলার মেয়ের জন্মদিনে আমাকে দাওয়াত করা হলো।আমি আর উনি দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে গেলাম।গিয়েই কেমন সন্দেহ হলো মহিলার আর ওনার আচরন দেখে।মহিলার গায়ে ওইদিন লাল টুকটুকে একটা শাড়ি ছিল।ঠিল যেমন শাড়ি উনি পছন্দ করেন।কারণ ওনার প্রিয় রঙ লাল।আমি তাও নিজের মনকে শান্তনা দিলাম যে মনের ভুল।কারণ শত অন্যায় জেনেও খুব বেশি ভালবাসতাম।আমার কৈশরের প্রথম প্রেম,ভাল না বেসে যে পারিনি।
কিছুদিন ধরে খেয়াল করতাম উনি খুব বাজে ব্যাবহার করতেন।আমাকে সহ্যই করতে পারতেন না।কেন জানি মনে হতো অচেনা লাগছে।আমার দিকে ফিরেও তাকাতেন না।আমি বুঝে গিয়েছিলাম কেউ এসেছে ওনার লাইফে।কিন্তু অবাক করা বিষয় হচ্ছে উনি যতবার পরকিয়ায় জড়িয়েছেন আমি কি ভাবে যেন জেনে গেছি।এবারও তার ব্যাতিক্রম হলো না।
একদিন স্কুল থেকে আসার সময় এক কলিগ আমাকে আচমকা জিজ্ঞাস করলেন আমার স্বামী ২য় বিয়ে করেছেন কিনা।আমি একেবারেই অবাক।বললাম না করেনি।কিন্তু সে নাকি আমার স্বামীর ২য় স্ত্রী কে দেখেছে।তার কাছে জানতে পারলাম আমার স্বামী এক মহিলাকে নিয়ে তাদের পাড়ায় ঘর ভাড়া করেছে স্বামী স্ত্রী পরিচয়ে।
আমি সেদিন বাস থেকে নেমে বাড়িতে না গিয়ে ওই সেই স্টুডেন্ট এর বাসায় গেলাম।আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল আমার কলিগ যে মহিলার কথা বলছেন সে মহিলা ওই স্টুডেন্ট এর মা ই।সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম কয়েকদিন আগে পাড়ার লোকেরা মিলে আমার স্বামী কে আর ওই মহিলাকে হাতেনাতে ধরেছেন।তারপরই আমার স্বামী ওনাকে নিজেই বাসা ভাড়া করে এখান থেকে নিয়ে গেছেন।এলাকার লোকজন ওই মহিলার স্বামীকে জানানোর চেষ্টা করেছিল।কিন্তু ওনি পুলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে বিদেশে মিশনে গেছিলেন বলে জানাতে পারে নি।ওনারা নাকি আমাকেই খুজচ্ছিলেন এসব জানাতে।এই মহিলা তো বলেই ফেললো আমি ভেবেছি ওর বউ দেখতে খারাপ তাই এইসব করে বাইরে। আর এম্ন সুন্দরী স্ত্রী রেখে এইসব!!ছি ছি!!এও শুনলাম উনি নাকি ওই মহিলাকে সকালে রান্না করতে দিতেন না।মহিলা আর মহিলার মেয়েদের হোটেল থেকে পরোটা এনে খাওয়াতেন।হাই রে পুরুষ মানুষ!!এইদিকে আমার ছেলেমেয়ে দুইটা না খেয়ে দিন পার করে দিত।তিনবেলা ভাত ছাড়া কিছুই খাওয়াতে পারতাম না।

এইসব আমি আর নিতে পারছিলাম না।আমার ধৈর্য শেষ হয়ে গেছিল।সেদিনের মত বাড়ি আসলাম।পরের দিন আমার মেয়ের এস এস সি এর টেস্ট পরিক্ষা।মেয়ে পাশে পড়ছিলো।সে ফিরলো রাত ১১টাই।খুব ভদ্রভাবে খেতে বসতে বললাম।সে জানালো বাইরে থেকে খেয়ে এসেছে।এইবার আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না।খাবার সব মেঝেতে ফেলে দিলাম।ইচ্ছামত গালাগালি,ভাঙচুর করলাম,জীবনে প্রথম স্বামীর গায়ে হাত তুললাম।ছেলে মেয়ে দুইটা এক কোনে দাঁড়িয়ে দেখছিল।কিন্তু একবার সে আমাকে থামিয়ে আমাকে এলোপাতাড়ি মারতে শুরু করলো। এই পর্যায়ে মেয়ে এসে তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল।আমি অবাক হচ্ছিলাম আমার মেয়েটা এমনভাবে আমার পক্ষ নিচ্ছিল যেন এমন কিছু হবে সে আগেই জানতো। উনি যখন দেখলেন পেরে উঠছে না মা মেয়ের সাথে বাইরের বেলকনিতে গেল গলায় দড়ি নিতে গ্রিল এর সাথে আমাদের ভিতরে আটকে।বাসাটা যেহেতু এক তলা ছিল আর বেল্কনি টা বাইরের ছিল তো বাইরের লোকেরা চিৎকার চেঁচামেচি করে ছুটে এসে তাকে বাচালো,তারপর আমাদের দরজা খুলে দিল।ততক্ষনে তার ফাস লেগে গেছিল।সেই রাতেই ছেলেমেয়ে দুইটাকে রেখে তাকে নিয়ে গেলাম হাসপাতালে।দুদিন পর হাসপাতাল থেকে তাকে ছেড়ে দিল।বাড়ি আনার পরের দিন ওই মহিলা তাকে দেখতে এলো। দুজনে সব স্বীকার করে মাফ চাইলো আর যোগাযোগ করবে না এই প্রতিজ্ঞা করলো। কিন্তু দুজনের ভাব দেখে মনে হচ্ছিল বাংলা সিনেমার নায়ক নায়িকাকে আমি ভিলেন হয়ে আলাদা করে দিচ্ছি। পরের দিন আমি আমার বাড়ির লোক আর তার বাড়ির লোককে সবটা জানিয়ে ডেকে পাঠালাম।আমার বাবা তাকে মারতে যাচ্ছিল বারবার।শালিস হলো
সেখানে আমার মেয়ে জানালো সে তার বাবার এইসব কাহিনী আগেই জানে। কিন্তু আমি কষ্ট পাব বলে জানায়নি।এটাই বললো ও ছোটবেলা থেকেই অনেক কিছুর স্বাক্ষী,কিন্তু আমার মুখপানে চেয়ে বলেনি।এটাও জানালো বাবার সাথে ছোটবেলায় ঘুমাতোনা বাবার কিছু ব্যাড টাচ তার ভাল লাগতো না।আমার বোনরাও জানালো অনেকভাবে তার অনেক অসদাচরণ থেকে নিজেকে রক্ষা করেছে কিন্তু আমাকে জানায়নি। শালিস বিচার যাই হোক সবার এক কথা ছেলেমেয়ের দিকে তাকিয়ে শেষবার ক্ষমা করতে।পরেরদিন ভোর হওয়ার আগে কাউকে না জানিয়ে দুঃসম্পর্ক এর এক খালার বাসায় চলে গেলাম।এর মাঝে আমার মেয়ে টেস্ট পরিক্ষা দিচ্চিল।পরের দিন ঠিক খোজ করে আমার বাবার বাড়ির লোক আমাকে পেয়ে গেল।আমার স্বামী একগাদা লোকের সামনে আমার পা ধরে বসে পড়লো। শেষবারের মত একটা সুযোগ চাইলো। সবার কথাতে দিলাম শেষ সুযোগ তবে আমার মন জানতো আমি তিলে তিলে শেষ হচ্ছিলাম।
তার পর এর গল্পটা খুব ছোট।আমার বাবার বাড়ির লোক অনেক কষ্ট করে লোক ধরে ওকে বিদেশ পাঠানোর ব্যাবস্থা করলো।কারন কুকুরের লেজ সোজা হয় না,আর আমিও চাচ্ছিলাম না ও আমার সামনে থাক।
হ্যা এখন ও বিদেশে থাকে।দু বছরে একবার আসে।নামে মাত্র আমাদের সম্পর্কটা টিকে আছে।সে এখন নানাভাবে আমাকে আগের মত করতে চায় কিন্তু না যে বিশ্বাস বারবার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়েছে তা আর জোড়া লাগবে না।সমাজের ভয়ে আর সন্তানদের জন্য আজ ও সুখী থাকার অভিনয় করছি মাত্র।গল্প তো শেষ হয়,জীবন যে শেষ হয় না।আজও বেচে আছি শেষ বিচারের অপেক্ষায়।
(সমাপ্ত)
(অনেকে বলবেন এন্ডিং ভাল হয়নি।ডিভোর্স দেয়া উচিৎ ছিল।কিন্তু ভেবে দেখুন আমাদের সমাজে হাজার হাজার তিয়াসা আছে যারা এভাবেই সহ্য করে বেচে আছে।এটাই বাস্তব।এটাই নিয়তি।কজন মেয়ে পারে সন্তান,সমাজকে উপেক্ষা করে জয়ী হতে??)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে