বিরহ ভালোবাসা পর্ব-১৮

0
814

#বিরহ_ভালোবাসা
#Tahmina_Akhter

১৮.

লাল বেনারসি, মাথায় লাল ওড়না, মায়ের দেয়া হালকা কিছু গহনা সাথে রুপা আপার ম্যাজিকাল মেক-আপ। ব্যস আমার ব্রাইডাল মেকআপ কমপ্লিট।

পাশের ঘর থেকে চেচামেচি শোনা যাচ্ছে দেখে রুপা আপা আমাকে একা রেখে ওঠে চলে গেলেন পাশের ঘরে।

খাটের ওপর রাখা ছোট্ট আয়না হাতে নিয়ে নিজের মুখটা দেখলাম। বৌ বেশে মন্দ দেখাচ্ছে না। এই যে বৌ বেশে থাকা আমি আজ দ্বিধান্বিত মনে ভাবছি শাদাদ ভাইয়ের বৌ হিসেবে সাজলে আমাকে কেমন দেখাতো? হয়তো শাদাদ ভাই আমাকে লাল শাড়ি পরতে দিতেন না। কারণ, শাদাদ ভাইয়ের লাল রঙ অপছন্দ। এই যে নাকফুল খুলে নোলক পরেছি এটাও হয়তো পরতে দিতেন না। শাদাদ ভাই বলতেন, নোলকের ভারে তোর বোঁচা নাকটা ছিঁড়ে যাবে রে লতা। হাতে গোল্ডের চুড়ি না থেকে ডজনখানেক কাঁচের চুড়ি থাকতো আমার। কিন্তু, রবিন সাহেবের স্ত্রী হিসেবে সেজেছি বলেই আজ আমার বৌ সাজে কতটা পরিবর্তন এসেছে!

মানুষটাকে পছন্দ করতে করতে একসময় তার সকল পছন্দ-অপছন্দকে নিজের পছন্দ-অপছন্দ হিসেবে মানিয়ে নিয়েছি। জানি না কবে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাব? মনে শাদাদ ভাই কিংবা তার পছন্দ-অপছন্দ রেখে রবিন সাহেবের স্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা কঠিন হয়ে যাবে আমার জন্য। তবুও চেষ্টা করব আমি। নয়তো, মানুষটাকে ঠকানো হবে।

এমন সময় বড়ো জেঠুর চেচামেচি শুনে আমার ধ্যানভগ্ন হয়। মনে অজানা আশংকায় আঁতকে ওঠে। পড়নের শাড়িটা দুহাতে একটু উঁচু করে ঘরের কাঠের দরজা খুলে পাশের ঘরের দরজা সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই আমার চোখ এমন একটা দৃশ্য দেখে স্থীর হয়ে যায়। মন বলছে বিশ্বাস করে নে লতা। কিন্তু, মস্তিষ্ক বলছে, কারনটা জেনে নে কেন এমনটা হলো?

কিছুক্ষণ আগে……

লতার বড়ো জেঠু বিয়ের কেনাকাটা সেড়ে লতার বাবা এবং রবিনকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। তারপর, নিজে এলাকার স্থানীয় কাজি অফিসে গিয়ে কাজি সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হোন।

বাড়িতে আসার পর বিয়ের যাবতীয় বিষয়ে তোড়জোড় শুরু হয়। কাজি সাহেব, লতার বাবা,রুপার স্বামী জাভেদ এবং রবিন একঘরে বসে আছেন। লতার মা তাদের সামনে নানানপদের নাশতা রেখে গেছেন।

লতাক তখন রুপা বৌ সাজাতে ব্যস্ত। লতার মা বাইরে রান্নাবান্না সামলাচ্ছেন। পাশের বাড়ির কয়েকজন মহিলা এসে লতার মাকে হাতে হাতে সাহায্য করছেন।

লতার জেঠু নিজের ঘরে বসে আলমারী খুলে কি যেন বের করছিলেন? এমন সময় ঘরে ঢুকে শাদাদ। দরজা খোলার শব্দ শুনে শাদাদের বাবা সাদিক চৌধুরী ঘাড় ফিরিয়ে দেখে নিলেন ঘরে কে এসেছে? ছেলেকে দেখে আবারও নিজের কাজে মনোযোগ দিলেন তিনি। শাদাদ এসেছে প্রায় দশমিনিট হয়ে যাচ্ছে কিন্তু সেই আগের মতো মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। সাদিক সাহেব ছেলের কান্ড দেখে যারপরনাই বিরক্ত। আলমারী লাগিয়ে নতুন পাঞ্জাবি পরে গায়ে সুগন্ধি আতর মাখলেন। চোখে সুরমা ব্যবহার করলেন।

এদিকে নিজের বাবাকে নতুন পাঞ্জাবি, গায়ে আতর, চোখে সুরমা দিতে দেখে শাদাদ ভাইয়ের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। নিজের ছেলে বরবাদিতে পৃথিবীর এই প্রথম কোনো বাবা এত সুন্দর পরিপাটি হচ্ছেন!

— উল্লুকের মতো মুখ বানিয়ে রেখেছিস কেন?

ছেলেকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করলেন সাদিকে সাহেব। শাদাদ মনের কষ্টখানি ঢোক গিলে গলার নীচে নামালো। কষ্ট বেশি হলে গলা থেকে বুক পর্যন্ত এত বেশি ব্যাথা করে কেন?

— বাবা, আ..মি আপনাকে চিঠি দিয়েছিলাম মাসখানেক আগে।

চিঠির কথা শুনে সাদিক সাহেব ভ্রু কুচকে বললেন,

— কই আমি তো কোনো চিঠি পাইনি! ভুল ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়েছিস হয়তো।

নিজের বাবার মুখ থেকে এই কথা শুনে শাদাদের মনে হলো, ও এই মূহুর্তে পৃথিবীর বাইরে গিয়ে মুখ থুবড়ে পরেছে। কারণ, এই পৃথিবীতে ওর মতো ভীতু প্রেমিক বোধহয় একটাও নেই। যেখানে পৃথিবীতে কত মানুষ তাদের ভালোবাসাকে সকলের কাছে অমর স্মরণীয় করে রেখেছে। সেখানে ওর মতো প্রেমিকের কি প্রয়োজন? লতা রে তোকে ভালোবেসে গেলাম। কিন্তু, বলার সাহস টুকু কেন নিজের মাঝে ধারণ করলাম না! সাহস করে চিঠিতে বাবাকে যাও মনের কথা বললাম। কিন্তু সেই চিঠি বাবার কাছে এসে পৌঁছায়নি। তোকে বুঝি হারিয়ে ফেললাম রে লতা!

ভাঙা কাঁচের প্লেটের মতো শাদাদ ভাইয়ের হৃদয়টা শ’খানেক টুকরো হলো। ভাঙা হৃদয়ের টুকরো গুলো নিয়ে আমতাআমতা করে নিজের বাবাকে বললো,

— বাবা আপনি একবার ডাকঘরে খবর নিয়ে দেখুন না আপনার নামে কোনো চিঠি পরে আছে কি-না?

— এই তুই কি পাগল হলি? বলছিস চিঠি পাঠিয়েছিস মাসখানেক আগে। আমি হাতে পাইনি। তার মানে কি দাঁড়ায় তোর চিঠি ডাকঘরে আসেনি। আসলে আমার হাতে অবশ্যই আসতো। এখন চিঠি চিঠি করে আমার মাথা নষ্ট করিস না। একটু পর এই বাড়ির ছোট মেয়ের বিয়ে। মাথায় কত চিন্তা আর উনি কিনা চিঠি নিয়ে পরে আছে! এমন মাথা নিয়ে অফিসার বানালো কে তোকে?

বড়ো গলায় কথাগুলি বললেন সাদিক সাহেব। উনার গলা শুনে পাশের ঘর থেকে লতার বাবা-মা, রুপা, জাভেদ চলে এলো। সবাই এসে বোকার মতো একবার শাদাদের দিকে তাকায়। তো আরেকবার সাদিক সাহেবের দিলে তাকায়। কিন্তু,দুজনের কেউই জবাব দেয় না।

রুপা এগিয়ে এসে ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে জানতে চায় কি হয়েছে? হয়তো, বোনের স্নেহের অপেক্ষায় ছিল শাদাদ। রুপার গলা জড়িয়ে ধরে একসময় শাদাদ নিঃশব্দে কাঁদতে শুরু করে। নিজের কাঁধে গরম পানির স্পর্শ পেয়ে রুপা অবাক হয়ে শাদাদকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে ধরে দেখলো শাদাদের চোখ ভেজা। ভাইয়ের মনের কষ্টটা বুঝতে পারে রুপা। ভাইটা শুধু বাবার কথায় মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। বাবার ইচ্ছায় আর্মিতে যোগ দিলো। কখনো নিজের ইচ্ছা বাবাকে বলতে চায়নি। কিন্তু, জীবনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের সময়ে কি বাবার সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া যায়? ভালোবাসিস লতাকে বলে দে সবাইকে শাদাদ?

রুপা আপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মনের কথা মনেই রয়ে গেলো। বলা হয় না ; কারণ বাবাকে তারা জমের মতো ভয় পায়।

—- মহিলাদের মতো ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদছিস কেন?

শাদাদকে উদ্দেশ্য করে এমন প্রশ্ন করলে উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে তাকায় শাদাদের দিকে। শাদাদ সবার দৃষ্টি থেকে নিজেকে আড়াল করে চোখের জল অতি সন্তর্পনে মুছে ফেললো।

—- ও কাঁদুক। হাঁদারাম একটা। প্রেম করতে পারে। বাবাকে সেই কথা চিঠিতে লিখতে পারে। সামনাসামনি বলতে যত লজ্জা-শরমে মরেন তিনি!

সাদিক সাহেব হুংকার দিয়ে কথাগুলো বলে খাটের ওপর বসে রাগে ফোসফাস করতে লাগলেন। নিজের বাবার মুখ থেকে এই কথা শুনে শাদাদ অবাক হয়ে যায়। তারমানে, ওর বাবা চিঠিটা পেয়েছে! কিন্তু, চিঠি না পাওয়ার ভান করলো কেন?

ততক্ষণে, দরজা খুলে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে বৌ বেশে থাকা লতা। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখলো, শাদাদ ওর বাবার পায়ের কাছে বসে আছে। হয়তো, পা ধরে বসে আছে। পরিবারের বাকি সদস্যরা লতার মতো বোকাচোখে তাকিয়ে আছে বাপ-ছেলের দিকে।

লতাকে দেখে শাদাদ মুখ নামিয়ে ফেলে। শাদাদের মুখ নামিয়ে ফেলাটা সাদিক সাহেব দেখে ফেললেন। তিনি শাদাদকে টেনে এনে নিজের পাশে বসালেন। এরপর, সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— কিছুদিন আগে আমার নামে একটা চিঠি আসে। চিঠিটা পেয়ে অবাক হয়ে ভাবছিলাম , কে দিতে পারে এই চিঠি? মনের কৌতুহল মেটাতে চিঠিটা পড়তে শুরু করলাম। হুবহু এমনটাই লিখা ছিল চিঠিতে।

প্রিয় বাবা,

মনে অনেক সাহস নিয়ে আপনাকে চিঠি লিখতে বসলাম। কারণ, আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আমার হাঁচি দিতে ভয় লাগে। পাছে না আপনি বলে ফেলেন, দিলি তো সব ভাইরাস আমার শরীরে ঢুকিয়ে।

কথাটি লিখতে গিয়েও আমি লজ্জা পাচ্ছি। তবুও, বলতে তো হবেই। অনেকবছর ধরে আমি একজনকে পছন্দ করি। সোজা কথা বলতে গেলে তাকে আমি আমার স্ত্রী রুপে পছন্দ করি। কারণ, আপনি তো প্রেম-ভালোবাসা বিরোধী। তাই ডিরেক্ট তাকে স্ত্রী হিসেবে পছন্দ করেছি আমি।

যদিও সে আমার পছন্দ সম্পর্কে অবগত নয়।ইদানিং, তার পরিবার উঠে পরে লেগেছে তাকে বিয়ে দেয়ার জন্য। তার বিয়ের দেয়ার জন্য আপনিও উঠে পরে লেগেছেন। কারণ, আপনার একমাত্র ছোট ভাইয়ের মেয়ে বলে কথা। আপনি কি নিজ হাতে আপনার ছেলের জীবন নষ্ট করতে চান, বাবা?

ইদানীং, আমার মনে হচ্ছে আপনার দেখাশোনা করার জন্য একটা লোকের দরকার। যে কিনা সার্বক্ষণিক আপনার সেবায় নিয়োজিত থাকবে। আমি থাকি বাড়ির বাইরে। আপার বিয়ে হয়ে গেছে। আপনি একা থাকছেন। চাচি বা আপনাকে আর কত দেখবেন? আপনার একমাত্র পুত্রকে বিয়ে করিয়ে। আপনি আপনার পুত্রকে তার বাবার জন্য করা দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিন।

ইতি
আপনার পুত্র।

—আমার ছেলে তার পছন্দের কথা চিঠিতে লিখতে পারে অথচ মুখে বলতে পারে না। এই যে রবিনকে ধরে এনেছি লতার সঙ্গে বিয়ে দেব বলে। তাও হতচ্ছাড়াটা আমার সামনে এসে একবারও বলার সাহস পায়নি যে, বাবা আমি লতাকে বিয়ে করব। কেন রে তোদের ট্রেনিংয়ের সময় তোদের সোজাসাপটা কথা বলার ট্রেনিং দেয়নি? সাহস দেয়নি?

সাদিক সাহেবের কথা শুনে শাদাদ মাথা নিচু করে নিজের বাবাকে জড়িয়ে ধরে। বাকি সবাই অবাক হয়ে যায়।

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি শাদাদ ভাই নামক মানুষটার দিকে। মানুষটা আড়ালে কতকিছু করেছে। আর আমি কিনা তাকে ভুল বুঝে, তাকে ভুলে থাকার চেষ্টা করেছি!

লতার বাবা মুখ গম্ভীর করে বললো,

— সবটাই তো শুনলাম। কিন্তু রবিন ছেলেটা অনেক আশা নিয়ে বরবেশে বসে আছে। তাকে কি করে?

লতার বাবার কথা শুনে সবার টনক নড়ে। সাদিক সাহেব রবিনকে ডাক দিলে ও এই ঘরে আসে। লতার সামনে দাঁড়িয়ে রবিন বললো,

— তুমি আমার অনেক পছন্দের মানুষ লতা। তাই তুমি মনে কষ্ট পাও এমন কোনো কাজ আমি করব না। শাদাদ সাহেবকে পেলে তুমি খুশি হবে এটা আমি জানি। তাই তো সাদিক আংকেলের সাথে আমি মিলে তোমাদের মিলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলাম। এবং আমরা সফলও হয়েছি। তাই না সাদিক আংকেল?

রবিনের কথা শুনে আমি, শাদাদ ভাইসহ বাকি সবাই অবাক। এদিকে জেঠু আর রবিন সাহেব সবার চাহনি দেখে শব্দ করে হাসছেন।

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে