বিরহ ভালোবাসা পর্ব-১০

0
1016

#বিরহ_ভালোবাসা
#Tahmina_Akhter

১০.

শাদাদ ভাইয়ের সামনে যেতে ইচ্ছে করছিল না। তাই রাতের খাবার মাকে বলে নিজের ঘরেই এনে খেলাম। শিপলু রাত দশটার দিকে একবার ডেকে গিয়েছিল। সবাই মিলে নাকি লুডু খেলবে। কিন্তু, আমার যেতে ইচ্ছে করছিল না। শিপলুকে বারণ করলে ও বিনাবাক্য চলেই যায়।

রাতটা যেন কাটতেই চাচ্ছিলো না। শাদাদ ভাইয়ের জন্য আমার হৃদয়ে যে সুর বেজে ওঠছে তা কখনোই আমি চাইনি। কিন্তু, আমার অবচেতন মন কখন তার প্রতি এতটা দূর্বল হয়েছে আমি নিজেও জানি না কিংবা জানতে চাই না। সবকথা কিংবা সবপ্রশ্নের উত্তর জানতে নেই। সেই ছোট্ট বেলা থেকে কখনো শাদাদ ভাইকে অনেকগুলো দিন এই বাড়িতে কাটাতে দেখেনি। পড়াশোনা করেছেন ফৌজদারহাট ক্যাডেট স্কুল এন্ড কলেজ থেকে। ছুটি পেলে জেঠু গিয়ে কিংবা বাবা গিয়ে শাদাদ ভাইকে নিয়ে আসতেন। এসএসসি পাশের পর থেকে নিজে একা আসা শুরু করলেন। বাড়িতে আসতেন দুই এক সপ্তাহ থেকে চলে যেতেন।

সেই সময়টাতে সকল কাজিনরা মিলে একসাথে হতাম বেশ আনন্দ হতো। ক্লাস নাইন অব্দি শাদাদ ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্কটা আট-দশটা কাজিন সম্পর্কের মতোই ছিল। কিন্তু, অপরিণতবয়স থেকে যতই পরিণত বয়সের দিকে যাচ্ছিলাম ঠিক ততই মনের কোণের কালো মেঘের ঘনঘটা অদৃশ্য হয়ে একটি বার্তা বলছিল, আর তা হলো আমি শাদাদ ভাইকে পছন্দ করি। সেই পছন্দটুকু পৃথিবীর সবচেয়ে আলাদা পছন্দ। তাকে নিয়ে ভালোবাসায় ভরা একটি সংসার থাকবে আমার। জোসনা রাতে দিঘির পানিতে পা ডুবিয়ে তার কাঁধে মাথা রেখে ঝিঝি পোকার ডাক শোনার অধিকারটুকু তার কাছ থেকে পাওয়ার অদম্য আগ্রহ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। কিন্তু, আজকের এই দিনশেষে আমার মন বলছে, শাদাদ ভাইকে পছন্দ করাটা আমার মস্ত বড়ো ভুল। তাকে না জেনে না বুঝে তার জন্য আমার হৃদয়টাকে উজাড় করে দেয়াটা ভুল। সে তো অন্যতে মত্ত। আমি তো তার হৃদয়ের আনাচে-কানাচেও নেই। খুব স্বাভাবিক একটা সম্পর্ক আমাদের যেমনটা সকল কাজিনদের মধ্যে থাকে।

আর কিছুই ভাবতে পারছিলাম না। বারান্দায় গিয়ে দেখলাম দূর আকাশে ধ্রুব তারা মিটমিটিয়ে জ্বলজ্বল করছে। নিকেষ রাতে, মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকা লতা আনমনে বলে উঠলো,

— আজকের পর থেকে আপনাকে নিয়ে ভাবব না শাদাদ ভাই। আপনাকে নিয়ে ভাবতে বসলে পুরো মাথা ফাঁকা হয়ে যায় আমার। যেখানে আপনাকে আমি পাব না জানতে পেরেছি সেখানে আপানাকে পাওয়ার আশা করা এখন ভুল। ভালোবাসায় কাতর হয়ে এতদিন আপনাকে ভেবে কেঁপে উঠেছিল হৃদয়। আজ থেকে নাহয় বিরহের জের ধরে আমার আপনাকে বিহীন পথচলা শুরু হোক।

————————————-

ধীরে ধীরে একাকীত্ব কমে আসছে কারণ লোকের সমাগমে বাড়ি মুখরিত। শাদাদ ভাইয়ের নানা বাড়ির হাতেগোনা কয়েকজন এলো। আমার নানুরবাড়ির লোকজন এলো। বিষন্নতায় ঘেরা মনটা একটু একটু করে ঠিক হচ্ছিল সকলের উপস্থিতিতে।

রুপা আপার গায়ে হলুদের দিন সবাই যে যার মতো করে তৈরি হয়ে ড্রইংরুমে এসে বসে রইলাম। কারণ, রুপা আপার জামাইকে হলুদ পরিয়ে, সেই হলুদ এনে রুপা আপাকে ছোঁয়াতে হবে। জাভেদ ভাইদের বাড়িতে আমি, শিপলু, নূর আপা, শাদাদ ভাই এবং উনার খালাতো বোন তর্সা যাব বলে ঠিক করেছেন বড়ো জেঠু। আমি আর নূর আপা মিলে সোফায় বসে কানে ফুলের দুল পরছিলাম। কারণ সময় পাইনি। শাদাদ ভাই একধমক দিয়ে আমাদের রুম থেকে বের করে এনে ড্রইংরুমে বসিয়ে রেখেছেন সেই কখন থেকে । যেকোনো মূহুর্তে গাড়ি চলে আসবে। এদিকে কানের দুল পরতে পারছি না।

পলাশের সঙ্গে কথা বলতে বলতে শাদাদ ভাই ড্রইংরুমের দিকে যাচ্ছিলেন। হুট করে চোখে পরলো একটা বিরক্ত মুখের দিকে। যে কি-না নিজের চুলের ওপর বিরক্ত। অবাধ্য চুলটাকে বারবার কানের পিছে গুঁজে দেয়ার পরও বারবার সামনে চলে আসছে। যার কারনে কানে দুল পরতে পারছে না। হুট করে সারাদিনের ধকল হাওয়া হয়ে গেছে শাদাদ ভাইয়ের।শরীর থেকে।

নীল পাড়ের হলুদ শাড়ি। নীল রঙের হাফ হাতা ব্লাউজ পরে থাকার কারণে ফর্সা রঙের হাতদুটো জ্বলজ্বল করছিল। অলংকারবিহীন গলা, বামহাতে ঘড়ি আর ডানহাতে হাফ ডজন চুড়ি। নাকফুলের সাদা পাথরটা যেন আজ চকচক করছে বেশি।

— মধু রে। তুই আজ আমাকে মেরে ফেলার পায়তারা করছিস। আ’ম শিউর আমি মরে গেলে তুই সবচেয়ে বেশি খুশি হবি। কারণ তোকে জ্বালানোর জন্য একমাত্র আমি এই পৃথিবীতে বেঁচে আছি তাই।

মনে মনে কথাগুলো বলতে বলতে শাদাদ ভাই সবার সামনে গিয়ে দিলো এক রামধমক। ব্যস, অমনি সকলে একসঙ্গে লাফিয়ে উঠে শাদাদ ভাইয়ের দিকে বোকাচোখে তাকিয়ে থাকে উত্তরের আশায়।

— আমি কি বলেছি এখানে বসে বসে সাজগোছ করতে? তোরা যেভাবে সাজুগুজু করে টাল দিয়ে ফেলছিস আমার তো দেখে মনে হচ্ছে বিয়েটা তোদের রুপা আপার না। যাহ্ গিয়ে গাড়িতে উঠে বস।

ব্যস, যে যেভাবে পেরেছে ড্রইংরুম ছেড়ে গাড়ির পথে রওনা হয়েছে। বাকি রয়ে গেছে আমাদের লতা। যিনি কিনা এখনও কানের দুল নিয়ে ব্যস্ত। শাদাদ ভাই চারদিকে তাকালেন, দেখলেন কেউ নেই। চট করে লতার পাশে গিয়ে বসলেন। লতার হাত থেকে কানের দুলটা হাতে নিয়ে নিলো। লতা অবাক হয়ে তাকায় শাদাদ ভাইয়ের দিকে। তারপর, শাদাদ ভাইয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে বললো,

— দুলটা দিন। এমনিতেই দেরি হয়ে যাচ্ছে।

শাদাদ ভাই লতার কথার কোনো জবাব না দিয়ে আরেকটু লতার ঘনিষ্ঠে এসে বসলেন। হাত দিয়ে লতার মাথাটা একপাশে করে দিলো। লতা তো চুপ। ওর কোনো নড়াচড়া নেই দেখে মনে হচ্ছে যেন কেউ ওর শরীরে এনথেশিয়া পুশ করে দিয়েছে। শাদাদ ভাই খুব যত্ন করে লতার চুলগুলো কানের পিছে গুজে দিলো। তারপর, কানে দুল পরিয়ে দেয়। আরও একবার লতার ওপর চোখ বুলিয়ে দেখে নিলো শাদাদ ভাই। এবার পার্ফেক্ট হয়েছে। লতা কিছু বলতে যাবে শাদাদ ভাইকে তারআগে চট করে লতার কানে চুকুস করে একটা চুমু খেলো।

শাদাদ ভাই কোনোকিছু হয়নি এমন একটা ভাব নিয়ে বাড়ির বাইরের দিকে চলে যাচ্ছেন। আর আমাদের লতা আজ একটার পর একটা ঝটকা খেয়ে মনে হচ্ছে সে যেকোনো মূহুর্তে অচেতন হয়ে পরে যাবে। প্রেশার বোধহয় লো হয়ে গেছে শাদাদ ভাইয়ের স্পর্শ পেয়ে।

এতক্ষণ অব্দি লতা কিংবা শাদাদের মাঝে যা কিছু হয়েছে সবটাই দেখেছে রুপা আপা। মনে মনে ভীষন খুশি হয়েছেন তিনি। কিন্তু এই সম্পর্কের পরিণতি সম্পর্কে রুপার খুব একটা স্বচ্ছ ধারণা হচ্ছে না। কারণ, রুপার বাবা মনে হয় না এই সম্পর্ককে খুব স্বাভাবিক ভাবে নিবেন! রুপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে চলে গেলো ঘরের ভেতরে।

রুপা ছাড়াও আরও একজন এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হয়েছে আজ। আর সেই মানুষটা হচ্ছে লতার মা তৃনা। উনার শরীর থরথর করে কাঁপছে। বাড়ির মেয়ে বাড়ির ছেলের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন এটা তিনি কল্পনাও করেননি। লতা না হয় বুঝে না এই সম্পর্কের পরিণতির কথা। কিন্তু শাদাদ কি জানে না ওর বাবা এই সম্পর্কের কথা জানলে কখনো মেনে নিবেন না! তৃনার হুট করে শরীর খারাপ লাগছে। হুট করে এতটা চাপ তিনি নিতে পারছেন না।

লতা ধীরপায়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গাড়িতে যেয়ে উঠে বসলো। কিন্তু, কপাল খারাপ হলে যা হয় আর কি! লতার পাশের সিটে শাদাদ ভাই বসে বসে গুনগুনিয়ে গান গাইছেন,

“তুমি এসেছিলে পরশু
কাল কেন আসোনি?
কাল ভালোবাসোনি”

শাদাদ ভাইয়ের গান শুনে লতা ভ্রু কুঁচকে শাদাদ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মানে কি? ওকে দুল পরিয়ে দেয়ার বাহানায় চুকুস চুকুস চুম খেতে পারে। আবার কি না গাড়িতে বসে বসে সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বিরহের গান গাওয়া হচ্ছে! এই লোকটাকে প্রশয় দেয়া ভুল হয়েছে লতার। হুট করে কাছে এসে ছুঁয়ে দিয়ে যাবে আবার প্রকাশ্যে অন্যকারো অপেক্ষায় থাকার কথা গানের মাধ্যমে বোঝায়।

সারা পথ জুড়ে লতা শাদাদ ভাইয়ের দিকে তাকালো না অব্দি। এদিকে তো আমাদের শাদাদ ভাই চোরা চোখে লতার দিকে তাকিয়ে ভালোবাসার তৃষ্ণা মেটাচ্ছেন।

দু’জন মানুষ দু’জনকে ভালোবাসাে। একজন প্রকাশ করতে চায় না। আর অন্যজন ভুলভাল বুঝে গাল ফুলিয়ে বিরহের বীজ হৃদয়ে রোপন করে বসে আছে। ভালোবাসায় এতটা বিরহ কেন?

#চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে