বিরহবিধুর চাঁদাসক্তি পর্ব-৮+৯

0
349

#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৮.
ইদের দিন। সকাল-সকাল মায়েরা তাদের ছেলে-মেয়েদের টেনেটুনে বিছানা ছাড়িয়েছেন। সবাই ফ্রেশ হয়ে এসে দেখল রান্নাঘরে রান্নার ধুম লেগে গেছে। আরিন্তার মা, চাচি, ফুপি সবাই রান্নায় ব্যস্ত। ছেলেরা সবাই ইদের নামাজ আদায় করার জন্য প্রস্তুত হয়েছে। সবার পরনে একই রকম শুভ্র পাঞ্জাবি। ঘর থেকে বেরোনোর আগে তাদেরকে সেমাই দেওয়া হলো মিষ্টি মুখ করার জন্য। সেমাই খেয়ে সবাই বেরোনোর সময় মেরিনা পেলবকে বলে দিলেন,
“নামাজ পড়ে মিশুকে নিয়ে আসিস।”
পেলব ঘাড় কাত করে বলল,
“আচ্ছা।”

ছেলেরা চলে যাওয়ার পর মেয়েরা নতুন জামা পরে সাজগোজ করতে লেগে পড়ল। ওদিকে মেরিনা আবার মিশকাতকে ফোন করেছে বাড়িতে আসতে বলার জন্য। এমনিতেও সে জানে মিশকাত আসবে, তবু তার বলতে হয়। মেরিনার কথার মাঝে আরিন্তা ফোন নিয়ে বলে বসল,
“মিশু ভাই, তুমি আসছো তো নামাজের পর?”
মিশকাত ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“কেন? মতলব কী?”
“কোনো মতলব নেই। আজ খুশির দিন। কত রান্না হচ্ছে জানো? এসে কবজি ডুবিয়ে খেয়ে যাবে।”
“ব্যস এটুকুই?”
আরিন্তা হেসে বলল,
“তোমরা সবাই এলে কুরবানি দেওয়ার পরেই কিন্তু আমরা সালামি অভিযানে নামব।”
“তা তো অবশ্যই।”
“এবার কোনো বড়োরা ছাড় পাবে না।”
“ছাড় দিলে তো পাবে।”
“তুমিও পাবে না।”
মিশকাত সন্দিহান কন্ঠে বলল,
“এই হচ্ছে আসল মতলব?”
“মতলবের কী আছে? তুমি তো বয়সে আমার চেয়ে বড়ো, সেই হিসাবে আমি তোমার থেকে সালামি পাওনা।”
মিশকাত বলল,
“তুই আমার কে যে তোকে আমি সালামি দিবো? ঘরের বউ হলে না হয় ভিন্ন কথা ছিল।”
“ভবিষ্যতে তো হব।”
“ভবিষ্যতেরটা ভবিষ্যতে দেখা যাবে। টাকা-পয়সা নিয়ে কোনো খাতির নেই।”
আরিন্তা মুখ কালো করে বলল,
“তাহলে তুমি আমাকে এবারো সালামি দিচ্ছ না?”
“না।”
“তোমার আসারই দরকার নেই। একদম আসবে না আমাদের বাড়িতে।”
“আমি আমার খালার বাড়ি যাব, তোর কী?”
“না খাইয়ে রাখব।”
“খালার সামনে বলিস, আজকের মতো তোর কপাল থেকেই খাবার উঠে যাবে।”

ইদের নামাজের পর তালুকদার বাড়ির সামনে বিরাট এক গোরু কুরবানি হলো। মাংস কা’টাকা’টির কাজে যোগ দিতে হয়েছে বাড়ির ছেলেদেরও। মিশকাত গলা ভিজানোর জন্য বাড়ির ভেতরে গিয়েছে। উঠানোর বাঁ পাশের কলপাড়ে গিয়ে কোনোমতে হাত ধুয়ে সে ঘরে ঢুকল। পেছনের দিকের রান্নাঘরে সিমেন্টের চুলায় তার খালা এখনো রান্না করছে। এদিকে ঘরের গ্যাসের চুলায়-ও আরিন্তার ফুপি কাবাব ভাজছে। তাকে দেখে তিনি শুধালেন,
“মিশকাত, কিছু লাগবে?”
মিশকাত উত্তর দিলো,
“না ফুপু, পানি খেতে এসেছি। গলা শুকিয়ে গেছে।”
সঙ্গে-সঙ্গে ফুপু হাঁক ছাড়লেন,
“এই, কার হাত ফাঁকা আছে? মিশকাতকে একটু ঠান্ডা পানি দে। মেয়েগুলোর কি সাজগোজ হয়নি এখনো?”

সবার আগে কোটর থেকে বেরিয়ে এল আরিন্তা-ই। এমনিতেও তার সাজগোজ হয়ে গেছে। ফুপুর ডাক শুনেও কেউ রুম থেকে বেরোতে চায়নি। আরিন্তাকে বলতেই সে মুখে একটু অনীহা মেখে মনে-মনে ধেই-ধেই করে নাচতে-নাচতে চলে এসেছে। মিশকাতের সামনে এসেই আঙুল উঁচিয়ে বলল,
“সালামি এনেছ? সালামি ছাড়া পানিও জুটবে না আজ।”
মিশকাত তার ডান পা এগিয়ে দিয়ে বলল,
“সালাম কর। বেয়াদবের মতো সালাম ছাড়া সালামি চাইছিস কোন আক্কেলে?”
“আগে দেখি তোমার সালামি, বের করো।”
“কখনো দেখেছিস সালামি চোখের সামনে ঝুলিয়ে রেখে কেউ সালাম দেয়?”
“নাহ্, দেখিনি। কিন্তু এখন দেখব। মানিব্যাগ বের করো তাড়াতাড়ি।”
“এখন আমি কাজে ব্যস্ত। পানি খাওয়া, খেয়ে কাজ সেরে আসি।”
“তুমি ছাড়াও কাজ করার অনেক মানুষ আছে ওখানে। অছিলা বাদ দাও, দেখি। মানিব্যাগ পকেটে না?”
বলতে-বলতে আরিন্তা মিশকাতের প্যান্টের পকেটে হাত ছোঁয়াতেই মিশকাত পিছিয়ে গেল। চোখ বড়ো করে বলল,
“হাত সামলে রাখ নির্লজ্জ মেয়ে। তোর ফুপু দেখলেই এক চিল্লানি দিবে। যা গলা!”
“দেখুক, তুমি আগে আমার সালামি বের করো।”

আরিন্তা আবারো মিশকাতের পকেট হাতড়াতে যেতেই মিশকাত তার হাত দুটো একসঙ্গে করে আরিন্তার নাকের কাছে ধরল। তার হাতে এখনো গোরুর রক্তের গন্ধ মিশে আছে। আরিন্তা নাক-মুখ কুঁচকে দ্রুত সরে গিয়ে বলল,
“মিশু ভাই, বিশ্রী গন্ধ তোমার হাতে।”

মিশকাত দাঁত কেলিয়ে হেসে হাত বাড়িয়ে আবার আরিন্তার কাছে আসা ধরতেই আরিন্তা ছুটে পালাল। ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা পানি বের করে গ্লাসে ঢেলে সাধারণ পানির সাথে মিশিয়ে নিয়ে এল। মিশকাত পানির গ্লাস হাতে নিয়ে বলল,
“তোর জন্য একটা বিশাল সুযোগ আছে কোনোরকম ঘ্যান-ঘ্যান ছাড়াই আমার থেকে সালামি আদায় করে নেওয়ার।”
আরিন্তা মুখ ভেঙিয়ে বলল,
“তোমার থেকে এত সহজে সালামি আদায়! স্বপ্নেও সম্ভব না। কিপটা লোক একটা।”
“সিরিয়াসলি বলছি কিন্তু আমি।”
“তাহলে অবশ্যই এই সুযোগের মধ্যে কোনো ঘাপলা আছে। সেই ঘাপলাটা কী?”
“খুবই সহজ। খালা যখন গোরুর ভুঁড়ি নিয়ে বসবে, তখন তুই-ও বাকিদের সাথে ভুঁড়ি পরিষ্কার করবি। রাজি থাকলেই পেয়ে যাবি নগদ সালামি। সালাম-ও করা লাগবে না।”
আরিন্তা চোখ ছোটো করে বলল,
“বসে আছি আমি তোমার এই ব’দ বুদ্ধির পাল্লায় পড়তে। পানি গিলে বিদায় হও তাড়াতাড়ি।”
মিশকাত এক চুমুকে সবটা পানি গলাধঃকরণ করে গ্লাসটা ফেরত দিয়ে বলল,
“ভেবে দেখতে পারিস। বিশাল সুযোগ, এমন সুযোগ দ্বিতীয়বার আসবে না।”
“প্রথমবার-ও লাগবে না তোমার বস্তাপচা সুযোগ।”
মিশকাত কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
“ওকে। তাহলে সালামির আশাও ভুলে যা।”

মিশকাত ঘুরে দাঁড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কী ভেবে আরিন্তা দৌড়ে গিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ডাকল,
“শোনো?”
মিশকাত পা থামাল। ঘুরে দাঁড়িয়ে শুধাল,
“কী? রাজি?”
“না। আমাকে কেমন লাগছে বললে না কেন? আমার সাজ চোখে পড়ছে না?”
মিশকাত একটু মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করল। আরিন্তার দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে বলল,
“তোকে আবার কেমন লাগবে? সবসময়ের মতোই লাগছে।”
“সবসময় কি আমি সেজে থাকি?”
“না, আমার চোখে তুই সাজলেও যেমন, না সাজলেও তেমন, সেটা বুঝিয়েছি।”
আরিন্তা খুশি হয়ে বলল,
“তবু, বলবে তো আমাকে সুন্দর লাগছে কি না?”
মিশকাত চোয়াল ঝুলিয়ে বলল,
“সুন্দর! তুই আবার সুন্দর কবে থেকে? আমার কাছে তো সবসময়ের মতোই‌ পে’ত্নী লাগছে। মুখে ওসব কী মেখেছিস? ঠোঁটে তো আবার র’ক্ত-ও লেগে আছে। ইয়াক্! কার ঘাড় মটকেছিস এই ইদের দিনে?”

আরিন্তা কপাল কুঁচকে ফেলল। রাগত মুখে বলল,
“কারোর ঘাড় না মটকালেও তোমাকে দিয়ে শুরু করব। পেটের শ’য়তানি বের করে দিবো একদম।”
“আগে মুখ ধুয়ে আয়, যাহ্। নইলে ঘর থেকে বেরোলেও মানুষ ভয়ে পালাবে। সবাই তো আর আমার মতো সাহসী না।”
মিশকাত আবার হাঁটা ধরলে আরিন্তা বিরক্তির সুরে ডেকে বলল,
“মিশু ভাই, যত-ই বাহানা দেখিয়ে কে’টে পড়ো। তুমি কিন্তু সালামি না দিয়ে আজ একদম ছাড় পাবে না। পালাবে আর কোথায়?”
মিশকাত ফিরেও তাকাল না। একদমই না শোনার ভান করে খুব ব্যস্ত পায়ে বাড়ির বাইরে চলে গেল।

গোরুর মাংস ভাগাভাগি করে বিলিয়ে দেওয়ার পর ছেলেরা সবাই হাত-মুখ ধুয়ে ঘরে এসে খেতে বসেছে। খাওয়া-দাওয়া শেষ হতে না হতেই শুরু হলো সালামি অভিযান। এই অভিযানে আগে নামল মেয়েগুলোই। আগে বড়োদের থেকে সালামি আদায় করে লাগল ভাইদের পেছনে। যাকে সামনে পেল তাকেই সালাম করে চেপে ধরল সালামির জন্য। মিশকাতের থেকে কোনোবারই কেউ এক পয়সা বের করতে পারে না। বের করবে কী? সে তো মানিব্যাগটাই বাড়িতে রেখে আসে। তারপর যখন সবাই সালামি চায়, তখন বলে, ‘আমি গরিব মানুষ। আমার টাকা তো দূর, মানিব্যাগ পর্যন্ত নেই। বিশ্বাস না হলে পকেট চেক করে দেখ।’
এবারেও সে একই কাজ করল। সবাই হতাশ হলেও আরিন্তা এবার নাছোড়বান্দা। সে কিছুতেই মিশকাতের পিছু ছাড়ছে না। এবার সে সালামি আদায় করেই ছাড়বে। ওদিকে মিশকাতের মা আয়েশা খাতুন মেরিনাকে ফোন করে বলেছে আরিন্তার ভাই-বোনদের নিয়ে তাদের বাড়ি পাঠাতে। পেলব গিয়েছিল খালার বাড়িতে মাংস দিতে, তাকেও বলে দিয়েছে সবাইকে নিয়ে আসতে। এমনিতেও সবার পরিকল্পনা ছিল বিকালের দিকে মিশকাতদের বাড়িতে যাবে। সেখান থেকে ইদের মেলা ঘুরতে যাবে। মিশকাতদের এলাকায় প্রতি ইদে বিশাল মেলা বসে। প্রত্যেকবারই তারা সবাই মিলে মেলায় যায়। বিকাল চারটায় আরিন্তারা সবাই মিশকাতের সঙ্গেই তাদের বাড়ি গেল। সেখান থেকে সামান্য কিছু খাওয়া-দাওয়া করে সুবর্ণাকে সাথে নিয়ে ছুটল মেলার উদ্দেশ্যে। বিশাল এক মাঠে মেলার আয়োজন। মাঠের চারপাশে বসেছে দোকান। ছোটোদের নানান রকম খেলনা, মেয়েদের সাজ-গোজের সরঞ্জাম, ঘরে ব্যবহৃত জিনিসপত্র, সবকিছুর দোকান বসেছে। নানান রকম মজাদার খাবারের দোকান তো আছেই। একপাশে আবার নাগরদোলা-ও বসেছে। মানুষের এত ভিড় যে, ঠেলাঠেলি করে ভেতরে ঠুকতে হয়। আরিন্তারা সবাই এক দোকানে ভিড় না জমিয়ে একেকজন একেক দোকানে ঢুকল। কারণ এক দোকানে সবাই ভিড় জমানো সম্ভব না। প্রত্যেক দোকানেই আগে থেকে ভিড় জমে আছে। এই সুযোগে আরিন্তা সুবর্ণাকে নিজের দলে টেনে মিশকাতের পেছনে লাগল। সুবর্ণাকে বলল মিশকাতের থেকে সালামি আদায় করবে। নিজের কিপটা ভাইয়ের থেকে সালামি পাওয়ার আশা নিয়ে সুবর্ণাও আরিন্তার সাথে তাল মিলিয়ে চলল। মিশকাত দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে ঘুরেঘুরে চারপাশের অবস্থা দেখছিল। আরিন্তা আর সুবর্ণা হাসিমুখে সামনে এসে উপস্থিত হতেই তার চোখ ছোটো হয়ে এল। সুবর্ণা কনুই দিয়ে আরিন্তাকে হালকা গুঁতা মে’রে ইঙ্গিত দিলো তাড়াতাড়ি মুখ খুলতে। কিন্তু আরিন্তার আগে মিশকাতই প্রশ্ন করে বসল,
“কী মতলব?”
সুবর্ণা উত্তর দিলো,
“আমরা মতলব না তো, তোমার বোন।”
আরিন্তা মিষ্টি করে হেসে বলল,
“মিশু ভাই, এখানে শুধু আমি আর সুবর্ণা আছি। আমাদের সালামিটা দিয়ে দাও, আমরা কাউকে বলব না।”
মিশকাত চোয়াল ঝুলিয়ে এমনভাবে তাকাল যেন ভিখারির কাছে ভিক্ষা চাওয়া হয়েছে। বলল,
“আমি কি উপার্জন করি, আমার পেছনে লেগেছিস সালামির জন্য?”
“আমি কি তোমার আস্ত মানিব্যাগটাই দিয়ে দিতে বলেছি? কটা টাকা সালামি দিবে, তা নিয়েও কিপটামি করো?”
“এটাকে কিপটামি না, অপচয় রোধ বলে। আমি ভালো ছেলে। যেখানে-সেখানে টাকা নষ্ট করি না।”
“আমাদের সালামি দিলে তোমার টাকা অপচয় হবে?”
মিশকাত দৃঢ় কন্ঠে বলল,
“অবশ্যই, কারণ সালামি দিয়ে তোরা কোনো মহান কাজ করবি না। হাতে পেলেই পেটে চালান করবি।”
“দাও না। দোআ করব তোমায়।”
“কী দোআ করবি?”
“যাতে তুমি অতি শীঘ্রই সুন্দরী একটা বউ পাও।”
“তোর দোআ ছাড়াই আমি অতি শীঘ্রই সুন্দরী বউ পাব।”
“এমন কিপটামি করো কেন?”
“টাকা নেই, আমি ফকির।”
সঙ্গে-সঙ্গে সুবর্ণা প্রতিবাদ করে বলে উঠল,
“মিথ্যা কথা বলো কেন? আব্বার দোকানে যে এ কদিন ইদের বেচা-কেনা করে দিলে, আব্বা তোমায় বাড়তি টাকা দেয়নি?”
মিশকাত কপাল কুঁচকে বলল,
“তোকে জিজ্ঞেস করেছে কেউ?”

আরিন্তা কিছুতেই হাল ছাড়তে রাজি না। সে ঠেলেঠুলে মিশকাতকে পাশের দোকানে ঢুকিয়ে বলল,
“সালামি লাগবে না। কিছু কিনে দাও।”
মিশকাত চোখ পাকিয়ে তাকালে আরিন্তা বলল,
“চোখ পাকিয়ে লাভ নেই। আমরা তোমায় মোটেও ভয় পাই না।”
মিশকাত তবু মোচড়া-মুচড়ি করছে। দোকান ভর্তি মানুষ তাদের কাণ্ড লক্ষ্য করে মুখ টিপে হাসছে। দুজনের পিড়াপিড়িতে শেষমেষ মিশকাত প্রশ্ন করতে বাধ্য হলো,
“কী কিনবি?”
সুবর্ণা সম্পূর্ণ নতুন ডিজাইনের সাজানো চুড়িগুলো দেখিয়ে বলল,
“আমি এই চুড়িগুলো কিনব।”
আরিন্তা গলার গহনা দেখিয়ে বলল,
“দেখো, এগুলো কী সুন্দর! আমি এর একটা নেব।”
মিশকাত বলল,
“বাইরে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়া। আমি কিনে আনছি। ঘ্যাঁন-ঘ্যাঁন করলে কিচ্ছু পাবি না।”

আরিন্তা আর সুবর্ণা অনিচ্ছা সত্ত্বেও দোকানের বাইরে বেরিয়ে এল। পাঁচ মিনিটের মাথায় মিশকাতও দোকান থেকে বেরিয়ে এল। তার হাতে একই রংয়ের দুমুঠো কাঁচের চুড়ি। আরিন্তা আর সুবর্ণা আহাম্মকের মতো তার হাতের চুড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। দুজনের হাতে দুমুঠো চুড়ি গুঁজে দিয়ে মিশকাত বলল,
“নে, আমার পকেট থেকে একশো বিশ টাকা দান করে দিলাম। সন্তুষ্ট থাক।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৯.
মেলায় সবার সাথে পাল্লা দিয়ে নাগরদোলায় চড়ে এখন আরিন্তার মাথা চক্রাকারে ঘুরছে। তাই আর বেশি দেরী না করে তাড়াতাড়ি তারা বাড়ি ফিরে এসেছে। বাড়ি ফিরে আরিন্তা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়েছে। তবে বেশিক্ষণ ঘুমাতে পারেনি। চাচাতো বোনের ছোট্ট মেয়েটার চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে গেছে। ঘুম থেকে উঠে টের পেল বাড়িতে মেহমানের সংখ্যা বেড়েছে। তার খালা, খালু আর মিশকাত এসেছে। সুবর্ণা বিকালেই তাদের সাথে চলে এসেছিল। আরিন্তাকে দেখেই সুবর্ণা ছুটে এল। তাকে দারুণ আনন্দিত দেখাচ্ছে। হাসিমুখে বলল,
“আপু, জানো কী হয়েছে?”
“কী?”
“এই দেখো।”

সুবর্ণা তার বাঁ হাত তুলে নেড়ে দেখাল। তার হাতে মেলায় পছন্দ করা সেই চুড়িগুলো। কিন্তু মিশকাত তো তখন এগুলো কিনে দেয়নি। আরিন্তা সুবর্ণার চুড়িগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে-দেখতে শুধাল,
“এগুলো আবার কখন আনলি?”
“ভাইয়া এনে দিয়েছে।”
“কখন?”
“জানি না। একটু আগে এসে হাতে ধরিয়ে দিলো।”
“ও।”
“তখন কিনে দিলে কী হত বলো তো? শুধু-শুধু ঢং করল।”

আরিন্তা ভাবছে তার জন্যও তাহলে গহনাটা এনেছে কি না। ভাবনা নিয়েই সে গেল মিশকাতের খোঁজে। মিশকাত পেলবের ঘরে সবার সাথে গল্পে মজে ছিল। আরিন্তা তার পেছনে গিয়ে দাঁড়াতেই সাইফুল বলে উঠল,
“আরি, ইদের দিন এত আনন্দ রেখে কেউ পড়ে-পড়ে ঘুমায়? এদিকে আয়, বোস এখানে।”
আরিন্তা একবার আড়চোখে মিশকাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
“বসব না। দাঁড়িয়েই থাকি।”

সবাই আবারও যার-যার মতো গল্পে মত্ত হলো। দুই মিনিটের মাথায় আরিন্তা বুঝতে সক্ষম হলো এরা দলবেঁধে রাতে ঘুরতে বেরোনোর পরিকল্পনা আঁটছে। আরিন্তা পেছনে দাঁড়িয়ে মিশকাতের চুল টান মা’রল বেশ কয়েকবার। প্রতিবারই মিশকাত ব্যথাগুলো গিলে নিল। ইচ্ছা হলেও সবার সামনে মুখ খুলতে পারল না। বিরক্ত হয়ে আরিন্তা যেভাবে এসেছিল, সেভাবেই আবার চলে গেল। তারপর থেকেই মিশকাত ছিল সুযোগের সন্ধানে। এক সুযোগে সে পকেট থেকে ফোন বের করে এমন একটা ভাব নিল, যেন তার অতীব জরুরী কল এসেছে। এক্ষুনি রিসিভ না করলে অনেক কিছু বন্যার জোয়ারে ভেসে যাবে। তার অজুহাত কেউ ধরতে পারল না। আরিন্তা টেবিলে বসে ছিল এক বাটি গোরুর মাংস নিয়ে। একমনে বসে সে কাঁটাচামচ দিয়ে মাংস মুখে পুরছে আর বাঁ হাতে ধরা মেরিনার ফোনের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। মিশকাতের ভ্রু কুঁচকে এল। ধীর পায়ে সে পেছন দিক দিয়ে এগিয়ে গেল। আরিন্তার পেছনে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল আরিন্তা তার বান্ধবীর সাথে ম্যাসেজে কথা বলছে আর এভাবে হাসছে। শেষ ম্যাসেজটায় আরিন্তা লিখেছে, ‘প্রেমিকগুলোর মাথায় কি এমনই গোবর ঠাসা থাকে?’

মিশকাত আরিন্তার মাথার পেছন দিকে টোকা মে’রে বলল,
“পোনি থেকে প্রেমিকবিশেষজ্ঞ হয়েছিস?”
আরিন্তা মাথা তুলে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে ফেলল। বলল,
“তোমাকে নিয়ে তো আর কথা বলছি না। ও ওর প্রেমিকের কথা বলছে। তোমাকে ডেকেছে কে?”
“একটু আগে প্যাঁচার মতো মুখ করে পেছনে দাঁড়িয়ে চুল টেনেছে কে?”
আরিন্তা ফোন রেখে নড়েচড়ে বসে প্রশ্ন করল,
“তুমি আবার মেলায় গিয়েছিলে?”
মিশকাত মাথা দুলিয়ে বলল,
“গিয়েছিলাম তো।”
“একা?”
“বন্ধুদের সাথে।”
“ওহ্।”
“কেন?”
“সুবর্ণা চুড়ি দেখাল, তাই জিজ্ঞেস করলাম।”

মিশকাত মাথা দোলাল। আরিন্তার মনে ঠিক কী চলছে, তা বুঝেও না বোঝার ভান করল। আরিন্তার মন খারাপ না হলেও কিঞ্চিত অভিমান হলো। সে-ও তা মিশকাতকে বুঝতে দিলো না। চুপচাপ কাঁটাচামচে মাংস গেঁথে মুখে পুরতে যেতেই মিশকাত ঝুঁকে পড়ে তার হাত টেনে নিয়ে মাংসের টুকরাটা নিজের মুখে পুরে নিল। আরিন্তা বাটি এগিয়ে ধরে শুধাল,
“খাবে?”
“তুই-ই খা। আমি তোর মতো রা’ক্ষস না। পেট ভর্তি।”

কথাটা বলেই মিশকাত আরিন্তার চুলে হালকা টান মে’রে দ্রুত কে’টে পড়ল। আরিন্তা চোখ-মুখ কুঁচকে মিশকাতের চলে যাওয়া পথে তাকিয়ে রইল। তারপর আবার ফোনে মনোযোগ দিলো। ম্যাসেজ সীন করে উত্তর না দেওয়ায় তার বান্ধবী লাগাতার ম্যাসেজ করেই চলেছে।

দীর্ঘ পরিকল্পনা শেষে সিদ্ধান্ত হলো সবাই মিলে বাইক রাইডে বেরোবে। ঘুরেফিরে রেস্ট্রন্টে খাওয়া-দাওয়া করে আসবে। এ কথা শুনে আরিন্তার ফুপি বিরক্ত মুখে বললেন,
“ইদের দিনে কী মর্জি শুরু করেছিস? বাড়িতে যে পাতিল ভর্তি রান্না হয়েছে, ওসব কে খাবে?”
পেলব বলল,
“ফিরে এসে ওসব সাবার করে ফেলব ফুপি। চিন্তা কোরো না।”
“বাইরে খেয়ে এসে তোরা আবার ঘরের খাবার শেষ করবি? বোকা পেয়েছিস আমাকে?”
মিশকাত হেসে বলল,
“কেউ না খেলেও আমাদের আরি রা’ক্ষসী আছে ফুপু। চিন্তার কোনো কারণ নেই।”
মিশকাতের কথায় মজা করে দু-একজন তাল মিলাল। আরিন্তা গাল ফুলিয়ে মিশকাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমার মাথা যে আস্ত আছে এটাই বেশি। কবে যেন ওটা-ও গিলে ফেলি।”

সবার ঘ্যানঘ্যানের চাপে পড়ে বড়োরা অনুমতি দিতে বাধ্য হলো। এরপর শুরু হলো মেয়েদের আরেক দফা সাজ-গোজের পালা। ওদিকে আরিন্তা সাজতে বসে তব্দা খেয়ে বসে আছে। তার সাজগোজের সরঞ্জামের মধ্যে মেলায় পছন্দ করা সেই গয়নাটা এল কোত্থেকে? মুহূর্তেই অবশ্য বুঝতে বাকি রইল না তাকে একটু চমকে দেওয়ার জন্যই এমন করা হয়েছে। খুশিমনে সেজেগুজে আরিন্তা নিচে এসে দেখল ছেলেগুলো একেকজন বিরক্ত মুখে অপেক্ষা করছে। সবার মাঝে আরিন্তা কেবল মিশকাতের চোখের দিকে তাকিয়ে হাসল। মিশকাত আরিন্তার ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হাসির রেখাটুকু দেখেই মনের উচ্ছাস টের পেল। মেয়েরা সবাই বেরিয়ে এলে খায়রুন নেসা বললেন,
“ওলো ঢংগীরা, রাইত-বিরাইতে এমন সাজগোজ কইরা ঘোরতে যাইতাছোস? মাইনষে দেখলে তো বিয়ার প্রস্তাব নিয়া আইব।”
পেলব বলল,
“ভালোই তো হবে দাদি। এই অছিলায় সবকটাকে বিদায় করা যাবে।”
আরিন্তা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“বুড়ি, তোমার নাতি নিজের সুবিধার লাইগা হা কইরা আছে। বুঝলা?”
খায়রুন নেসা হেসে বললেন,
“রঙ্গিলাও তো ভালোই সাজছে। আইজকা আমার নাতজামাই পিছন-পিছন বাইত আইব।”
মিশকাত উত্তর দিলো,
“দেখো গিয়ে তোমার নাতজামাই বাড়ির গেইটে অপেক্ষা করছে কি না।”

পেলব আর মিশকাত আগে থেকেই বাইকের ব্যবস্থা করে রেখেছিল। একেকটা বাইকে দুই বা তিনজন করে উঠল। সুবর্ণাকে মিশকাতের বাইকে উঠতে বললে সে কিছুতেই রাজি হলো না। কারণ ভাইয়ের সাথে থাকা মানেই বোবার মতো পথচলা। এই সুযোগে আরিন্তা খুব সমর্থন দেখিয়ে সুবর্ণাকে পেলবের বাইকে দিয়ে নিজে চড়ে বসল মিশকাতের বাইকে। মিশকাতের কাঁধে হাত রেখে হাসিমুখে নিচু স্বরে বলল,
“মিস্টার পোল্ট্রি, গেইটের সামনে এসে জামাই না পেয়ে খুবই দুঃখ বোধ করছি। তাই আপনার কাছে এলাম।”
“এখান থেকে সোজা কাজী অফিসে নিয়ে গিয়ে বিয়ের শখ মিটিয়ে দিবো।”
কথাটা বলেই মিশকাত বাইক স্টার্ট করল। সবাই পাশাপাশি বা সামনে-পেছনে বাইক চালাচ্ছে আর জোরো-জোরে কথা বলছে। মিশকাত ইচ্ছা করেই বাইকের স্পিড কমিয়ে সবার পেছনে বাইক চালাচ্ছে। আরিন্তা সামনের সবার কথা স্পষ্ট শুনতে না পেয়ে গোমড়া মুখে বলল,
“মিশু ভাই, তুমি ঠেলাগাড়ির স্পিডে বাইক চালাচ্ছ কেন?”
মিশকাত বলল,
“রকেটের স্পিডে চালাব? পেছন থেকে তুই হাওয়ায় উড়ে গেলে পরে যেন তোর বাপ আমাকে জেলে না ঢুকায়।”
“রকেটের গতিতে চালাতে যাবে কেন? সবাই যেমন চালাচ্ছে, তেমনভাবে চালাও। বাইকে বসে ঠেলাগাড়ির ফিল এলে ভালো লাগে?”
“ঠিক আছে। তাহলে তোকে রকেটের ফিলই দিচ্ছি। বসিস কিন্তু শক্ত হয়ে, উড়ে গেলে আমি নির্দোষ।”

মিশকাত বাইকের স্পিড বাড়াতে যাচ্ছিল। আরিন্তা আগেভাগেই দুহাতে তাকে চেপে ধরে বলল,
“একদম শ’য়তানি করবে না। আমি কিন্তু সাইফুল ভাইয়ার বাইকে চলে যাব।”
মিশকাত বলল,
“সাহস থাকলে যা। দেখি তারপর তোর সাইফুল ভাইয়া তোর হাত-পা কী করে আস্ত রাখতে পারে।”
“গুন্ডা সাজা হচ্ছে?”
“উঁহু, হিরো-হিরো ফিল হচ্ছে। বাইকের পেছনে বসে এক সুন্দরী এভাবে জাপটে ধরে রাখলে হিরো ফিল না এসে উপায় আছে?”
আরিন্তা সঙ্গে-সঙ্গে হাত সরিয়ে নিল। বিড়বিড় করে বলল,
“হিরোর বডিগার্ড এসেছে।”
মিশকাত ঘাড় একটুখানি ঘুরিয়ে বলল,
“ভুল বললি। হিরোইনের বডিগার্ড বললে মানা যেত।”

সামনে থেকে আরিন্তার চাচাতো বোন ঘাড় ঘুরিয়ে উচ্চস্বরে বলে উঠল,
“এই মিশকাত, তুমি অমন পেছনে পড়ে আছো কেন?”
আরিন্তা গলা উঁচিয়ে উত্তর দিলো,
“পেটে খাবার কম পড়ে গেছে, তাই মনে হয় শরীরে শক্তি নেই।”
“ইদের দিন পেটে খাবার কম পড়েছে?”
মিশকাত বলল,
“আরে না। পেছনে একটা জলহস্তী বসিয়েছি তো, তাই বাইক সামনে এগোতে চাইছে না।”

মিশকাতের কথা শুনে সবাই হু-হা করে হেসে উঠল। আরিন্তা মিশকাতের কোমরের কাছে গুঁতা মা’রল। মিশকাত ঠোঁট চেপে হাসছে। কিছুক্ষণ পর আরিন্তা মিশকাতের কাঁধের কাছে থুতনি ঠেকিয়ে ডাকল,
“মিশু ভাই, শোনো।”
মিশকাত সাড়া দিলো,
“হুঁ?”
“তুমি আমায় বললে না কেন ওই গয়নাটা এনেছ? আমাকে সরাসরি দিলে কী হত?”
“তাহলে কি আর এত অভিমান দেখা হত?”
“আমার অভিমান দেখতে বুঝি তোমার ভালো লাগে?”
“কী জানি!”
“ঢং না করে যখন চেয়েছিলাম, তখনই কিনে দিতে পারতে।”
“এনে দিয়েছি এটাই বেশি, শুকরিয়া আদায় কর। অন্য কোনো কথা থাকলে তা বল।”
“কী কথা বলা যায়?”
“কোনো কথা খুঁজে না পেলে বিয়ের কথা বল।”
“মাথায় শুধু ওই একটা শব্দই ঘোরে?”
“তো আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কেন কী কথা বলবি? তোর মতো রেডিওর আবার এই প্রশ্ন করা লাগে? চব্বিশ ঘন্টাই তো মুখ চলতে থাকে।”
“বিয়ে-বিয়ে করো, বিয়ের পর রেডিও শুনতে-শুনতে কালা হয়ে যাবে।”
“ওসব নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। আমার বউয়ের ব্যাপার আমি দেখে নেব। তুই নিজের চরকায় তেল দে।”
“বউটা কে হবে?”
“পোনি।”
“তাহলে এটা আমারো ব্যাপার।”

ইদের একদিন পর মিশকাতদের বাড়িতে সবার দাওয়াত পড়েছে। আয়েশা খাতুন নিজেই দাওয়াত করেছেন। বোনের আর্থিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে মেরিনা বারবার নিষেধ করেছিল, কিন্তু আয়েশা খাতুন শোনেননি। টাকা খরচ হলেও তার এবার দাওয়াত করার ইচ্ছা জেগেছিল। সারা বছর তো বোনের বাড়িতে খেয়েই গেলেন, খাওয়াতে আর পারলেন কই? গতকাল রাতেই শমসের খাঁন বাজার করে রেখেছিলেন। সকাল থেকেই আয়েশা খাতুন আর সুবর্ণা কাজে লেগে আছে।
আরিন্তারা আসতেও বেশি দেরী করেনি। মেরিনা আর তার ননদ সবাইকে তাড়া দিয়ে উপস্থিত হয়েছে দুপুরের আগেই। আয়েশা খাতুনের সঙ্গে হাতে-হাতে কাজও এগিয়ে দিতে লেগে পড়েছেন। মিশকাত দোকানে ছিল। এসেছে দুপুরের আজানের সময়। তখন বাড়ি ভর্তি মেহমান। নিজের ঘরটাও ফাঁকা পেল না। সেখানে সুবর্ণা, আরিন্তা আর তার দুজন চাচাতো, ফুপাতো বোন বিছানায় গোল হয়ে বসে লুডু খেলছে। সঙ্গে চিৎকার, চেঁচামেচি তো আছেই। মিশকাত দরজায় দাঁড়িয়ে বলল,
“কী করছিস তোরা এখানে?”
একসঙ্গে চার জোড়া চোখ পড়ল মিশকাতের ওপর।
আরিন্তা বলল,
“দেখতেই তো পাচ্ছ কী করছি।”
মিশকাত ঘরে ঢুকে বলল,
“হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি। এখন বেরো সব এখান থেকে।”
আরিন্তার চাচাতো বোন বলল,
“কেন ভাইয়া? আপনার ঘরে কি বউ আছে যে আপনি এলে বেরিয়ে যেতে হবে?”
“থাকতেও তো পারে।”
“অদৃশ্য ভূ’ত হয়ে থাকে?”
“ভূত না, পেত্মী। যেকোনো সময় তোদের ঘাড়ও মটকে দিতে পারে।”

আরিন্তা সূক্ষ্ম চোখে তাকাল। মিশকাত সেদিকে তাকিয়ে না থেকে পকেট থেকে ফোন, মানিব্যাগ বের করে রেখে জামা-কাপড় নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে-যেতে বলল,
“এসে যেন একটাকেও না দেখি এখানে।”

মিশকাত গোসল সেরে আসার আগেই অবশ্য লুডু খেলার সমাপ্তি ঘটল। আরিন্তা সময় দেখার জন্য টেবিলের ওপর থেকে মিশকাতের ফোন হাতে তুলে পাওয়ার বাটন অন করতেই সময়ের আগে লকস্ক্রিনে ভেসে ওঠা নোটিফিকেশনে চোখ আটকাল। রিমার ফেসবুক আইডি থেকে ম্যাসেজ, ‘আজ বিকালে একবার দেখা করতে পারবেন? আমি কলেজের সামনে অপেক্ষা করব।’
ফোনের পাসওয়ার্ড জানা সত্ত্বেও আরিন্তা ম্যাসেজ অন করে দেখার সুযোগ পেল না। বোনদের তাড়াতে ফোন জায়গামতো রেখে চলে যেতে হলো। কিন্তু তার মনের ভেতরের খচখচানি কমল না। রিমা মনে-মনে মিশকাতকে পছন্দ করে। এ কথা আরও এক বছর আগেই রিমার মুখেই সে শুনেছিল। কিন্তু মিশকাতকে বলার সাহস পায়নি বলে রিমা মিশকাতের সামনে মুখ খুলতে পারেনি। এমনকি রিমা ফোন কেনার পর মিশকাতকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টও পাঠিয়েছিল। কিন্তু মিশকাত আজ পর্যন্ত তাকে অ্যাকসেপ্ট করেনি। পছন্দের মানুষের ফ্রেন্ড লিস্টে ঝুলে থাকার দুঃখ রিমা কদিন আগেও আরিন্তার কাছে প্রকাশ করেছিল। তাহলে এখন মিশকাতের ফোনে রিমার ম্যাসেজ এল কোত্থেকে? এর মানে তো মিশকাত রিমাকে অ্যাকসেপ্ট করেছে, আর তাদের মধ্যে কথাও হয়। এই একটা কথার সূত্র ধরে আরিন্তা কিছুতেই নিজের মনকে শান্ত রাখতে পারল না। খাওয়ার আগ মুহূর্তে সুযোগ পেয়ে মিশকাতকে প্রশ্ন করে বসল,
“মিশু ভাই, রিমার সঙ্গে আপনার যোগাযোগ হয়?”
মিশকাত কপাল কুঁচকে উত্তর দিলো,
“তোর বান্ধবীর সাথে আমার কিসের যোগাযোগ হবে?”
“ওর তো ফোন আছে। আপনাকে ম্যাসেজ করে না?”
“ফোন থাকলেই আমাকে ম্যাসেজ করবে? মনের মধ্যে কী চলছে তোর? ব্যাপার কী? ভয়ে আছিস রিমা সুন্দরীর প্রেমে পড়ে যাই কি না?”
“এমনি জিজ্ঞেস করলাম।”
কথাটা বলেই আরিন্তা সরে গেল।
সূত্র মিলছে না। মিশকাত অস্বীকার করে আরও গুলিয়ে দিলো। মিশকাত তাকে মিথ্যা বলবে, এ যেন তার কল্পনাতীত ছিল। নিজের মস্তিষ্ক কেমন অগোছালো মনে হলো আরিন্তার। দুশ্চিন্তায় এত-এত খাবারের আয়োজনেও তার ক্ষুধা হারিয়ে গেল। খাবার দেখলেই পেটে ক্ষুধা অনুভব করা আরিন্তা কেবল সবার প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে বহু কষ্টে কয়েক লোকমা ভাত মুখে তুলল। সবাই অবাক হলে অজুহাত দেখাল তার পেটের মধ্যে সমস্যা হচ্ছে, তাই খেতে পারছে না। অথচ আসল সমস্যাটা তার মনে ছিল।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে