#বিয়ে_থা
#পর্ব- ৪১
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
বড়পর্ব- ৫
বিয়ের চার বছর পর নিনীকা প্রথম মা হয়েছে। হসপিটালের চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে দুটো ফ্যামিলি। নিনীকাকে কেবিনে শিফট করা হবে কিছুক্ষণ পর। তখনই সবাই দেখা করতে পারবে। ধ্রুব একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। একজন নার্স তোয়ালে তে মোড়ানো সদ্য জন্ম নেওয়া বাচ্চা তার দিকে এগিয়ে দিয়েছে।
‘ মিস্টার ধ্রুব মাহবুব আপনার ছেলেকে কোলে নিন। ‘
ধ্রুব কাঁপা কাঁপা হাতে ছেলেকে কোলে তুলে নিলো। নিষ্পাপ মোমের মতো মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো একদৃষ্টিতে। চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো বাচ্চাটির কপালে। ফাহিম মাহবুব পেছন থেকে ছেলেকে ধরে বসালেন। ধ্রুব নিজের বাবার দিকে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে জিজ্ঞেস করলো,
‘ এটা আমার ছেলে বাবা? ‘
ফাহিম মাহবুব মাথা নাড়ালেন।
‘ এটা তোর ছেলে ধ্রুব। আজ থেকে বহু বছর আগে ঠিক এভাবেই পৃথিবীতে এসে তুই আমাকে বাবা বানিয়ে দিয়েছিলি। সেদিন আমারও এমনই অনুভূতি হয়েছিলো। ‘
ধ্রুবর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটেছে। কাঁপা ওষ্ঠদ্বয় ছেলের কপালে চেপে ধরলো।
বাচ্চাটাকে একে একে সকলে কোলে নিলেন। রমজান শেখ কোলে নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন কিছুক্ষণ। আচমকা মিথিলাকে বললেন,
‘ দেখো মিথি ভাই আমাদের নিনীর গায়ের রঙ পেয়েছে। নিনীর গায়ে ফুলের ঠুকা লাগলে ও তো রক্তের মতো লাল হয়ে যায়। ওর ও কি তাই হবে? ‘
মিথিলা হাসবেন নাকি কাঁদবেন বুঝতে পারছেন না। ধ্রুব পাশে বসে বলল,
‘ আব্বু আমরা ওকে ফুলের ঠুকা থেকে বাচিয়ে রাখবো না-হয়। ‘
রমজান শেখ মাথা নাড়ালেন।
‘ ভাই কবে চোখ মেলে তাকাবে মিথি? ‘
‘ সদ্য ভূমিষ্ট হয়েছে। কয়েকদিন ঘুমাবে। তারপর পিটপিট করে তাকাবে। ‘
ধ্রুব ছেলের নরম কোমল হাতের আঙুল গুলো ছুঁয়ে দেখতে লাগলো।
‘ দেখতে একদম বাপের মতো হয়েছে। ‘
রমজান শেখের কথায় ধ্রুবর অদ্ভুত শান্তি লাগলো। এতো সেই ছেলেটা যাকে ধ্রুব স্বপ্নে দেখেছিল। যে ধ্রুবকে বাবা বলে ডেকে ছিলো।
নিরব এলো সবার শেষে। ধ্রুব ছেলেকে কোলে নিয়ে দেখিয়ে বলল,
‘ লুক ক্যাপ্টেন, এটা সেই যাকে আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম। আমার ছেলে! ‘
নিরব বিস্ময়কর দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ বাচ্চাটিকে দেখলো। কোলে নিতে গেলে ফারিন এসে নিজের কোলে নিয়ে নিলো।
‘ আমার ভাইপো কে সবাই কোলে নিচ্ছো কেন এতো? যে কোলে নিবে সে আগে হাত ওয়াশ করে আসবে। অন্যথায় কোলে নিতে দিবো না। ‘
নিরব অসহায় চোখে তাকালো। সে কর্মস্থল থেকে এসেছে। হাত ধোঁয়ার সময় বা ইচ্ছে কোনোটাই তার হয়নি।
ধারা নাতিকে নিজের কোলে নিয়ে বসলেন।
‘ কেউ কাড়াকাড়ি করবে না৷ দাদু ভাই ব্যথা পাবে। ‘
ফারিন ঠোঁট উল্টে বলল,
‘ আমার কাছে দাও মাম্মা। ‘
‘ একদম না, তুমি নিজেও মেডিকেল কলেজ থেকে এসেছো এখানে। হাত ওয়াশ করেছিলে? ‘
ফারিন চুপসে গেলো৷ ফাহিম মাহবুব মেয়েকে পাশে বসালেন।
‘ মন খারাপ করো না মা, কিছুক্ষণ চুপচাপ বসো। ক্লাস থেকে এসেছিলে কিছু খেয়েছো? ‘
ফারিন মাথা নাড়িয়ে না করলো।
‘ তবে চলো ক্যান্টিনে কিছু খেয়ে নিবে। ‘
ফাহিম মাহবুব মেয়েকে নিয়ে চলে গেলেন। ধ্রুব মায়ের পাশে বসে ছেলের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। লাল টুকটুকে ঠোঁট ফুলিয়ে ঘুমাচ্ছে তার ছেলে।
নিনীকাকে কেবিনে দিতেই ছেলেকে কোলে নিয়ে সবার আগে ধ্রুব ঢুকলো। ছেলেকে মায়ের বুকে ছেড়ে দিয়ে বউয়ের কপালে ঠোঁট চেপে রাখলো দীর্ঘক্ষণ। নিনীকার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো। ছেলের চোখেমুখে হাত ভুলিয়ে চুমুতে ভরিয়ে দিতে লাগলো। এতো নিষ্পাপ দেখতে পবিত্র শিশুটি তার!
‘ আমাদের ছেলে মিসেস। ‘
নিনীকা চোখে জল নিয়ে হাসলো,
‘ বাপের মতো দেখতে হয়েছে। ‘
‘ মায়ের মতো সুন্দর হয়েছে। ‘
ধ্রুব ছেলের কপালে চুমু দিলো।
‘ মাশাআল্লাহ আমার বাচ্চাটার নজর না লাগুক। ‘
নিনীকা ছেলেকে বুকের মধ্যে ধরে রাখলো। ধ্রুব বউ বাচ্চাকে দেখতে লাগলো। তার চোখেমুখে গভীর মায়া। নিনীকাকে পেয়ে তার রগচটা স্বভাব কোথায় উধাও হয়ে গেছে সে নিজেও জানে না। এবার আল্লাহ তাকে যা দিলেন সেটা সে কিভাবে রক্ষা করে সারাজীবন রাখবে সেটা এখন থেকেই চিন্তা করতে লাগলো।
একদিন পরই বউ বাচ্চা নিয়ে বাড়িতে ফিরে গেলো ধ্রুব। রুমে ঢুকে নিনীকা অবাক হতে গিয়ে ও হেসে ফেললো। পুরো রুমে বাচ্চাদের জিনিসপত্র। দোলনায় বাচ্চার জন্যে নরম বিছানা করা। খাটে বাচ্চার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখা।
ধ্রুব ছেলেকে দোলনায় শুইয়ে দিলো। শরীর থেকে কাপড় খুলে ফেললো। এই গরমে তার ছেলেটা নাহলে কষ্ট পাবে। নিনীকা বিছানায় বসে নিজের স্বামীকে মুগ্ধ চোখে দেখতে লাগলো। ধ্রুব কখন যে পাশে বসেছে খেয়ালই করেনি।
‘ এভাবে তাকিয়ে কি দেখছো মিসেস? ‘
নিনীকা চোখ তুলে তাকে দেখলো।
‘ তোমাকে নতুন রুপে দেখছি। তোমার বাবা রুপ দেখছি।
ধ্রুব নিনীকাকে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে।
‘ তোমাকে ঠিক কি দিলে আমি তৃপ্তি পাবো বুঝতে পারছি না মিসেস। তুমি আমাকে কি দিয়েছো তুমি জানো না। আমার মনে হচ্ছে এই দুনিয়ায় আমার আর কিছু চাওয়ার নেই। আমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ বানিয়ে দেওয়ার জন্যে তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসা। সারাজীবন ধ্রুবর ভালোবাসায় থেকে যেও। ‘
‘ দুজনের চেষ্টাতেই তো আমরা আজ মা বাবা হয়েছি। তুমি ছাড়া আমি কি কখনো মা হতে পারতাম? এখানে তোমার ভূমিকাও ছিল। সুতরাং আমাকে এতো মুখের ভালবাসা না দিয়ে বুকে জড়িয়ে ভালোবাসা দাও। দেখবে খুশি হয়ে গেছি। ‘
ধ্রুব হেসে ফেললো,
‘ তুমি তো সারাক্ষণ বুকেই থাকো মেয়ে। ‘
–
সাত আট দিন পুরোদমে ঘুমিয়েছে বাচ্চা টা। তারপর থেকেই মাঝে মধ্যে পিটপিট করে তাকিয়ে থাকতো। ঘুমের রেশ তখনো কাটেনি। দশ মিনিট তাকিয়ে থাকলে চার ঘন্টা ঘুমিয়ে কাটাতো। ধ্রুব কাজে থাকলে নিনীকা ভিডিও কলে ছেলেকে দেখাতো। কখনো তাদের ফটো ফ্রেম দেখিয়ে ছেলেকে বুঝাতো এটা তোমার বাবা। এটা তোমার মা।
কাজ থেকে ফিরে ধ্রুব সারাক্ষণ ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে থাকতো। ছেলে যখন পিটপিট করে তাকিয়ে তাকে দেখতো তখন তার অদ্ভুত অনুভূতি হতো। চোখ আবেগে ভিজে যেতো। নিনীকা পাশে বসে বাবা ছেলের কাহিনি দেখে হাসতো।
*
‘ বা বা বা বা..’
মেঝেতে হামাগুড়ি দিয়ে নিষ্পাপ শিশুটি নিজের বাবাকে ডাকছে। ঠিকঠাক হামাগুড়ি দিতেও শিখেনি। তবুও কতো চেষ্টা তার বাবার কাছে যাবেই।
ধ্রুব মেঝে থেকে ছেলেকে কোলে তুলে নিলো। বুকে জড়িয়ে মুখের সাথে মুখ লাগাতেই ছেলেটি তার মুখে লালা লাগিয়ে দিয়ে বাবার প্রতি নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করছে৷
রান্নাঘর থেকে ছেলের জন্য পাতলা খাবার নিয়ে ডোয়িং রুমে এলো নিনীকা। ছেলেকে বাবার কোলে দেখে নিজের কোলে নিতে হাত পাতলো।
‘ দিব্য আমার সোনা ছেলে, মাম্মার কোলে আসো। বাবা কাজে যাবে বাচ্চা। ‘
দিব্য শুনলো কি না বুঝা গেলো না। বাবার কাঁধে মাথা রেখে পিটপিট করে মাকে দেখতে লাগলো।
‘ দিব্যকে আমার কোলে দিয়ে চলে যাও। নিজ থেকে কোনদিন তোমাকে ছাড়ে ও? ‘
ধ্রুব ছেলের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে। দিব্য বাবার নেওটা। ধ্রুব যদি এখন জোর করে কোল থেকে নামিয়ে রেখে চলে যায় তবে চিৎকার করে কেঁদে বাড়ি মাথায় তুলবে। সারাদিন ‘বা বা বা বা’ করে অভিযোগ করবে।
ধ্রুব ছেলেকে রেখে কোথাও যেতে চায় না। ছেলেটাও বাপের জন্য পাগল। নিনীকা জোর করে কোলে নিলো। দিব্যর গালে চুমু দিয়ে বলল,
‘ বাবাকে টাটা দাও সোনা। ‘
দিব্য দিনদুনিয়া ভাসিয়ে কাঁদতে শুরু করলো। ধারা নাতিকে কোলে নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন। নিনীকা ধ্রুবর ক্যাপ ঠিকঠাক করে দিলো।
‘ মুখটা অমন করে রেখেছো কেন? ‘
ধ্রুব বউয়ের কপালে আদর দিলো।
‘ দিব্যকে দেখে রেখো। আমি তাড়াতাড়ি ফিরবো আজ।’
*
ফারিন বিকালে মেডিকেল কলেজ থেকে ফিরলো। সে এইবার মেডিকেল সেকেন্ড ইয়ারে।
বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে তার প্রথম কাজ দিব্যকে কোলে নেওয়া৷ প্রতিদিনকার মতো ভাইপোকে কোলে নিতে সে ভাইয়ের রুমে গেলো।
দিব্য বিছানায় বসে চারিদিকে ছড়িয়ে দেওয়া খেলনাগুলোকে তাবা দিচ্ছে। মাঝে মধ্যে ঠোঁট উল্টে নিজের ঘুমন্ত মাকে দেখছে। কখনো বা নিনীকার উপরে উঠে মুখে লালা লাগিয়ে আদর করে ডাকছে,
‘ মা ম ম মা…’
নিনীকা ঘুমের মধ্যে ছেলেকে পাশে শুইয়ে মাথায় হাত ভুলিয়ে দিলেও দিব্য উঠে বসে একই কাজ করছে। ফারিন দরজায় দাড়িয়ে হেঁসে ফেললো। এগিয়ে এসে কোলে তুলে নিলো দিব্যকে। দিব্য ফুপিকে দেখে হয়তো খুশি হলো। ছোট ছোট হাত দিয়ে ফারিনের চুল টানতে টানতে ডাকতে লাগলো,
‘ ফু ফু ফু…’
ফারিন গালে শব্দ করে চুমু খেলো। মাথার চুল এলোমেলো করে দিলো। যে-ই না রুম থেকে বের হবে ওমনি হাজির হলো ধ্রুব।
আর্মি ইউনিফর্ম পরিহিত ধ্রুব রুমে ঢুকেই ছেলেকে সম্মুখে দেখে খুশি হলো। ডাকলো,
‘ দিব্য…’
দিব্য তার বাবার গলা চিনে। ঘাড় ঘুরিয়েছে তৎক্ষনাৎ। বাবাকে দেখতে চেয়ে শব্দ তুলে হাসছে। ফারিনের কোল থেকে হাত বাড়িয়ে ডাকছে,
‘ বা বা বা বা…’
ফারিন দিব্যকে হঠাৎ পাল্টি খেতে দেখে চোখমুখ কুঁচকে ফেললো।
‘ আমি মাত্রই দিব্যকে কোলে নিয়েছি ব্রো, তুমি এখন তাকে পাবে না। তাছাড়া ও তুমি ফ্রেশ হওনি এখনো৷ ‘
ফারিন দিব্যকে নিয়ে চলে গেলো। দিব্য চিৎকার করে কাঁদছে। নিনীকা তড়িৎ গতিতে উঠে বসেছে৷ আশেপাশে তাকিয়ে ছেলেকে খুঁজলো৷ ধ্রুব বউয়ের ফুলোফুলো গাল টেনে দিলো।
‘ তোমার ননদীনি নিয়ে গেছে৷ ফ্রেশ হয়ে যেনো আমার ছেলেকে রুমে পাই৷ নিয়ে এসো যাও৷ ‘
নিনীকা বিপাকে পড়লো৷ ধ্রুব ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে দেখলো নিনীকা তখনো বসে আছে৷
‘ দিব্যকে আনতে বলেছিলাম না মিসেস? ‘
‘ কিভাবে আনবো, ফারিন মন খারাপ করবে তো। তার চেয়ে নিচে চলো। ও খাবে তুমিও খাবে। দিব্যকে তখন নিয়ে নিও। ‘
ধ্রুব মেনে নিলো। নিনীকার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো নিচে।
ফারিন দিব্যকে টেবিলের উপর বসিয়ে দিয়েছে। দিব্য চামচ দিয়ে প্লেটে নাড়াচাড়া করছে। মাঝে মধ্যে মুখে চামচ ঢুকিয়ে বলছে,
‘ বা বা উম..’
ফারিন ভাইপোর গাল টেনে দিলো,
‘ ফু ফু উম বলো দিব্য সোনা। ‘
ধ্রুব টেবিলের উপর থেকে ছেলেকে কোলে তুলে নিলো তৎক্ষনাৎ। দিব্য বাবাকে দেখে খুশি হলো। কাঁধে মাথা এলিয়ে ডাকতে লাগলো আদুরে স্বরে।
‘ বা বা বা বা বা…’
দিব্যকে কোলে নিয়েই খেতে বসলো ধ্রুব। ফারিন হিসহিসিয়ে বলল,
‘ ওরে বেঈমান, ওরে বিশ্বাসঘাতক। বাবাকে পেয়ে ফুপিকে ভুলে গেলি! ‘
ধ্রুব শব্দ করে হেসে ফেললো।
‘ তোর কোনো দাম নেই দেখেছিস? যা ভাগ। ‘
দিব্য বাবার মুখ দু’হাতে ধরতে চেষ্টা করছে। ছোট্ট হাতে ধ্রুবর মুখ বড্ড ভারী লাগছে৷ ধ্রুব নিজেই ছেলের মুখের সাথে মুখ লাগালো।
‘ কি হয়েছে আমার দিব্যর? ‘
দিব্য বাবার মুখে হা করে লালা লাগিয়ে ফেলছে।
‘ বা বা বা বা উম…’
নিনীকা হাত বাড়ালো,
‘ মাম্মার কোলে আসো সোনা, বাবা খাবে এখন। ‘
ধ্রুব বাঁধা দিলো,
‘ আমার কোলেই থাক, খেতে অসুবিধা হবে না। ‘
‘ তোমার মুখ ভরিয়ে দিচ্ছে তো। ‘
‘ দিক। ‘
–
রাতে ঘুমাতে গিয়ে অনেক কাহিনি হয়। দিব্য কখনো সারারাত ঘুমায় না। আজ দিব্য ঘুমাচ্ছে না। নিনীকা ছেলেকে বুকে নিয়ে মাথায় হাত ভুলিয়ে দিচ্ছে। দিব্য মায়ের দুগ্ধ পান করছে। ধ্রুব নিনীকার উপর নিজের শরীরের ভর ছেড়ে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে আছে। দুজনের ভারে নিনীকা চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছে।
‘ দিব্য ঘুমিয়েছে? ‘
নিনীকা কিছু বলতে নিলো তার আগেই দিব্য ডেকে উঠলো,
‘ বা বা বা বা উম…’
ধ্রুব ছেলের পিঠে হাত ভুলাতে লাগলো।
‘ খাও বাবা,, খেয়ে ভালো ছেলের মতো ঘুমিয়ে পড়ো। ‘
দিব্য উঠে বসেছে। হামাগুড়ি দিয়ে ধ্রুবর পিঠে উঠে বসলো। ধ্রুব যেমন হাত পা ছড়িয়ে নিনীকার উপর শুয়ে আছে তেমন করে দিব্যও বাবার উপর শুয়ে পড়লো। ধ্রুবর উন্মুক্ত পিঠে মুখের লালা লাগিয়ে ডাকতে লাগলো,
‘ বা বা বা বা বা…’
নিনীকা হেসে ফেললো।
‘ নাও এবার ছেলেকে ঘুম পাড়াও আগে। ‘
ধ্রুব হাত বাড়িয়ে ছেলেকে টেনে নামালো। পড়োনের ছোট্ট গেঞ্জি খুলে দিলো। এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিয়ে ছেলেকে নিনীকার পেটের উপর শুইয়ে দিলো। পেটে আস্তে করে চাপড় দিতে লাগলো যাতে ঘুমিয়ে পড়ে।
দিব্য হাত দিয়ে ধ্রুবর গলা জড়িয়ে ধরলো। ধ্রুব হার মেনে ছেলেকে নিয়ে নিনীকার উপর থেকে সরে গেলো। দিব্য বাবার বুকে শুয়ে আরামে চোখ বন্ধ করলো। বাবাকে আশ্চর্য করে দিয়ে ঘুমিয়ে ও পড়লো।
ধ্রুব ঘুমন্ত দিব্যর পুরো মুখে চুমু খেলো।
‘ আমার আদুরে বাচ্চা, ঠিক যেনো ছোট্ট বিড়ালছানা। ‘
‘ সাথে বাবার নেওটা। ‘
ধ্রুব হাসলো,
‘ আমার ছেলে তো আমার নেওটা-ই হবে মিসেস। ‘
ধ্রুব ছেলেকে দোলনায় শুইয়ে দিলো। বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে হাত বাড়িয়ে নিনীকাকে আহ্বান করলো।
‘ সারাদিন কাছে পাই নি। এবার কাছে আসো। ‘
রাত্রির শেষ প্রহরে ধ্রুব যখন ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়েছে, তখনই দিব্য জেগে উঠলো। নিনীকা ছেলেকে বিছানায় এনে শুইয়ে দিয়েছিলো। দিব্য ঘুম ভাঙার সাথে সাথে মায়ের বুকের উম পেয়ে কিছুক্ষণ শান্ত রইলেও একটু পর বা বা বা বলে ডাকতে লাগলো ধ্রুবকে।
নিনীকার পেট জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে ধ্রুব। ক্লান্ত ঘুমন্ত স্বামীর জন্য নিনীকার বড্ড মায়া হলো। দিব্যকে ঘুম পাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করলো। কিন্তু দিব্য আর ঘুমাবে না। ভোরের আগে ঘুম ভাঙলে সে আর ঘুমায় না। দিনের আলো ফুটে গেলে ধ্রুব কাজে চলে গেলে তারপরই ঘুমায়। যদি কালেভদ্রে ভোরের আগে ঘুমিয়ে যায় তো সেদিন নিনীকা স্বস্তি পায়। সেইসব দিন দিব্যর ঘুম ধ্রুব যাওয়ার পরই ভাঙে।
নিনীকা ঠিক করলো ছেলেকে নিয়ে রুমে কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি করবে। ধ্রুবর বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করলো। দিব্য তখন ও ডাকছে,
‘ বা বা বা বা…’
ধ্রুব জেগে গেলো। নিনীকাকে শক্ত করে ধরলো।
‘ কোথায় যাচ্ছো মিসেস? ‘
‘ দিব্যকে নিয়ে হাটাহাটি করবো, তুমি ঘুমাও লক্ষীটি। ‘
ধ্রুব ভালো করে তাকাতে পারছে না।
‘ দিব্যকে আমার পিঠে ছেড়ে দাও, ও এমনি শান্ত হয়ে যাবে। তুমিও ঘুমিয়ে পড়ো। ‘
নিনীকা তাই করলো। দিব্য বাবার পিঠে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো। মুখ গালে লালা লাগিয়ে ফেললো। ধ্রুবর মুখ থেকে সেটা গড়িয়ে নিচে থাকা নিনীকার গলায় পড়তে লাগলো। ক্লান্ত নিনীকা ও ঘুমিয়ে পড়েছে। ধ্রুব চোখ বন্ধ রেখেই হাত উপরে তুলে ছেলের পিঠে চাপড় দিতে লাগলো। দিব্য বাবার পিঠে নিজে নিজে খেলা করলো অনেকক্ষণ। ভোরের আগে ঘুমিয়ে ও পড়লো।
সকালে দিব্য জাগলো না। ধ্রুব ঘুমন্ত ছেলের মুখে অজস্র আদর দিলো। নিনীকাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বাহিরে এলো। এ সময় বাড়ির সবাই ঘুমে থাকে।
জিপগাড়িতে উঠে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বলল,
‘ দিব্য উঠলে কল করো, নাহলে কান্না করবে। ‘
‘ সাবধানে যাও, পৌঁছে ফোন দিও। ‘
ধ্রুব চলে গেলো। সেদিন দিব্য ঘুম থেকে উঠে বাবাকে না পেয়ে চিৎকার করে কাদলো। নিনীকা ধ্রুবকে ভিডিও কল করে ছেলের হাতে মোবাইল ধরিয়ে দিলো। স্কিনে বাবাকে দেখতে পেয়ে দিব্য ঠোঁট ভেঙে কাঁদতে কাঁদতে ডাকলো,
‘ বা বা বা বা আ আ আ..’
ধ্রুব ছেলেকে বুঝ দিলো।
‘ বাবা আসবো তো দিব্য, তুমি ততোক্ষণ মায়ের বাধ্য ছেলে হয়ে থাকো কেমন? ‘
দিব্য বাবার কথা বুঝলো কি না কে জানে। ঠোঁট উল্টে মোবাইল হাত থেকে ছেড়ে দিলো। বালিশে মুখ গুজে পড়ে রইলো।
নিনীকা মোবাইল হাতে নিলো।
‘ দেখো তোমার ছেলেকে। এখনো ঠিকঠাক কথা বলতে শিখেনি, হাঁটতে শিখেনি। কিন্তু বাবার প্রতি অভিমান করতে শিখেছে। ‘
নিনীকা ছেলেকে কোলে তুলে নিলো।
‘ দিব্য দেখো বাবা তোমাকে ডাকে। ‘
দিব্য হাত বাড়িয়ে ডাকলো,
‘ বা বা বা আ আ..’
নিনীকা ছেলের গালে চুমু খেলো। ধ্রুবকে মিছে রাগ দেখালো।
‘ শয়তান লোক, আমার ছেলেকে কাঁদায়। দিব্যর বাবাকে অনেক বকে দিবো আমরা কেমন? ‘
(চলবে)
#বিয়ে_থা
#পর্ব- ৪২
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
বড়পর্ব- ৬
ভোরে ঘুম ভাঙার পর ধ্রুব সবার প্রথমে ফ্রেশ হয়ে নামাজ আদায় করে। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। নিনীকাকে ডেকে তুললো। দিব্য আগেই বাবার সাথে উঠে পড়েছে। নিনীকাকে তুলে বউ বাচ্চা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো ধ্রুব।
নিনীকা আগে বের হয়ে দুটো জায়নামাজ বিছিয়ে নিয়েছে। ধ্রুব ছেলেকে কোলে নিয়ে বের হলো। নিনীকা দিব্যর শরীর মুছিয়ে দিলো। দিব্যকে তার বাবার মতো শুভ্র পাঞ্জাবি পড়ালো। ধ্রুব ছেলের মাথায় টুপি পড়িয়ে দিয়ে নিজের সাথে জায়নামাজে বসালো।
দিব্য ভালো করে হামাগুড়ি দিতে পারে এখন। মাঝে মধ্যে উঠে দাড়িয়ে থাকে কিছু সেকেন্ড। তারপর ঠাস করে পড়ে যায়।
ধ্রুব যখন জায়নামাজে দাড়িয়েছে তখন সেও দাড়াতে চেষ্টা করলো। কিছু সেকেন্ড পর ঠাস করে পড়ে গেলো। খিলখিল করে হেসে বাবার পিঠে উঠতে চেষ্টা করলো। একসময় পিঠে উঠে গলা জড়িয়ে ধরে ঝুলে রইলো।
নামাজ শেষ করে ধ্রুব ছেলেকে পিঠ থেকে নামিয়ে দোয়া পড়ে কপালে ফু দিলো। নিনীকা নামাজ পড়ে উঠতেই তার কপালেও দোয়া পড়ে ফু দিয়ে দিলো।
বাগানে মা বাবার হাত ধরে হাঁটতে শিখছে দিব্য। এক পা ভালো করে ফেলতে না পারলেও তার খুশির সীমা নেই। পেছনে ধারা ও ফাহিম দাড়িয়ে আছেন। দিব্য মা বাবার হাত ধরে জবা ফুলের গাছটার কাছে চলে গেলে তারা সেখান থেকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসছেন দুদিকে ধরে। কখনো মা বাবা কখনো দাদা দাদির হাত ধরে পা ফেলতে চেষ্টা করছে সে। ফারিন বসে বসে দেখছে। দিব্য হাসলে সকলে হাসছে।
–
তারপরের দৃশ্যটি নিত্যদিনকার। ধ্রুব উদাম শরীরে টাউজার পড়ে বুক ডাউন দিচ্ছে। পিঠে দিব্য বাবার গলা জড়িয়ে ধরে ঝুলে আছে। ধ্রুবর নিচে নিনীকা বুক ডাউন দিতে চেষ্টা করছে। মাঝে মধ্যে ধ্রুবর সাথে পাল্লা দিতে না পেরে চিৎ হয়ে পড়ে যাচ্ছে। ধ্রুব তখন বুকে হাত রেখে রক্ষা করছে তো কখনো দু’হাতে শক্ত করে ধরে বুক ডাউন দিতে শেখাচ্ছে।
দিব্য হঠাৎ করে নিনীকাকে ডাকলো,
‘ মা ম ম মা..’
নিনীকা সোজা হয়ে শুয়ে পড়লো। ধ্রুব নিজেও শরীর এলিয়ে দিলো। নিনীকা হাত বাড়িয়ে ছেলেকে বুকে টানলো। দিব্য মায়ের বুকে আরামে চোখ বন্ধ করে খাচ্ছে৷
ধ্রুব ছেলের পিঠে হাত ভুলিয়ে দিতে লাগলো।
‘ মিসেস চলো কোথাও ঘুরে আসি। ছুটিতে আছি তো। ‘
নিনীকা দিব্যর মুখ তুলে বলল,
‘ দিব্য কি নানু বাসায় যেতে চায়? ‘
দিব্য মায়ের কথা বুঝেনি। তবে নানু ভাইকে সে চিনে। বললো,
‘ না ন না ন না..’
‘ চলো দিব্যর আব্বু দিব্যর নানু বাসায় যাই? ‘
ধ্রুব বাচ্চা ও বাচ্চার মাকে জড়িয়ে ধরলো।
‘ দিব্য ও দিব্যর আম্মু যখন চাইছে তবে তো যেতেই হয়।’
*
শেখ বাড়ির গেইট দিয়ে ধ্রুবর জিপগাড়ি ঢুকলো। সদর দরজা দিয়ে ছুটে এলেন মিথিলা৷ নিনীকার কোল থেকে নিয়ে নিলেন দিব্য কে।
দিব্য হাসছে। মিথিলার মুখে হাত দিয়ে ডাকলো,
‘ আ প প পা..’
মিথিলা পুরো মুখে চুমুতে ভরিয়ে দিলেন। রমজান শেখ নাতি আসার খবর পেয়ে আজ অফিসে যাননি। মিথিলার পেছনে দাড়িয়ে দিব্যর থুতনি টেনে দিলেন।
‘ আমার ভাই এসেছে যে। ‘
দিব্য হাত তালি দিলো। রমজান শেখের দিকে হাত বাড়ালো। নানা ভাইয়ের কোলে উঠে মুখে মুখ লাগিয়ে আদর দিলো।
‘ না ন ন না..’
‘ কেমন আছে আমার ভাইটা? ‘
দিব্য শুধু হাসে। তার গলা দিয়ে হাসির সাথে সাথে এক ধরনের চিৎকার বের হচ্ছে। সে যে দারুণ উচ্ছ্বসিত ও খুশি তা বুঝিয়ে দিচ্ছে।
ধ্রুব হাতের সব মিষ্টান্ন সার্ভেন্টদের কাছে দিলো। মিথিলাকে সালাম দিয়ে রমজান শেখের পাশে দাঁড়ালো।
‘ আসসালামু আলাইকুম আব্বু, কেমন আছেন? ‘
রমজান শেখ উত্তর দিয়ে নাতি ও মেয়ে জামাইকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকলেন। পেছনে নিনীকা নাক ফুলিয়ে মিথিলাকে বলল,
‘ তোমার বর তো দেখি আমাকে ভুলে গেছে। তার যে একটা মেয়ে আছে তা কি সে জানে না? ‘
মিথিলা মেয়ের কাঁধ জড়িয়ে নিয়ে যেতে লাগলেন।
‘ তোর বাবার নাতি পেলে কি আর কারো দিকে খেয়াল থাকে? ‘
*
নরম বিছানায় মায়ের দু-হাত ধরে লাফালাফি করছে দিব্য। মুঠোফোনে বেজে চলেছে দিব্যর প্রিয় কার্টুন গান ‘শাক।’
তন্মোধ্যে দরজা দিয়ে ঢুকলো ধ্রুব। বউ বাচ্চাকে দিনদুনিয়া ভুলে লাফাতে দেখে হেসে ফেললো। বাবাকে দেখে হাত বাড়িয়ে হেঁটে আসতে চাইলো দিব্য। পারলো না। বিছানায় বসে পড়লো ধপাস করে৷ ধ্রুব এগিয়ে এসে ছেলেকে কোলে তুলে নিলো। দিব্য বাবার বুকে মুখ লুকিয়ে ডাকলো,
‘ বা বা..উম ‘
ধ্রুব বিছানায় চিপসের প্যাকেট ছড়িয়ে দিলো। দিব্যকে বসিয়ে দিলো মাঝে। দিব্য তাবা দিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলো সব।
নিনীকার কোমড়ে টান পড়লো।
‘ বাড়ি যেতে হবে না ম্যাডাম? ‘
নিনীকা গলা জড়িয়ে ধরলো,
‘ যাবো তো, সন্ধ্যায় যাই? বাবা অফিস থেকে তাড়াতাড়ি চলে আসবেন। আমাকে কি যেনো বলবেন বলেছিলেন আজ। ‘
‘ ঠিক আছে। ‘
শেখ বাড়িতে তিনদিন হয়ে গেলো এসে। ধারা বার-বার ফোন দিয়ে নাতিকে নিয়ে আসতে বলছেন। দিব্যকে ছাড়া কারোরই ভালো লাগে না।
রমজান শেখ বিকালে ফিরলেন। সোফায় বসা স্ত্রী, কন্যাকে বললেন,
‘ আমার তো উত্তরাধিকার বলতে একমাত্র তুমিই নিনী৷ আমার পরে সেজন্য তোমাকেই সব দেখতে হবে মা। তুমি তো পড়াশোনা শেষ করে দেড় বছরের মতো পাইভেট কোম্পানিতে জব করেছো। সেজন্য তোমার তেমন অসুবিধা হবে না বিজনেস সামলাতে। যদি কিছু না বুঝো তো বুঝিয়ে দিতে আমি আছি। তবে হালটা এখনই ধরতে হবে তোমায়। ধীরে ধীরে তোমাকে সবকিছু বুঝিয়ে দিতে পারলেই আমার শান্তি। কবে কার কি হয়ে যাবে বলা তো যায় না! ‘
নিনীকা কিছু সময় চুপ থাকলো। তারপর বলল,
‘ মাকে সব বুঝিয়ে দাও বাবা, তোমার পরে সেই সবকিছুর দায়িত্ব নিবে৷ ‘
রমজান হাসলেন,
‘ এই সহজ সরল রমনী কি বিজনেস বুঝতে পারবে? তবে তাকেও বুঝাতে চেষ্টা করবো। কিন্তু অফিসে এমডির আসনে তোমাকেই বসতে হবে আমার পর। ‘
মিথিলা রেগে বললেন,
‘ তোমার পর মানে কি? তুমি কি আমাদের ফাঁকি দিয়ে চলে যেতে চাইছো কোথাও? ‘
‘ আরে কি বলো, বয়স তো কম হয়নি। তোমাদের এখন যদি সব বুঝিয়ে না দেই তো কবে দিবো? ‘
‘তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছো আমরা সেম বয়সের। তুমি আমার থেকে অনেক ফিট। সুতরাং পরপারে যদি যেতে হয় তো তোমার আগে আমি-ই যাবো। সুতরাং তোমার মেয়েকেই সব বুঝিয়ে দাও। ‘
‘ তোমাকেও এখন থেকে আমার থেকে বিজনেস বুঝতে হবে। বয়স বা ফিটনেস কখনো একটা মানুষের আয়ু ধরে রাখতে পারে না। ‘
মিথিলা হার মানলেন,
‘ ঠিক আছে। ‘
ধ্রুবরা সন্ধ্যায় বউ কথা কও-তে ফিরে গেলো। নিনীকা দৃদিন পর থেকেই ছেলেকে নিয়েই অফিসে যেতে শুরু করে। একমাসে সে বিজনেসের অনেক কিছুই আয়ত্ত করতে পেরেছে। কোনো জরুরি মিটিংয়ে নিনীকা ও মিথিলাকে রমজান শেখের সাথে থাকতে হয়৷
*
মেডিকেল কলেজের সামনে দাড়িয়ে উঁকিঝুকি দিচ্ছে এক যুবক। ফারিন পেছন থেকে মাথায় টুকা দিলো। যুবকটি হাসার চেষ্টা করে বলল,
‘ মিস ফারিন আপনি? ‘
ফারিন চোখ ছোটছোট করে তাকালো।
‘ হাঁটুর বয়সী মেয়েকে ইভটিজিং করতে লজ্জা করে না? আপনি না ক্যাপ্টেন? ‘
নিরব অসহায় চোখে তাকালো।
‘ আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন। ‘
‘ তাই নাকি? তবে আপনি কি জন্য এসেছেন শুনি! ‘
‘ মাকে নিয়ে এসেছিলাম ডক্টরের কাছে। ‘
‘ স্যরি বিশ্বাস করলাম না। কচি মেয়ে বিয়ে করার শখ বাদ দিন। নেক্সট টাইম যেন এখানে আর উঁকিঝুঁকি দিতে না দেখি! ‘
নিরব অকপটে বলল,
‘ কচি মেয়ে বিয়ে করার শখ বাদ দেওয়া যাবে না ম্যাডাম। বাদ দিলে এতোদিনে আমারও ধ্রুব স্যারের মতো সন্তান থাকতো হয়তো। ‘
ফারিন কোমড়ে দুহাত রেখে চোখ গরম করে তাকালো।
‘ কোন কচি মেয়ে বিয়ে করবে আপনাকে? ‘
‘ কারো করতে হবে না। ‘
নিরব গটগট করে হেঁটে চলে গেলো গাড়ির কাছে। কিছুক্ষণ পর মেডিক্যাল থেকে নিরবের মাকে বের হতে দেখলো ফারিন। ভদ্রমহিলা গাড়িতে উঠে বসেছেন।
বিকেলে যখন ফারিন বাসায় গেলো তখন ডোয়িং রুমে নিরবের মাকে দেখে অবাক হলো। ভ্রু কুঁচকে গেলো তার। আড়ালে নিনীকাকে টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘ উনি হঠাৎ? ‘
নিনীকা হেসে ফেললো,
‘ তোমার কি খুবই চিন্তা হচ্ছে? টেনশন করো না তোমার মা বাবা কখনোই তোমার মতামত না নিয়ে কিছু করবেন না। ‘
নিরবের মা চলে যাওয়ার পর নিনীকা ফারিনকে নিয়ে ধারার সামনে বসলো। ধারা মেয়েকে আগলে নিলেন।
‘ কয়েক বছর আগে ও প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন তিনি। তুমি ছোট বলে এ বিষয়ে তোমাকে কিছু বলিনি। তবে এখন তুমি যথেষ্ট বুঝদার হয়েছো। আজও তিনি প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন। নিরব কেমন সেটা আমরা সকলে জানি। সুতরাং আমাদের কোনো আপত্তি থাকবে না যদি তোমার উত্তর হ্যাঁ হয়। তুমি ভেবে মাম্মাকে জানাবে, কেমন বাচ্চা? ‘
ফারিন অস্ফুটস্বরে বলল,
‘ যদি উত্তর না হয় তবে? ‘
‘ তবে আমরা মানা করে দিবো, ব্যস। ‘
*
পার্কে বসে আছে নিরব। তার পাশে একটু দূরত্বে বসে আছে ফারিন। জরুরি ভিত্তিতে তাকে ডাকা হয়েছে এখানে।
‘ মিস ফারিন? আপনি কি বলবেন ঠিক কি জন্য আমাকে ডাকা হলো? ‘
ফারিন অনেকক্ষণ পর বলল,
‘ আপনার মা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেছেন আমাদের বাসায়। সে বিষয়ে আপনি জানেন? ‘
‘ হ্যাঁ জানি। এবং এর আগে আরও একবার মা প্রস্তাব নিয়ে গেছিলেন। ‘
‘ কেন? ‘
‘ বিয়ের প্রস্তাব কেন নিয়ে যায়? অফকোর্স বউ বানানোর জন্য। ‘
‘ দুনিয়ায় আর কোনো মেয়ে নেই? ‘
নিরব হাসলো, সরল সুন্দর হাসি তার। ফারিন সেই হাসিতে আটকে গেলো। নিরব বলল,
‘ দুনিয়ায় মেয়ের অভাব নেই মিস ফারিন। তারপরও আমরা নির্দিষ্ট এক জনের প্রতিই আকৃষ্ট হই, এবং তাকেই পেতে চাই। এবং এটাতে আমি কোনো ভুল বা দোষ দেখি না। ‘
‘ মাম্মা বলেছে আমি যদি না করে দেই তো আপনাদের মানা করে দিবে। ‘
‘ সে তো দিবেই। কাউকে তো জোর করা যায় না। ‘
‘ বিয়ে করবেন না? ‘
নিরব তার সেই সরল হাসিটাই দিলো।
‘ আমার বাবা নেই, আমি যখন পঞ্চম শ্রেনীতে পড়ি তখন মা*রা গেছিলেন। মা টিচার ছিলেন বলে কোনোরকমে আমাকে মানুষ করতে পেরেছেন। আমার মায়ের অবদান আমার জীবনে অনেক বেশি। আমি তাকে এতো বছর অপেক্ষা করিয়েছি। এরপর হয়তো আর আটকে রাখা সম্ভব হবে না। ইচ্ছেতে হোক বা অনিচ্ছায় আমাকে বিয়ে করতেই হবে। ছেলেকে বিয়ে করাবে সেরকম স্বপ্ন তারও আছে। আমি তার স্বপ্ন পূরণ না করে তার মনে আঘাত দিতে পারবো না। ‘
ফারিন কেমন করে যেন তাকালো। নিরব ঠিক বুঝতে পারলো না। আচমকা তার কলারে টান পড়লো। ঝুঁকে পড়লো ফারিনের দিকে।
‘ আপনি অন্য কাউকে বিয়ে করবেন! ‘
‘ বিয়ে তো করতেই হবে। ‘
ফারিন ছেড়ে দিলো।
‘ ঠিক আছে। চলে যান, বিয়ে করুন। ‘
ফারিন উঠে দাঁড়ালো। নিরব প্রথমবার সাহস করে হাত টেনে ধরলো।
‘ আপনি যদি হ্যাঁ বলে দিতেন! ‘
‘ দিলে কি হবে? ‘
‘ আমি হয়তো অদ্ভুত এক যন্ত্রণা থেকে বেঁচে যাবো। ‘
ফারিন হাত ছাড়িয়ে চলে গেলো। নিরব যখন অসহায় করুণ মুখ নিয়ে বাড়ি ফিরলো তখন নিজের মায়ের কাছে শুনলো,
‘ কিছু মিনিট আগেই ধারা ফোন করে ফারিন রাজি আছে বলে জানিয়েছেন! ‘
*
গোধুলি এক লগ্নে ফারিনকে নিজের সাথে সারাজীবনের জন্য বেঁধে ফেললো নিরব। ধ্রুব বোনের হাত তুলে দিয়ে বলল,
‘ দায়িত্ববান ক্যাপ্টেন, আজ তুমি আমার বোন জামাই হয়ে গেলে। পাগলিটাকে দেখে রেখো। ‘
নিরব বিনিময়ে হাসলো। ফারিন ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদছে। ধ্রুব মজা করে বলল,
‘ দেখ তোকে বিদায় করে দিয়েছি। ‘
দিব্য মায়ের কোল থেকে আধোআধো স্বরে বলল,
‘ টা টা টা টা..’
ফারিন রাগে অভিমানে ফাহিম মাহবুবকে জড়িয়ে ধরলো।
‘ তোমার ছেলে আর নাতিকে আমি কিন্তু মা*রবো! ‘
ফারিন পড়াশোনা শেষ করবে বউ কথা কও-তে থেকেই। অর্থাৎ শ্বশুরবাড়িতে পার্মানেন্ট যাচ্ছে না সে। সেজন্য কান্না ভুলে শেষে হাসি-হাসি মুখ নিয়েই উঠে বসলো গাড়িতে। পাশে নিরব।
শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছে নিরবের সাথে দেখা হলো একেবারে বাসর ঘরে। নিরব সুপুরুষদের মতো করেই বললো,
‘ আমার কোনো তাড়া নেই, আপনি যথেষ্ট সময় পাবেন। ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন৷ ‘
কিন্তু মানলো না ফারিন। টেনে ফেললো বিছানায়।
‘ এতো এতো বছর এতো খুঁচা মে*রেও মুখ থেকে ভালবাসি কথাটা বের করতে পারিনি। শালা বিয়ে করে এখন বলছে বাসর করবে না! ‘
নিরব হতভম্ব হয়ে গেছে। ফারিন রেগে ফুসফুস করে আবারও বলল,
‘ কচি মেয়ে বিয়ে করতে তো অসুবিধা হয়নি, বাসর করতে অসুবিধা কিসের? ‘
নিরব আমতা আমতা করলো,
‘ আপনি বুঝতে পারছেন না। আমি আপনাকে সময় দিতে চেয়েছি কারণ আপনি যদি প্রস্তুত না থাকেন…
‘ কেউই আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নামে না। ‘
নিরব থমকালো। ফারিন আচমকা ঠোঁট চেপে ধরলো কপালে। বুকে মাথা রেখে বলল,
‘ আপনি তো কখনো বলবেন না ভালোবাসি, সেজন্য আমিই বলে দিচ্ছি। আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি। ‘
নিরবের হয়তো আজ অবাক হওয়ার দিন। বলল,
‘ কবে থেকে? ‘
‘ যখন থেকে আপনার অনুভূতি বুঝতে পেরেছি তখন থেকে৷ ‘
‘ কখনো বলেন নি! ‘
‘ আপনি বলেছেন? ‘
নিরব দু’হাতে মুখ তুলে ধরলো,
‘ আমাকে খুঁচাতেন কেন তাহলে? ‘
ফারিন নাক ফুলিয়ে সরে গেলো। পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। নিরব পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।
‘ আপনাকে বলতে হবে না। ঠিক আছে বাবা স্যরি, এখন থেকে প্রতি ঘন্টা একবার করে ভালোবাসি বলবো। ‘
‘ আমি ভীতু লোকদের থেকে ভালোবাসি শুনতে বসে নেই। ‘
নিরবের মুখ চুপসে গেলো।
‘ মেজরের বোনকে ভালোবেসেছি, একটু ভয়ডর তো থাকবেই। ‘
ফারিন সোজা হয়ে গলা জড়িয়ে ধরলো।
‘ আমি কিন্তু পরিবারের বাহিরে ভীষণ অভদ্র একটি মেয়ে। সামলাতে পারবেন? ‘
‘ অভদ্র সম্বোধনটির মধ্যেও ভালো খারাপ থাকে। আপনি ভালোর কাতারেই অবস্থান করছেন। নাহলে আমার বউ হতে পারতেন না। ‘
ফারিন চুপ করে রইলো। নিরব মিটমিটিয়ে হাসলো,
‘ বউয়ের কাছে এবার আমাকে অভদ্র হতে হবে। আপনি প্রস্তুত তো? ‘
ফারিন গলা জড়িয়ে ধরলো। ছুঁড়ে দিলো নিজের ডায়লগ,
‘ কেউ প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নামে না! ‘
*
বউ কথা কও নিস্তব্ধ। সবাই যার যার ঘরে। দিব্য বিছানায় বসে খেলছে। নিনীকা ধ্রুবকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। সবার মনই ভার। ধ্রুবর চুলের ভাজে হাত চালালো সে।
‘ কয়েকদিন পরই তো চলে আসবে। পড়াশোনা শেষ না করে পার্মানেন্ট শ্বশুরবাড়ি তো থাকবে না। আর মুখ ভার করে রেখো না। ‘
ধ্রুব ঠোঁট ফুলিয়ে শ্বাস ছাড়লো। দিব্যর দিকে হাত বাড়িয়ে ডাকলো,
‘ দিব্য..এসো বাবা। ‘
দিব্য বাবার আহ্বানে খুশি হলো। অস্পষ্ট চিৎকার বের হচ্ছে তার গলা দিয়ে। কোলে বসে বাবার মুখে মুখ লাগিয়ে দিলো। কখনো মা কখনো বাবার দিকে সে খুশি নিয়ে তাকাচ্ছে। নিনীকা ছেলের গালে আদর দিলো।
‘ আমার সোনা বাবা টাহ্। ‘
ধ্রুব নিনীকার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। দিব্যকে নিজের বুকের উপর শুইয়ে দিলো।
‘ আমরা বাবা ছেলে ঘুমাবো। তুমি জেগে পাহারা দাও। ‘
(চলবে)