#বিবি
#রোকসানা_রাহমান
(৪১)
নিবিড় বাসায় ফিরল প্রায় বারোটা নাগাদ। ক্লান্ত চোখজোড়া এক সেকেন্ডের জন্য নিবদ্ধ হয়েছিল স্ত্রীর অপরিমেয় উদ্বিগ্নে পিষ্ট হওয়া মুখটায়। তারপরেই ক্লান্ত পথিকের মতো হেঁটে গেল অনড়ার রুমটার দিকে। যেতে যেতে শুনল,
” কোথায় ছিলে এতক্ষণ? আম্মা খুব দুশ্চিন্তা করছিলেন।
ভেতরে এসে বিছানায় বসল। কোমল পিছু পিছু আসলেও দরজার কাছটায় দাঁড়িয়ে পড়েছে। বুঝতে পেরেও সেদিকে তাকাল না। নীঃশব্দে থম মেরে বসে থাকল। কোমল দুয়ারের কাছ থেকেই বলল,
” হাত-মুখ ধুয়ে এসো। আমি খাবার বাড়ছি। ”
নিবিড় উঠে ধৌতখানার দিকে এগুলে কোমল রান্নাঘরের দিকে ফিরে গেল। দ্রুতহাতে খাবার বেড়ে স্বামীর অপেক্ষা করছে। প্রায় মিনিট দশ পেরুনোর পরও সে আসছে না দেখে নিজেই আরেকবার ডাকতে গেল। দুয়ারের কাছে পৌঁছে আঁতকে ওঠল। রুম অন্ধকার। জনপ্রাণীর সাড়াশব্দ নেই। পাখা বন্ধ। ভ্যাপসা গরমে হালকা দুর্গন্ধ। অনড়া চলে যাওয়ার পর এ কক্ষে কেউ ঢুকেনি। দরজা-জানালা বন্ধ থাকায় গন্ধটা তৈরি হয়েছে। খোলা দরজা দিয়ে বাইরের আলো কিঞ্চিৎ প্রবেশ করায় অন্ধকার কিছুটা হালকা হয়েছে। কোমলের সন্ধিৎসু দৃষ্টিতে নিবিড়ের দেহটা কালো ছায়ার মতো ধরা দিল। সে হাত-পা মেলে শুয়ে আছে।
” তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে? ”
প্রশ্নটা করতে করতে বন্ধ জানালার পাল্লা খুলে দিল। পাখাটা ছেড়ে দিয়ে স্বামীর শিয়রে বসল। পরম স্নেহে কপালে হাত রেখে দরদ ঢেলে দিল কণ্ঠস্বরে,
” আজ খুব চাপে ছিলে, তাই না? চিন্তা করো না। আর তো কিছুদিন। ইন্টার্নি শেষ হলে নিজস্ব চেম্বার নিয়ে বসবে। তখন আর..”
কোমল কথা শেষ করতে পারল না। নিবিড় হাতটা ঝকটায় সরিয়ে দিয়ে বলল,
” তুমি এখান থেকে যাও। ”
তার আকস্মিক কণ্ঠস্বরে খানিক চমকে ওঠল কোমল। খেঁই হারাল। নরম শরীরটা কাঠের মতো শক্ত হলো। রেগে গিয়ে আদেশ করল নাকি বাধ্য হয়ে অনুরোধ করল বুঝতে পারছে না। কয়েক মুহূর্ত নির্বোধের মতো বসে থেকে বলল,
” সারাদিন খাওনি তো। খাবে না? ”
নিবিড় নীরস কণ্ঠে উত্তর দিল,
” না। ”
” কেন? ”
” ইচ্ছে হয়েছে তাই। তুমি কি যাবে? ”
তার এমন রূঢ়কণ্ঠকে সয়ে নিলেও ব্যবহারে যে বিরক্ত প্রকাশ পাচ্ছে সেটা মানতে পারছে না। নিবিড়ের নিকট সে কখনই বিরক্তের কারণ হয়নি। সামান্যতমও না! কোমল মনের ভাবনাকে, ধারণাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলল,
” আলসেমি লাগছে? ঠিক আছে, তুমি বসো। আমি খাবারটা এখানে নিয়ে আসছি। ”
সে এমনভাবে বেরিয়ে এলো যেন কেউ তাকে তাড়া করছে। ধরা পড়লে বিপদ! প্লেটে ভাত ও তরকারি সাজিয়ে নিয়ে আরেকদফা অবাক হলো। নিবিড় দরজা আটকে দিয়েছে। বন্ধ দরজার পানে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শামুকের মতো শক্ত খোলস ছেড়ে নরম মনটা বেরিয়ে এলো। দৃষ্টি ঝাপসা হতে বুঝতে পারল, চোখে পানি জমছে। এত সামান্য ব্যাপারে কান্না পেয়ে গেল বলে নিজেই বিস্মিত হচ্ছে। চোখ বন্ধ করে মাথা ঝাড়া দিয়ে সংযমী হলো। গলা স্বাভাবিক করে বলল,
” ঘুমিয়ে পড়লে নাকি? আমি খাবার হাতে দাঁড়িয়ে আছি। দরজাটা খোলো। ”
ভেতর থেকে কোনো উত্তর এলো না। অন্যরকম সাড়াও না। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার বলল,
” আমি কোনো কথা বলব না। খাবারটা রেখে আসব শুধু। ”
এবারও কোনো উত্তর এলো না। দরজাও খুলল না। কোমল পুনরায় বলল,
” এখন ইচ্ছে না হলে খেও না। ঢাকনা চাপা দিয়ে আসব। পরে খেও। ”
প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে মানানোর চেষ্টা করল। ব্যর্থ হয়ে দরজার সামনে বসে পড়ল। চুপচাপ দীর্ঘসময় বসে থাকার পর হালকা স্বরে সুধাল,
” তুমি কি এখানে ঘুমাবে? ”
” হ্যাঁ। ”
উত্তরটা এত দ্রুত ও পরিষ্কার শোনাল যে তার মনে হলো, নিবিড় হয়তো এই প্রশ্নটার জন্যই অপেক্ষায় ছিল। কোমল আর এক মুহূর্তও থাকল না সেখানে। খাবারগুলো সেভাবে রেখেই নিজ কক্ষে ফিরে এলো। ঘুমানোর জন্য বিছানা ঝাড় দিলেও শোয়া এবং বসা কোনোটাই করল না। ওযু করে জায়নামাজ বিছিয়ে নফল নামাজের জন্য দাঁড়িয়ে পড়ল। সেজদাহর জন্য মাটিতে মাথা ঠেকাতে বেঁধে রাখা অশ্রুকণা বারিধারায় রূপ নিল। চোখের পলকে ভিজে গেল জায়নামাজের রেশমি সুতো। পবিত্র কাপড়ে আগা-গোড়া মোড়ানো দেহটায় মৃদু কম্পন শুরু হলো। থামার বদলে ক্রমশ বেড়েই চলল।
নিবিড় বিছানা ছাড়ল ফজরের আযান শুনে। দরজা মেলে দেখল, নিচে ভাতের প্লেট ও পানির গ্লাস রাখা। সেগুলো তুলে নিয়ে রান্নাঘরে রাখল। অতঃপর সচেতনে এগিয়ে গেল নিজেদের রুমটিতে। দরজা মেলাই ছিল। ভেতরে ঢুকে দেখল, কোমল গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে জায়নামাজে। বন্ধ চোখের নিচের মাংস পিণ্ড ফুলে গেছে। নিষ্প্রভ মুখটায় অশ্রু ধারা শুকিয়ে আকাঁবাঁকা রেখা সৃষ্টি করেছে একাধিক। ধীরপায়ে কাছে এগিয়ে গিয়ে কোলে তুলে নিল প্রাণপ্রিয় বিবিকে। বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে আপনমনে বলল, ‘ আমি আমার কোমলকে ফেরত চাই। যতদিন না পাচ্ছি ততদিন এমনই চলবে। ‘
__________
স্নেহের অনড়া,
আমার রাত জেগে তৈরি করা নোটগুলোর এমন দুর্দশা দেখে একটু কষ্ট পেয়েছি। চিঠির মালিককে যে এত জলদি খোঁজার চেষ্টা করবেন ভাবতেও পারিনি। নোট পাঠিয়ে কি খুব বড় অন্যায় করে ফেলেছি? আমার তো তেমন মনে হচ্ছে না। রাগটা হয়তো অন্য কোথাও। ঠিক ধরেছি তো?
আসল কথাই আসি এবার, আপনাকে জ্বালাতন করার ইচ্ছেটা বাতিল করতে গিয়েও স্থগিত রাখতে হলো আপনার জন্য। এভাবে হুট করে হলে উঠেছেন যে, খোঁজ-খবরও নেননি হয়তো। যাদের সাথে আপনি রুম শেয়ার করছেন তারা প্রত্যেকেই উচ্ছৃঙ্খল জীবন-যাপন করে। একজন বহুপ্রেমিক নিয়ে ঘুরে, আরেকজন ঘণ্টায় ঘণ্টায় সিগারেটের প্যাকেট কিনে। অন্য একজন সমকামী। বিশেষ দিনে সকলে একসাথে মদ পান করে। তার খরচ যোগাতে এক নিষিদ্ধ রাস্তায় নিষিদ্ধ কাজের উদ্দেশ্যে রাতের আঁধারে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে থাকে।
এবার উপকার নয় উপদেশ দিচ্ছি, সঙ্গ দোষে লোহায় ভাসতে না চাইলে এই সিটটা ত্যাগ করুন। অন্য সিটের আবেদন করে রাখুন। যতদিন না পাচ্ছেন ততদিন মহিলা ম্যাচে গিয়ে থাকুন। কয়েকটা ভালো মহিলা ম্যাচের ঠিকানা দিয়ে দিলাম, ইচ্ছে হলে খোঁজ নিতে পারেন। এগুলোর মধ্যে একটাতে আপনার বন্ধু সুমনাও থাকছে। সম্ভব হলে তার সাথে থাকতে পারেন।
ইতি
চেনা কেউ
পুনশ্চঃ আমার দেওয়া গোপন নামটা কি বের করতে পেরেছেন? আমি ঠিক করেছি, যেদিন ‘ আমি রূপে ‘ ধরা পড়ব সেদিন ঐ নামে ডেকে তোমার রাগ দমন করব।
অনড়া এই চিঠিটাও ছিঁড়ে ফেলল কয়েকশো টুকরোয়। সবগুলোকে অঙ্গুলির সাহায্যে দলে-পিষে ছুঁড়ে মারল জানালা দিয়ে। তখনই মোবাইলটা বেজে ওঠল। কোমল কল করেছে। কলটা ধরতেই শুনল,
” অনু, তুই কি আমার কাছে কিছু লুকাচ্ছিস? ”
সে একটুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর করল,
” না। ”
” মিথ্যা বলছিস? ”
আগের চেয়েও দ্বিগুণ সময় চুপ থেকে উত্তর করল,
” না। ”
এবার বুঝি কোমলের চুপ থাকার পালা। বেশ কিছুক্ষণ পর বলল,
” সাবধানে থাকিস। ”
” আচ্ছা। ”
” নিজের যত্ন নিস। ”
” আচ্ছা। ”
” নিয়মিত কল করিস। কিছুর দরকার হলে সঙ্গে সঙ্গে বলবি। কোনো সমস্যা হলে অবশ্যই জানাবি। আমার মতো ভুল করিস না। ”
” আচ্ছা। ”
বুবুর কথা ফুরিয়ে এসেছে বুঝতে পেরে কলটা কেটে দিতে গিয়েও ডেকে ওঠল,
” বুবু? ”
ওপাশ থাকে দ্রুত উত্তর এলো,
” হ্যাঁ, বল। লাইনে আছি। ”
অনড়া কিছু বলার বদলে চুপ করে থাকল। কোমল অসহিষ্ণু গলায় বলল,
” বলছিস না কেন? ”
” আমার জন্য দোয়া করো। ”
কথাটা বলেই কল কেটে দিল।
__________
নিবিড় যত কোমলকে উপেক্ষা করতে থাকল ততই যেন তার রাগ-ক্ষোভ, ব্যথা-যন্ত্রণা, দুঃখ-কষ্ট, অভিমান-অভিযোগের কারণ স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ল কোমলের চোখে। তার করা অন্যায়টা কাঁটার মতো বিঁধতে লাগল হৃদয়ে। অনুতাপের বিষ ছড়িয়ে পড়ল শিরা-উপশিরায়, রন্ধ্রে রন্ধ্রে, অস্থিমজ্জায়। একসময় বাধ্য হয়ে আপনমনে চিৎকার করে বলল, ‘ আমি ক্লান্ত। সবাইকে নিয়ে চলার শক্তি ক্ষয়ে এসেছে। ধৈর্য্য ফুরিয়ে এসেছে। আমি সাহসী নই, ভীতু। আর ভীতুরা নিজ জীবনে সুখী। আমিও তাদের মতো সুখী হব। নিজেকে নিয়ে ভাবব, যেটায় আমার আনন্দ সেটাই আমার চাই। আর কিছু না। ‘ এই জীবনে প্রথমবারের মতো যখন একটু স্বার্থপর হওয়ার চেষ্টা করছিল ঠিক তখনই বাঁধা হয়ে দাঁড়াল কুকসুম নাহার। নতুন শাড়ি পরে তার সামনে এসে বলল,
” বড় বউ? নিবিড়ের তো আজ ছুটি। একটু কইয়া দেও তো, আমাকে ছোট বউয়ের কাছে দিয়া আইতো। পোয়াতি মাইয়াডা রে আর চোখে চোখে রাখতে পারলাম না। ক্যামনে চলতাছে আল্লাহই জানে! তিনমাস তো শেষ হইল, শরীর বাড়ব এহন। লগে একজন না থাকলে হয়? ”
” ওখানে থাকতে পারবেন না, আম্মা। ”
” ক্যান? ”
” অনু যেখানে থাকে সেখানে বাইরের মানুষদের থাকার অনুমতি নেই। ”
কুলসুম নাহারের উজ্জ্বল মুখটা অনুজ্জ্বল হয়ে এলো। একটুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
” তাইলে আর কী, দেহা কইরা চইলা আমু। যাও, নিবিড়রে কইয়া আহো। সকাল সকাল গেলে বেশিক্ষণ থাকতে পারমু। ”
শাশুড়ির আদেশ পেয়ে নিবিড়ের কাছে গেলেও কথাটা বলতে একটু সময় নিল। সে এক ঝলক চেয়ে মানিব্যাগ ধরিয়ে দিল কোমলের হাতে। নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে বলল,
” যাও, শাশুড়ির ইচ্ছে পূরণ করো। ”
কুলসুম নাহারকে নিয়ে কোমলই বেরুল। অনড়া যে হলের ঠিকানা দিয়েছিল সেখানে গিয়ে দেখল, সে নেই। তার সাথে থাকে এমন একজন জানাল, অনড়া পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি চলে গেছে।
চলবে
#বিবি
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৪২)
হোস্টেল থেকে ফেরার পথে বাবাকে কল করেছিল কোমল। অনড়ার খোঁজ চাইলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে কোনো তথ্য দিতে পারলেন না। বলে রাখলেন সন্ধ্যার পর জানাবেন। ঠিক সন্ধ্যায় জানাতে না পারলেও তার কিছু সময় পর জানিয়েছিলেন, অনড়া নানির সাথে গ্রামেই আছে। কোমল যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল! দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেল। জমিলা বেগম বয়োঃবৃদ্ধ মানুষ। বছরের পর বছর গর্ভিনীদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে ভালোই অভিজ্ঞ হয়েছেন। অনড়ার দেখভাল তার চেয়ে অধিক ভালো আর কে করতে পারবে! এই ঘটনার প্রায় একমাস পরের এক রাতের বেলা। নিবিড় রাতের খাবার শেষ করে শয়নকক্ষে বিশ্রাম নিচ্ছিল। সহসা মায়ের চেঁচামেচির হালকা সুর এসে বিঁধল কর্ণকুহরে। সে কৌতূহলবশত উঠে বসল। ধীর ও শব্দহীন পদধ্বনিতে এগিয়ে গেল মায়ের রুমটির কাছে। দুয়ারে পৌঁছানোর পূর্বেই বুঝতে পারল কোমলকে বকাবকি করছে কোনো এক বিষয়ে। শাশুড়ির প্রতি যার প্রাণ ত্যাগ পরিমাণের শ্রদ্ধা, সম্মান, ভালোবাসা সে ঠিক কোন অপরাধে এমন রুক্ষস্বরকে সয়ে নিচ্ছে তা জানার তীব্র আকাঙ্খা তৈরি হলো। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। কুলসুম নাহার ধমকাধমকির মধ্যেই পুনঃবার প্রকাশ করে ফেললেন। তার ভাষ্যমতে, বেশ কিছুদিন ধরেই কোমলকে বলছিলেন, তিনি গ্রামে যাবেন। অনড়াকে সাথে নিয়ে স্বামীর ভিটেতে থাকবেন। অতঃপর নাতি- নাতিনের মুখ দেখে তাকে সঙ্গে করে তবেই ফিরবেন। এ কথাটা যেন নিবিড়ের কানে দেওয়া হয়। তাকে রাজিও করানো হয়। কোমল তার এই আদেশটুকু শিরোধার্য করছে না। কেন করছে না তার কারণও প্রকাশ করছে না। চুপচাপ অবনত হয়ে শাশুড়িমায়ের বকা শুনছে, ধমক খাচ্ছে। তার এই ধৈর্য্য ও নিশ্চুপতা তিনি বেশি সময় সহ্য করতে পারলেন না। গলার স্বর পূর্বের চেয়ে উচ্চতর হতেই নিবিড় দুয়ার থেকে কঠিন ও দৃঢ়স্বরে বলল,
” গ্রামে যেতে চাও? চলো, আমি দিয়ে আসছি। শুধু জেনে রাখ, তোমার সাথে এটা আমার শেষ দেখা হবে। ঢাকাতে কাটানো তোমার শেষ রাত। ভেবে নিও, তোমার ছেলে মারা গেছে। ”
কুলসুম নাহারের পিল চমকে ওঠল। কলিজা কামড়ে ধরল বুঝি কোনো বিষাক্ত পোকা! বিস্ফারিতনেত্র মেলে বিস্মিত স্বরে বললেন,
” মায়ের লগে সম্পর্ক ছিন্ন কইরা দিবি? ”
” সে যদি চাই তাহলে অবশ্যই দিব। সন্তান হিসেবে তো আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য। ”
কথা দুটো বলেই নিজকক্ষে ফিরে গেল। মায়ের সেই চেঁচামেচি আর শোনা যাচ্ছে না। কানদুটো একটু আরাম পেতেই চোখ বুঝে নিল পরম স্বস্থিতে।
___________
ভোরের আলো প্রকৃতি ছুঁয়ে ঘরের মধ্যে অবাধে প্রবেশ করতেই ঘুম ভাঙল কোমলের। চোখ মেলে দেখল, চারপাশ ফর্সা, স্পষ্ট। নিবিড়ের নামাজ শেষ। মোনাজাতে বসে আছে। বিবাহের পর থেকে সবসময় সে নিবিড়ের পরে ঘুম থেকে উঠে। আজও তেমনটাই ঘটেছে। তবুও তার মনখারাপ হলো। আগে নিবিড় তার চোখদুটিতে আদর করত। তারপর অত্যন্ত মিষ্টি ও কোমল স্বরে ‘ বিবি ‘ বলে ডাক দিত। এখন তেমনটা হয় না।
নিবিড় নামাজ শেষ করে উঠতেই কোমল হালকা স্বরে বলল,
” সেদিন যদি শর্ত ভেঙে বিয়ে না করতে তাহলে আমাদের পথ চলা এত দূর অবধি হতো না। তোমার মন ও বিবেক দুটোই আমাকে অযোগ্য প্রমাণ করে গোপন ও দুর্বল সম্পর্কটা ছিন্ন করে দিত। এখন আমরা দুটো আলাদা পথের পথিক হতাম। ”
জায়নামাজ এক ভাঁজ করে স্ত্রীর কোলে রাখল নিবিড়। তার নিচু দৃষ্টির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুঁড়ে বলল,
” তখনও অযোগ্য ছিলে না, এখনও না। তোমার যোগ্যতা রূপে নয়, বয়সেও নয়, শুধুমাত্র গুণে। যেটা এখনও বহাল আছে। আমার কষ্টটা অন্যখানে যেটা তোমার খুব ভালো করেই জানা। তারপরও নিজেকে ছোট বানাচ্ছ? ”
কোমলের দৃষ্টি উঁচু হলো। স্বামীর চোখের দিকে চাইতেই মনিদুটো অশ্রুতে ডুবে গেল। নিবিড় সেই দৃষ্টিকে গ্রহণ করতে পারল না। অন্যদিকে চেয়ে বলল,
” নামাজ পড়ে নেও। ”
নামাজ শেষ করে বাইরে বেরুতে ইচ্ছে হলো না। স্বামীর পাশে বসল। আপনমনে বলল, ‘ সাত মাস হতে চলল অনুর সাথে কথা বলছি না। কোনো রকম যোগাযোগ রাখছি না। এতে কি তোমার কষ্ট কমেছে? আমাকে কাছে টেনেছ? দূরত্ব কমার বদলে বেড়েই চলছে শুধু! ‘ বুকের খুব গভীর থেকে একটা ভারী নিশ্বাস বেরিয়ে আসতে শুনতে পেল,
” তোমার বাবা অসুস্থ? ”
কোমল উদাসভাব কাটিয়ে উত্তর করল,
” হ্যাঁ, একটু। ”
” একটু অসুস্থতার জন্য দুইদিন হাসপাতালে ভর্তি ছিল, তাই না? ”
কোমল নিরুত্তর থাকলে সে আবার বলল,
” তোমার বাবা তোমাকে দেখতে চাচ্ছেন, যাচ্ছ না কেন? ”
” তোমাকে বলা হয়নি তাই। ”
” বলোনি কেন? যে কথাটা তুমি বললেই হতো সেটা তোমার মায়ের কাছ থেকে শুনতে হয়েছে। ”
কোমল এবারও চুপ থাকলে সে একটু জোরাল স্বরে বলল,
” আমার উত্তর চাই, কোমল। ”
” গ্রামে তো অনুও আছে। আমার মনে হয়েছিল, বাবার অসুস্থতার কথা বলে যেতে চাইলেও তুমি ভাববে আমি অনুর সাথে দেখা করতে চাচ্ছি। ”
নিবিড় প্রত্যুত্তরে চুপ থাকল। স্ত্রীর দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে আহত স্বরে বলল,
” তুমি আমাকে অবিশ্বাস করছ বলে ধরে নিলে, আমিও তোমাকে অবিশ্বাস করব? যে ভালোবাসার জোরে আমি এখনও শক্ত আছি সেই ভালোবাসার সৃষ্টির মূলেই তো তুমি! তোমাকে অবিশ্বাস করা মানে আমার ভালোবাসাকে অবিশ্বাস করা। এইটুকু বোধও তোমার হয়নি? কোমল, আমাকে এমন করে নিরাশ করো না। আমার সেই পুরোনো কোমলকে ফিরে পাব বলে খুব আশা করে আছি। ”
কোমল অবোধের মতো চেয়ে থাকলে নিবিড় পুনরায় বলল,
” নাস্তা সেরে তৈরি হও। ”
___________
মোল্লাবাড়িতে পা রাখতেই নিবিড়ের হাবভাব বদলে গেল। কঠিন ব্যবহার নরম হলো। গম্ভীর মুখে এক ঝলক আনন্দের প্রলেপ পড়ল স্থায়ীভাবে। মলিন ওষ্ঠদ্বয়ে এক ফালি হাসি লটকে রইল সারাক্ষণ। কোমলের সাথে দুষ্টু মিষ্ট কথাও চলল মাঝেমধ্যে। স্বামীর এই পরিবর্তনে কোমলের গত হওয়া দুর্দম বেদনাকে ভুলে অনড়াকে দেখতে যাওয়ার আবদার করে বসল। নিবিড় এক মুহূর্ত নীরব থেকে বলল,
” যাও। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকা চলবে না। ”
কোমল কৃতজ্ঞতায় গলে পড়ে বলল,
” আচ্ছা, যাব আর আসব। ”
অনড়াকে দেখতে গিয়ে আরেক বিপত্তি ঘটল। সে কিছুতেই দেখা করবে না। ভেতর থেকে দরজার খিল আটকে আছে। কোমলের সাথে জমিলা বেগমও অনেক ডাকাডাকি করলেন। একসময় বাধ্য হয়ে বললেন,
” তুমি চইলা যাও, পরে আমি বুঝাইয়া তোমার কাছে নিয়া যামু নে। ”
কোমল সেই কথা মানল না। তার মনে হলো, আজ দেখা না হলে কোনোদিন হবে না। এখানে কতদিনের জন্য আছে, জানে না। নিবিড় যদি বলে আজই চলে যেতে, তাহলে তাকে যেতেই হবে। তাই জেদ ধরে বলল,
” আমি আজই দেখা করব, নানি। সবসময় এমন করলে চলে? ঢাকা থেকে আসার সময় আমাকে বলে আসেনি। ও কি জানে না, ওর জন্য বুবুর কত চিন্তা হয়? ”
কোমল দরজায় বিরতিহীন আঘাত করতে থাকলে অনড়া দরজা খুলে দিল। বুবুর দিকে না তাকিয়ে বিছানায় গিয়ে আধশোয়া হলো। অনড়ার আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করতে করতে ভেতরে ঢুকল। ওর কোমরের কাছে বসে বলল,
” তোর দেখি শুধু পেটটাই ফুলেছে রে অনু! আমার তো পুরো শরীরটাই ফুলে গেছিল। এমনি কালো তখন আরও কালো হয়ে গেছিলাম। যে দেখেছে সেই বলেছে, আমার ছেলে হবে। ”
কথাটা মজা করে শুরু করলেও শেষটায় হৃদয় ভার হয়ে আসল। হঠাৎ করে মনে পড়ল, তার ছেলে হয়েছিল নাকি মেয়ে হয়েছিল জানা-ই হয়নি। গোপন শোক কাটিয়ে আবারও প্রফুল্লচিত্তে বলল,
” বাচ্চা নড়ে তো ঠিকমতো? ”
অনড়া সংক্ষেপে উত্তর দিল,
” হ্যাঁ। ”
” অন্য কোনো সমস্যা নেই তো? থাকলে বল। বাচ্চার বাবাকে ডেকে আনি। সে তো এখন পুরোপুরি ডাক্তার। প্রাইভেট হসপিটালে ভিজিটে রোগী দেখছে। কয়েক দিনের মধ্যে নিজস্ব চেম্বারও খুলে বসবে। ”
” ডাকলে আসবে? ”
অনড়ার প্রশ্নটায় কোমলের ঠোঁটের হাসিটা মিলিয়ে গেল। অপ্রতিভ হয়ে বলল,
” আসবে না কেন? অবশ্যই আসবে। ”
” মিথ্যা সান্ত্বনা দিচ্ছ কেন, বুবু? ”
অনড়ার হাত ধরে একটু কাছে ঘেষে বসল। বামহাত গালে রেখে নরম স্বরে বলল,
” বাবুটা পৃথিবীতে আসুক। দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। বাবুর বাবা নিজ থেকে তোকে ঐবাড়িতে নিয়ে যাবে। ”
” স্ত্রীর মর্যাদা দিবে? ”
” হ্যাঁ। ”
” তোমার মতো বিবি বলে ডাকবে? ”
কোমল একটু সময় নিয়ে বলল,
” দুজনকে বিবি ডাকলে তো সমস্যা। একজনকে ডাকলে অন্যজন চলে আসব। তাই তোকে ছোটবিবি ডাকবে। ”
” আমি তার ছোটবিবি না একমাত্র বিবি হতে চাই, বুবু। যত দিন না হচ্ছি ততদিন তার সংসারে পা রাখব না৷ ”
ছোট বোনের এমন সিদ্ধান্তে তার বুক কেঁপে উঠল। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, অনড়া তাকে নিবিড়ের জীবন থেকে সরে যেতে বলছে। সে থাকলে তো একমাত্র বিবি হওয়া সম্ভব নয়!
” কোমল? তোমার জামাই আইছে। বাইরে ডাকে। ”
জমিলা বেগমের দিকে তাকিয়ে সন্দেহিসুরে বলল,
” ও সত্যি এখানে আসছে, নানি? ”
” হ, ঐ তো উঠোনে দাঁড়াইয়া আছে। ”
কোমল আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে বলল,
” বাইরে দাঁড়িয়ে আছে কেন? ভেতরে আসতে বলেন। ”
” কইছি। আহে না। ”
সে নিজেই উঠে বাইরে গেল। নিবিড়কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ভেতরে টেনে আনল জোর করে। অনড়ার সামনে দাঁড় করিয়ে বলল,
” ওর মুখ দেখ, কী সুন্দর হয়েছে! আমার তো মনে হয় মেয়ে-ই হবে। তুমি চেয়েছিলে না আমাদের একটা মেয়ে হোক? ”
নিবিড় দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” আমাদের বলেছিলাম। অন্য কারও না। চলো এখান থেকে। ”
কোমলের হাত ধরার পূর্বে সেই নিবিড়ের হাত ধরে ফেলল। অনড়ার বর্ধিত পেটে রেখে বলল,
” দেখ তো বাবু নড়ছে নাকি। ”
নিবিড় ঝটিতে হাত সরিয়ে নিতে গিয়েও থেমে গেল। দৃষ্টি চলে গেল অনড়ার মুখে। সেখানে স্থির রেখে জায়গা বদল করে পেটে হালকা চাপ দিল কয়েকবার। মুহূর্তেই রাগ উবে গেল। চৌকস হেসে বলল,
” কোমল, তুমি যদি চাও বোনের সাথে থাকতে পার কিছুদিন। ”
কোমল বিস্মিত নয়নে চেয়ে বলল,
” সত্যি? ”
অনড়ার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। মৃদু হেসে বলল,
” হ্যাঁ। আমি তো চাইব, ডেলিভারি হওয়া পর্যন্ত থাকো। ”
কোমল সত্যি সত্যি থেকে গেল। অনড়া শত আপত্তি দেখালেও মানল না। নিবিড় নিজ উদ্যোগে তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সেখানে দিয়ে আসল। সাথে এটাও বলে আসল, ডেলিভারীর ব্যথা শুরু হলে তাকে যেন অবশ্যই জানায়।
প্রথম কয়দিন কোমলের উপস্থিতিতে বিরক্ত দেখালেও একটা সময়ে গিয়ে মেনে নিল অনড়া। দুই বোন একসাথে ঘুমাতে শুরু করল। মাঝরাত অবধি গল্প চলল, আড্ডা চলল। বোন ঘুমিয়ে যাওয়ার পর কোমল ঘুমাত। এমন করেই চলল কয়েক রাত। ঠিকঠাক, স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিকতা ভেঙে দিল এক ভোরে। বাচ্চার কান্না শুনে ঘুম ভাঙল কেমলের। চোখ মেলে উঠে বসতে দেখল, জমিলা বেগমের কোলে সদ্য জন্ম নেওয়া একটি শিশু। সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
” এটা কার বাচ্চা, নানি? ”
তিনি একটুক্ষণ চুপ থেকে আচমকা বললেন,
” আমাগো অনড়ার। ”
কোমল ঝটিতে তাকাল অনড়ার দিকে। সে ঘুমাচ্ছে। চারপাশ বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। আতুরনিবাসের ছিঁটে-ফোটাও নেই কোথাও। সবিস্ময়ে বলল,
” কখন হলো? আমি তো কিছুই টের পেলাম না! ”
জমিলা বেগম নাতির কাছে ছুটে এলেন। কোলের কাছে বাচ্চাটাকে রেখে মৃদু স্বরে ডাকতে লাগলেন। সে লাফিয়ে উঠতে বলল,
” তুমি তো ঘুমাইছিলা, তাই বুঝতে পারনি। ”
কোমল কিছু বুঝে উঠার পূর্বে তিনি তাড়া দিয়ে বললেন,
” তুমি একটু বাইরে যাও তো। অনুরে ভালা কইরা পরীক্ষা করি। ভেতরে কিছু থাইকা গেল নাকি! ”
তাকে ঠেলতে ঠেলতে বের করে দিল। দরজা লাগানোর পূর্বে হাতে মোবাইল ধরিয়ে দিয়ে বলল,
” তোমার শাশুড়ি রে শুভ সংবাদটা দেও। ”
কোমল অনেকটা ঘোরের মধ্যে থেকেই নিবিড়ের নাম্বারে কল দিল। সে সংবাদটা শুনে খুশি হওয়ার বদলে রেগে গেল। রাগান্বিত স্বরেই বলল,
” একটা কাজ দিয়ে এলাম সেটাও করতে পারলে না! ”
বলেই কল কেটে দিল। কোমল থতমত খেয়ে বাইরে বসে পড়ল। কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না যেন! সবকিছু কেমন স্বপ্নের মতো দ্রুত ঘটে যাচ্ছে। নিবিড়-ই বা কী কাজ দিয়েছিল তাকে?
এই স্বপ্নের মধ্যে আরও দুদিন কেটে গেল কোমলের। নিবিড় আসেনি। মোবাইল বন্ধ করে রেখেছে। বাধ্য হয়ে বাবাকে ঢাকা পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিতে আরেক ঘটনা ঘটে গেল। অনড়া বাচ্চা রেখে কোথাও চলে গেছে। জমিলা বেগমকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি একটা কাগজ ধরিয়ে দিলেন। সেখানে শুধু একটা শব্দ লেখা, ‘ গুরুদক্ষিণা। ‘
কোমল কয়েক মুহূর্ত সেখানে চেয়ে থেকেই যেন তার মস্তিষ্কের জোট খুলে গেল। বাচ্চাকে জমিলা বেগমের কাছে রেখে বিকেলের বাসে করে ঢাকা ছুটল। সোজা গিয়ে ওঠল সুমনার বাসায়। অনড়ার দর্শন পেয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করল,
” আমার হাতে মার খেয়েছিস কখনও? ”
” না। ”
” যদি খেতে না চাস, তাহলে এখনই সব সত্য বলবি আমায়। ”
চলবে