#বিবি
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৩৭)
বেলা এগারোটা। সূর্য কোমল আলো হারিয়ে আগুনের মতো উত্তপ্ত প্রভা ছড়াচ্ছে একটু একটু করে। শীতল হাওয়া ধীরে ধীরে গরম হয়ে উঠতে ঘেমে উঠল নিবিড়ের কপাল, গলা ও চাদরে ঢাকা বাকি শরীরটুকুও। গরম ও ঘাম তাকে এতটাই উত্ত্যক্ত করল যে চোখের ঘুম পালাতে বাধ্য হলো। দীর্ঘ ঘুমে ভার হওয়া পাতা দুটো কেঁপে আলগা হতে একটা শ্রুতিমধুর কণ্ঠস্বর শুনতে পেল,
” তোমার কাপড় ইস্ত্রি করা আছে, গোসল করে এসো। ”
বাক্যটা কর্ণ গহ্বর দিয়ে ছুটে গিয়ে মস্তিষ্কে আঘাত করল বিদ্যুৎ ঝটকার মতো। মুহূ্র্তে শরীরের সকল ক্লান্তি, ঝিমুনিভাব ছুটে গেল। ঝটিতে উঠে বসে পাশ ফিরল। সেই শ্রুতিমধুর কণ্ঠের মালিকের মুখটা দৃষ্টি সীমায় আসতে পুনরায় প্রকাশিত হলো,
” আজ ঘুম থেকে উঠে প্রথম আমার মুখ দেখেছ। কেমন লাগছে? ”
নিবিড় কোনো প্রতিক্রিয়া করতে পারল না৷ বোবা রূপে বজ্রাহতের মতো দেখছে, অনড়াকে৷ সে একটি হালকা রঙের সুতি শাড়ি পরে আছে। চুল খোলা ও ভেজা। সুশ্রী মুখটা বেশ স্নিগ্ধ ও পবিত্র। নির্মল দৃষ্টি জোড়াতে উপচে পড়া আনন্দ!
অনড়া হেঁটে এসে বসল নিবিড়ের পাশে। মুখটা নিবিড়ের কর্ণপাশে নিয়ে দুষ্টস্বরে বলল,
” আমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে, তাই না? আদর করার মতো সুন্দর। ”
নিবিড় স্থাণুভাব কাটিয়ে উঠল। অনড়ার চোখে চোখ রেখে বলল,
” তুমি যেমন দেখাতে চাচ্ছ তেমন কিছুই হয়নি। ”
তার এমন অটল চাহনিতে অনড়ার দুষ্টুভাব মিইয়ে গেল। ভেতরটা হাওয়ার মতো নরম হয়ে দুলে উঠল। অযাচিত একটা খোলসভাব ধরে রেখে জোর দিয়ে বলল,
” হয়েছে। ”
নিবিড় বিছানা থেকে উঠে বসল। রাতে পরিহিত শার্টটা খোঁজায় ব্যস্ত হলে অনড়া বলল,
” তোমার পিঠে আমার নখের আঁচড়গুলোই তার প্রমাণ। ”
কৃত্রিম কৌতূহলে আয়নার কাছে এগিয়ে গেল। উল্টো দাঁড়িয়ে কালসিটে এবড়ো-থেবড়ো দাগগুলোর দিকে চেয়ে বলল,
” এই কটা দাগ কেন, পুরো পৃথিবীও যদি তোমার পক্ষে কথা বলে তবুও আমি বিশ্বাস করব না। ”
শার্টটা গায়ে দিয়ে বোতাম লাগাচ্ছিল আয়নায় চেয়ে তখনই সে বলল,
” বুবু বললেও বিশ্বাস করবে না? ”
নিবিড় আয়নার মধ্য দিয়ে ভ্রূ বাঁকিয়ে তাকাল অনড়ার দিকে। শেষ বোতামটা লাগিয়ে ফিরে এলো তার কাছে। জিজ্ঞেস করল,
” তোমার কাপড় খোলার সময় বুবুকে সামনে বসিয়ে রেখেছিলে নাকি? ”
অনড়ার চোখ জ্বলে উঠল। আক্রোশে ঠোঁট কাঁপছে। তাকে আরেকটু রাগিয়ে দিতে বলল,
” কোথায়, কয়টা চুমু খেলাম, কতভাবে আদর করলাম সেগুলোর হিসেব রাখছিল বুঝি? ”
একটু থেমে আবার বলল,
” হিসেবগুলো আরেকবার মিলিয়ে নিও, যাতে ভুল নাহয়। ”
” ছি, তুমি এত বিশ্রীভাবেও কথা বলতে পার! ”
অনড়া নাক শিটকে মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নিল। নিবিড় থুতনি ধরে সেই মুখ সোজা করে বলল,
” কোমল তোমার মতো নির্লজ্জ নয়। ওর শরীরভর্তি লজ্জা। আমি আদর করতে গেলে সেটা শতগুণে বেড়ে যায়। এজন্যই তোমাকে দাওয়াত দিয়ে যায়নি। ওর হয়ে আমি দিচ্ছি। আজ রাতে আমাদের রুমে এসো। খাতা-কলমের সাথে ক্যালকুলেটর আনতে ভুলবে না। হিসেবে ভুল করা যাবে না একদমই, বুঝছ? পরে তিনজনে মিলিয়ে দেখব, কার ভাগে আদর কম পড়ছে। যার ভাগে কম করবে তাকে আবার আদর করব। অংক ঠিক আছে না? ”
নিবিড়ের হাত সরিয়ে দিল ধাক্কা দিয়ে। একটু পাশে সরে বলল,
” আমাকে অপমান করলেই সত্যি, মিথ্যা হয়ে যাবে না। ”
নিবিড়ও পাল্টা জবাব দিল,
” নাটকের কাহিনি, চরিত্রগুলোর অভিনয়-সাজ যত বাস্তব বা নিঁখুতই হোক না কেন একসময় সেটি শেষ হয়ে যায়। এক মুহূর্তের জন্য দর্শকের মনে সত্যির দোলা লাগিয়ে হারিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ”
নিবিড় আর এক দণ্ডও দাঁড়াতে চাইল না। রুমটাকে এখন জাহান্নামের মতো লাগছে তার কাছে। দ্রুতকদমে দরজার দিকে এগিয়ে গেলে পেছন থেকে শুনতে পেল,
” সত্যি নাকি মিথ্যা, কয়েকদিন পরেই প্রমাণ হয়ে যাবে। ”
সে পেছন না ফিরেই বলল,
” সেইসময়টা পাচ্ছ কোথায়? হিসেবমতে, আমি শাস্তি গ্রহণ করে ফেলেছি। এখন নিজ থেকে বিদায় হও। ”
__________
কোমল দুপুরের জন্য ভাত চড়াচ্ছিল। নিবিড় রান্নাঘরে গিয়ে তাকে টেনে আনল রুমে। দরজা আটকে তার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল,
” কয়টা বাজে? ”
তার এমন রূঢ়কণ্ঠে ভয়ে কেঁপে উঠল কোমল। সময় ভুলে গেছে। দেয়ালে সাজানো বড়-সড় ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে যে মনে করবে সেই সাহসও যোগাতে পারল না। তোতলাতে তোতলাতে নিজের অপরাধ স্বীকার করল,
” ভুলে গেছি। ”
নিবিড় তার বাজু চেপে ধরে পেছনে ঘুরিয়ে বলল,
” ঘড়ি দেখে বল। ”
কোমল সভয়ে বলল,
” এগারোটা পনেরো। ”
” আমার এখন কোথায় থাকার কথা? ”
” হসপিটালে। ”
কাঁপা স্বরে উত্তরটা পেয়ে তাকে নিজের দিকে ঘুরাল। বাজু থেকে হাত সরিয়ে বলল,
” তাহলে আমি বাসায় কেন? ”
কোমল নিরুত্তর থাকলে নিবিড় পুনরায় বলল,
” তুমি যখন শত মাইল দূরে ছিলে তখনও আমাকে কোনো কাজে হের-ফের করতে দেওনি, পুরো রুটিনে রেখেছ। তাহলে আজ তুমি পাশে থেকেও এমনটা ঘটল কীভাবে? ”
কোমল সভয়ে বলল,
” আমি অনড়াকে বলেছিলাম, ডেকে দিতে। ও জানাল, তুমি ঘুমিয়েছ ভোরের দিকে। ঠিকমতো ঘুম নাহলে শরীর খারাপ লাগতে পারে তাই আর জোর করিনি।
” অনড়াকে ডাকতে বলবে কেন? তুমি কী করছিলে? ”
” আমি ডাকতে যাই কী করে? তুমি তো ওর রুমে ঘুমাচ্ছিলে। ”
” ওর রুমে ঘুমালাম কেন? ”
কোমলের মাথায় যে উত্তরটা এলো, সেটা প্রকাশ করতে ভয় হলো। তাই চুপচাপ থাকল। নিবিড় নিজ থেকে বলল,
” যখন দেখলে ঘুমানোর সময় পার হওয়ার পরও আমি আসছি না তখন ডাকতে গেলে না কেন? ”
কোমল তখনও চুপ হয়ে থাকলে নিবিড় একটু কঠিন স্বরে বলল,
” চুপ থাকবে না, উত্তর দেও। আমি জানতে চাই, তুমি কর্তব্য ভুলে গেলে কেন? ”
” ভুলিনি। ”
” মনে থাকতেও আমি অন্যের রুমে রাত যাপন করেছি? ”
” হ্যাঁ, আমি ইচ্ছে করে ডেকে আনিনি। অন্যের রুম বলছ কেন? ওটা তোমারও রুম। অনড়া আর তোমার। স্বামী- স্ত্রী একসাথে থাকবে এটাই নিয়ম, স্বাভাবিক। এতে এত রাগ হচ্ছ কেন? ”
” আপনার রাগ হচ্ছে না? ”
নিবিড়ের সম্বোধন আপনিতে বদলে যেতে কোমলের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। বুকের ভেতরটায় ছলাৎ ছলাৎ ছন্দ তুলছে। সেই অবস্থায় তার মুখ বন্দী হলো নিবিড়ে দুই হাতের তালুতে। স্নেহভরে মুখটা টেনে তার চোখের সামনে যেতেই চোখ বন্ধ করে ফেলল। শুনতে পেল,
” আপনার খারাপ লাগছে না? কষ্ট হচ্ছে না? ”
কোমল বহুকষ্টে উচ্চারণ করল,
” না। ”
সঙ্গে সঙ্গে মুখটা ছেড়ে দিল নিবিড়। সরে গেল সামনে থেকে। নীরবে হেঁটে গেল গোসলখানার দিকে। সশব্দে দরজা আটকে দিতে চমকে গিয়ে সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল কোমলের। বন্ধ দরজার দিকে নিষ্পলক চেয়ে থেকে ফিরে গেল রান্নাঘরে। নিবিড়ের জন্য নাস্তা সাজাল প্লেটে। একবার ভাবল অনড়াকে দিয়ে পাঠাবে পরমুহূর্তে ভাবনা বদলে ফেলল। নিবিড়ের মেজাজের অবস্থা ভয়াবহ। তার বদলে অনড়াকে দেখলে, ভয়ঙ্কর কিছু ঘটিয়ে ফেলবে। সেই মেজাজ ঠিক করতে তাকেই যেতে হবে। প্লেট হাতে রুমের দিকে অগ্রসর হতে হতে আপনমনে আওড়াল, ‘ তুমি যদি এমন বেসামাল হয়ে পড়ো, নিজেকে সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে যায়। ‘
নিবিড় গোসলখানা থেকে বেরিয়ে বলল,
” যদি না চান, খাবারগুলো আমার হাত থেকে নষ্ট হোক, তাহলে এগুলো তুলে নিয়ে যান। ”
কোমল তুলল না। তোয়ালে নিয়ে এগিয়ে গেল নিবিড়ের কাছে। মাথাটা মুছে দিতে দিতে বলল,
” আমার কষ্ট দেখতে চেয়ে নিজে কষ্ট পেও না। ”
স্ত্রীকে দূরে সরিয়ে দিয়ে বলল,
” আমি যদি কষ্ট প্রকাশ করতে পারি, আপনাকেও পারতে হবে। ”
” না থাকলেও? ”
” আছে। ”
” নেই। ”
নিবিড় ধুয়ে ইস্ত্রী করে রাখা শার্টের ভাঁজ খুলল। হাতায় হাত ঢুকাতে ঢুকাতে বলল,
” আপনার চোখ দেখে বুঝা যাচ্ছে, সারারাত জেগে ছিলেন, এক সেকেন্ডের জন্যও পাতা এক করেননি। কণ্ঠ শুনে বুঝা যাচ্ছে, রাতে খাননি, সকালেও না। ”
কোমল সামনে এগিয়ে এলো। তোয়ালে নিজের কাঁধে রেখে নিবিড়ের শার্টের বোতাম লাগিয়ে দিতে দিতে বলল,
” এখানে আসার পর তোমাকে ছাড়া একরাতও থাকা হয়নি। একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তাই হঠাৎ অভ্যাস ভেঙে যাওয়ায় ঘুম আসেনি। আর তুমি না খেলে যে আমি খাই না। এটা তো শুরু থেকেই দেখে আসছ। ”
” আমি ব্যাখ্যা শুনতে চাইনি। কষ্ট দেখতে চেয়েছি। ”
কথাটা বলে স্ত্রীর হাত সরিয়ে দিল নিবিড়। শেষ বোতামদুটো নিজে লাগিয়ে বলল,
” আমাকে জড়িয়ে ধরুন তারপর কাঁদুন। আপনার চোখের পানিতে- নাকের পানিতে আমার প্রিয় শার্টটা নষ্ট করতে চাই। ”
কোমল খেয়াল করল নিবিড়ের পরনে তার নিজ হাতের সেলাই করা শার্টটি। সে মেয়েদের পোশাক সেলাই করায় পটু হলেও ছেলেদের পোশাকের বেলায় একদম কাঁচা। তবুও শখের বশে একবার শার্টের কাপড় এনে বানানোর চেষ্টা করেছিল। সামনেই তাদের ষষ্ঠ তম বিবাহ বার্ষিকী ছিল, ভেবেছিল উপহার দিবে। খুব যত্ন ও সময় নিয়ে বানানোর পর দেখল, সেলাই ভালো হলেও মাপে কোথাও ভুল হয়েছে। ফলস্বরূপ কাঁখতলির এখানে টান দিয়ে কুঁচকে থাকে। কোমল পরতে মানা করলে নিবিড় বলেছিল, শুধু বাসায় পরবে। সেই কথা ভুলে গিয়ে প্রায় সময় বাইরে পরে গিয়েছে, এখনও যায়।
” যদি কাঁদতে না পারেন তাহলে রাগ করুন। অভিমানে গাল ফুলান। আমি আজ সারাদিন আপনার অভিমান ভাঙাব। ”
চলবে
#বিবি
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৩৮)
” যদি কাঁদতে না পারেন তাহলে রাগ করুন। অভিমানে গাল ফুলান। আমি আজ সারাদিন আপনার অভিমান ভাঙাব। ”
কোমল না কাঁদল না রাগ করল। কাঁধের মধ্যে ভেজা তোয়ালে নিয়ে মাকড়শার মতো শক্তদেহে দাঁড়িয়ে থাকল চুপচাপ। নিবিড় অস্থিরচিত্তে অনিমিষনেত্রে চেয়ে আছে তার দিকে। অপেক্ষার সময় কমার বদলে বেড়ে যাচ্ছে শুধু। একসসময় কেঁপে উঠল চোখের পলক। বুকের গভীর থেকে চোট্ট নিশ্বাস বেরিয়ে এলো। নিজ সিদ্ধান্তে অটল থেকে ঘুরে দাঁড়াল দরজার দিকে। কোমল অনুরোধের সুরে বলল,
” খেয়ে যাও। ”
” আপনি চাচ্ছেন, আমি না খেয়ে থাকি। ”
অভিমান প্রকাশ করে দরজার কাছে চলে গেল। পাল্লা মেলে বের হবে তখনই দুটি নরম ও ঈষৎ উষ্ণ হাতের স্পর্শ পেল পেট ও বুকের মাঝামাঝি অংশে। দীর্ঘ পরিচিত ও প্রিয় কণ্ঠস্বরটি বলল,
” এই জড়িয়ে ধরলাম। এবার খেয়ে নেও। ”
নিবিড় মৃদু হাসল। স্ত্রীর হাতদুটো আরও টেনে একত্রে করে বাঁধন গাঢ় করল। হালকা স্বরে সুধাল,
” ভুলাতে চাচ্ছেন? ”
স্বামীর পিঠে মাথা বিছিয়ে রাখল আলতো করে। মোলায়েম স্বরে বলল,
” যেটা পারি সেটাই তো করব। ”
” এবার যে এই গুণটি কাজে লাগবে না ”
” এমন বলে না। সহজ হও। মেনে নেওয়ার চেষ্টা তো করো। অনুকে আমি গড়েছি। বড় করেছি। যোগ্যতায় আমার চেয়েও কয়েক গুণ এগিয়ে। আমার বিশ্বাস একমাত্র ঐ পারবে তোমাকে সুখী ও পরিপূর্ণ করতে। ”
নিবিড়ের নরম হয়ে আসা শরীরটা শক্ত হলো মুহূর্তেই। কোমলের হাতের বাঁধন মুক্ত করতে চাইল, পারল না। হাতদুটো সর্ব শক্তিতে তার শার্ট খামচে ধরে আছে। ভীষণ চাপে দেহের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে যেন। তেমন অবস্থায় শুনল,
” এই পৃথিবীতে পাওয়া শ্রেষ্ঠ উপহারটি হলো, আমার স্বামী। শ্রেষ্ঠ আনন্দ হলো, তার সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত। দীর্ঘ সাত বছরের দাম্পত্য জীবনে সামান্যতম ঝগড়া হয়নি আমাদের। রাগারাগি, ছাড়াছাড়ি হওয়ার মতো কোনো ঘটনাও তৈরি হয়নি। সেই শুরু থেকে আজ অবধি একইভাবে, একই পরিমাপে ভালোবাসা পাচ্ছি। একজন স্ত্রী হিসেবে এ আমার পরম পাওয়া। এরপরও কি আমার চাওয়া থাকতে পারে? আমার তো কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে করতে বাকি জীবন কেটে যাবে। ”
” এজন্য স্বামীকে দান করে ফেলবেন, তাই তো? ”
কোমলের খামচির জোর আর টিকল না। নিবিড় বাঁধন থেকে মুক্ত হলো। তার মুখোমুখি হয়ে বলল,
” আপনিও আমার শ্রেষ্ঠ উপহার, শ্রেষ্ঠ আনন্দ। তাই বলে কি আমার চাওয়া শেষ হয়ে গেছে? যায়নি। আমি আমৃত্যু আপনার সঙ্গ চাই। নিভৃতে, খুব যত্নে। আমার প্রতিটা ভোরের সূচনা করতে চাই, আপনাকে দেখে। নিশিরাতের স্বপ্নটাও দেখতে চাই, আপনার স্পর্শে থেকে। ”
” নিজে থেকে বুঝে না। বুঝালেও বুঝে না। ধুর! ”
কোমল বড় বড় পা ফেলে বিছানায় গিয়ে বসল। নিবিড়ও তার পাশে বসল। জিজ্ঞেস করল,
” আপনি রাগ করেছেন? ”
সে উত্তর দিল না। তাকালও না। ভ্রূ কুঁচকাল শুধু। নিবিড় ভীষণ উৎসাহের সাথে জিজ্ঞেস করল,
” আপনি বিরক্ত হচ্ছেন? ”
কোমল এবারও নিরুত্তর থাকল। বসা থেকে উঠতে চাইলে হাত ধরে ফেলল নিবিড়। জোর করে বসিয়ে দিয়ে কোলে মাথা রাখল। পা’দুটি খাটে তুলে লম্বাভাবে মেলে দিয়ে বলল,
” রাগের কারণ যায়-ই হোক। করেছেন তো। আমার এতেই চলবে। দিনের বাকি সময়টা আপনার রাগ ভাঙাতে ব্যয় করা যাবে। ”
স্ত্রীর ডানহাতটা মাথায় রেখে বলল,
” আপনি আপনার স্বামীকে দান করতেই পারেন। সম্পূর্ণ অধিকার আছে আপনার। করেছেনও। এবার বাকিটা স্বামীকেই সামলাতে দেন। ”
কোমল চুলে আঙুল ডুবিয়ে দিয়ে উদাস হয়ে পড়ল। দৃষ্টি জোড়া নিবিড়ের মুখটা ছাপিয়ে কোথাও হারিয়ে গেছে। আনমনে ভাবছে, না পারছে মানুষটাকে জোর করে দূরে সরাতে, না পারছে বুকের সাথে বেঁধে নিতে। এরচেয়ে অপেক্ষা করা-ই শ্রেয় হতো। স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন চিরস্থায়ীভাবে বেঁধে রাখার একমাত্র সুতো হলো সন্তান। যেটা তাদের নেই, হবেও না কোনোদিন। ফলে, ধীরে ধীরে এই বন্ধন ঢিলা হতো, দুর্বল হতো, পক্কতা হারাত। ঠিক সেই সময়ে ভালোবাসার গভীর অর্থ, কারণ, সংঙ্গা বদলে যেতো। তার প্রতি এই শক্ত টানটা কমে যেত। চোখজোড়া পড়ত অন্য কোথাও। কল্পনায় আসত অন্য নারী। সেই সময়ে বিয়ের কথা বললে হয়তো এত ঝামেলা হত না। মেনে নিত খুব সহজে। সংসার হত, নতুন অতিথির আগমনও হত। এখন যদি স্বামীর সোহাগ ভাগ করতে পারে, তখনও পারত নিশ্চয়। তাহলে কোন ভয়ে এত জলদিতে দ্বিতীয় বিয়ে করানোর জন্য উঠে-পড়ে লেগেছিল সে? মাঝখান থেকে নিবিড়ের কষ্ট বাড়ছে, অনড়া সংসারে জড়িয়েও মূল উপকরণটাকেই পাচ্ছে না! কোমলের হৃদয় ভার হয়ে এলো অনুতাপে। আফসোস গড়িয়ে পড়তে শুরু করল নিশ্বাসে, চাহনিতে। দেহভঙ্গিতে ছড়িয়ে পড়তে কুলসুম নাহারের মুখটা ভেসে ওঠল চোখের তারায়। তার দুঃখী মুখটা আনন্দে রূপ পাচ্ছে ধীরে ধীরে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে একটা সুসংবাদের জন্য। মাঝে মাঝে তো কোমলকে জিজ্ঞেসও করে বসে, তাদের খবর কী। তাড়া দেয়, নিবিড় ও অনড়াকে বুঝানোর জন্য। বয়স হচ্ছে তার। মৃত্যুদূত চলে আসার আগেই নাতি-নাতনির মুখ দেখতে চান। তার ইচ্ছেটা মনে পড়তে অনুতাপের আগুনটা তাপ হারাতে শুরু করল।
” শার্টটা উপরে তুলুন। ”
নিবিড়ের কণ্ঠে উদাসভাব কাটে তার। প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালে সে আবার বলল,
” তুলুন, তাহলেই বুঝতে পারবেন। ”
কোমল শার্ট উপরে তুললে নিবিড় সামান্য ডানে ঘুরল। পিঠটা আলগা হয়ে চোখের সামনে আসতে চাপা চিৎকারে বলল,
” এগুলো কিসের দাগ? কীভাবে হলো? ”
নিবিড় একপেশে হেসে বলল,
” আপনি ব্যথা দিচ্ছেন হৃদয়ে। আপনার বোন দিচ্ছে শরীরে! ”
ব্যথার স্থানে স্ত্রীর সস্নেহের স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠল সামান্য। শার্ট নিচে ছেড়ে বামে ঘুরে সোজা হলো। বলল,
” ক্ষিধে পেয়েছে। শুয়ে খাওয়ার মতো শুকনো কিছু আছে? উঠতে ইচ্ছে করছে না। একটু খায়িয়ে দেন না। ”
তার এমন আবদারে কোমল বিস্মিত না হয়ে পারল না। নরম কণ্ঠে শক্ত করে বলল,
” শুকনো খাবার থাকলেও শুয়ে খাওয়া যাবে না। উচিতও না। উঠে বসো। খায়িয়ে দিচ্ছি। ”
নিবিড় অনিচ্ছায় উঠে বসল। কোমল প্লেটের ঢাকনা সরাতে বলল,
” থাক, আমি নিজেই খাচ্ছি। তুমি বরঞ্চ তোমার বোনের রুম থেকে ঘুরে আসো। ”
” কোনো দরকার? ”
” হ্যাঁ, ওর পরনে যে শাড়িটা আছে ওটা খুলে নিয়ে আসবে। ”
” কেন? ”
” আজকে যে কাণ্ডটা করেছে, এরপর তোমার জিনিসে ভাগ বসাবে তো দূর স্পর্শ করতেও দিব না। ”
” ওটা আমার না ওর-ই। ”
” কীভাবে হলো? আমি তোমার জন্য এনেছিলাম। ”
” এখানেই তো ভুল হয়েছে। স্ত্রী দুজন অথচ শাড়ি এনেছ একটা। ”
নিবিড় স্তম্ভিত হলো। একটুক্ষণ নির্বোধ থেকে বলল,
” আগে এক স্ত্রীর ভরণ-পোষণের দায়িত্বও দেওনি। এখন একসঙ্গে দুজনের দিচ্ছ। তোমার মন থেকে কি দয়া-মায়া সব হারিয়ে যাচ্ছে? ”
” তখন সামর্থ্য ছিল না, এখন আছে। ”
” আমি এতকিছু জানি না। তুমি শাড়িটা ফিরিয়ে আনো। ”
কোমল জায়গা থেকে নড়ল না। তাকে মানাতে বলল,
” ঠিক আছে, এরপর থেকে সবকিছু দুটো আনব। এখন তো যাও। ”
” না। ফিরিয়ে আনলে তুমি এই ভুল আবার করবে। এটা ওর কাছে থাক। তোমারও একটু শাস্তি হবে। ”
_________
স্নেহের অনড়া,
বেশ কিছুদিন ধরে খেয়াল করছি, আপনি নিয়মিত ক্লাসে আসছেন না। আসলেও অমনোযোগী থাকছেন সারাক্ষণ । এর কারণ কী পারিবারিক ঝামেলা নাকি ব্যক্তিগত কিছু? প্রশ্নটা উত্তরের জন্য না।
যাইহোক, সামনে পরীক্ষা। রুটিন প্রিন্ট হয়ে গেছে। আপনার জন্য কিছু নোট ও রুটিনটা পাঠিয়ে দিলাম। আশা করছি, আপনার কাজে দিবে।
ইতি,
চেনা কেউ
পুনশ্চঃ রূপে, গুণে ও মেধায় আপনি অনন্য। সবার থেকে আলাদা। তাই গোপনে আপনার একটা নাম ঠিক করেছি। বলুন তো কী হতে পারে? হিন্ট দিব? আপনার নামের সাথে ঐ নামেরও একটু মিল আছে। আদর করে ডাকলে দুটো একরকম-ই শুনাবে।
চিঠিটা পড়ে অনড়ার শরীর জ্বলে উঠল। মেজাজ হলো আগুনের মতো। ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর বুবুর কাছ থেকে একটা মোবাইল উপহার পেয়েছিল সে। যার নাম্বারটা বাড়ির বাইরে শুধুমাত্র কলেজের খাতা-পত্রে দেওয়া আছে। সেখান থেকে নিশ্চয় কেউ তাকে নোট পাঠাবে না? এত দয়াবান ইউনিভার্সিটির কর্তৃপক্ষ হতে পারে না। অসম্ভব! অথচ কুরিয়ার সার্ভিসের অফিস থেকে তার নাম্বারেই কল এসেছে। নাম্বারটা অন্য কাউকে দিয়েছে নাকি ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল সুৃমনার কথা। ভার্সিটিতে গেলে বেশিরভাগ সময় কাটানো হয় ওর সাথে। একবার নাম্বার নেওয়ার জন্য খুব জোরাজুরি করলে এই নাম্বারটা দিয়েছিল। দুই-একবার কলে কথাও হয়েছিল তাদের। অনড়া তাৎক্ষণিক কল লাগাল সুমনার নাম্বারে৷ ধরতেই বলল,
” তুই কি আমার জন্য নোট পাঠিয়েছিস? ”
সে বোধ হয় আকাশ থেকে পড়ল। বিস্ময়ের অতিকে ওঠে বলল,
” আমি নোট পাঠাব তোকে? এমন ধারণাও তোর হতে পারে? ”
” ঢং বাদ দিয়ে সোজাসুজি উত্তর দে। ”
” উত্তর পাওয়া বাকি আছে এখনও? উল্টো আমি অপেক্ষায় আছি, তোর কাছ থেকে নোট নিয়ে পড়ব বলে। ”
” কাউকে আমার নাম্বার দিয়েছিস? অথবা কেউ চেয়েছে কখনও? ”
” কই, না তো। ”
তার স্পষ্ট জবাবে কল কেটে দিল অনড়া। নোটের দিকে এক পলক চেয়েই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল। পাগলের মতো দু-হাতে মুচড়ে, টেনে ছিঁড়তে লাগল পাতার পর পাতা। পরের দিন ভার্সিটিতে গিয়ে খুব চোটপাট করল ক্লাসে। মিনিটের মধ্যে ক্লাসে গরম ধোয়া উড়তে লাগল। মেয়েদের ব্যাগ থেকে নিজেই খাতা-পত্র বের করে হাতের লেখা মেলাতে শুরু করল। ছেলেদের তো হাতের লেখা মেলানোর পাশাপাশি জিজ্ঞাসাবাদও চালাল। পাশ থেকে সুমনা ভয়ে ভয়ে বার বার বলছিল,
” কী করছিস এসব? রেগে গেলে সর্বনাশ। রাস্তা-ঘাটে পথ আটকে…”
” তুই দূরে যা তো। আমি এই মহাদয়াশীলকে বের করেই ছাড়ব। কত বড় সাহস, আমাকে নোট দিয়ে সাহায্য করে! ”
সুমনা দূরে যাওয়ার বদলে অনড়ার হাত থেকে ছেঁড়া কাগজটা নিল। লেখার দিকে চেয়ে বলল,
” কী সুন্দর লেখা! এমন লেখা আমাদের ক্লাসের কারও হতেই পারে না। আমার মনে হয়, সিনিয়র কোনো ভাইয়া তোর প্রেমে পড়েছে। তাই নোট-টোট দিয়ে মন গলাতে চাচ্ছে আগে থেকে। ”
চলবে