#বিবি
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (২)
অনড়ার বাবা-মায়ের দাম্পত্য জীবন ভালো ছিল না। একটুতেই তর্কে জড়িয়ে পড়ত দুজন৷ কথা কাটাকাটি থেকে মারামারি! রান্না বন্ধ, খাওয়া বন্ধ, কথা বন্ধ থাকত প্রায়শই। এমন অবস্থায় জন্ম হয় অনড়ার। তার জন্মের পর এই ঝগড়াঝাঁটি বেড়ে হয় দ্বিগুণ। অনড়ার বয়স যখন দুই বছর তখন তার মা রাগ করে বাপেরবাড়ি চলে আসে। অনড়ার বাবা সেই রাগ না ভাঙিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করে। এ খবর শোনার পর শ্বশুরবাড়িমুখো হয়নি অনড়ার মা। কয়েকদিন চুপচাপ থেকে নদীর জলে নিজেকে বিসর্জন দেয়। স্ত্রীর মৃত্যুর খবর পেয়েও অনড়ার বাবা দেখতে আসেনি। মেয়ের খোঁজ-খবর নেয়নি। তারপর থেকে নানি জমিলা বেগমের কাছে বড় হচ্ছে অনড়া।
জমিলা বেগম দরিদ্র মানুষ। হা-ভাতের সংসার। ধাইয়ের কাজ করে যা পান তাই দিয়ে নিজের পেট চালাতেন। তন্মধ্যে নাতির দেখাশোনার দায়িত্ব পড়ায় বৃদ্ধ বয়সে কাজ নেন মোল্লাবাড়িতে। ছোট্ট অনড়াকে সঙ্গে নিয়েই সে বাড়ির গৃহকর্ত্রীকে নানান কাজে সাহায্য করতেন। মোল্লাবাড়ির একমাত্র মেয়ে কোমল। সকলের আদুরের এই মেয়েটির আদর গিয়ে পড়ল অনড়ার উপর। কোমলের কোনো ভাই-বোন না থাকায় এই বাচ্চা মেয়েটি হলো তার খেলার সঙ্গী, ছোটবোন। ভাব একটু গভীর হতে বুবু ডাকা শেখাল। বইপত্র কিনে দিয়ে পড়ানো শুরু করল। জমিলা বেগমের দায়িত্বের বোঝাও যেন একটু কমল। প্রসূতিসদনে ডাক পড়লে কোমলের কাছে রেখে যেতেন নিশ্চিন্তে। কোমলও সুযোগে বড়বোনের মতো খায়িয়ে-দায়িয়ে নিজের বিছানায় ঘুম পাড়িয়ে দিত। আজও তাই ঘটেছিল। দূরপাড়া থেকে জমিলার ডাক পড়লে অনড়াকে কোমলের কাছে রেখে যান। সন্ধ্যা শেষে রাত নামলেও তার ফেরার নাম নেই। পড়া শেষ করে খেয়ে নিয়েছে অনড়া। ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। হঠাৎ বলল,
” তুমি ছেলেকে দেখেছিলে? ”
কোমল দরজায় সিটকানি টানতে টানতে জিজ্ঞেস করল,
” কোন ছেলে? ”
” তোমাকে দেখতে এসেছিল যে। ”
” না। ”
” আমি দেখেছি। মাথায় চুল নেই অথচ ঠোঁটের উপর ইয়া মোটা গোঁফ। ভালো হয়েছে বিয়ে ভেঙে গেছে। তোমার সাথে একটুও মানাত না। ”
কোমল বিছানায় উঠল। অনড়ার পাশে শুয়ে কাত হলো। কৌতূহলীভঙ্গিতে বলল,
” একটুও মানাত না? ”
” না। ”
” কেন? ”
” দেখতে ভালো না তাই। ”
” দেখতে ভালো না হলে মানায় না? ”
” সবাই তো তাই বলে। ”
” ভুল বলে। ”
মাত্র কৈশোরে পা দেওয়া মেয়েটি কোমলের কথার ভাবার্থ ধরতে পারল না। বলল,
” তোমার কম চুল, মোটা গোঁফ পছন্দ? ”
” না। ”
” তাহলে? ”
” তাহলে কী? ”
” তোমার কেমন ছেলে পছন্দ? ”
” আমার পছন্দ শুনে কী করবি? ”
” ছেলে খুঁজে আনব। ”
” তাই? ”
অনড়া মাথা নাড়ে। কোমল একটু ভাবার ভঙ্গি করে বলল,
” যে ছেলের মন সুন্দর আমার তাকে পছন্দ। ”
একটু থেমে আবার বলল,
” যে ছেলের ব্যবহার সুন্দর আমার তাকে পছন্দ।
আরেকটু থেমে বলল,
” যে ছেলের চরিত্র সুন্দর আমার তাকেও পছন্দ। ”
অনড়া চোখ বড় বড় করে বলল,
” তুমি তিনটা ছেলেকে বিয়ে করবে? আমি তিনজনকে দুলাভাই ডাকব? ”
কোমল শব্দ করে হেসে ফেলল। তার এই হাসির কারণ ধরতে পারল না অনড়া। জিজ্ঞেস করল,
” হাসছ কেন? ”
কোমল উত্তর দেওয়ার বদলে হাসতেই থাকল। অনড়া মুখ কালো করে ফেললে সে বলল,
” এই তিনটি গুণ তিনজন আলাদা ব্যক্তি কেন? একজনের মধ্যে থাকতে পারে না? ”
অনড়া একটু সময় নিয়ে উত্তর দিল,
” পারে তো। ”
” তাহলে সে ছেলে ধরে নিয়ে আয়। বিয়ে করে ফেলি। ”
অনড়া ভীষণ খুশি হলো। উৎসাহি কণ্ঠে বলল,
” সুন্দর মন, সুন্দর ব্যবহার, সুন্দর চরিত্রের ছেলেটিই হবে আমার বুবুর সুন্দর বর। ”
অনড়ার গাল টেনে ধরে কোমল বলল,
” উহু, উত্তম ব্যবহার, উত্তম মন ও উত্তম চরিত্রের ছেলেটিই হবে তোর বুবুর উত্তম বর। ”
_______________
ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছে নিবিড়। দু’মাস হতে চলল পরিবার থেকে দূরে। প্রিয়জনদের মুখ দেখছে না। যোগাযোগ রাখছে চিঠি-পত্রের মাধ্যমে। রাত-দিন এক করে টানা পড়ার গতি আরও বেড়েছে আজ। কাল তার মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষা। খাওয়া, ঘুম, বিশ্রাম ত্যাগ করে একনাগাড়ে পড়ছে। ঠোঁটের সাথে হাতও চলছে তাল মিলিয়ে। লিখতে লিখতে হঠাৎ কালি শেষ হয়ে যাওয়ায় কলম খুঁজছিল। তখনই একটি সোনার কানের দুলে চোখ পড়ে। মুহূর্তেই চঞ্চল দৃষ্টি আচঞ্চল হয়। অস্থির ঠোঁট জোড়া স্থির হয়। নিবিড় পড়া ভুলে, ধ্যান হারায়। অচেতনতায় দুলটি হাতে নিয়ে চোখের সামনে ধরে। দৃষ্টিতে ধরা পড়ে গভীর মোহ, মুগ্ধতা। শুষ্ক ঠোঁটদুটিতে লাজুক হাসি। সন্ধ্যার মায়া ঠেলে আবির্ভুত হয় দুটি চোখ। কী মায়া সে চোখে! কী নেশা তার পলকে! নিবিড়ের হৃদয় পুলকিত হয়। উন্মত্ত হয় চাওয়া-পাওয়া। সেসময় কেউ একজন ছোঁ মেরে দুলটি নিয়ে গেল। নিবিড় পাগলপ্রায় অবস্থায় পেছন ঘুরে। ব্যাকুল হয়ে বলল,
” দুলাল ভাই, দুলটা দেন। ”
দুলাল হলো নিবিড়ের রুমমেট। বয়সে বড় হওয়াই ভাই সম্বোধন করে নিবিড়। শ্রদ্ধাও করে। তার ছোট-খাটো প্রয়োজন দুলালভাই মিটিয়ে দেয়।
দুলাল ভাই দুলসহ ডানহাতটা পেছনে মুড়ে নিয়ে বললেন,
” আগে বল এর রহস্য কী? ”
” কোনো রহস্য নেই। ”
” আছে। অবশ্যই আছে। কেউ মারা গেলেও তোকে পড়ার টেবিল থেকে উঠানো যায় না। অথচ এই সামান্য দুলটা শুধু পড়া না, দুনিয়াটাই ভুলিয়ে দেয়। এর কারণ কী? কী আছে এতে? ”
নিবিড় উত্তর দিতে পারে না। চুপও থাকতে পারে না। অস্থিরচিত্তে দাঁড়িয়ে থাকে। দুলাল গভীরভাবে জরিপ করেন নিবিড়কে। সন্দিহানে বললেন,
” প্রেম করছিস? ”
নিবিড় লজ্জা পেল। দৃষ্টি নত করল। অস্থিরভাব দমিয়ে রাখার পুরো চেষ্টা চালালেও সফল হলো না। দুলাল ভাই ধরে ফেললেন। সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন,
” নাম কী? ”
” জি? ”
” দুলকন্যার নাম কী? ”
নিবিড় সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিতে পারল না। খানিক্ষন ইতস্ততায় ভুগে ধীরে বলল,
” কোমল। ”
দুলাল বিস্ময় কণ্ঠে বলল,
” তুই সত্যি প্রেম করছিস? ”
নিবিড় তড়িঘড়িতে বলল,
” একদম না। ”
” তাহলে? ”
” পছন্দ করি। ”
দুলাল জিজ্ঞাসা পর্ব শেষ করতে পারল না। মধ্যপথে একটি চিঠি এসে পৌঁছাল নিবিড়ের হাতে। ঠিকানা দেখে জানাল,
” বাড়ি থেকে এসেছে। ”
” চিঠি পড়ে শেষ কর। খেতে যাব। ”
নিবিড় অনুমতি পেয়ে চিঠির খাম খুলল। এক নিশ্বাসে পুরোটা পড়ে আমচকা বলল,
” তোমার কাছে একশ টাকা হবে, দুলাল ভাই? ”
” একশ টাকা? কেন? ”
” বাড়ি যাব। ”
” চাচা-চাচির কিছু হয়েছে? ”
” না। ”
” তাহলে? ”
নিবিড়ের উত্তর দেওয়ার সময় নেই যেন। চটপটে শার্ট গায়ে দিয়ে বলল,
” এখন বলার সময় নেই। এসে বলব। টাকা থাকলে দেও। ”
দুলাল টাকা বের করতে করতে বলল,
” এখনই যাবি? কাল না তোর পরীক্ষা? ”
” সে পরে দেখা যাবে। ”
দুলালের দিতে হলো না। নিবিড় নিজেই একশ টাকার নোটটি নিয়ে দরজার দিকে ছুটল। দুলাল পেছন থেকে বলল,
” পরীক্ষাটা না দিলে তোর স্বপ্ন ভেঙে যাবে। ”
নিবিড় চোখের আড়াল হতে হতে বলল,
” এখন না গেলে আমার ভবিষ্যৎ হারিয়ে যাবে। ”
________________
নিবিড় বাড়িতে পৌঁছাল মাঝরাতে। কুলসুম নাহার শঙ্কিত গলায় বললেন,
” তুই? এতরাতে? ”
নিবিড় মায়ের প্রশ্নের জবাব দিল না। মায়ের পেছনে দাঁড়ানো বাবার উদ্দেশ্যে বলল,
” আমি কোমলকে বিয়ে করব, বাবা। আজ, এখনই। ”
মতিন মিয়ার চোখ জ্বলে উঠল। স্ত্রীর পেছন থেকে সামনে এসে জিজ্ঞেস করলেন,
” গাঞ্জা খাইছস? ”
” না, বাবা। ”
” তাইলে মদ খাইছস। ”
” আমি কিছু খাইনি, বাবা। ”
” তাইলে তোর মাথা খারাপ হইয়া গেছে। ”
নিবিড় শান্ত থাকতে পারল না। অধৈর্য্য হয়ে বলল,
” এসব কেন বলছ, বাবা? আমার মাথা ঠিক আছে। ”
” আমি বিশ্বাস করি না। মাথা ঠিক থাকলে কি তোর থেকে ছয় বছরের বড় মাইয়ারে বিয়া করতে চাইতি? ”
মতিন মিয়া স্ত্রীর দিকে ঘুরে আবার বললেন,
” তোমার পোলার মাথা নষ্ট হইয়া গেছে। জলদি সামলাও। নাহলে আমাগো পেটে লাথি মারব। ”
চলবে
#বিবি
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৩)
নিবিড়ের বাবা একজন দিনমজুর। মোল্লাবাড়ির জমিতে হালচাষ করেন। তার একা আয়ে তিনজনের পেট চললেও ঢাকতে পারে না। নিতান্ত বাধ্য হয়ে মোল্লাবাড়ির কর্তা আনিস মোল্লার কাছে স্ত্রীর জন্য একটি কাজের অনুরোধ করেছিলেন। আনিস মোল্লা ভালো মানুষ। অনুরোধ ফিরিয়ে দিলেন না। স্ত্রীলোক বিধায় ক্ষেত-খামারে কাজ না দিয়ে বাড়িতে তার বেগমের কাছে পাঠাতে বলেন। রাবেয়া খাতুন নিজের কাজে না রেখে কোমলের পরিচারিয়া পদে নিযুক্ত দেন। এতে বড়ই খুশি হোন মতিন মিয়া। স্বপ্ন দেখেন, তার ছেলে গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি দিচ্ছে। বড় দালানের ভেতর পড়াশোনা করছে। তারপর হুট করে সাদাকোট পরে বলছে, ‘ বাবা, আমি ডাক্তার হয়ে গেছি। তোমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। ‘
স্বামীর আদেশে কুলসুম নাহার শঙ্কিত হয়। বিপট টের পায়। দ্রুত ছেলের কাছে এগিয়ে বললেন,
” শান্ত হ, বাপ। ভিতরে আইয়া ব। মাথা ঠাণ্ডা হইব। ”
নিবিড় আপত্তি করে বলল,
” আমার কাছে এত সময় নেই। তোমরা আমার সাথে চলো। ”
” কই যামু? ”
” কোমলদের বাড়িতে। বিয়ের কথা বলতে। ”
ছেলের এই উদ্ধত আচরণ মা সহ্য করলেও বাবা সহ্য করতে পারলেন না। স্ত্রীকে একহাতে সরিয়ে অন্যহাতে চড় মেরে বসলেন ছেলের গালে। চিৎকার করে বললেন,
” এহন হাত দিয়া মারছি, আরেকবার কোমলের নাম মুখে নিলে কুঞ্চি দিয়া পিটামু। ভিতরে যা। ”
ধমকের মধ্যেই নিবিড়ের শার্টের কলার চেপে ভেতরের দিকে টান দিলেন। পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলাল নিবিড়। সেই অবস্থায় দৃঢ় গলায় বলল,
” আমার রক্তে যদি বন্যা বয়ে যায় তবুও সিদ্ধান্ত বদলাবে না। ”
ছেলের এমন মাত্রাতীত সাহস দেখে মতিন মিয়া ভয়ংকর রেগে গেলেন। নিবিড়ের দিকে তেড়ে আসলে কুলসুম নাহার ছোলের একহাত চেপে ধরলেন। জোর করে টেনে আনলেন নিজের রুমে। চৌকিতে বসিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। বুঝাতে চাইলেন, কোমল উঁচু বংশের মেয়ে। বিশাল সম্পত্তির মালিক। গ্রামের সকলে শ্রদ্ধার চোখে দেখে, সম্মান করে। অন্যদিকে নিবিড়দের ভিটেটুকু ছাড়া কিছু নেই। বাবা-মা দুজনেই কোমলদের নিযুক্ত কর্মচারী। তাদের টাকায় সংসার চলে, নিবিড়ের পড়াশোনার খরচ চলে। কোমলের চেয়ে নিবিড় শুধু বয়সেই ছোট না, সবকিছুতেই ছোট। এমন ছেলের কাছে কোমলকে কেন বিয়ে দিবে? আনিস মোল্লা ভালো মানুষ হতে পারেন কিন্তু বোকা নন।
মায়ের দাঁড় করানো যুক্তিগুলো ধূলোর মতো উড়িয়ে দিল নিবিড়। বলল,
” পরিশ্রমের বিনিময়ে টাকা নেও। এমনি এমনি না। ”
” সুযোগ তো তারাই দিতাছে, তাই না? ”
মায়ের আরও একটি যুক্তিতে বিরক্ত হলো নিবিড়। দাঁড়িয়ে বলল,
” জানি না। ”
” সত্যকে এড়াইয়া গেলে তো হইব না, বাপ। মাথা খাটাইতে হইব। ”
ছেলের দিক থেকে উত্তর না পেয়ে আবার বললেন,
” তোর তো বিয়ার বয়সও অয় নাই। কাম-কাজ কিছু করছ না। পড়ালেখা শিখে ডাক্তার হ। তারপরে তোর জন্য বউ খুঁজমু। পরীর মতো বউ আনমু। দেখবি, পুরা গ্রাম চাইয়া থাকব। ”
নিবিড় এবারও নিরুত্তর থাকলে কুলসুম নাহার উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন,
” থম ধইরা আছস ক্যান? আমি কী কইতাছি বুইঝা ল। ভাইবা দেখ। বড় হইতাছস, দুনিয়া দেখতাছস। সবই বুঝার কথা। ”
নিবিড় মায়ের কাছ থেকে দূরে হেঁটে গেল অস্থিরভাবে। চুপচাপ থাকল কয়েক মুহূর্ত। সহসা পেছন ঘুরে বলল,
” আমি কোমলকে ছাড়া কিছু ভাবতে পারছি না, মা। ক্ষমা করে দেও। ”
এটুকু বলে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে চাইল নিবিড়। কুলসুম নাহার দ্রুত জিজ্ঞেস করলেন,
” কই যাস? ”
” কোমলের কাছে। ”
কুলসুম নাহার দৌড়ে এসে ছেলের পথরোধ করে বললেন,
” তুই কি সত্যি পাগল হইছস? ”
” তোমাদের কাছে যদি সেরকম মনে হয় তাহলে তাই। ”
কুলসুম নাহার পরাজিত মেনে নিলেন না। কান্নার ভাব ধরে বললেন,
” এহন কোমলই তোর সব? আমরা কিছু না? আমগো ভালোবাসার কোনো মূল্য নাই? দাম নাই? ”
” দাম বা মূল্য কোনো নির্দিষ্ট প্রতিপাদ্য বিষয়ের উপর নির্ভর করে না। সময়, পরিস্থিতি আর ব্যক্তির প্রয়োজনের উপর নির্ভর করে। আর এই মুহূর্তে আমার কোমলকে প্রয়োজন। তোমরা কেন বুঝতে পারছ না? ”
নিবিড়ের কণ্ঠে আকুলতা। ভেঙে পড়ার জোয়ার। কাতর কণ্ঠে বলল,
” আমাকে দুর্বল না করে সাহস দাও, মা। আমি হয়তো আমার মনের অবস্থা তোমাদের বুঝাতে পারছি না। ”
ছেলের এমন আকুল প্রার্থনায় মন গলে গেল কুলসুম নাহারের। বললেন,
” কোমল তো তোরে পুরাই পাগল বানাইয়া দিছে। খুব ভালোবাসে তোরে? ”
নিবিড় চোখ তুলে তাকাল মায়ের দিকে। এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল,
” জানি না, মা। ”
” জানিস না মানে? ”
” এ নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো কথা হয়নি। ”
কুলসুম নাহার বিস্ময়াপন্ন হয়ে বললেন,
” তাইলে বিয়ের জন্য পাগল হইছস ক্যান? ”
” পরে যদি সুযোগ না পাই? ”
কুলসুম নাহার কী বলবেন ভেবে পেলেন না। নিবিড় ঘড়ি দেখে বলল,
” সময় নেই, মা। আমার আবার ঢাকায় ফিরতে হবে। আমি এগুলাম। তুমি বাবাকে নিয়ে আসো। ”
নিবিড় সত্যি সত্যি বেরিয়ে গেলে কুলসুম নাহারের চেতন হলো। ছুটে গেলেন স্বামীর নিকট। পায়ে পড়ে বললেন,
” আর অমত কইরো না। আমার লগে লও। ”
মতিন মিয়া বাকরুদ্ধ থেকে ধমকে উঠলেন,
” পোলারে বুঝ দিতে গিয়া নিজেই অবুঝ হইয়া আইছ দেহি। তোমার কী মনে হয়? আমরা বিয়ার প্রস্তাব দিমু আর উনি খুশি হইয়া মিষ্টি বিলাইব? লাত্থি দিয়া বাইর কইরা দিব। গ্রাম ছাড়াও করতে পারে। ”
” তেমন হইলে গ্রাম ছাইড়া দিমু। আমার একটাই পোলা। ওর ভালার লাইগা যদি রক্ত পানি কইরা টাকা কামাইতে পার তাইলে ঝরাতে পারবা না? ”
মতিন মিয়া স্তব্ধ হয়ে গেলেন। স্ত্রীর দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে থাকলে কুলসুম নাহার আঁচলখানা কাঁধে টেনে নিয়ে বললেন,
” তুমি না গেলে নাই, আমি যামু। আমি বাঁইচা থাকতে ওরে একা মাইর খাইতে দিমু না। দশ মাস পেটে ধরছি কি একা ছাইড়া দেওয়ার জন্য? মাইর খাইয়া পইড়া থাকার জন্য? ”
কুলসুম নাহার জেদ ধরে ছেলের পিছু ছুটলে মতিন মিয়া বসে থাকতে পারলেন না। কয়েক মিনিট বাদেই বড় বড় কদম ফেলে স্ত্রীর কাছে চলে গেলেন। ফিসফিস করে বললেন,
” আমি যদ্দুর জানি, কোমল পুরুষ মানুষের লগে কথা কয় না। খুব দরকার ছাড়া বাইরে যায় না। বাড়ির ভিতরেও কঠিন পর্দা করে। আমি এত বছর ধইরা মোল্লা সাহেবের লগে আছি, ঐ বাড়ি যাওয়া-আসা করি তাও কোমলের মুখ দেখতে পারি নাই। তোর পোলা ক্যামনে দেখল? ”
কুলসুম নাহার নিচু স্বরে উত্তর দিলেন,
” দেখে নাই। ”
” তাইলে ভালোবাসা-মহব্বত ক্যামনে হইল? ”
” তোমার পোলারে গিয়া জিগাও। আমি ক্যামনে কমু? ”
স্ত্রীর খিটখিট মেজাজে খানিকটা দমে গেলেন মতিন মিয়া। কৌতূহল দমন করতে চেয়েও পারলেন না৷ একটু চুপ থেকে জিজ্ঞেস করলেন,
” এতই যদি মহব্বত তাইলে কোমল বিয়া আটকায় না ক্যান? একের পর এক পোলা তো দেখতে আইতাছে। ”
” সাহস নাই মনে হয়। ”
” তোমার পোলার তো খুব সাহস। বাপ-মাকে গ্রাম ছাড়া করার জন্য উইঠা-পইরা লাগছে! গ্রাম ছাড়া হলেও ভালো, পৃথিবী ছাড়া না হইলেই হয়। ”
কুলসুম নাহার উত্তর দিলেন না। অন্ধকার পথে ছেলের থেকে নিজেদের দূরত্ব কমিয়ে আনছেন কদমে কদমে। মতিন মিয়া একটুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
” কোমলের বিয়ার কথা হইতাছে শুইনাই মনে হয় আমার পোলাডা ছুইটা আইছে। কিন্তু ও শুনল ক্যামনে? ”
কুলসুম নাহার থেমে গেলেন। খুব বেশি পড়াশোনা না থাকলেও বানান করে একটু-আধটু লিখতে পারেন। সে গুণেই ছেলের চিঠির উত্তর দেন মাঝে মাঝে। শেষ চিঠিটায় নিজেদের কথা লিখতে গিয়ে কোমলের কথা লিখে ফেলেছেন। তাকে দেখতে এসে পাত্রপক্ষ কত বড় ঝামেলা করেছিল তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করেছিলেন। তাহলে কি এই চিঠিই তাদের কাল হয়ে দাঁড়াল?
” দাঁড়াইয়া পড়লা ক্যান? ”
স্বামীর প্রশ্নে কুলসুম নাহার হালকা ছিটকে উঠলেন। সত্য কথাটা চেপে গিয়ে বললেন,
” কোমলও মনে হয় আমগো মতো চিডি লিখে পাঠায় নিবিড়ের কাছে। সেখান থেইকা জানতে পারছে। ”
” হ, তাই অইব। ”
মতিন মিয়া স্ত্রীর মিথ্যার সাথে মত মিলাইয়া পায়ের গতি বাড়ালেন। তাড়া দিয়ে বললেন,
” তাড়াতাড়ি হাঁটো, পোলারে আগে ঐ বাড়িত ঢুকতে দেওয়া যাইব না। মোল্লা সাহেবের লগে পরথমে আমি কথা কমু। লাত্থি দিলে পরথমে আমিই খামু। ”
চলবে