#বিবর্ণ ভালোবাসা
#Tahmina_Akhter
শেষ পর্ব….
যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো,
তুমি চলে এসো, এক বর্ষায়।
সবুজ ঘাসে বিস্তীর্ণ কবরস্থানে কত আপন মানুষ গভীর নিদ্রায় শায়িত আজ। অথচ কিছু বছর আগেও তাদের সাথে কত সুখ, দুঃখ, ভালোবাসা, অভিমান, রাগ জিইয়ে রেখেছিল! কিন্তু, আজ সময়ের পালাবদলে সবই স্মৃতি। মাঝে মাঝে কিছু স্মৃতিরা এভাবে তাড়া করে যে মনে হয় যেন হৃদয় থেকে, এই পৃথিবী থেকে তারা প্রস্থান না নিলেও পারত। কিন্তু, প্রকৃতির নিয়মের বাইরে কি চলা যায়? সময়ের স্রোতে কত মানুষ এই পৃথিবীতে এসেছে, কত মানুষ চলে গেছে পৃথিবীতে স্বল্প সময় কাটিয়ে।
— রুদ্র?? এই রুদ্র??
প্রেয়সীর ডাকে মোনাজাত শেষ করে ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকিয়ে রুদ্র দেখতে পেলো তনুজা মুখে কাপড়ে দিয়ে চেহারা আড়াল করে ওর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে কবরস্থানের মুখ্য দুয়ারের বাইরে। তনুজার সাথে একটুখানি হাসি বিনিময় করে রুদ্র মেঘলার কবরের দিকে তাকিয়ে মনে মনে আপন সুরে বলে উঠলো,
— ভালোবাসা বড্ড অবেলায় আসে রে! তোর এত গাঢ় ভালোবাসা তুই কেন অপাত্রে ঢেলেছিস আমার জানা নেই। ইমরান কিংবা আমি কেউই তোর ভালোবাসার পাবার যোগ্য ছিলাম না। তবুও, তোর ভালোবাসায় আমাদের কারোর মনে একটুখানি ভালোবাসা জাগায়নি। আমি জানি না ইমরানের তোর ভালোবাসার প্রতি কি ধারণা ছিল? কিন্তু, আমারটা আমি হলফ করে বলতে পারি মেঘলা তোকে আমি সবসময় ভালবেসেছি তবে বন্ধু হিসেবে। কারণ, রুদ্রের হৃদয়ে শুধু একজনই আছে, ছিল এবং থাকবে। আর সেই মানুষটা হলো আমার তনুজা। তবে, তোর সাহসী সেই সিদ্ধান্তে আমার মন গর্বে ফুলে ওঠে। আমার বন্ধু শুধুমাত্র আমার ভালোবাসাকে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টায় নিজের সন্তানকে বিনাশর্তে আমাকে দিয়ে দিতে চেয়েছে। তুই অনেক বড়ো মনের মানুষ মেঘলা। দোয়া করি পরপারে তুই যেন অনেক অনেক ভালল থাকিস। আজ আসছি, ভালো থাকিস।
রুদ্র আর পেছন ফিরে তাকালো না। সোজা কবরস্থানের মুখ্য দুয়ারের পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। তনুজার সামনে এসে রুদ্রের পায়ের গতি থেমে যায়।
তনুজা রুদ্রকে নিজের সম্মুখে দেখে মুখের কাপড় সরিয়ে দিয়ে বললো,
— আজ এতক্ষণ অব্দি এখানে! নামাজ তো সেই কখন শেষ হলো।
ঘর্মাক্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে রুদ্র স্তব্ধ হয়। নাকের ডগায় জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। ঘামের দিকে চোখ পরতেই রুদ্রের একটা কথা মনে পরে যায়। যার নাকি নাকের ডগায় ঘাম জমে তার স্বামী বা স্ত্রীর কাছ থেকে নাকি অতিরিক্ত আদর-সোহাগ পায়। এমন কথা মনে আসতেই বেশ হাসি পেলো রুদ্রের। হুটাৎ রুদ্রের এমন আচরণ দেখে তনুজা ভয় পেয়ে যায়। কবরস্থানের কোনো অজানা জিনিস রুদ্রের ওপর ভর করলো না তো আবার।
— এই..ই কি হলো আপনার? এভাবে হাসছেন কেন?
তনুজার প্রশ্ন শুনে হকচকিয়ে যায় রুদ্র। তার মানে ওর চেহারায় হাসি রেখা ফুটে উঠেছে! নিজেকে স্বাভাবিক করে রুদ্র তনুজার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তনুজা শাড়ির আঁচল মাথায় দিয়ে রুদ্রের পেছনে পেছনে এগিয়ে যাচ্ছে।
ভাদ্র মাসের প্রখর রোদ গায়ে লাগছে বেশ। বাগানের উঁচু গাছগুলো কি করে ডালপালা এদিকসেদিক ছড়িয়ে জানান দিচ্ছে তীব্র হাওয়ার আগমনী বার্তা। উত্তরের ডোবায় দশ-বারোটা রাজহাঁস সাতার কাটছে। মাঝে মাঝে ওদের ডাক প্যাক-প্যাকানো ডাক শোনা যাচ্ছে।
রুদ্র এবং তনুজা বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই আট-দশটা ছেলে-মেয়ে এসে ওদের ঘিরে ধরলো। তনুজা আর রুদ্র একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসি দিয়ে সবচেয়ে ছোট্ট দুজন বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে এগিয়ে যায় খাবার ঘরের দিকে। যেখানে প্রায় পঞ্চাশ জনের অধিক লোক একসঙ্গে বসে খাবার খেতে পারে।
তনুজা এবং রুদ্র নিজেদের কোলে থাকা বাচ্চাদের নিয়ে নীচে বিছানো দস্তরখানায় বসলো। অন্যান্য বাচ্চারা এসে একে নিজেদের জায়গায় এসে বসে পরে। তারপর, একে একে জমিদার বাড়ির দাসীরা সবার পাতে খাবার তুলে দেয়।
রুদ্র নিজের কোলে থাকা তিনবছরের ছোট্ট কন্যা আয়রাতের মুখে ছোট্ট এক লোকমা ভাত তুলে দেয়। আয়রাত ছোট্ট মুখে খাবার তুলে নিয়ে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দেয়। মেয়ের হাসি দেখে রুদ্র এবং তনুজা হেসে ওঠে।
সকলের খাবার-দাবার শেষ হলে যার যার ঘরে চলে যায় বাচ্চারা। তনুজা আর রুদ্রের কাছে আয়রাত থেকে যায়। আয়রাতকে ঘুম পাড়িয়ে দখিনা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রয় রুদ্র। তনুজা তখন নিজের চুলগুলো চিরুনি চালিয়ে জট ছাড়াচ্ছে। তারপর, খুব সুন্দর করে হাতে চুল পেঁচিয়ে বড়ো খোপা করে রুদ্রের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
তনুজার উপস্থিতি টের পেয়ে রুদ্র তনুজার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো গভীর দৃষ্টি নিয়ে। রুদ্র খেয়াল করলো তনুজার কানের দুপাশে উপরিভাগে সাদা চুলের আনাগোনা বেড়েছে। মুখটায় তেমন বয়সের ছাপ স্পষ্ট হয়নি তবুও যেন ধীরে ধীরে তনুজা মাঝে বার্ধক্যের চিহ্ন স্পষ্ট হচ্ছে। রুদ্র মনে হলো এই তো সেদিন মোমের পুতুলকে দেখে রুদ্রের কঠিন মন গলে গিয়েছিল একটুখানি ভালোবাসা পাওয়ার নেশায়। অথচ, আজ পনেরোটা বছর কেটে গেছে তাদের বিবাহিত জীবনের। জীবনের কত উত্থান-পাথানের পর আজ রুদ্র – তনুজা এক হয়েছে।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে রুদ্র তনুজাকে টেনে এনে বুকের মাঝে চেপে ধরলো। তনুজা রুদ্রের বুকে মাথা গুঁজে চুপ করে থাকে। রুদ্রের হৃদয়ের আনাচে-কানাচে কি কথা হয় সবটা জানতে চায় তনুজা। কিন্তু, চাইলেও কি আর সবটা জানা যায়?
— তনুজা???
— হুম??
— হয়তো, বিধাতা চায়নি বলে সেদিন মেঘলার মেয়েটা বাঁচেনি। হয়তো বিধাতা চেয়েছেন তোমার আমার সম্পর্ক কোনো বাচ্চার মাধ্যমে আমাদের ভালোবাসার সেতুবন্ধন রচিত না হয়। চেয়েছেন আমরা যেন একে অপরকে ভালোবাসতে পারি আমৃত্যু পর্যন্ত কোনো কারণ ছাড়াই।
— তাই হবে হয়তো। কিন্তু, আল্লাহ যদি আমাদের এক সন্তানের সুখ দেননি কিন্তু আজ এতগুলো বছর পর আমরা কতজনের বাবা-মা হলাম। এতিম বাচ্চাগুলো আমাদের বাবা-মা মেনে বুকের হাহাকার মেটায় আর আমরা ওদের মুখ থেকে বাবা-মা ডাক শুনে নিজেদের শূন্য মরুভূমিতে এক পশলা বৃষ্টির ছোঁয়া পাই।
কথাটি বলতে বলতেই তনুজার গলা ভারি হয়ে আসে। রুদ্র তনুজাকে বুকে চেপে ধরে শক্ত করে।
সেদিন মেঘলার প্রস্থানের পর মেঘলার বাবার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে দেশে আসার বন্দোবস্ত করে রুদ্র। তনুজা সেদিন প্রতিবাদ করেনি। কারণ রুদ্রের করা কাজের উদ্দেশ্য জানার পর তনুজার রুদ্রের প্রতি ধারণা পুরোটা বদলে যায়। তনুজা এবং মেঘলা আর মৃত মেয়েটাকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসে রুদ্র। নিজেদের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করে মেঘলা এবং ওর মেয়েকে। রুদ্র তনুজাকে নিয়ে থাকতে শুরু বাংলাদেশের মাটিতে। বছর দুয়েক অতিক্রম হবার পর রুদ্রের দাদি এবং ওর বড়ো মা রুক্মিণী মারা যায়। সেদিনের পর থেকে রুদ্র আর তনুজা যেন একাকীত্বের বেদনায় জর্জড়িত হতে থাকে।
অতঃপর, অনেক ভেবেচিন্তে রুদ্র সিদ্ধান্ত নেয় বিশাল এই জমিদার বাড়ির একাংশে এতিমখানা খুলবে। যেখানে বাবা-মা হীন সন্তানেরা এসে থাকবে রুদ্র এবং তনুজাকে বাবা-মা হিসেবে জানবে। আজ তেরো বছর হলো এই প্রতিষ্ঠানের। বাচ্চাগুলো যেন সত্যি রুদ্র এবং তনুজার। কত মায়া নিয়ে কথা বলে ওরা। বিশেষ করে আয়রাতকে পেয়ে যেন রুদ্র আর তনুজার জীবন আমূল-পরিবর্তন হয়েছেন।
পুরনো সবটা ভেবে তনুজার গর্বে বুক ফুলে ওঠে। কারণ এমন একটা মানুষের কাছ থেকে ভালোবাসা পেয়েছে তনুজা যে সাত জনম তপস্যা করলেও এমন ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতা ছিল না তনুজার। সন্তান দিতে অক্ষম মানুষটা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভালোবাসাটুকু আজ বিধাতার কাছে বারবার কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে।
রুদ্র তনুজার হাতে হাত রেখে বললো,
— তনুজা, আমি যদি কখনো মরে যাই কিংবা হারিয়ে যাই ধরনী থেকে তবে যত্ন রেখো তোমার আর আমাদের বাচ্চাদের। যদি সময় বের করতে পারো তবে মেঘলার কবরটা বছর বছর লোক দিয়ে পরিষ্কার করে রেখো।
রুদ্রের কথায় বুকে কাঁপন ধরে যায় তনুজার। রুদ্র পাঞ্জাবি খামছি দিয়ে ধরে বললো,
— আমি যেন আপনার আগে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে পারি। কারণ, আপনার হাতের এক মুঠো মাটি যদি আমার কবরে পরে তবে আমার চেয়ে সৌভাগ্যবতী আর কে হবে রুদ্র?
কান্নারত অবস্থায় তনুজাকে দেখল রুদ্রের বেশ কষ্ট অনুভব হলো। তাই তো তনুজার হাত ধরে বাড়ির বাইরে যেতে যেতে তনুজাকে বললো,
— তোমার আমার ভালোবাসা বিবর্ণ হবে না কোনোদিনও। যতদিন থাকব বেঁচে ততদিন শুধু তোমারই রব,প্রেয়সী।
অজানা প্রান্তরে হেঁটে যাচ্ছে দুজন। শেষ বিকেলের আলো, আর নাম জানা পাখির কলরব জানান দিচ্ছে ওদের ভালোবাসা যেন চিরদিন বেঁচে রয় এই পৃথিবীর বুকে।
সমাপ্ত…