বিবর্ণ ভালোবাসা পর্ব-১৫

0
1080

#বিবর্ণ ভালোবাসা
#Tahmina_Akhter

১৫.

….পাকিস্তানী এক ছেলের সঙ্গে আমার কঠিন প্রেম জমে গেলো ভার্সিটির প্রথমদিনেই। এত মায়াময় চেহারা ছিল তার! ছোট্ট ছোট্ট চোখগুলো দিয়ে যখন আমার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতো না তখন আমার এক অন্যরকম অনুভূতি হতো! বলে প্রকাশ করা যাবে না কেমন অনুভব করতাম আমি? ক্লাস মিস করে দুজনে চলে যেতাম পাশের কোনো আয়ল্যান্ডে। মাথার ওপরে নীলচে আকাশ, বাতাসের দোলে নারকেল গাছের মন জুড়ানো শীতল বাতাস, সূর্যের তীক্ষ্ণ আলোতে যখন ইমরান চোখ মুখ কুচকে মুগ্ধ হয়ে সুমদ্রের চারপাশের পরিবেশ দেখতে ব্যস্ত তখন আমি ওকে পলকহীনভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম। ইমরানকে দেখার মাঝে আমার কোনো ক্লান্তি ছিল না। সময় আমার কাছে কোনো ম্যাটারই ছিল না। ও যখনই পার্ট টাইম জব কিংবা পড়াশোনা থেকে ফাঁকফোকড় পেয়ে আমাকে কল দিয়ে আধভাঙা বাংলায় বলতো,

” চলো না মেঘলা সাথ মে ঘুমতে যাতে হে”

তখন যদি আমার সামনে পাহাড় অবস্থান করতো তবে আমি পাহাড় ভেঙে হলেও ইমরানের কাছে চলে যেতাম।

হুট করে একদিন ভার্সিটির ক্যান্টিনে বসে মজার ছলে বলেছিলাম,

” ইমরান চলো না আমরা বিয়ে করে ফেলি”

আমার কথায় ইমরানের কি যে হলো সেদিন ও আমার হাত ধরে নিয়ে গেলো ওর এক বন্ধুর বাড়িতে। ব্যস, সেদিন স্বল্প পরিসরে আমার আর ইমরানের বিয়ে সম্পন্ন হয়।

মাঝেমাঝে ভার্সিটির বাহানায় ওর ভাড়া বাসায় চলে যেতাম। সেখানে কিছু সময় আমাদের একান্তই বহাল থাকতো। সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে আমার আর ইমরানের বিয়ের ছয়মাস কেটে যায়।

এতকিছুর পরও কে জানত এত ভালোবাসার মাঝে কোনো খুঁত থাকতে পারে! একদিন হুট করে ইমরানের চিহ্ন এই শহরের বুক থেকে হারিয়ে যায়। এমন কোনো এরিয়া নেই যে যেখানে ইমরানকে আমি খুঁজিনি। ও যেই রেষ্টুরেন্টে পার্টটাইম জব করতো সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম, ইমরান ওর স্বদেশ পাকিস্তানে ফিরে গেছে। এতটুকু বাক্য আমার পুরো জীবনটাকে বদলে দিয়েছে। পেটে দেড়মাসের বাচ্চা নিয়ে যখন আমি নানানরকমের প্ল্যান করছিলাম ইমরানকে কি করে এই খুশীর খবরটা জানাবো। ঠিক তখনি জানতে পারলাম আমার এতদিনের ভালোবাসা, ওর পায়ের কাছে সমর্পন করা আমার দেহের অন্তরালের সবটুকু বিলিয়ে দেয়ার পর আজ ইমরান আমাকে এই সমাজের কাছে কলঙ্কিনী বানিয়ে চলে গেছে।

আমার মরণ ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। একদিকে এক অমানুষের কাছে নিজের ভালোবাসা বিলিয়ে দেয়ার অনুশোচনা। অন্যদিকে নিজের মাঝে অন্য এক প্রাণের ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠার অনুভূতিতে আমি দিশেহারা বোধ করছিলাম। সুইসাইড করতে গিয়ে ফিরে আসি কারণ নিজের প্রাণ নেবার মতো সাহস আমার মাঝে নেই।

ঠিক সেইসময় আমার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয় আমার বাল্যবন্ধু রুদ্র। আমার পেটের সন্তানকে নিজের সন্তানের পরিচয় দিয়ে সমাজের কাছে আমাকে ওর স্ত্রী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলো। সেদিন নিজের ভাগ্যকে কি বলে পরিচয় করিয়ে দিব বুঝে উঠতে পারিনি! আমার বৈধ সন্তানকে যাতে কেউই জারজ বলতে না পারে সেই উদ্দেশ্য আমার বন্ধু রুদ্র নিজের সন্তান বলে পরিচয় করিয়ে দিলো ওর বাবা-মায়ের কাছের। রুদ্রের বাবা-মা সেদিন ভীষন অবাক হয়েছিল কারণ রুদ্র একজনকে ভালোবাসে। অজানা কারণে ওর ভালোবাসায় পূর্ণতা পায়নি। যেই রুদ্র প্রতিজ্ঞা করেছিল জীবনেও কোনো নারীকে ওর জীবনের সঙ্গে জড়াবে না। সেই রুদ্র সকলের আড়ালে নিজের বেস্টফ্রেন্ডকে বিয়ে করেছে, স্ত্রীর যখন দেড়মাসের অন্তঃসত্তা ঠিক তখনি সবার সামনে এনেছে ব্যাপারটা। রুদ্রের বাবা-মা সেদিন ছেলেকে বিশ্বাস না করতে চেয়েও বিশ্বাস করেছিলেন।

আমার মনে তখনও হাজারো প্রশ্নের জবাব পাওয়া বাকি। এক সপ্তাহ কেটে যায় তবুও কোনো প্রশ্নের জবাব যখন পাচ্ছিলাম না ঠিক তখনি একরাতে রুদ্র আমাকে নিয়ে ওদের বাড়ির ছাঁদে নিয়ে যায়। আমাকে দোলনায় বসিয়ে নিজেও আমার পাশে বসে। দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে রুদ্র খানিকটা সময় নিয়ে আমাকে বললো,

— মেঘলা মাতৃত্বের স্বাদ নেয়াটা বুঝি একটা নারীর জন্য ভীষন জরুরি। দেখ না আমার বাবা বড়ো মাকে বিয়ে করলো কিন্তু সন্তান দিতে অক্ষম দেখে আমার বাবা এই দেশে চাকরি বাহানায় থেকে আমার মাকে বিয়ে করলো। আমি হলাম ব্যস আমার মা হলো এখন জমিদার বাড়ির যোগ্য বৌ। আর বড়ো মা আগাছার ন্যায় পরে আছে জমিদার বাড়িতে। পুরোটা জীবনে না পেলো স্বামীর সুখ আর না পেলো সন্তানের সুখ। কিন্তু, দেখ না বিধাতার কি খেল! সেই একই ঘটনা আমার জন্য আল্লাহ তায়ালা পুনরাবৃত্তি ঘটালেন। আমার হৃদয়ে যার নাম খোদাই করে লেখা, যাকে একপলক দেখার জন্য আমার মন ছটফট করে, যাকে যে কোনো কিছুর বিনিময়ে আমি চাই সেই তনুজাকে নাকি আমি কখনোই আমার করে পাবো না। কারণটা, হলো ও আমাকে বাবা বানাতে ব্যর্থ হবে। জমিদার বংশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে অক্ষম আমার তনুজা। এই অক্ষমতার জের ধরে তনুজার সঙ্গে আজ আমার পাঁচ বছর ধরে নেই কোনো যোগাযোগ। আমি জানি গত পাঁচটা বছর ধরে কি করে আমার দিন কাটছে! খেয়ে থাকি বেঁচে থাকার আশায় কিন্তু, মনটা তো সেই কবেই মরে গেছে। এই বেঁচে থাকা কি আর প্রকৃত অর্থে বেঁচে থাকা বলে?

এতটুকু অব্দি বলে রুদ্র চুপ হয়ে যায়। মেঘলা চুপ হয়ে থাকে রুদ্রের বাকি কথা সম্পূর্ণভাবে শোনার জন্য। রুদ্র ঢোক গিলে কাঁপা গলায় মেঘলার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,

— তোর সন্তানকে আমার পরিচয় দিয়েছি যাতে কেউ বলতে না পারে ওর বাবার পরিচয় নেই। তুই আমার স্ত্রী না কিন্তু সমাজের লোক জানবে তুই আমার স্ত্রী। কিন্তু, তোর কাছে আমার একটাই আবদার মেঘলা, আমার তনুজাকে মা ডাক শোনার অধিকারটুকু দে। ওকে যেন আমার বুকের মাঝে এনে রাখতে পারি মেঘলা। আজ এতগুলো বছরে তনুজাকে পাওয়ার অপেক্ষায় আমার এই হৃদয় মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। তোর বেস্টফ্রেন্ডকে আজ খালি হাতে ফিরিয়ে দিস না মেঘু। নয়তো, আমি মরে যাব। এভাবে আমি আর বেচে থাকতে পারছি না।

সেদিন আমি দেখেছিলাম রুদ্রের কান্না, তনুজাকে নিজের করে পাওয়ার রুদ্রের চোখের তারায় যেই আশাটুকু দেখছিলাম সবটাই ছিল আমার একটি হ্যা’র।

সারারাত ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, রুদ্রকে ওর তনুজার কাছে ফিরিয়ে দিবে। মেঘলার সন্তান রুদ্রের মতো মানুষের কাছ থেকে পিতৃ স্বীকৃতি পাবে এরচেয়ে বড়ো পাওয়া আর কি’বা হতে পারে!

পরদিন রুদ্রের সঙ্গে সবটা নিয়ে খোলামেলা আলোচনায় বসে মেঘলা। রুদ্র মেঘলার সিদ্ধান্ত শুনে ভীষণ খুশি হয়। মেঘলার হাত ধরে বারবার ওর শুকরিয়া আদায় করতে থাকে।

তারপরই, রুদ্র তনুজার বিয়ে হলো। বিয়ের পর রুদ্র যখন মালদ্বীপ ফিরে এসে মেঘলার কাছের হাসিমুখে বলেছিল,

— সবটাই সম্ভব হয়েছেন তোর জন্য। তোর এই ঋণ কখনোই ভুলবার নয়। তুই যা চাইবি তাইই আমি দিব।

এই কথার প্রেক্ষিতে সেদিন আমি মুচকি হেসে বলেছিলাম,

— সময় হলে আমিই চেয়ে নিব।

সঠিক সময়টা আর এলো না রে রুদ্র। তোর কাছে আমার চাওয়া হলো না, আমি কি চাই তোর কাছে? ভেবেছিলাম বাচ্চাটা হলে তোদের কাছে দিয়ে অজানা কোনো প্রান্তে গিয়ে বসবাস করব যেখানে আমার কোনো পিছুটান থাকবে না। কিন্তু, ডক্টরের কাছে গিয়ে জানতে পারলাম আমার প্রেগন্যান্সিতে কমপ্লিকেশন আছে। বাচ্চা কিংবা আমার দু’জনেরই ক্ষতি হতে পারে। তখন অতটা গায়ে মাখিনি। ভেবেছিলাম হয়তো আমারই সমস্যা হবে। কিন্তু কে জানত আমার মনিটা পৃথিবীতে এসে আলোর মুখ না দেখে চলে যাবে!

এতটুকু অব্দি লেখা অতঃপর ডায়েরিটা বন্ধ করে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় রুদ্র। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। মাথায় আধপাকা চুল আর গালে দাঁড়ি ভর্তি। বয়সের তুলনায় এখনো যথেষ্ট ইয়াং দেখায় রুদ্রকে। কাঁপাকাঁপা হাতে পাঞ্জাবির পকেট থেকে নীল চিরকুট বের করে চোখের সামনে মেলে ধরলো। লাল কলমের আচরে লেখা মেঘলার শেষ কিছু বাক্য এই চিরকুটে।

প্রিয় রুদ্র,

ভালো আছিস কিনা জিজ্ঞাসা করব না। কারণ, তনুজা যেহেতু তোর পাশে আছে তবে তুই সবসময় ভালোই থাকবি।

তুই একবার বলেছিলি না, আমি যা চাই তুই তাই দিবি? মনে আছে না তোর কথাটি। জীবনের অন্তিম মূহুর্তে এসে আমার মনে হলো, আমি দ্বিতীয়বারের মতো কাউকে ভালোবেসেছি। তাও আবার তোকে। লজ্জায় কিংবা সংকোচে বলতে পারিনি এতদিন। তবে আজ বলতে বাঁধা নেই। ভয় পাস না কারণ তোর কাছে আমার ভালোবাসার প্রতিদান চাইব না। কারণ, তোকে এই চুপি চুপি ভালোবাসায় আলাদা এক অনুভূতি আছে। তোকে হারাবার ভয় নেই। আর না আছে আমার ভালোবাসায় কারো হস্তক্ষেপ। হয়তো, হাতেগোনা কিছু মূহুর্ত আছি তোদের পাশে। আমি জানি আমার এই বিবর্ণ ভালোবাসা আমারই মতো একদিন হারিয়ে যাবে। ঠিক তেমনি ভাবে কাগজে পানির স্পর্শে কলমের কালি যেভাবে বিলীন হয়ে যায় ঠিক সেভাবেই আমার হৃদয়ে তোর জন্য জন্ম নেয়া ভালোবাসা একদিন বিবর্ণ হয়ে যাবে। তবে, হাশরে যদি আমার কিছু চাওয়ার অনুমতি থাকে তবে আমি তোকেই চাইব।

ভালো থাকিস রুদ্র।

ইতি
তোর, বিএফ।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে