বিবর্ণ ভালোবাসা পর্ব-১৩

0
980

#বিবর্ণ ভালোবাসা
#Tahmina_Akhter

১৩.

— কি হয়েছিল তখন? যার কারণে আপনি রুদ্রের কাছ থেকে দূরে ছিলেন মিস তনুজা?

ড. রোয়েনের করা প্রশ্ন তনুজার কূর্ণকুহুর অব্দি পৌঁছানো মাত্র সেদিনের দৃশ্য মানসপটে দৃশ্যমান হলো যেদিন রুদ্রের মা এসে অজানা কোনো এক কারণে তনুজার মাকে অনেক অপমান করে। তনুজার খুব ভালোভাবে মনে আছে সেদিন ওর মা কি করে মুখে কাপড় চেপে ধরে অঝোরে ধারায় চোখের জল ফেলছিল!

— আমি ছিলাম পুকুর ঘাটে। রুদ্রের মা কখন আমাদের বাড়িতে এসেছেন তা আমি জানতাম না। বাড়ির ভেতরে কারো চিৎকার চেচামেচি শুনে আমি বাড়ির পথে রওনা দেই। যেহেতু বাড়ির কাছাকাছি পুকুর ঘাট তাই সহজে বাড়ির ভেতরকার উচ্চস্বরের কথাবার্তা অনায়াসে শোনা যেত। বাড়ির ভেতরে আসার পর সর্বপ্রথম আমার নজরে পরে আমার মায়ের দিকে। আমার মা শাড়ির আঁচলের কোণা দিয়ে মুখে চেপে ধরেছেন যাতে উনার কান্না কেউ দেখতে না পায়। এদিক দিয়ে অচেনা একজন মহিলা আমার মাকে বিনা কারনে কথা শোনাচ্ছে এই ব্যাপারটা আমার ভালো লাগেনি। কিছু বলার জন্য মুখ খুলব তার আগেই মায়ের ইশারায় আমাকে চুপ থাকতে হলো। রুদ্রের মায়ের দৃষ্টি এবার আমার ওপরে এসে পরলো। মায়ের উদ্দেশ্য করা গালমন্দ বন্ধ করে এবার আমার সামনে হাতজোড় করে অনুরোধ করতে লাগলো, যেন আমি উনার ছেলেকে বিয়ে না করি। যদি বিয়ে করি তবে উনার পরিবার নাকি নিঃশেষ হয়ে যাবে। একজন মায়ের আবদার যেন আমি রাখি।

— তো আপনি কি করেছিলেন মিস তনুজা?

উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করে ড. রোয়েন। তনুজা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানালার দিকে গাঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে যান্ত্রিক গলায় বলছে,

— সেদিন এক মায়ের আবদার রেখেছিলাম আমি। রুদ্রের মায়ের আবদার রেখেছিলাম আমি। রুদ্রকে ভুলে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম আমি। সেদিন রুদ্রের মা ভীষণ খুশি হয়ে আমাকে অগাধ দোয়া দিয়ে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু, আমার মনে হলো সেদিনের দেয়া রুদ্রের মায়ের দোয়া ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো অভিশাপ। কারণ, আমার মা সে রাতে মারা যায়।

শেষের কথাটি বলে ডুকরে কেঁদে উঠে তনুজা। রোয়েন হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রয় তনুজার মুখের দিকে। এমনও কি হয় মানুষের জীবনে! ভালোবাসার মানুষকে ভুলে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি যেদিন দিতে হলো সেদিন গর্ভধারীনি মা তাকে ছেড়ে চলে গেলেন এই পৃথিবী থেকে। কতটা নির্মম এই পৃথিবীর মানুষজন!

— মা সারারাত কেঁদে বালিশ ভিজিয়েছেন। আমি মায়ের শিয়রে বসে মায়ের কাছে হাজারবার জানতে চেয়েছিলাম, মা কি এমন কথা তোমাকে বলেছে রুদ্রের মা যে কারণে তুমি এভাবে কান্না করছো?
মা আমার কথার উত্তর দেয়নি। পলকহীনভাবে তাকিয়ে রয় আমার আর টগরের মুখের দিকে। আমি জানতাম না এই মায়াময় চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকা আমার মায়ের শেষ তাকানো হবে। আর কখনো আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকবে না, বলবে না তনুজা টগর এদিকে আয় তোদের একটু দেখি। আমার মা সেদিন এক বুক কষ্ট নিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন ডক্টর। সেই কষ্টের কথা আমাকে বলেনি আমার মা। যদি জানতে পারতাম কি এমন কথা শোনার পর আমার মা এতটা কষ্ট পেয়ে চলে গিয়েছিলেন?

কথাগুলো বলতে বলতে উদভ্রান্তের মতো কাঁদতে থাকে তনুজা। রোয়েন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, ঝাপসা হয়ে আসে তার চোখ। কিন্তু, লোকের আবার মানা পুরুষ লোকের কাঁদতে নেই। কিন্তু, মাঝে মাঝে কিছু দুঃখ শুনলে খুব করে কাঁদতে ইচ্ছে করে পুরুষ মানুষের। কিন্তু সমাজের নিয়মনীতি আর লোকলজ্জায় সেই কান্না টুকু প্রকাশ করা যায় না। তনুজা নামক মেয়েটাকে কি বলে স্বান্তনা দিবে জানা নেই রোয়েনের? তবে ভবিষ্যতে কখনো যদি তনুজার কারো সাহায্যের প্রয়োজন হয় তবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে কার্পন্য করবে না রোয়েন।

বাম হাতের কব্জি উঁচু করে দেখলো সময় তখন দুপুর একটা। লাঞ্চ টাইম তাই ড. রোয়েন তনুজার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কেবিনের বাইরে চলে যায়। তবে যাওয়ার আগে তনুজাকে বলে যায় রোয়েন আবারও ফিরে আসবে। কারণ তনুজার সাথে তার অনেক কথা বলার বাকি আছে।

বিকেল পাঁচটা.

সূর্যের লাল রঙের আভা পুরো শহরের বুকে ছড়িয়ে আছে। যানজট পূর্ণ রাস্তায় উদভ্রান্তের মতো হাঁটছে মেঘলা। মনে তখন হাজারো প্রশ্নের আনাগোনা। তনুজাকে যবে থেকে দেখেছে তখন থেকেই ছোট বোন বলে ভেবে এসেছে। কিন্তু, আজকের পর থেকে তনুজার মনে হয়তো মেঘলার জন্য কোনো সম্মান থাকবে না, না থাকবে বোনপ্রীতি। যা অবশিষ্ট আছে তা হয়তো ঘৃণা বৈ কিছুই না। আজ দুদিন ধরে রুদ্রের সঙ্গে দেখা হয় না মেঘলার। একপ্রকার রুদ্রই হয়তো মেঘলাকে এড়িয়ে চলছে। রুদ্রের মনের অবস্থা তেমন ভালো নয়। নিজের প্রেয়সীকে এতটা কাছে পাওয়ার পর যখন হারিয়ে ফেলতে হয় তখন মানুষ পাগল হয়ে যায়। অথচ, রুদ্র এমন একটা মানুষ যে কিনা তনুজাকে ফিরে পাওয়ার জন্য কত কিছুই না করেছে? যার সবটাই মেঘলার কাছে উন্মুক্ত।

দূর আকাশের দিকে মেঘলা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। হুট করে তলপেটসহ দুই উরুতে অসহনীয় ব্যাথা করছে। মেঘলার সন্তানের এই পৃথিবীতে আশার সময় হয়েছে তবে। কাঁপা কাঁপা হাতে ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে সর্বপ্রথম কল দেয় ওর বাবার কাছে। মেঘলার বাবা মেয়ের কল পেয়ে অতি দ্রুত রওনা হয় শপ থেকে। মেঘলার বাবা এসে অতি দ্রুতই মেয়েকে নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্য রওনা হয়। হসপিটালের সকল ফর্ম্যালিটি শেষ করার পর মেঘলাকে অটিতে শিফট করা হয়। মেয়েটা একা একা কেন এতকিছু করছে বুঝতে পারছে না মেঘলার বাবা! রুদ্রকে কল করে মেঘলার অবস্থা জানিয়ে দিলেন মেঘলার বাবা। রুদ্র তখন নিজের ঘরে বসে ছিল। কল পেয়ে অতি দ্রুত রওনা হসপিটালের উদ্দেশ্য।

———————–

তনুজা তখনও ঘুমিয়ে আছে। অথচ সকাল সাতটা বাজে। কেবিনের বাইরে থেকে কাচের দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র। তৃষ্ণার্ত চোখে তাকিয়ে আছে মোমের পুতুলের দিকে। মোমের পুতুল সেই আগের মতো নেই। চেহারায় কতটা মলিনতায় ছেয়ে আছে! গোলাপের পাপড়ির ন্যায় ঠোঁট জোড়া শুকিয়ে আছে, চোখের নীচে অধিক দুশ্চিন্তার ফল। দেখলে যে কেউ ভাববে কাজল লেপটে আছে। রুদ্র নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেবিনের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ে রুদ্র। তনুজার পায়ের কাছে বসে পরে রুদ্র। তনুজার মুখের দিকে স্বস্তি ফিরে আসে রুদ্রের হৃদয়ে। আজ তিনদিন ধরে কতশত অনুরোধ আর কাকুতি মিনতি করেও তনুজাকে একপলকের জন্যেও চোখের দেখা দেখতে পায়নি। তাই তো আজ চোরের মতো সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে তবেই তনুজাকে দেখতে এসেছে।

ততক্ষণে তনুজার ঘুম হালকা হতে শুরু করেছে। ভালোবাসার মানুষের গায়ের গন্ধ এসে নাকে লাগছে তনুজার। বিভ্রান্ত হয়ে চোখ খুলে তাকাতেই স্থীর হয়ে যায় তনুজা।

মানুষটা কিছুটা দূরত্বে বসে আছে। চোখেমুখে বিষন্নতার ছাপ। চোখের দৃষ্টি নিজের কোলের মাঝে নিবদ্ধ করে রেখেছে। রুদ্রের দৃষ্টিকে অনুসরণ করে তনুজা রুদ্রের কোলের দিকে তাকায়।

ফুটফুটে এক শিশু রুদ্রের কোলে। পরম মমতায় আগলে রেখেছে রুদ্র। তনুজার এই দৃশ্যটা ভীষণ ভালো লাগে। মনটা কেমন উৎফুল্ল হয়ে যায়! কিন্তু, হুট করে মনের এককোনা থেকে কেউ জানান দেয়, তনুজা রুদ্র তোমাকে ধোকা দিয়েছে। আর কোলের বাচ্চাটা নিশ্চয়ই তোমার সতীনের।

তনুজার দুচোখে ছাপিয়ে জল নামে। তনুজা কি করে ভুলে গেল সেই কালো স্মৃতি! রুদ্রের সাহস তো কম নয় ওর প্রথম পক্ষের সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে তনুজার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে?

রুদ্র তখনও টের পায়নি যে তনুজা ঘুম থেকে জেগে উঠেছে।

— আপনি কেন এসেছেন এখানে?

তনুজার গলার স্বর শুনে রুদ্র তনুজার পানে তাকায়। তনুজার চোখে কান্নার ছাপ স্পষ্ট। রুদ্র হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রয় তনুজার মুখের দিকে। কাঁদছে কেন তনুজা? রুদ্র জানেও না কেন তনুজার চোখের জলের কারণটা হচ্ছে রুদ্র এবং রুদ্রের কোলে থাকা বাচ্চাটি।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে