বিবর্ণ ভালোবাসা পর্ব-১১

0
942

#বিবর্ণ ভালোবাসা
#Tahmina_Akther

১১.

পাশের ঘর থেকে আমার মায়ের আদরে ভরা কন্ঠ শুনতে পাচ্ছি। কারণ, উনার ভাইয়ের একমাত্র পুত্র এসেছেন। আমি দ্বিধান্বিত মনে বারবার ভাবতে বাধ্য হচ্ছি আমার মায়ের ভাই এলো কোত্থেকে আর ভাইয়ের ছেলে এলো কোত্থেকে? যতদূর মনে পরে আমার মা নাকি এতিম। এলাকার সবাই একই কথা বলে। তবে, আজই কেন অচেনা একজন হুট করে এসে আমার মায়ের ভাইয়ের পুত্র বনে গেল!

এমনিতেই, সেই সময়ের বিব্রতকর পরিস্থিতির স্মৃতি স্মরণে এলে আমার ভীষণ লজ্জা লাগছে। সেই যে একদৌঁড়ে ঘরে এসেছি এখন পর্যন্ত ঘর থেকে বের হয়নি। গ্রীষ্মের দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো এখন পর্যন্ত গায়ে পানি ঢালতে পারিনি তাই তো গা থেকে তাপ বের হচ্ছে।

দরজার একটু ফাঁক করে মাথা বের করে দেখছিলাম কেউ আছে কি না? নাহ্ কেউ নেই। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে খাটের ওপর থেকে কমলা রঙের থ্রী-পিছটা নিয়ে দরজা খুলে দিলাম দৌঁড়।

কিন্তু, দৌঁড় দিতে গিয়ে উপুড় হয়ে পরে যাচ্ছিলাম। ভয়ে চোখ বন্ধ করে কালেমা পাঠ শুরু করে দিলাম, যদি মরে যাই! অন্তত কালেমা পড়তে পড়তে তো মরতে পারব। কিন্তু, আল্লাহ সহায় হয়েছেন বলে কে যেন আমাকে পরে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।

আমার হৃদপিণ্ড অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে। মনে মনে ওপর ওয়ালার শুকরিয়া আদায় করছি এমন সময় মায়ের কন্ঠ শুনতে পেলাম।

— এত্ত বড়ো মেয়ে দৌঁড়ানোর সময় যদি মাটিতে পরে যাস তখন লোকে দেখলে দাঁত কেলাবে। ফাজিল একটা।

লজ্জা এবং মায়ের বকা শুনে আমার চোখে জল চলে এলো। কেন জানি মা বকা দিলে ভীষন কষ্ট হয় আমার?

—ফুপি, একটু না-হয় অসাবধনতাবশত ভুল হয়ে গেছে। তাই বলে এভাবে বকাঝকা করাটা অনুচিত।

পুরুষালী কন্ঠ শুনে চমকিত দৃষ্টিতে মায়ের পাশে দাঁড়ানো যুবকটির দিকে তাকালাম। ঝাপসা নয়নে তাকিয়ে তার চেহারার যা বুঝতে পারলাম তা হলো তিনি আমার পক্ষেই আছেন।

আচ্ছা, কিছুক্ষণ আগে যে পরে যাচ্ছিলাম তখন কি উনি মায়ের সাথেই ছিলেন? হুট করে তনুজার মননে লজ্জারা দানা বাঁধতে শুরু করে। তনুজা দ্রুতগতিতে ছুটে যেতে শুরু করে পুকুর ঘাটে। তনুজার এমন প্রস্থান দেখে তনুজার মা নিজের ভাইয়ের ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— বাবা, তুমি বিল্ডিংয়ের গোসলঘরে চলে যাও। পুকুরে যাবার দরকার নেই।

ফুপির আদেশ শুনে ভদ্র ছেলের মতো ঘাড় কাত করে সায় জানিয়ে গোসলঘরে চলে গেলো।

গোসল শেষ করে সবেমাত্র গোসলঘর থেকে বের হয়ে ঘরে চলে যাই। যেই কদিন থাকি এই ঘরেই থাকব। বড়ো জানালার সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা চুল টাওয়াল দিয়ে মুছতে থাকি আমি। জানালা দিয়ে হুড়মুড়িয়ে বাতাস বইতে থাকে। স্নিগ্ধ পরিবেশ, শীতল হাওয়ায় আমার মন যেন শতগুণ ভালো হয়ে গেলো। চুল মুছতে মুছতে হুট করে থেমে গেলাম আমি। হাতের শক্তি নেই বললেই চলে। কারণ, মস্তিষ্ক তখন ভালোলাগার মতো কিছু মূহুর্ত চোখের মাঝে বন্দী করছে। কমলা রঙের থ্রীপিছ পরনে, ভেজা চুল সবুজ রঙা গামছা দিয়ে বাঁধা মোমের পুতুল তার ভেজা কাপড় দড়িতে শুকোতে দিচ্ছে। কাপড় দড়িতে দেয়ার সময় যখন বিন্দু পানির ছিটা এসে মুখে পরছে তখন চোখ-মুখ কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করছে।

— এ কোন মায়া লাগালে আমায়? এসেছিলাম ফুপির খোঁজ নিতে। কিন্তু এখানে আসার পর আমি আমাকে হারাতে যাচ্ছি।

জানালার কাছ থেকে সরে এলো রুদ্র। সেলফোন বের করে নিজের বাবার কাছে কল করলো। ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করলো কিন্তু ফুপির বাড়িতে যে এসেছে তা বলেনি। হয়তো, গোপনে এসেছে এখানে।

খাবার টেবিলে বসতেই রুদ্রের চোখ ছানাবড়া। না হলেও সাত পদের ভর্তা, ইলিশ মাছ ভুনা, মাষকলাইয়ের ডাল, হাঁসের ডিম ভাজা, দেশী মুরগীর ঝোল, চিকন চালের ভাত। রুদ্র মনে মনে ভয়ের ঢোক গিললো। কারণ, রুদ্রের পেটে যে এই খাবারগুলো চালান করা হবে ও খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে।

রুদ্রের পাশের চেয়ারে টগর এসে সুবোধ বালকের ন্যায় চুপ করে বসে রইলো। রুদ্রের ফুপি রৌশনি রান্নাঘর থেকে পায়েসের বাটি নিয়ে বের হয়ে এলেন। রুদ্র দেখতে পেলো ওর ফুপির আড়ালে সেই কমলা সুন্দরী দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা এত লজ্জা পাচ্ছে কেন? ভারী অদ্ভুত তো!

রৌশনি পায়েসের বাটি টেবিলের ওপর রেখে পেছনে তাকিয়ে দেখলো তনুজা রান্নাঘরের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। কপালে কুঞ্চিত ভাজ ফেলে তনুজাকে নিজের কাছে ডাক দিলেন। কিন্তু, তনুজা মাথা দুলিয়ে না বোধক অর্থ বুঝাচ্ছে। অর্থাৎ ও এখানে বসবে না। এদিকে রুদ্র আর টগরের দৃষ্টি তনুজার দিকে। রৌশনি উপায়ন্তর না পেয়ে চোখ রাঙানো দিলে তনুজা হুড়মুড়িয়ে এসে টগরের পাশের চেয়ারে বসে পরলো।

রৌশনি সকলের পাতে খাবার তুলে দিচ্ছেন যার যার পছন্দসই খাবার। রুদ্র তো আলুভর্তা আর হাঁসের ডিম ভাজা দিয়ে ভাত মুখে দিয়ে বুঝতে পারছে ইটালিয়ান আর থাইফুড ছাড়াও বাঙালি কিছু খাবার আছে যা খেলে মনে হবে অমৃত পান করছে।

খাবারের পর্ব শেষ হতেই রুদ্র আর ঘরে বসে থাকলো না। টগরকে নিয়ে বেরিয়ে পরলো গ্রাম ঘুরে দেখবে বলে।

টগর সামনে আর রুদ্র পেছনে। রুদ্রের গলায় দামী ক্যামেরা ঝুলানো। যার কারণে গ্রামের বায়জৈষ্ঠ্য থেকে শুরু করে ছোটরা একবার হলেও রুদ্রের দিকে তাকাচ্ছে।

দুই পাশে বিস্তীর্ণ সমতল ভূমিতে ধান রোপণ করছে চাষীরা। দুই জমির মাঝে তৈরি করা ছোট্ট পথ ধরে ধীর গতিতে হেটে যাচ্ছে টগর আর রুদ্র। একটু ভুল হওয়া মানে সোজা কাদামাটিতে পরে কাপড় নষ্ট করা। মাঝামাঝি পথে এসে রুদ্র দাঁড়িয়ে যায়। এমনসময় দমকা হাওয়ার স্পর্শে রুদ্রের বাবড়ি চুলগুলো এলেমেলো করে দিয়ে যায়। রুদ্র বেশ কয়েকটি ছবি তুললো। নতুন ধান বোনা খেতের ছবি, পুরনো বটগাছের নীচে বসে থাকা ছোট ছোট বাচ্চাদের।

হাঁটতে হাঁটতে টগর রুদ্রকে নিয়ে নদীর পাড়ে চলে এলো। রুদ্র সুবিশাল সমুদ্রের বুকে কতবার স্পিডবোট দিয়ে ঘুরে বেরিয়েছে। কতবার সে সমুদ্রের তলদেশে গিয়েছে এডভেন্চারের জন্য। সমুদ্রের তলদেশে কতশত মূর্হুত রুদ্রের চোখে স্মৃতি হয়ে আছে। কিন্তু, এই নদীর পাড়ে এসে মনে হচ্ছে পৃথিবীর কোনো সৌন্দর্যের সঙ্গে কোনো সৌন্দর্যের কম্পেয়ার করতে নেই। যে যার জায়গায় সুন্দর! পাহাড়ের জায়গায় পাহাড়ের সুন্দর। সমুদ্রের জায়গায় সমুদ্র সুন্দর। আর নদীর জায়গায় নদী সুন্দর। এই জন্যই বুঝি বাংলাদেশকে নদীমাতৃক দেশ বলা হয়। এই জন্যই বুঝি এদেশের কবিরা বারবার তাদের লেখা শব্দের মাধ্যমে আমাদের কাছে পৌঁছে দিতে চেষ্টা করেছেন এই দেশের সৌন্দর্য সম্পর্কে।

— কি দেখছেন অমন করে?

— দেখছি নিজের মাতৃভূমির সৌন্দর্যকে। কতটা মনোমুগ্ধকর আর স্নিগ্ধ পরিবেশ। হরেক পাখির কলরব শুনতে ভালো লাগছে।

আনমনা হয়ে টগরের প্রশ্নের জবার দেয় রুদ্র।

— কই আমরা তো এত মুগ্ধ হই না!

টগরের কথা শুনে রুদ্র মেকি হাসি দিয়ে বললো,

— কারণ, তোমরা এমন পরিবেশ দেখে অভ্যস্ত।
গ্রাম্য পরিবেশ দেখার ভাগ্য হয়নি আমার। কারণ, বাংলাদেশের মাটিতে আমার জন্ম হয়নি ; হয়েছিল সুদূর মালদ্বীপে। আমার মা মালদ্বীপের নাগরিক। বাবা চাকরিসূত্রে মালদ্বীপে গিয়েছিলেন। কোনো একসূত্র ধরে বাবা-মায়ের পরিচয়। পরিচয় থেকে পরিণয়। মায়ের ইচ্ছে ছিল না বাংলাদেশের আসার তাই তো আমাকে সেই দেশে বড়ো হতে হলো। আজকের পর থেকে বাংলাদেশের সৌন্দর্যের কাছে আর কোনো দেশের তুলনা করতে ইচ্ছে করবে না আমার।

রুদ্র এবং টগরের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা তনুজা রুদ্রের প্রত্যেকটি শব্দ মোহমুগ্ধের ন্যায় শ্রবণ করে।হৃদয়ের এক কোণায় রুদ্রের প্রতি আলাদা সম্মান তৈরি হয়। কারণ, দেশপ্রেম আজকাল কার মাঝে দেখতে পাওয়া যায়? সকলেই তো পশ্চিমাদের অনুকরণ করতে ব্যস্ত।

কারো গলা খাঁকারি শুনে রুদ্র আর টগর পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলে তনুজা দাঁড়িয়ে আছে। টগর
এক লাফে বোনের সামনে চলে যায়। রুদ্র এদিকসেদিক তাকায় তবুও ভুল করে হলেও তনুজার দিকে তাকায় না। এই মেয়ের দিকে তাকালে রুদ্রের বুকে অজানা তোলপাড় শুরু হয়।

—আপনারা দাদীজান এসেছেন। আপনাকে মা ডাকছেন। অতি শীঘ্রই বাড়িতে ফিরে যেতে হবে।

তনুজার কথা শেষ হবা মাত্রই রুদ্র দ্রুত গতিতে এগিয়ে চললো। পেছন পেছন টগর আর তনুজা এগিয়ে যাচ্ছে। টগর এসবের কিছু বুঝতে না পারলেও তনুজা ঠিকই বুঝতে পারছে কোনো কিছুর কারনেই হয়তো ওদের মা এতদিন অভিমান করে বাবার বাড়িতে যোগাযোগ রাখেননি।

—নানীজান এসেছেন মানে আজ বড়ো ধরনের কিছু হতে চলেছে। দীর্ঘ বিশবছর পর মা-মেয়ের মিলন হলো। না জানি কি হয়?

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে