#বাসর
#৯ম_পর্ব
‘
‘
জাহানারা বেগম ঘরের রোয়াকে বসে নীলার মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছেন। দীর্ঘদিন চুলের যত্ন না নেয়ায় কেমন ধূসর হয়ে আছে তার চুল।অথচ ঘরে থাকতে এই চুলের কী যত্ন নিতো নীলা! পরিপাটি হয়ে সেজুগুজে থাকতো সব সময় সে। নীলার চুলের ভেতর তেলে চুবিয়ে রাখা আঙুল চালাতে চালাতে তাকে আদরে গলায় বকাঝকা করছেন তিনি।
‘কী হাল করে রাখছে দেহো চুলের।তোর শাশুড়ির কী তেল কিনোনের পয়সা নাই!’
মার এইসব আহ্লাদী কথায় রাগ করা উচিৎ নয়। কিন্তু নীলার রাগ উঠে যায়।তার মুখ কেমন ভার হয়ে থাকে। জাহানারা বেগম তাই আবার ওর মাথায় আস্তে করে চাটি মারেন। তারপর বলেন,’শাশুড়ির জন্য একেবারে বিরাট দরদ হয়ে গেছে। কিছুই বলা যায় না। মুখ ভার করে ফেলেন তিনি।জগতে এমন শাশুড়ি আর নাই!কিপ্টে একটা শাশুড়ি তার জন্য এতো দরদ!’
নীলা এবার কথা বলে।সে চাপা গলায় বলে,’আম্মা তিনি কিপ্টে না।তার মন কতো বড় তুমি জানো না!’
‘আমার চেয়ে বড়ো?’
‘জানি না।’
জাহানারা বেগম অনেক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর বলেন,’তোর বড় মামা একটা আলাপ করছিলো।ছেলে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। বয়স কম। স্ত্রী সন্তান যোগে মারা গেছে।’
নীলা চুপ করে রইলো।তার ভেতরটা কেন জানি হঠাৎ নাড়া দিয়ে উঠলো।বুক ভেঙে কান্না এসে যেতে চাইছে খুব।সে দ্রুত আঁচলে মুখ ঢাকলো।
জাহানারা বেগম লক্ষ্য করে বললেন,’বোকা মেয়ে। এভাবে তো দিন যাবে না। মেয়ে হয়ে জন্মাইছস।একা একা তো আর জীবন কাটবো না।আমরা কয়দিন বাঁচবো বল!’
নীলা আঁচলে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলে।
জাহানারা বেগম তাকে কাছে টেনে নেন। তারপর ভেজা গলায় বলেন,’কপাল।সব কপাল রে মা। নাইলে এইদিন কেন ঘটে তোর।’
নীলা তার কান্নামাখা গলায় বলে,’পারবো না আমি আম্মা।ইনারে ভুলে গিয়ে নতুন কাউরে—‘
জাহানারা বেগম আর কোন কথা বলেন না।তার নিজেরও খুব কান্না এসে যায়।তাই তিনি কান্না লুকোতে কৌশল করে এখান থেকে উঠে রান্নাঘরের দিকে চলে যান। তারপর কাঁদেন। লুকোচুরি করে কাঁদেন।
‘
খালিদের সাথে উঠোনে বসে নীলা গল্প করছে। খালিদের কী যে রাগ আর অভিমান ছিল তার বোনের প্রতি।সে তো প্রথমে কথাই বলতে চায়নি। সে একেবারে বলে দিয়েছে,’যে আমায় একা রেখে চলে যায় তার সাথে কথা বলি না আমি।’
তারপর নীলা তাকে কত করে যে রাগ ভাঙিয়েছে!
খালিদ একটা কাঁঠাল পাতা কুড়িয়ে এনেছে।সে সেই পাতা নিয়ে নীলার কাছে এসে বললো,’বুবু, কাঁঠাল পাতা খাই?’
নীলা তার কান টেনে ধরে বললো,’তুই কী ছাগল?’
খালিদের তখন ভীষণ রাগ পেয়ে বসে।সে তেড়ে যায় নীলার দিকে।বলে,’তোমার জামাই ছাগল।’
নীলার শূন্য বুকটা কেমন ধক করে কেঁপে উঠে তখন।চোখ ছল ছল করে উঠে লবণ জলে।
পায়ের নিচের মাটি সড়ে যেতে থাকে দূরে।
খালিদ তার বোনের ফ্যাকাশে মুখটার দিকে তাকায়। তাকিয়ে থাকে আর তাকিয়েই থাকে এক দৃষ্টিতে।
‘
ফয়জুর রহমান খেতে কুমড়োর মাচা বাঁধছিলেন।খেতের গা ঘেঁষে ছুটে গেছে শহরের দিকে কাঁচা সড়ক। সেই সড়কে একজন মেয়ে মানুষকে হেঁটে আসতে দেখে তিনি হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন। এই মহিলাকে তিনি চেনেন। নীলার শাশুড়ি সালমা বেগম। তিনি বুঝতে পারলেন না কিছুই।নীলা বাড়ি ফেরার তিন দিন পরেই তার শাশুড়ি চলে এলেন তাদের বাড়িতে। ফয়জুর রহমান তাকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন। নীলা এসেছে মাত্র তিনদিন হয়েছে এর মধ্যেই তিনি হঠাৎ চলে এলেন কেন?
সালমা বেগম দূর থেকেই চিনে ফেললেন ফয়জুর রহমানকে দেখে।তাই কাছে এসে বললেন,’থাকতে পারলাম না বেয়াই।মেয়েরে ছাড়া কী একলা একলা থাকন যায়! এই তিনদিন আমার কাছে মনে হইছে তিন হাজার বছর।’
ফয়জুর রহমান অবাক হলেন ঠিক কিন্তু তিনি এমন ভাব করলেন যেন সালমা বেগমের এখানে হঠাৎ করে চলে আসাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ফয়জুর রহমান মাচা বাঁধার কাজ রেখে সালমা বেগমের ব্যাগটা হাতে নিয়ে বললেন,’আসেন বেয়াইন সাব।’
তারপর যেতে যেতে কত কথা বললেন তারা। সালমা বেগম জিজ্ঞেস করলেন নীলার কথা।আর ফয়জুর রহমান জিজ্ঞেস করলেন সেলিমের কথা।গোহালের গরু বাছুরের কথা।ধানী খেতের কথা।’
‘
জাহানারা বেগম নীলার শাশুড়িকে এভাবে হঠাৎ চলে আসতে দেখে চমকে উঠলেন।মনে হলো তিনি রাগও পেয়েছেন খানিক। কেন জানি তার ঈঁষৎ রাগ সালমা বেগমের প্রতি। মেয়ে বিধবা হলো বলেই কি না কে জানে! কিন্তু এতে সালমা বেগমের কী দোষ?তিনিও তো ছেলে হারিয়েছেন। এই জন্য তিনি দোষবেন কাকে?
নীলা এসে সালমা বেগমকে সালাম করলো। সালমা বেগম তাকে বুকে টেনে নিয়ে তার কপালে চুমু খেলেন। তারপর বললেন,’লক্ষ্মী মা আমার।’
নীলা বললো,’আম্মা আপনি কেমন আছেন?’
সালমা বেগম বলেন,’মাগো,তোমারে ছাড়া এক দন্ডও ভালা থাকতে পারি না আমি। আমার কিছু ভালা লাগে না।খালি কান্দন পায়!’
নীলা বললো,’আমারও খারাপ লাগে আম্মা।’
সালমা বেগম বললেন,’তোমারে সাথে নিয়া যাইয়াম মা আমি।তোমারে ছাড়া থাকতে পারতাম না আমি।’
নীলা চুপ হয়ে যায়।সে জানে তার বিয়ের আলাপ হচ্ছে।তার মা ওখানেই বিয়ে দিয়ে দিতে চাইবেন তাকে। কিন্তু নীলার বিয়ে করার ইচ্ছে নেই মোটেও।সে যে নাঈমকে ভালোবাসে!
সালমা বেগম বললেন,’যাইবা না মা আমার সাথে?’
নীলা বলতে চাইছিলো কিছু একটা।এর মধ্যে জাহানারা বেগম এসে গেলেন এখানে। তিনি এসে বললেন,’বেয়াইন সাব।মেয়ের বিয়ের আলাপ আসছে একটা। পছন্দ হলে হয়ে যাবে বিয়েটা।’
সালমা বেগম যেন হঠাৎ আঁতকে উঠলেন। তিনি কী বলবেন বুঝতে পারছেন না।তার চোখ কেমন ছলছল করে উঠেছে জলে। মুহুর্তে তিনি বুঝে গিয়েছেন নীলার প্রতি তো তার কোন অধিকার নাই এখন আর। তিনি কী আর জোর করতে পারবেন নীলাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য! তবুও একবার তিনি বললেন,’বউমারে ছাড়া আমি থাকবাম কেমনে?’
কথাটা বলে কেঁদে উঠলেন সালমা বেগম।
জাহানারা তখন তাকে বুঝিয়ে বললেন,’বোন,কী করবেন সব কপাল। সেলিমের জন্য ঘরে বউ অনেন। নতুন বউ কাছে থাকলে নীলার কথা অতটা মনে পড়বে না।আর মনে পড়লে মাঝেমধ্যে এসে নীলাকে এসে তার শশুর বাড়িতে দেখে যাবেন।’
সালমা বেগম সেলিমের নামটা শুনে বলতে চেয়েছিলেন , সেলিমের লাইগা যদি বউমারে রাইখা দেই!
কিন্তু এই কথাটা বলতে গিয়ে তার কেমন বাঁধলো।মনে মনে তিনি ভাবলেন, নীলা যদি এটা মেনে না নেয় তখন?
‘
রাতে সবার সাথে খাবার খেতে বসলেন সালমা বেগম। কিন্তু তিনি দেখলেন তার গলা দিয়ে খাবার নামছে না। গলায় কাঁটা হয়ে বিঁধে আছে ওই কথাটা। তিনি ফয়জুর রহমান সাহেব কিংবা জাহানারা বেগমের কাছে সেলিমের সাথে নীলার বিয়ে নিয়ে কথাটা বলতে চান। কিন্তু নীলাকে ভয় পেয়ে বলতে পারছেন না। নীলা যদি মেনে না নেয়! তিনি কী কথাটা তুলে দেখবেন একবার? নীলা তো মানতেও পারে!পারে না?
‘
‘
#চলবে_
#অনন্য_শফিক