#বাসর__
#২য়_পর্ব
‘
নীলা ধীর পায়ে দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।তার হাত পা প্রচন্ড রকম কাঁপছে। আর ফুঁপিয়ে কান্না আসছে।তার হঠাৎ করে মনে পড়ছে সপ্তাহ খানেক আগের কথা।সালমা বেগম তাকে ফোন করেছিলেন একদিন বিকেলে।সে ফোন ধরেই বলেছিল,’আম্মা, কেমন আছেন আপনি?’
সালমা বেগম তার গলা মধুর করে বলেছিলেন,’ভালা আছি আম্মা। তুমি কেমন আছো? শরীর ভালা তোমার গো মা?’
‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো আম্মা।’
‘খাওয়া দাওয়া করতাছো তো ভালা কইরা?দেখছি তুমি কিন্তুক অনেক রোগা। রোগা থাকলে হইবো কেমনে? স্বাস্থ্য অইলো সুখের মূল মা। এখন থাইকা দিনে পাঁচবার কইরা খাইবা।খাইয়া স্বাস্থ্য ঠিক করবা।’
নীলা আস্তে করে বললো,’আচ্ছা আম্মা।’
তারপর সালমা বেগম বললেন,’মারে, নাঈমের বয়স এখন পঁচিশ।তার সাথে তোমার বিয়াও দিলাম। তবুও আমার মনে হয় কী জানো মা।নাঈম বুঝি এই এট্টুক পোলা মাত্র। আসলে সন্তানরা তার মার কাছে সব সময় ছোটই থাহে। নাঈমের সাথে তুমি এহন থাইকা ঘর সংসার করবা।সে তোমার স্বামী মা। স্বামী হইলো মাথার তাজ গো মা।যার স্বামী দুইনাই নাই সে জানে স্বামী কী জিনিস। তুমি তো বেহুলার কথা জানো। সেই বেহুলা তার স্বামীর জীবন ফিরাইয়া আনার লাইগা কত রাজ্যে গেল।কত কষ্ট সহ্য করলো।এইটাই অইলো পতি ভক্তি মা। আবার স্বামীরও স্ত্রীর প্রতি অনেক দায়- দায়িত্ব।আল্লার নবী বলেন, স্ত্রী যদি বলে আমার স্বামী ভালা তাইলে হাশরের দিন স্বামীর সব অপরাধ মাপ।’
নীলার কানে বারবার এসে তার শাশুড়ির কথাগুলো বাজছে।আর বাহির থেকে তখন নাঈমের ছোট ভাই সেলিম চিৎকার করে ডাকছে,’ভাবি,ও ভাবি,দরজা খুলেন।খুলেন বলছি।’
সাথে সাথে সালমা বেগমও ডাকছেন।’বউমা,বউমা গো, এই নাঈম,ও বাজান কী অইছে তোরার ঘরে?বউ কান্দে কের লাইগা?দরজা খুল বাজান।’
এই সময় একটা কুকুর বাইরে দাঁড়িয়ে ঘেউ ঘেউ করে আর্তনাদ করে উঠলো।নীলা ভয়ে আঁতকে উঠে চিৎকার করে বললো,’ও আল্লাহরে আল্লাহ!’
সেলিম এই সময় লাথি দিয়ে দরজাটা ভাঙতে চাইলো। কিন্তু দরজা ভাঙলো না। খানিক নড়লো শুধু। তারা এবার ভয়ে জমে যেতে লাগলো। সেলিম এবং তার মা দুজনই কেমন বুদ্ধি শূন্য হয়ে গেল হঠাৎ। এখন তারা কী করবে, কীভাবে ঘরের ভেতর ঢুকবে কিছুই বুঝতে পারছে না।
কুকুরটা আবার ডাকলো। কিন্তু নীলা ভয় পেলো না এবার আর।সে আল্লাহর নাম নিয়ে দরজার খিলে হাত দিলো।আর মনে মনে ঠিক করলো,ভয় পেয়ে কী হবে আর।যে নারীর স্বামী বাসর ঘরে তার স্ত্রীর সাথে মিলনের আগেই মারা যায় তার আবার কপাল!সে তো বেঁচেও এখন মৃতের সমান। জীবনে কী ভুলতে পারবে কোনদিন এমন একটি কালরাতের কথা সে। অথবা তার জীবন কী আর কোনদিন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে! আজ থেকে তো সে সমাজের চোখে বিধবা সাজবে। খানিক পরেই তার শরীর থেকে নেমে যাবে সকল সাজ সরঞ্জাম,গহনা, রঙিন শাড়ি। তারপর তাকে দেয়া হবে সাদামাটা কোন পোশাক। কী জীবন তার!কী নির্মম নিয়তি আহা!
খানিক পর হয়তোবা এ বাড়ি লোকারণ্য হয়ে উঠবে লোকে।সবাই এসে ভীড় করবে তার চারপাশে।কেউ কেউ তার দিকে সন্দেহের চোখে তাকাবে।খুনি,পিশাচিনি,ডাইনি, চরিত্রহীন এবং অসতী বলে ডাকতে থাকবে থাকে। আবার কেউ কেউ সহমর্মিতাও দেখাবে। আফশোস করে বলবে,আহা!কী কপাল গো মেয়েটার।বড় দূর্ভাগা মেয়ে। এমন যেন আর কারো সাথে না হয়।
এইসব কথা শোনার চেয়ে কী জেলে যাওয়া ভালো নয়?আদালতে বিচারক যদি তার উপর দোষারোপ করে তাকে ফাঁসির আদেশও দেয় তবে তা হবে তার উপর বিচারকের একটা সহমর্মিতা।সে হাসিমুখে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তখন বলবে, আপনাকে আল্লাহ দীর্ঘজীবী করুন।
‘
দরজা খুলতেই ওরা চটজলদি ঘরে প্রবেশ করলো। সেলিম এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল,’ভাইয়া কই?’
নীলা তখনও কাঁদছে। কান্না থামাতে পারছে না।সে কান্নাভরা গলায় বললো,’আপনার ভাইয়া আর——
কথাটা শেষ করতে পারলো না আর নীলা।ধপাস করে পড়ে গেল জমিনের উপর। সেলিম দ্রুত তাকে ধরলো। কিন্তু ততক্ষণে নীলা জ্ঞান শূন্য হয়ে গেল। সেলিম যখন নীলার মুখের দিকে লক্ষ্য করলো তখন দেখলো ওর মুখ দিয়ে ফেনার মতো কী যেন বের হচ্ছে।আর এক পাটির দাঁতের সাথে অন্য পাটির দাঁত একেবারে মিশে গেছে।সে তখন ভয়ানক গলায় বললো,’আম্মা, ভাবীর অবস্থা খারাপ!’
সালমা বেগম কী করবেন এখন? খানিক সময়ের জন্য তিনি বোকা বনে গিয়েছিলেন।একটু পর যখন তার খেয়াল হলো বিপদের সময় সাহস রাখতে হবে বুকে, তখন তার বুকে আপনিতেই বল ফিরে এলো। তিনি নীলার মাথাটা নিজের কোলে টেনে নিতে নিতে বললেন,’বালতি দিয়া পানি নিয়া আয়।’
সেলিম দৌড়ে গিয়ে পুকুর থেকে বালতি ভরে পানি নিয়ে এলো।সালমা বেগম নীলার মাথাটা একটু উঁচু করে ধরে তার মাথায় পানি ঢালতে লাগলেন।আর মনে মনে বড় ভক্তির সহিত জপতে লাগলেন,লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নী কুনতু মিনাজ জাওয়ালেমীন।
‘
প্রায় আধঘন্টা ধরে মাথায় পানি ঢালার পর নীলার জ্ঞান ফিরলো। জ্ঞান ফেরার পর সে আবার চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে সে বললো,’আম্মা, আম্মা গো আপনার ছেলে আর নাই!’
সালমা বেগম কথাটা শুনে যেন বিশ্বাস করতে পারলেন না। তিনি শুধু চোখ বড় বড় করে নীলার দিকে তাকালেন। সেলিম এই সময় জায়নামাজের উপর শুয়ে থাকা তার ভাইয়ের কাছে গেল।নীলা কাঁদতে কাঁদতে আবার বললো,’আম্মা, আপনার ছেলে আর নাই।’
সালমা বেগম এবার বুঝতে পারলেন সবকিছু।ওদিক থেকে সেলিমও চিৎকার করে কেঁদে উঠেছে।সে নাঈমের উপর ঝুঁকে পড়ে ওর একটা হাত ধরে চিৎকার করে ডাকছে,’ভাইয়া,ভাইয়ারে,কথা কস না কেনরে ভাইয়া? আমার লক্ষ্মী ভাই, তুই কথা ক!’
সালমা বেগম কিন্তু মোটেও চিৎকার চেঁচামেচি করলেন না। শব্দ করে কাঁদলেনও না। শুধু দেখা গেল তার চোখের কোল গড়িয়ে সরু নদীর মতো জলের তোর নামছে। তিনি সেই জল হাত দিয়ে মুছছেন না।ধীরে স্হীরে পা ফেলে তিনি তার ছেলেদের কাছে গেলেন। ওখানে গিয়ে তিনি দেখতে পেলেন জায়নামাজের উপর তার দুই ছেলে।এক ছেলে জীবিত আর অন্য ছেলে মৃত। মৃত ছেলেটা শুয়ে আছে জায়নামাজের উপর।সালমা বেগম ছেলেদের পাশে বসলেন। সেলিম খুব পাগলামি করছে। চিৎকার চেঁচামেচি করছে। বারবার ডাকছে তার মৃত ভাইটিকে।সালমা বেগম নাঈমের মাথাটা তার কোলের উপর টেনে নিলেন। তারপর চেয়ে থাকা চোখ দুটি বন্ধ করে দিয়ে ডাকলেন নীলাকে। বললেন,’বউমা, এইদিকে আসো।’
সেলিম তার মার কথার উপর চিৎকার করে বললো,’এই মহিলা এইখানে আসবো কেন? আমার ভাইরে সেই মারছে।খুন করছে। নাইলে একটা সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ হঠাৎ মরে যাবে কেন?’
সালমা বেগম সেলিমকে ধমক দিয়ে বললেন,’চুপ কর বলছি।’
‘চুপ করবো? কেন চুপ করবো?খুনিরে খুনি বলবো না তো কাকে বলবো? এই মহিলা খুব পরিকল্পনা করে আমার ভাইটারে মারছে।’
নীলা সেলিমের কথাগুলো শুনেছে। কিন্তু এইসব কথা তাকে মোটেও অবাক করে দিচ্ছে না। কিংবা সে ভয়ও পাচ্ছে না এখন আর। কারণ সে জানতো বেহুলার কোন দোষ না থাকা সত্ত্বেও স্বামীর মৃত্যুর জন্য তাকেই দোষারোপ করা হয়েছিল।বেহুলা তো যেভাবেই হোক কষ্ট করে তার স্বামীকে সুস্থ করে নিজেকে সতী, নিরপরাধ প্রমাণ করেছিল। কিন্তু সে কী করে নিজেকে সতী, নিরপরাধ প্রমাণ করবে?তার তো আর কোন উপায়ই আর নাই।
সালমা বেগম আবার ডেকেছেন নীলাকে। নীলা এবার হেঁটে যাচ্ছে তাদের কাছে। সেলিম এবারও বলছে,’খবরদার কইলাম ডাইনি!খবরদার!খালি আরেক পাও এই দিকে আগাইলে তোরে আমি খুন করে ফেলবো।’
সেলিমের মুখ থেকে এমন একটা ভয়ংকর কথা শোনার পরেও সে এগিয়ে আসছে। কিংবা তার শাশুড়ি তাকে ডেকে নিয়ে কী করে বসেন তাও তো সে জানে না।ছেলের খুনি হিসেবে তাকে দোষারোপ করে খুন টুনও তো করে ফেলতে পারেন!
তবুও নীলা ভয় পাচ্ছে না। সেলিম এখনও চিৎকার করে বলছে,’এই খুনি,থাম তুই। এইদিকে একটা পাও ও আর ফেলবি না বলছি। আমি কিন্তু তোরে খুন করে ফেলবো বলতেছি।সত্যি খুন করে ফেলবো।’
নীলা তবুও এগিয়ে যাচ্ছে।কী সাহস তার!
‘
#চলবে_
#অনন্য_শফিক