বাসর ১ম পর্ব

0
3139

#বাসর
#১ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক

নীলার আজ বাসর। এই বাসর রাত যে তার জন্য কালরাত সে কোনদিন জানতো না। খানিক আগেও সাজসজ্জা করে একেবারে হুরপরীর মতো সেজেগুজে খাটের উপর বসে থেকে সে নাঈমের জন্য অপেক্ষা করেছে। অপেক্ষা করতে করতে সে নাঈমকে নিয়ে কতকিছু ভেবেছে। একবার ভেবেছে তাদের প্রথম সন্তান যদি ছেলে হয় তবে তার নাম দিবে নিবিড়।আর মেয়ে হলে নোলক।ভাবতে ভাবতেই সে ভেবেছে ছিঃ! এসব কি ভাবছি! লজ্জায় নীলা দাঁতে জিভ কেটেছে তিনবার। তারপর সে ভেবেছে নাঈমকে আজ সে বলবে,’শুনুন, আপনার কাছে আমার একটা চাওয়া আছে!’
নাঈম যদি অবাক হয়ে বলে,’ কী চাও তুমি আমার কাছে?’
নীলা তখন আস্তে করে নাঈমের কানের কাছে তার মুখ নিয়ে বলবে, ‘আপনাকে আমি ভালোবাসতে চাই।’
নাঈম কী তখন হো হো করে হেসে উঠবে নাকি তাকে জড়িয়ে ধরে বলবে,’তুমি অনেক ভালো নীলা। অনেক অনেক ভালো?’
নীলা নিজে নিজেই ফিক করে হেসে উঠলো। তারপর আবার জিভ কেটে বললো,’আর হাসবো না।নাঈম এসে যদি দেখে আমি হাসছি তখন তো সে ভাববে আমি মনে হয় বোকা।নয়তো ভাববে আমার উপর জ্বিন পরীর কোন আসর আছে।হাসবে না বলে জিভ কেটেও সে আবার হেসে উঠলো। তারপর বললো, যাহ এখন থেকে নাঈম না আসা পর্যন্ত আমি হাসতেই থাকবো! কিন্তু মানুষ যা ইচ্ছে করে তা কী আর সব সময় সে করতে পারে? নীলাও পারলো না।সে এখন আর হাসতে পারছে না।সে এখন কাঁদছে। কারণ বাড়িতে রেখে আসা তার ছোট্ট ভাইটির কথা তার খুব মনে পড়ছে। এই ভাইটির বয়স ছয়।নাম খালিদ।খালিদ তাকে ছাড়া একদিনও ঘুমোতে পারে না। রোজ দিন খালিদকে তার ছড়া শুনিয়ে ঘুম পাড়াতে হয়। আচ্ছা ,আজ কী খালিদ একা ঘুমোতে পেরেছে?
এইসব কিছু ভাবতে ভাবতে বারবার সে ঘড়ি দেখছে।নাঈম আসতে দেরি করছে। আচ্ছা নাঈমটা এতো গর্দভ কেন?সে কী জানে না বাসর রাতটা বাইরে ঘুরে খাটানোর নয়। এই রাতে স্বামী স্ত্রী দুজন একসাথে থাকতে হয়।

নাঈম যখন ঘরে ঢুকেছে তখন অর্ধরাত। নাঈম পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে বললো,’আসতে পারি?’
নীলা কী বলবে? আসুন?না নীলা কিছুই বললো না।নাঈম এবার সালাম দিলো।বললো,’আসসালামু আলাইকুম। আমি নাঈম, আপনার বর।আজ আমাদের বাসর। আপনার ঘরে আসতে চাচ্ছি বাসর পালনের জন্য। আমি কী আসতে পারি?’
নীলা ফিক করে হেসে উঠলো নাঈমের কথা শুনে। তারপর গুটিগুটি পায়ে দরজার কাছে এগিয়ে এসে বললো,’ওয়ালাইকুমস সালাম।আসুন।’
নাঈম ঘরে ঢুকতেই তার পা ছুঁয়ে সালাম করতে চাইলো নীলা। কিন্তু নাঈম সালাম করতে দিলো না।সে খানিক সরে গিয়ে বললো,’সালাম করতে হবে না।তারচে বরং আপনি আমার একটা হাত ধরুন।’
নীলা সত‍্যিই লজ্জায় মরে যাচ্ছিলো। তবুও সে নাঈমের একটা হাত ধরলো। এবার নাঈম মুচকি হেসে বলল,’এখন আমায় জায়নামাজের কাছে টেনে টেনে নিয়ে যান।’
নীলা নাঈমকে টেনে টেনে জায়নামাজের কাছে নিয়ে গেল। তারপর নাঈম বললো,’এভাবে রোজ দিন আমায় আপনি জায়নামাজের কাছে টেনে নিয়ে যাবেন। ঘুমাবার আগে রোজ দিন আমরা জায়নামাজে দু রাকাত নামাজ আদায় করে বলবো,’হে আল্লাহ, আপনার প্রতি আমরা শোকর আদায় করছি।’
নীলা আস্তে করে বললো,’আচ্ছা।’
তারপর তারা দু রাকাত শুকরানা নামাজ আদায় করলো।নাঈম এবার বললো,’নীলা, আপনি কী আমায় এক গ্লাস পানি খাওয়াতে পারেন!’
নীলা বললো,’জ্বি।’
বলেই সে উঠতে চাইলো। কিন্তু সে উঠতে পারলো না।পেছন থেকে তার হাতটা টেনে ধরলো নাঈম। লজ্জায় লাল হয়ে পেছনে তাকালো নীলা। তাকিয়ে সে চমকে উঠলো। নাঈমের চোখে জল।কী অদ্ভুত ব্যাপার!নীলা খানিক ভয়ও পেলো।সে সঙ্গে সঙ্গে নাঈমের পাশে বসে বললো,’আপনি কী আমার প্রতি ক্রোদ্ধ কিংবা আমায় পছন্দ হয়নি আপনার?’
নাঈম জলভরা চোখে নীলার দিকে অনেক্ষণ তাকিয়ে রইল। তাকিয়ে থেকে নীলার হাতটা আরো শক্ত করে ধরে তার বুকের কাছে টেনে নিয়ে বললো,’এই যে এখান থেকে আওয়াজ আসছে। আমার হৃৎপিণ্ড বলছে, আপনাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি।আপনি আকাশের চাঁদের চেয়েও সুন্দর!’
‘তবে কাঁদছেন কেন?’
নাঈম তার বাম হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললো,’খুশিতে। আমার জীবনে প্রথম স্পর্শ আপনি। আর আপনিই আমার প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসা।’
নীলা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে যেতে যেতে বলল,’তবে যে আপনি আপনি করে ডাকছেন আমায়?’
নাঈম বললো,’আপন মানুষকে তো আপনি করেই ডাকতে হয়। তুমি করে ডাকতে আমার ভালো লাগে না। আমি আপনাকে সব সময় আপনি করেই ডাকবো।’
নীলা ফিক করে হেসে উঠে বললো,’পানি নিয়ে আসি।’
নাঈম পেছন থেকে ডেকে বললো,’পানির চেয়ে আপনার ঠোঁটের স্পর্শই ভালো হতো। একেবারে সারা জীবনের তিয়াস মিটে যেতো।’
কথাটা শুনে এমন লজ্জা পেলো নীলা! কিন্তু ভালোও লাগলো তার। টেবিলের উপর রাখা জগটার কাছে যেতে যেতে ভাবলো,কী রোমান্টিক মানুষ গো!
নীলা জগ থেকে চকচকে লম্বা গ্লাসটায় এক গ্লাস পানি ভরে নিয়ে এলো নাঈমের কাছে। এসেই সে অবাক হলো। মাত্র এক মিনিটে কী করে একটা মানুষ ঘুমিয়ে যেতে পারে।তাও আবার জায়নামাজের উপর!আজ না তাদের বাসর? তাছাড়া পানি খেতে চেয়েছিলো আবার মানুষটা!
নাকি মজা করে শুয়ে আছে এভাবে নাঈম? নীলা ভাবলো সেও মজা দেখাবে। পেটের মাঝে এমন গুঁতো দিবে যে বেচারা খ‍্যাক করে হেসে উঠবে।নীলা এক হাতে জলের গ্লাসটা ধরে অন‍্য হাতে নাঈমের পেটে একটা গুঁতো দিলো।নাঈম কিছুতেই নড়লো না। তখন কেন জানি আচমকা ভয়ে নীলার সাড়াটা শরীর জমে উঠলো। নীলার হাত থেকে টুপ করে জলভর্তি গ্লাসটা মাটিতে পড়ে ভেঙে কয়েক টুকরো হয়ে গেল।নীলা ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গিয়ে নাঈমের শরীরে নাড়া দিতেই বুঝতে পারলো নাঈমের শ্বাস প্রশ্বাস চলছে না।সে যেন হঠাৎ নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছে না।তাই সে নাঈমের গায়ে তীব্রভাবে নাড়া দিতে দিতে ডাকলো,’এই যে? এই যে শুনুন!’
একবার,দু বার এবং বারবার ডাকলো নীলা। কিন্তু কিছুতেই কাজ হলো না।শেষে কোন কিছুই বুঝতে না পেরে নীলা বোকার মতো চিৎকার করে কেঁদে উঠলো।তার কান্নায় শেষ রাতের আকাশ বাতাস তারা এবং পূর্ণ যুবতী চাঁদটাও কেঁপে উঠলো। কিন্তু নাঈমের কোন সাড়া মিললো না।সে যেভাবে ছিল ঠিক সেভাবেই পড়ে রইলো।

নীলার কান্নার গলা শোনে বাড়ির সবাই জেগে উঠলো। ভয়ে ভয়ে তারা এগিয়ে এলো নীলার ঘরের দরজার কাছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভীত সন্ত্রস্ত দেখাচ্ছে নাঈমের মা সালমা বেগমকে। তিনি দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে কাঁপছেন। কাঁপতে কাঁপতেই তিনি দরজায় কড়া নেড়ে বললেন,’কী হয়েছে বউ মা? কাঁদছো কেন?দরজাটা খুলো।’
নীলা তার শাশুড়ির গলা শুনতে পেয়ে আরো ভয় পেয়ে গেল। এবার সে নাঈমের মৃত্যুর শোকের চেয়ে নিজেকে নিয়ে ভাবতে লাগলো। আচ্ছা দরজা খুলে যদি তার শাশুড়ি দেখে নিজের ছেলে মরে পড়ে আছে বাসর ঘরে জায়নামাজের উপর তখন তিনি বিষয়টা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারবেন তো?নাকি সব দোষ দিয়ে বসবেন তাকে?তার চুলের মুঠি টেনে ধরে বলবেন,’কাল নাগিনী, তুই আমার ছেলেরে দংশন করছত।তোরে আমি ছাড়তাম না।জেলে দিয়াম।’
নীলার ভয় হচ্ছে। ভীষণ ভীষণ ভয়।সে কী দরজার খিল খুলে দিবে?

#চলবে__

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে