বাবলু – মোঃ জামাল উদ্দিন

0
511

#গল্পপোকা_চিঠি_প্রতিযোগিতা_২০২০

বাবলু,

তুই কি জানিস, কী করলে মানুষ প্রাণ খুলে হাসতে পারে? কতদিন প্রাণ খুলে হাসি না রে! মানুষকে ধোঁকা দেই। সামনের কয়েকপাটি দাঁত বের করে হি হি শব্দ করি। সবাই ভাবে হাসছি। কিন্তু আমি তো জানি রে, এই হাসির আড়ালে কী জমাট বাঁধা কষ্টটাই না আছে!

হয়তো বলবি, আমি একটা পাগল। মাথা খারাপ হয়েছে তাই আবোল-তাবোল বকছি। কত বড় শহর ঢাকা! এখানে কি আর কোনোকিছুর অভাব আছে?

কিন্তু তুই জানিস না, কত আজব এই শহর! এখানে সব আছে তবু কী যেন নেই, কীসের যেন অভাব। সবসময় বুকের মধ্যে একটা শূন্যতা নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হয়।

এখানে মাঝে মাঝে বৃষ্টি নামে কিন্তু তাতে প্রাণ ভরে না। মনে হয়, এ যেন কোনো মুনি ঋষির অভিশাপ প্রাপ্ত বৃষ্টি। তার আসার কোনো ইচ্ছেই ছিল না, জোর করে পাঠানো হয়েছে। হৃদয়টা ব্যাকুল হয়ে থাকে বৃষ্টির একটুখানি ঝুম ঝুম শব্দ শোনার জন্য।
কিন্তু হায়! কোথায় সেই চিত্তহারী শব্দ?

এখানে সন্ধ্যা নামে। কিন্তু ঠিক কখন যে নামে তা আমি টের পাই না। কল্পনার ক্যানভাসে তুলির আঁচড় দিতেই চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ওঠে সেই সোনাঝরা স্মৃতিগুলো।

বসে আছি শান্ত নদীর তীরে। এক অপূর্ব রক্তিম আভায় রঞ্জিত পশ্চিমের আকাশ। চারপাশ উদ্ভাসিত করা এক নজরকাড়া স্নিগ্ধ জ্যোতি। সূর্যি মামা তার পূর্বের প্রখর দীপ্তি কমিয়ে এখন টকটকে লাল। কেমন নরম সুবোধ বালকের মতো লুকিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমের দিগন্ত রেখার নিচে। ওখান থেকেই যেন বলছে, “বিদায় খরতপ্ত পৃথিবী, আজকের মতো চললুম।”
অদূরের বিল থেকে কতগুলো পাখি মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল উত্তরের দিকে। নীড়ে ফেরার সে কী তাড়া তাদের!
এক মায়াবী আঁধার ধীরে ধীরে ঘিরে ধরতে লাগল পৃথিবীকে।
বহুদূরে কার ছাগলটা যেন তখনো একটানা ডেকে যাচ্ছে। কার একটা হাঁস তখনো নদীতে। সঙ্গীদের হারিয়ে সে একা হয়ে পড়েছে। এখন নিজের বাড়ির রাস্তাটাও চিনতে পারছে না। এক অজানা আতঙ্ক তাকে ঘিরে ধরেছে। সেটি একটানা প্যাঁক প্যাঁক করে ডেকেই যাচ্ছে।

আহ! নদীর ধারে মহাকাব্যিক কী অপূর্ব সন্ধ্যাগুলোই না নামত!

ঝাঁকে ঝাঁকে মশা এসে কানের কাছে ভনভন শুরু করতেই সৎবিত ফিরে পাই। খেয়াল হয়, বসে আছি আজব শহরের একটা ব্যালকনিতে। এতগুলো মন ভোলানো জিনিস থেকে আমাকে বঞ্চিত করে সূর্যি মামা ডুবে গেছে সেই কখন! বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে।

জানিস, এখানে হেমন্ত শেষ হলেও শীত আসে না। অনাবৃত দিগন্ত বিস্তৃত প্রকৃতির মাঝখানে শীতের সকালগুলো যে সৌন্দর্য মহিমায় সেজে উঠত তা এখানে নেই।
কোনো কোনো দিন মনে হয়, এই বুঝি শীত এল ঘন কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে। উত্তুরে হিমেল হাওয়া এসে এই বুঝি হাড়ে কাঁপন ধরিয়ে দিল। কিন্তু ইট পাথরে ঘেরা এই কৃত্রিম পরিবেশে সবই যেন মায়া।

হঠাৎ কোনোদিন পানি আনতে ছাদে যাই। দেখি, মাথার উপর থালার মতো পূর্ণিমার চাঁদ। কিন্তু তার আলো কোথায়?
মনে হয়, সে দুঃখ ভারাক্রান্ত। নীরবে কাঁদছে। চারপাশের বাহারি আলোর মাঝে পড়ে বেচারা যেন নিজের অস্তিত্বটাই হারিয়ে ফেলেছে।

দিন আসে দিন যায়। কত স্মৃতি এসে জীবনের পাতায় জমা হয়। কিন্তু জীবন থেকে খসে যাওয়া সেই দিনগুলোর কথা মন থেকে মুছে না।

যেদিন একা থাকি সেদিন খুব মন খারাপ হয়। বিস্মৃতপ্রায় অতীতের ঝকঝকে চিত্রগুলো ফুটে ওঠে মানসপটে। অন্যমনস্কভাবে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থাকি।
ওই মোবাইল কোম্পানির টাওয়ারটির মাথায় যে আকাশটা ওরই ওপারে বহুদূরে আমার প্রাণের গ্রামটি। যেন এখনও আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে। সেই ডাকে আমি সাড়া দিতে পারি না।
কিন্তু কেন?
কার এতবড় সাহস?
কীসের শক্তিবলে সে আমাকে আমার স্নিগ্ধ সুন্দর জন্মালয় থেকে, আমার প্রিয়জনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে?

হারিয়ে যাই ভাবনার অতল গহ্বরে। সময় গড়িয়ে যায় তবু আমার ভাবনার শেষ হয় না। দিন-রাত পার হয়ে মাস, বছর চলে যায়। আমি ভাবতেই থাকি।

জীবিকা নামক এক ভয়ংকর দৈত্যের বাঁধানো ছকে আটকা পড়েছে জীবন। চাইলেও আর ছুটতে পারছি না। খাঁচায় বন্ধি সেই পাখিটার মতো খাচ্ছি, দুঃখ চেপে রেখে সুখের গান গাইছি। আর স্বপ্ন দেখছি, কোনো একদিন তো মুক্তি মিলবে!

আজকাল নিজেকে মাছের মতো মনে হয়। কোনো চতুর শিকারি যেন ছলে বলে কৌশলে আমাকে বড়শির টোপ গিলিয়েছে। এখন আর পরিত্রাণের উপায় নেই। যেকোনো সময় টান মেরে আমার চিরচেনা এই জলাশয় থেকে তুলে নিয়ে যাবে।

আর কোনোদিন উঠানে মাদুর পেতে রূপকথার গল্প শোনা হবে না। বাদুড়ে খেয়ে ফেলা অর্ধেকটা আমের জন্য আর দৌড়ানো হবে না। মনোহরের জনহীন ভিটায় ভাঁটফুলের ফাঁকে ফাঁকে জোনাকি পোকা ডাকবে, রাত গভীর হলে উত্তরের ঘন বনে ছাতিম কিংবা শ্যাওড়ার ডালে বসে লক্ষ্মীপেঁচা ডাকবে, কিন্তু তা আর আমি শুনতে পাব না।

আষাঢ়ে বাদল নামবে। অবিশ্রান্ত বর্ষণে মুখরিত হবে চারপাশ। এরই মধ্যে নেমে আসবে সন্ধ্যা। পশ্চিম আকাশের সূর্যাস্তের বর্ণবাহার ছাড়াই সেদিন সন্ধ্যাটা নামবে। দূরের কদম গাছটা শ্যামল সৌন্দর্যে মেঘের সাথী হবে। তারই ডালে বসে ভিজে কাক অসহায় আর্তনাদে প্রকৃতিতে কারুণ্য ফুটিয়ে তুলবে। ধীরে ধীরে অন্ধকার গাঢ় হবে। যুগ যুগ ধরে অপরাজেয় সৈনিকের মতো দাঁড়িয়ে থাকা মাঠের পাশের বটগাছটা অদৃশ্য হবে। ব্যাঙের একটানা সুর বাশির মতো বাজবে। মসজিদ থেকে ভেসে আসবে আযানের সুমধুর ধ্বনি।

কিন্তু আফসোস, এসব কিছুই আর আমার দেখা হবে না, শোনা হবে না।

আমি জানি না মরলে মানুষ কোথায় যায়! সেখান থেকে এই মায়ার পৃথিবীতে আর ফিরে আসে কী না! তবু মহান প্রভুর কাছে একটা ফরিয়াদ জানাই, তিনি যদি আমাকে আবার এই পৃথিবীতে পাঠান তবে যেন আমার ওই গ্রামটিতেই পাঠান। এর ব্যত্যয় করলে আমি সুখী হব না।
আমি আরেকবার প্রাণভরে সেই নৈসর্গিক দৃশ্যগুলো দেখতে চাই।

আজ তবে রাখছি। ভালো থাকিস তোরা।

ইতি
জামাল

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে