#বাদলে_ঘেরা_আকাশ
#Part_7_and_8 ( last part )
#Writer_Tahsina_Islam_Orsha
মনে হচ্ছে আকাশ টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ছে বর্ষার উপর। বর্ষা কল্পনাও করেনি এমন কিছু দেখবে। ছবির দিক থেকে একবার চোখ দুটো সরিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। আকাশের চোখ দুটো প্রখর নীরব। নিরবতায় ভয় লাগছে বর্ষার। ঝড় আসার পূর্বে যেমন সব কিছু নিরব থমথমে হয়ে যায় এখন ঠিক সেই পরিস্থিতি বিরাজমান ঘরটাতে।
মনে হচ্ছে এখনি কোন বড় সড় ঝর আসবে। আর দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে যাবে সব।
বর্ষা আবার তার চোখের দৃষ্টি ছোট ছবিটাতে আবদ্ধ করে। ছবিটা তার বাবার। অনেক পুরনো সেই ছবি তখন সম্পুর্ণ ইয়াং তিনি৷ ছবিটিতে বর্ষার বাবার মুখ লাল কালি দিয়ে ক্রস চিহ্ন করা। বর্ষা অবাক হওয়ার সর্বোচ্চ তুঙ্গে। তার বাবার ছবি কেন এখানে আসবে? আর কেনই বা এমন লাল দাগ এঁকে রাখবে ছবিতে। এতো পুরনো ছবি কোথায় বা পেলো?
আকাশ একটু সামনে এগিয়ে বড় ছবিটিতে নরম ভাবে হাত বুলিয়ে
‘এটা আমার ফুপু আঁখি যুবায়েরের ছবি। আমার ফুপু বললে ভুল হবে আমার আরেক মা। আমার মায়ের থেকে বেশি ভালোবাসতো উনি আমায়৷ আমার গোসল, খাওয়া,ঘুম সব ছিলো আমার ফুপুর সাথে ফুপুর হাতে। আমিও ফুপু ছাড়া কিছু বুঝতাম না। মা বলেই ডাকতাম। ছোট ছিলাম তাই হয়তো বেশি আদরের ফলে এমন করতাম। ফুপু না খাইয়ে দিলে খেতাম না এমনকি আম্মু খাইয়ে দিলেও না।
আকাশ একটু চুপ থেকে
‘ আমার নামটাও ফুপুর দেওয়া। আকাশ। ( আবার একটু থেমে) এতো বিশালতার মাঝে আমি হঠাৎ আমার ফুপুকে হাড়িয়ে ফেললাম।
নিশ্চয়ই ভাবছো আমি তোমায় কেন এসব বলছি আর তোমার বাবার ছবিই বা এখানে এই ভাবে কেন!
তোমার বাবা আমার ফুপুকে বাঁচতে দেয়নি।
তোমার বাবার ছবি এইজন্য এখানে।
বর্ষা হতবাক হয়ে
‘ কি বলছো এইসব আকাশ।
‘ তোমার বাবা আমার ফুপুর খুনি। এক হাস্যজ্জল পরিবার ছিলো আমার। দাদা, ফুপু আব্বু ,আম্মু আমি,আফিফ। কতো আনন্দে দিন পাড় করছিলাম আমরা। কিন্তু তোমার বাবার জন্য সেই আনন্দ বেশিদিন টিকেনি।
তোমার বাবা আমার ফুপুকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে। সন্তান রেখে স্ত্রী মারা গেছে শুনে ফুপুও মায়ায় পড়ে যায় তোমার আব্বুর, ভালোবেসে ফেলে ওই মানুষ রুপি জানোয়ারকে। একসময় আমার ফুপু জানতে পারে ফুপু প্রেগন্যান্ট। তোমার বাবার কাছে গেলে উনি তোমাদের দোহাই দিয়ে ফিরিয়ে দেয় আমার ফুপুকে। বলে দেয় এবরশন করিয়ে নিতে। আবার বিয়ে করলে নাকি তোমাদের কষ্ট হবে। ফুপু অনেক বলেছিলো তোমাদের মায়ের আদর দিয়ে বড় করবে। কিন্তু তোমার বাবা অপমান করে তাড়িয়ে দেয় ফুপুকে। আর কোন উপায় না পেয়ে ফুপু আম্মুকে সব বলে, আম্মু আব্বুকে বলে আর আব্বু আমার দাদাকে।
আকাশ থমকে যায়। শরীরের শিরায় শিরায় মনে হচ্ছে রক্তের বদলে আগুন প্রবাহিত হচ্ছে। সারা শরীর জ্বালা করছে
বর্ষা কান্না করছে এই সব শুনে।
‘ তারপর!
আকাশ দগ্ধ চোখে
‘ দাদু ফুপুকে মেরেছিলো কেন এমন করলো তাই। সব শেষে আব্বু আর দাদু তোমার বাবার কাছে যায়। তোমার বাবা স্পষ্ট বলে দেয় ওটা উনার বাচ্চা নয়।
আব্বু আর দাদা চুপ করে এসে ড্রয়িংরুমে বসে। ফুপু এসে দাদুকে জিজ্ঞেস করে কি বলেছে নাইম।
দাদু চুপ করে ছিলো কোন কথা বলছে না। আব্বু যখন দাদুকে ধরতে যাবে তখনি দাদু আমার সামনে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। দাদুকে হাসপাতালে নিয়ে কোন কাজ হয়নি
কারন দাদুর ডেথ নাকি বাড়িতেই হয়ে গিয়েছিলো। সবাই বাড়ি এসে ফুপুকে ডাকলে ফুপুর কোন সারাশব্দ পাওয়া যায় না। সবাই দৌড়ে ফুপুর রুমের কাছে এসে দেখি ফুপুর রুম ভিতর থেকে লক করা। অনেক ডাকাডাকির পরও যখন ফুপু দরজা খুলে না তখনই আব্বু দারোয়ানকে ডেকে আনে দুজন মেলে দরজা ভাঙে…..
বর্ষার শরীর কাঁপছে। সে স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। হাত পা থরথর করছে। কাপাকাপা কন্ঠে
‘ তারপর
আকাশ রাগ আর ক্রোধে ভরা চাহনিতে তাকায় বর্ষার দিকে। তাকিয়ে আবার চোখ বন্ধ করে
‘ দরজা ভাঙতেই দেখি ফ্যানের সাথে ঝুলে আছে ফুপু। সবাই দৌড়ে গিয়ে ফুপুকে ধরে। আমি নড়তে পারছিলাম না একটুও। নড়ার শক্তি পাচ্ছিলাম না। দাদার জন্য কান্না করে আর চোখ দিয়ে পানিও বের হচ্ছিলো না। সবাই আমাকে অনেক কাঁদানোর চেষ্টা করেছিলো জানো কিন্তু কেউ পারেনি।
আকাশের গলা শুকিয়ে যায়। একটু ঢোক গিলে
‘ দাদা আর ফুপুকে একসাথে কবর দিয়েছি। ফুপুর রুম থেকে আমি প্রতিদিন কান্নার আওয়াজ শুনতে পেতাম। প্রতিদিন ফুপু আমায় বলতো আকাশ আয় তোকে আমি ঘুম পাড়িয়ে দেই। তাই প্রতিদিন রাতে আমি ফুপুর রুমে যেতাম। আম্মুরা বুঝতে পারছিলো আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে তাই ওই রুমে যেতে দিতো না। কেউ যাতে ওই রুমে যেতে না পারে তাই আমিই ছোট করে লিখে রেখেছিলাম। এই রুমে কেউ প্রবেশ করবেন না। শুধু আমিই লুকিয়ে লুকিয়ে আসতাম রুমে।
আম্মু আব্বু দুজনই জানে তোমায় কেন বিয়ে করেছি আমি। ওরা না করেছিলো তোমার সাথে এমন করতে কিন্ত আমি যে ওয়াদা করেছিলাম ফুপুর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে তোমার বাবাকে আমি ছাড়বো না। উনি আমার পরিবারের সুখ শান্তি সব নষ্ট করে দিয়েছিলো। আমি উনার সুখ শান্তি নষ্ট করবো।
সেই কাজিনের মাধ্যমে জানতে পারি তুমি তার সাথে ভার্সিটিতে পড়ো। আর তার মাধ্যমেই তোমার সাথে পরিচয়। প্রেমের অভিনয়, বিয়ে সবই ছিলো অভিনয় কিন্তু মাঝখান থেকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম তোমায়। কিন্তু তোমার থেকে আমি আমার ফুপুকে বেশি ভালোবাসি। ফুপুর কথা মনে হতেই তোমার প্রতি আমার ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই আসেনা। আমার ফুপুর যেই অবস্থা করেছে তোমার বাবা আমিও ঠিক তেমন অবস্থা করবো তোমার ভেবেছিলাম কিন্তু তোমায় ভালোবেসে বিয়ে করে ফেললাম। কিন্তু তুমি শাস্তি পেতে তৈরি হয়ে যাও। তোমার বাবা এখন বুঝবে আমরা কেমন অবস্থায় ছিলাম।
বর্ষা ফ্লোরে বসে পড়ে কান্না করে
‘ মিথ্যে সব মিথ্যে। আমার আব্বু এমন হতে পারেনা। তোমাদের কোথাও ভুল হচ্ছে। যে লোকটা তার মেয়েদেরকে এতো ভালোবেসে মানুষ করতে পারে। সে অন্য একটা মেয়ের সাথে এমন করতে পারে না।
বর্ষার কথা শুনে গর্জন করে উঠে আকাশ। হাটু গেড়ে বসে এক হাত দিয়ে বর্ষার মুখে চাপ দিয়ে ধরে
‘ শাট আপ জাস্ট শাট আপ।
আকাশ একটা চেয়ার লাথি মেরে ফেলে দিয়ে
‘ যে রাগ আমি পুষে এসেছি এতো গুলো বছর। তা আমি কমাবার চেষ্টা করেছিলাম। এতো কিছুর পরও আমি মানা করেছিলাম এই রুমে আসতে। কেন আসলে? আর এই শাস্তি এখন তোমার পেতেই হবে।
‘ আকাশ কেন করছো আমার সাথে এমন? বাবা এসব করতে পারে না। যদিও বা করে থাকে তাতে আমার কি দোষ বলো আমি তো শুধু তোমায় ভালোবেসেছি। ( কান্নায় কথা বলতে পারছে না বর্ষা।
‘ আমার ফুপুও শুধু ভালোবেসেছিলো। আর তুমি ওই লোকের মেয়ে এটাই তোমার দোষ। তোমার বাবাকে জিজ্ঞেস করো তাহলেই সব জানতে পারবে মুখোসের পিছনে কি লুকিয়ে আছে। আমার বাবা মা তোমায় তোমার ফেমিলিকে ক্ষমা করে দিতে পারে কিন্তু আমি করবো না।
দূর থেকে আযানের শব্দ ভেসে আসছে
আকাশ বর্ষাকে টেনে তুলে
‘ যাও কাপর-চোপর গুছানো শুরু করো। এই রাতই ছিলো তোমার শেষ রাত আকাশ যুবায়েরের কাছে। ডিভোর্সের সব ব্যবস্থা সকালে উকিলের সাথে কথা বলে করবো।
আকাশ টেনে রুম থেকে বের করে বর্ষাকে। নিজের রুমে নিয়ে গিয়ে ড্রয়ার থেকে সব কাপড় ছুড়ে ফেলতে থাকে বর্ষার উপর।
‘ নাও প্যাক করা শুরু করো।
বর্ষা দৌড়ে গিয়ে আকাশকে ঝাপ্টে ধরে
‘ তোমার পায়ে ধরি আকাশ আমার সাথে এমন করো না। আমি তোমায় ভালোবাসি তোমায় ছাড়া থাকতে পারবো না। এই বাড়িতে আমি কাজের মেয়ে হয়ে থাকবো তবু একটু জায়গা দাও আমায়।
আকাশ তৃপ্তির হাসি হেসে
‘ আমার ফুপুও নিশ্চয়ই এই ভাবে ভিক্ষা চেয়েছিলো তোমার বাবার কাছে।
.
.
.
কিছুদিন পর
বর্ষার বাবা নাইম সাহেব বসে আছে আকাশ যুবায়েরের বাড়ির ড্রয়িংরুমে। পাশেই চুপ করে মাথা নিচু করে বসে আছে আশিক যুবায়ের।
আকাশ ডান হাতে সাদা এপ্রোন নিয়ে সিড়ি দিয়ে উপর থেকে নামতে নামতে
‘ আব্বু এখনো এই লোক যায়নি?
আকাশের কথা শুনে আশিক সাহেব
‘ আকাশ বৌমা প্রেগন্যান্ট, মা হতে যাচ্ছে। তুই আর রাগ নিয়ে বসে থাকিস না বাবা। বর্ষাকে নিয়ে আয় বাড়ি।
নাইম সাহেব দাঁড়িয়ে
‘ বাবা তুমি আমার মেয়েটার সাথে এমন করো না। আমার মা মরা মেয়ে অনেক কষ্টে ওকে মানুষ করেছি। ও দিন দিন অনেক অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। তোমার প্রয়োজন এখন ওর।
আকাশ বিদ্রুপাত্মক একটা হাসি দিয়ে
‘ যা হচ্ছে এই গুলো আপনাদের পাওনা। আব্বু উনাকে চলে যেতে বলো নয়তো আমার হাত উঠে যাবে।
বর্ষার প্রেগন্যান্সির আট মাস চলছে। অনেক কষ্ট হয় এখন চলাফেরা।আকাশের সাথে অনেক যোগাযোগ করতে চেয়েছে কিন্তু পারেনি।
একটু একটু করে হেটে কিচেনে গিয়ে চা বানিয়ে নিয়ে যায় নাইম সাহেবের রুমে।
নাইম সাহেব ইজি চেয়ারে বসে আছে চোখ বন্ধ করে।
বর্ষা ধীরে ডেকে
‘ আব্বু তোমার চা।
নাইম সাহেব চোখ খুলে
‘ তোকে কে বলেছে চা নিয়ে আসতে এখন এতো নড়াচড়া করিস না মা।
বর্ষা নাইম সাহেবের চোখের দিকে মায়া নিয়ে তাকিয়ে
‘ হুম
বর্ষা ঘুরে চলে যেতে নিলেই
‘ বর্ষা
‘ হুম আব্বু
নাইম সাহেব বর্ষার হাত ধরে
‘ মারে আমায় ক্ষমা করে দিস। আমার জন্য তোকে এসব পোহাতে হচ্ছে।
‘ এসব বলো না বাবা। ঘুমিয়ে যাও তাড়াতাড়ি
‘ হুম
অনেক বেলা হয়ে গেছে তনিমা নাস্তা বানিয়েছে। বর্ষা খাবার পরিবেশন করছে
‘ তনিমা আব্বু এখনো উঠেনি?
‘ না আপু আমি তো ডেকেছি দুবার উঠেনি।
‘ আব্বু তো এতক্ষণ ঘুমায় না। দাঁড়া আমি ডেকে নিয়ে আসছি। এক সাথে না খেলে ভালো লাগে না।
বর্ষা আব্বু বলে কয়েকটা ডাক দেয় নাইম সাহেবের কোন উত্তর না পেয়ে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে দেখে নাইম সাহেব এখনো ইজি চেয়ারেই বসে আছে রাতে হয়তো এখানেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলো।
বর্ষা নাইম সাহেবের চশমাটা খুলতে নিলেই নাইম সাহেবের হাত পড়ে যায় নিচে মাথা পড়ে যেতে নিলেই আব্বু বলে জোরে চিৎকার দিয়ে ধরে ফেলে।
তনিমা দৌড়ে আসে বর্ষার চিৎকার শুনে। দারোয়ানও ভিতরে এসে
‘তনিমা মা কি হয়েছে বর্ষা মা চিৎকার করলো কেন?
দারোয়ান নিজামুদ্দিন ভালো করে লক্ষ করে দেখে বর্ষা জড়িয়ে ধরে আছে নাইম সাহেবকে। দারোয়ান কাছে গিয়ে নাইম সাহেবের বুকে মাথা রেখে বলে উঠে
‘ মারে সাহেব আর বেঁচে নেই। রাতেই ও আমার কাছে গিয়ে বলছিলো নিজামুদ্দিন আমার কিছু হলে আমার মেয়ে দুইটারে দেখে রাখিস।
কান্না করছে নিজামুদ্দিন। তনিমা চিৎকার করে কান্না করছে। বর্ষা নাইম সাহেবের মুখখানিতে একবার হাত বুলিতে দিলো।
আফিফ, আশিক সাহেব মনিরা বেগম এসেছে কিন্তু আকাশ আসেনি। নাইম সাহেবকে কবর দেওয়া হয়ে গিয়েছে। আশিক সাহেব বর্ষাকে নিয়ে যেতে চাইলে
‘ অনেক তো হলো বাবা এখন একটু নিজের মতো বাচঁতে চাই। তনিমাটার আর আমি ছাড়া কেউ নেই।
‘কিন্তু বর্ষা মা তোর এই অবস্থায় এখানে থাকা রিস্ক। কখন কি হয় না হয়।
‘ আল্লাহ আছে বাবা কিছু হবে না আমার আকাশকে বলে দিবেন বাচ্চা হওয়ার পরই ওকে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিবো আমি। ওর মনের ইচ্ছেতো পূরণ হয়েছে ওকে জানিয়ে দিয়েন। অবশ্য জেনে গেছে এটা জানি। তবে জানিয়ে দিবেন আমিও আর ওর পথের কাটা নই। মনিরা বেগম কান্না করছে বর্ষাকে ধরে।
.
.
.
বর্ষা তনিমা কে ধরে শুয়ে আছে হসপিটালের বেডে। তনিমা কান্না করছে যেখানে বর্ষার কান্না করার কথা ছিলো
‘ আরে পাগলি মেয়ে কিছু হবে না আমার। কান্না করছিস কেন? আমি জানি আমি ছাড়া তোর কেউ নেই। তাই এতো তাড়াতাড়ি তোকে ছেড়ে যাচ্ছিনা। চিন্তা করিস না।
বাচ্চা নরমালে হবে না তাই সিজার করা হবে। দুজন নার্স এসেছে বর্ষাকে ওটিতে নিয়ে যাবার জন্য৷
ওটিতে নিয়ে গিয়েছে বর্ষাকে তনিমা আফিফ আর তার বাবা মাকেও বলেছে আসতে ওরা সবাই এসেছে। আকাশ আগে থেকেই হসপিটালে ছিলো। আকাশ যেই হসপিটালে আছে সেই হসপিটালেই বর্ষাকে নিয়ে আসা হয়েছে
কিছুক্ষন পর কান্নার আওয়াজ শুনতে পায় সবাই তনিমা খুশিতে লাফিয়ে উঠে। আফিফের মুখেও খুশি দেখার মতো। একজন নার্স বাচ্চাকে এনে তনিমার কোলে দিলো। তনিমা কান্না করছে বাচ্চাকে দেখে। ছেলে বাবু হয়েছে। মনিরা বেগম খুশিতে তার নাতিকে তনিমার কোল থেকে নিজের কোলে তুলে নেয়। আফিফ দৌড়ে গিয়ে আকাশকে জোর করে নিয়ে আসে ওটির সামনে আকাশ আসতেই তনিমা সরে যায় রাগে৷
মনিরা বেগম খুশিতে
‘ আকাশ দেখ তোর বাচ্চা ঠিক তোর মতো হয়েছে। ছোট্ট আকাশ আমাদের।
আকাশ কোলে তুলে নেয় বাচ্চাকে। কি এক অদ্ভুত অনুভুতি হচ্ছে ভিতরে। এই সুখ যেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখ। এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আকাশের চোখ দিয়ে অজান্তেই একটু পানি বের হয়ে গেলো।
এমন সময় ওটি ওটি থেকে বের করছে অবচেতন বর্ষাকে। হাতে সেলাইন লাগানো। ওই ঘটানার পর এই প্রথম আকাশ বর্ষাকে দেখছে। মেয়েটা আগের থেকে অনেক সুন্দর হয়েছে। আকাশের খুব ইচ্ছে হচ্ছে বর্ষাকে একটু ছুঁয়ে দিতে কিন্তু তার আগেই বর্ষাকে নিয়ে যায় নার্সরা কেবিনে দেওয়ার জন্য। আকাশ ছেলের কপালে একটা চুমি এঁকে দিয়ে বাচ্চাকে আফিফের কোলে দিয়ে নিজের কেবিনে চলে যায় আকাশ।
আকাশের এই একটা বছর আনন্দে কাটেনি। প্রতিটিদিন সে কেঁদেছে বর্ষার জন্য । আকাশও জানে বর্ষার সাথে সে অন্যায় করেছে কিন্তু প্রতিশোধ আর প্রতিশ্রুতি তাকে বর্ষার কাছে যেতে দেয়নি। বর্ষাকে শাস্তি দিয়ে আকাশও একা কেঁদেছে।
মনিরা বেগম ক্লান্ত শরীর নিয়ে হতাশা হয়ে আকাশের রুমে গিয়ে দেখে আকাশ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। মনিরা বেগম আকাশের পাশে বসে
‘ আকাশ আজকে এক মাস হলো তোর বাচ্চা হয়েছে। বাচ্চাকে দেখতে গেলি না। বর্ষাকে বলেছিলা তনিমা সহ এখানে চলে আসতে সেও আসলো না হাসপাতাল থেকেই চলে গিয়েছে বাবার বাড়ি। বাবা প্রতিশোধ মানুষকে ভালো থাকতে দেয়না। তাই দেখ আজকে তুই প্রতিশোধ নিয়েও ভালো নেই। তোর মনে শান্তি নেই। মানুষকে ক্ষমা করতে শেখ। ক্ষমার মাঝে এক অপুর্ব শান্তি আছে। আর বর্ষার তো কোনো দোষ ছিলো না। কার শাস্তি তুই কাকে দিলি বাবা ভেবে দেখ। ওটা একটা এক্সিডেন্ট ছিলো। তোর ছেলেরও তো কোনো দোষ নেই ওকে কেন বাবার আদর থেকে বঞ্চিত করছিস?
আকাশ এবার মনিরা বেগমকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে। আকাশের বুকেও যে ভীষণ ব্যাথা।
‘ যা বাবা বর্ষার কাছে যা ওকে ফিরিয়ে নিয়ে আয়। আর দেরি করিস না।
আকাশ ছুটছে তার বর্ষার কাছে। আজকে ক্ষমা চেয়ে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে তার বর্ষাকে।
অনেকক্ষণ ধরে ড্রয়িংরুমে বসে আছে আকাশ কিন্তু বর্ষা আসছে না। ঘন্টাখানেক পর বর্ষা এসে
‘ সরি একটু দেরি হলো বাচ্চাকে ঘুম পাড়াচ্ছিলাম তো।
আকাশ বর্ষার দিকে তাকিয়ে আছে৷ বর্ষার সৌন্দর্য দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। মা হওয়ার জন্য হয়তো। বর্ষার মুখে কোন ক্লান্তির ছাপ নেই
‘ আকাশ
বর্ষার ডাকে চোখ নামায় আকাশ
‘ কেমন আছো বর্ষা?
‘ খারাপ দেখতে চেয়েছিলে কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছেই ভালোই আছি ।
‘ আমাকে ক্ষমা করে দিয়ে আমার ছেলেকে নিয়ে ফিরে চলো বর্ষা। আমি অনেক অন্যায় করেছি আমি জানি কিন্তু বিশ্বাস করো আমিও ভালো ছিলাম না।
‘ তোমাকে আমি ক্ষমা অনেক আগেই করে দিয়েছি আকাশ। তবে হ্যা তোমার ছেলে না ও শুধু আমার একার ছেলে। আয়াতের উপর তোমার কোন অধিকার নেই। চলে যাও আকাশ আমি ফিরে যাবো এই অপেক্ষায় আর থেকো না।
‘ একটি বারের জন্য ফিরে চলো বর্ষা
‘ আমি এখন শুধু আমার ছেলের জন্য বাঁচবো আকাশ। আমার ভালোবাসাকে তো তুমি মেরেই ফেলেছো।
আর যাওয়ার আগে শুনে যাও যার শাস্তি তুমি আমার বাবাকে আর আমাকে দিয়েছো সেই গুনাহ আমার বাবা করেই নি। আব্বুর ডায়েরি পড়ে জেনেছিলাম তাও আব্বু বলেনি কিছু। ওরা যমজ ভাই ছিলো। নাইম আর ফাহিম। আমার ফাহিম চাচ্চু তোমার ফুপুর সাথে অপরাধ করেছিলো আমার আব্বু নয়। ফাহিম চাচ্চু আব্বুর নাম করে এসব ব্লান্ডার করে বেড়াতো। তখন নতুন নতুন আম্মু মারা গিয়েছিলো আমাদের নিয়ে আব্বু দেশের বাহিরে ছিলো। আমরা যখন দেশে আসি আব্বু লোকের মাধ্যমে জানে ফাহিম চাচ্চু এসব করেছে তারপর উনাকে আব্বু বাসা থেকে বের করে দেয় উনার সম্পত্তি দিয়ে। আব্বু যদি তোমাদের আগে চিনতো তাহলে আমাকে নিশ্চয়ই বিয়ে দিতো না তোমার কাছে।
আকাশ বাকরুদ্ধ হয়ে যায় কি বলছে এসব বর্ষা
‘ আমায় আগে বলোনি কেন বর্ষা?
‘ আগে বললে কি হতো আকাশ? আমার চাচ্চু তো আমার রক্তই। তখন বলতে তোমার চাচ্চু তো এমন করেছে তার শাস্তি তুমিই পাবে। মাঝখান থেকে দেখো আমার আব্বু চলে গেলো আমাদের এতিম করে। আর কেউ রইলো না আকাশ আমাদের ছায়া হয়ে। ( কান্না সামলিয়ে)
আমার বাবা আমার আদর্শ। আমি জানতাম আমার বাবা এমন কিছু করতে পারে না। তোমার মতো আমার বাবার মৃত্যুর জন্য আমি তোমাকে দায়ী করবো না। এটা আমার ভাগ্য।
তুমি ভালো থেকো আকাশ
আকাশ বেড়িয়ে পড়ে বর্ষার বাড়ি থেকে অঝোরে কান্না করছে সে। কি করলো এটা আকাশ? মাফ চাইলেই কি আর সব কিছু ঠিক হবে? মাফ কি ভাবেই বা চাইবে বর্ষা মাফ করে দিলেও তো সে নিজেকে মাফ করতে পারবে না
🍁🍁🍁পাঁচ বছর পর 🍂🍂🍂
তনিমা তোর হাজবেন্ডকে বল তার ভাইকে বলতে আমি ফিরবো না কিছুতেই। এমন ভুলগুল যেন না শেখায় আমার ছেলেকে।
‘ আপু আফিফ তো বলেই সব সময় কিন্তু আকাশ ভাইয়া কার কথা শোনে? আকাশ ভাইয়া তো আকাশ ভাইয়াই।
তনিমা আর আফিফের বিয়ে হলো দুই বছর। কিন্তু এরপরেও বর্ষার মন গলাতে পারেনি আকাশ। তনিমা আফিফও কম চেষ্টা করেনি বর্ষার রাগ ভাঙাতে। আকাশ প্রতিদিন এসে অনেক রাত অব্দি থাকে কখনো থেকে যায় রাতে আয়াতের সাথে। কিন্তু বর্ষার দিক থেকে কোন সারাশব্দ পায় না।
আকাশ আয়াতকে কোলে নিয়ে
‘ আয়াত তোমার আম্মুকে বলো একটা বিশ্বস্ত কাজের ছেলে তোমাদের ভীষণ প্রয়োজন। আমাকে যাতে রেখে দেয়।
আয়াত কুটিকুটি করে হেসে
‘ পাপ্পা কি বলো তুমি না ডাক্তার?
‘ হ্যাঁ বাপ কিন্তু তোর মা তো একজনকেও রাখতে চাইছে না ডক্তার হোক বা কাজের ছেলে।
আয়াত আবার হাসছে। ছেলের হাসি দেখে বর্ষা মুখ আড়াল করে হাসছে।
বর্ষা এক কাপ চা তনিমাকে দিয়ে
‘ তনিমা এটা তোর ভাইয়াকে দিয়ে আয়।
‘ আপু আমি বুঝিনা সবই ঠিক আছে তোদের কিন্তু তুই ভাইয়ার সাথে কথা বলিস না কেন।
বর্ষা দীর্ঘশ্বাস ফেলে
‘ আমি ওকে ভালোবাসি তনিমা। ও যেই ভুলটা করেছে আমি সেটা করতে চাই না। তাই ওকে দূরে সরিয়ে দিইনি। আয়াতকেও তার বাবার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করতে পারিনা আমার জন্য ।
‘ তাহলে কাছে টেনে নিচ্ছিস না কেন ভাইয়াকে?
একটু চুপ থেকে
‘ জানি না। ও প্রতিদিন ক্ষমা চায় আমার কাছে সেটা আমার ভালো লাগে।
হঠাৎ আফিফ এসে
‘ কিন্তু ভাবি আর চাইবে না। আমার স্মার্ট ফোনে আপনার সব কথা রেকর্ড হয়ে গিয়েছে আর তা এখন ভাইয়াকে শোনাবো হিহিহি।
‘ আফিফ ভালো হবেনা কিন্তু ফোন দাও আমাকে।
আফিফ ভোঁ দৌড় বর্ষা জানে সে পারবে না তাই আর কথা বাড়ায়নি।
বর্ষা তার রুমে আয়াতের কাপড় গোছাচ্ছিলো। হঠাৎ পিছন থেকে আকাশ জড়িয়ে ধরে বর্ষাকে। বর্ষা কেঁপে ওঠে আকাশের ছোঁয়া পেয়ে। আফিফ হয়তো ফোনে রেকর্ড করা সব শুনিয়েছে আকাশকে তাই এতো সাহস নিয়ে এসেছে বর্ষার কাছে। নাহয় এতো গুলো বছরের মাঝে বর্ষাকে ছোঁয়ার সাহস করেনি। বর্ষার ইচ্ছে করছে না আজ আকাশকে বাধা দিতে। বর্ষার এখন মনে হচ্ছে ” বাদলে ঘেরা আকাশ ” বর্ষাকে আকাশের দিকে ঘুরিয়ে জড়িয়ে ধরতেই আয়াত এসে
‘ পাপ্পা তোমাদেল কি আড়ি শেষ হয়ে গিয়েছে?
বর্ষা লজ্জায় পড়ে যায়। কাপড় ঠিক করে চুপ করে বের হয়ে যায় রুম থেকে। আকাশ আয়াতকে কোলে তুলে গালে একটা চুমু দিয়ে। চলো এখন আম্মুর চুমু খাবো।
আয়াত হো হো করে হেসে উঠে আকাশ আয়াতকে নিয়ে বর্ষার পিছন পিছন রুম থেকে বের হয়।
সমাপ্ত
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।