বাতাসে প্রেমের আভাস পর্ব-০৩

0
568

#বাতাসে_প্রেমের_আভাস (পর্ব-৩)
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

আধ্রিকা বর্তমানে তনুদের সুইমিংপুল এড়িয়াতে বসে আছে। সে একা নয়। বলতে গেলে সবাই সেখানে উপস্থিত। তাহসানদের পরিবার, তাদের পরিবার, মিসবাহ্’দের পরিবার সবাই রয়েছে। আধ্রিকার খালামণিরা মিসবাহ্ দের জোর করে আ’টকে রেখেছে। ডিনার না করিয়ে নাকি ছাড়বেই না। এদিকে তাহসান এসে বিবিকিউ পার্টির প্ল্যান করে ফেলল। তাই বাড়ির পেছনের দিকে লনে, সুইমিংপুলের পাশেই আয়োজনটা করা হচ্ছে। তাহসান, আরাফাত, মিসবাহ্’র ছোট ভাই অর্থাৎ তনুর বর মাহমুদ এরা তিনজনই বিবিকিউ করার দায়িত্ব নিয়েছে। আর কাজটা তারা বেশ মজা করেই করছে। আধ্রিকা মিসবাহ্’র দিকে তাকালো। তার থেকে পাঁচ, ছয় হাত দূরে বেতের সোফায় বসে মোবাইলে ব্যস্ত সে। আধ্রিকা বেশ অবাক হচ্ছে। লোকটা একবারের জন্যও তার দিকে তাকাচ্ছে না। কেন যেন মিসবাহ্’র এই আচরণ সে স’হ্য করতে পারছে না। তার আত্ম অহমিকাতে এই ব্যাপারটা আ’ঘা’ত হেনেছে। এই ছেলেই তো তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল আর এখন ফিরেই তাকাচ্ছে না! আধ্রিকার মাথা বেশ গরম হয়ে গেল এসব ভেবে। সে হাতে থাকা জুসের গ্লাসটা শব্দ তুলে কাঁচের টেবিলে রাখল। তাতেও মিসবাহ্ চোখ তুলে তাকালো না। বরং দূরে থাকা তাহসান চেঁচিয়ে বলল,

-‘এই মহিলা! আমাদের কোনো জিনিসপত্র ভাঙলে তোর খ’ব’র করে ছাড়ব।’

আধ্রিকা তাকে মুখ ঝামটা মে’রে সেখান থেকে উঠে গেল। সোজা বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল। অবশ্য মিসবাহ্’র সামনে দিয়ে হেঁটে আসার সময় হাই হিল দিয়ে ইচ্ছে করে একটু বেশি গটগট আওয়াজ তুলল। তবুও মিসবাহ্’র কোনো নড়চড় দেখা গেল না।

আধ্রিকা চলে যেতেই মিসবাহ্’র ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুঁটে ওঠে। এতক্ষণ সে ইচ্ছে করেই তো তাকায়নি। অথচ তার পুরোটা ধ্যান আধ্রিকার উপরেই তো ছিল! সে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। তারপর হাতে থাকা মোবাইলটা প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে সে তাহসানদের দিকে এগিয়ে গেল।

—————————-
আধ্রিকা দোতালার করিডোর ধরে হাঁটছে। তার মনটা ভীষণ খা’রা’প। এত মন খা’রা’প হচ্ছে কেন তার? আচ্ছা! তাকে কি আজকে সুন্দর লাগছে না নাকি! সে দেয়ালে ফিট করা আয়নার দিকে তাকালো। ভালো করে নিজেকে দেখল। তারপর জুঁই নারিকেল তেলের সেই বিজ্ঞাপনের মতো মিথিলা যেমন করে আয়নায় নিজেকে দেখে সেও নিজের চুল নেড়ে চেড়ে আয়নায় নিজেকে দেখল। আর গাইল,

‘ভেংচি কে’টে আয়না বলে তোমায় ভালো লাগে না! লা লা লা লা….’

তারপর আবার ঢং করে বলল,
-‘ভালো লাগে? লাগে, লাগে!’

মাইমুনা দোতলায় উঠে ননদকে এমন অঙ্গভঙ্গি করতে দেখে হেসে বলল,

-‘তোমার আবার কী হলো! এমন করছ কেন?’

একটা চাপা ক্ষো’ভ ভেতরে আ’টকে রেখে আধ্রিকা জবাব দিল,

-‘কিছু না। এমনিতেই।’

-‘আচ্ছা। কিছু না হলে না হোক। শোনো! মিসবাহ্ ভাইয়ার মা তোমাকে ডেকেছেন। গিয়ে দেখা করে আসো। না গেলে মানুষটা মনে দুঃখ পাবেন।’

আধ্রিকার একটু অস্ব’স্তি লাগছিল তারপরেও বলল,
-‘আচ্ছা যাচ্ছি। কোথায় আছেন উনি?’

মাইমুনার থেকে মিসবাহ্’র মায়ের অবস্থান জেনে নিয়ে আধ্রিকা হাঁটা ধরল। সে আসলে খুব ছোট হয়ে গেছে নিজের কাজে। সবাই তো বিয়ের তারিখটাও ঠিক করে ফেলছিল একপ্রকার। আর তখনিই সে বিয়েটা করবে না বলে ভেঙেও দিল। ভদ্র মহিলা নিশ্চয়ই তার উপর বেশ রে’গে আছেন। কি বলতে ডেকেছেন উনি? ক’ড়া কিছু শোনাবে নাকি?

মিসবাহ্’র মা আধ্রিকার সাথে খুব সুন্দর আলাপন সাড়লেন। আধ্রিকা এতে ভীষণ অবাক হলো। ভদ্র মহিলা হেসে হেসে কথা বলেছেন। অথচ তার এমন ভাবে কথা বলার ছিল না বোধ হয়। তার ছেলেকে রিজেক্ট করেছে আধ্রিকা। মা হিসেবে সেটা নিয়ে তার তো দুঃ’খ এবং রা’গ দুটোই হওয়ার কথা। কিন্তু সেইসব মনে হচ্ছে না। বরং তার চোখে মুখে অনুতাপ বোধ দেখা যাচ্ছে। আধ্রিকা বুঝে উঠতে পারছে না কিছুই। তার কেন যেন মনে হচ্ছে মিসবাহ্’র মা হয়তো জানে না যে সে বিয়েতে অমত দিয়েছে। কিন্তু জানল না কেন? মিসবাহ্ জানায় নি? উফ! এখন এই কথাটা তার মাথায় ততক্ষণ ঘুরঘুর করবে যতক্ষণ না সে তা না জানবে।

সবাই সুইমিংপুল এড়িয়াতে এসে বসেছে। বিবিকিউ হয়ে গেছে। এবার খাওয়ার পালা। আধ্রিকা এলো সবার শেষে। এসে দেখল বসার জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। তাহসান তাকে দেখে বলল,

-‘এই লেট লতিফ! এত দেরি করিস কেন সবকিছুতে? দ্যাখ, এখন বসার জায়গা পাচ্ছিস না।’

-‘আমি লেট করি সেটা তো জানো। তা আগে থেকে জায়গা রাখতে পারলে না? আর বাড়িতে কি আর চেয়ার নেই তোমাদের?’

তাহসান হেসে বলল,
-‘আছে তো। দাঁড়া নিয়ে আসছি।’

তাহসান উঠতে নিলেই মিসবাহ্’র মা বলে উঠলেন,

-‘তুমি ক’ষ্ট করে চেয়ার আনতে যেও না বাবা। মিসবাহ্’র পাশে বসার জায়গা হবে তো। ওখানেই বসুক।’

আধ্রিকা সরু চোখে মিসবাহ্ যেদিকে বসেছে সেদিকে তাকায়। একটা ডাবল সোফায় বসেছে। একটু আগে লাবিবকে দেখল তার পাশে গড়াগড়ি করতে। এখন লাবিবকে দেখা যাচ্ছে না। হয়তো তাদের অনিকের সাথে খেলতে গেছে। আধ্রিকাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভদ্র মহিলা আবারও বললেন,
-‘কী মা! তোমার অসুবিধা আছে?’

আধ্রিকা মাথা নাড়ায়। অসুবিধা নেই। প্রথমত সে এই নিষ্পাপ, মায়াবী মুখের উপর না করতে পারছে না, দ্বিতীয়ত তার মিসবাহ্’র সাথে কথা আছে। তাই একান্ত প্রয়োজনেই সে মিসবাহ্’র পাশে গিয়ে বসল। মিসবাহ্ বাকি সবার থেকে একটু দূরেই বসা ছিল। জায়গাটাও ঠান্ডা, নীরব। আধ্রিকার কেন যেন মনে হচ্ছে সবাই আবারও তাকে আর মিসবাহ্’কে এক করতে চাইছে। নয়তো মা, ভাবী, খালামণি এরা এমন মুখ টিপে হাসল কেন যখন সে মিসবাহ্’র পাশে গিয়ে বসে!

তাহসান আধ্রিকাকে খাবার প্লেট আর কোল্ড ড্রিংক্স দিয়ে গেল। আধ্রিকা সেটা হাতে নিয়ে বসে আছে। খাচ্ছে না। মিসবাহ্ নিজের কোল্ড ড্রিংক্সে চুমুক দিচ্ছে। পাশে যে একটা মানুষ বসে আছে তার কোনো হেলদোলও নেই! আধ্রিকার ইগো হার্ট হলো মা’রা’ত্ম’ক ভাবে। কিন্তু সেটাও প্রকাশ করতে পারছে না। সে কথা গুছিয়ে নিচ্ছে। কি বলবে না বলবে, কি দিয়ে কথা শুরু করবে এসবই ভাবছে সে।

কিছু সময় পার হয়ে যাওয়ার পরেও আধ্রিকার মুখ ফুঁটে কথা বের হয় না। সে ভাবুচ হয়ে বসে থাকে। এমন সময় মিসবাহ্ হঠাৎ উঠে যেতে নিলেই আধ্রিকা আর কূল কিনারা না পেয়ে খপ করে মিসবাহ্’র হাতটা ধরে ফেলল। বাকিরা নিজেদের মধ্যে কথা বলার ব্যস্ত থাকায় ব্যাপারটা খেয়াল করেনি।

মিসবাহ্ ভ্রু কুঁচকে তাকালো আধ্রিকার দিকে। আধ্রিকা ফট করে হাতটা ছেঁড়ে দিয়ে আমতা আমতা করে বলল,

-‘আসলে কিছু কথা ছিল!’

মিসবাহ্ একবার ভালো করে আধ্রিকাকে পরখ করে নিয়ে আয়েশী ভঙ্গিতে বসল পুনরায়। আধ্রিকা কি করল কথা না বলে আগে কোল্ড ড্রিংক্স মুখে দিল। উফ! গলাটা এত শুকিয়ে আছে! এই একটু কথা বলেই তো না’জে’হা’ল অবস্থা হয়েছে। বাকিটা কী করে বলবে? সে একটু পাশে ফিরে মিসবাহ্’র মুখোমুখি বসার চেষ্টা করল। কিছুটা সক্ষমও হলো বটে।

-‘আপনার মা কি জানেন না?’

মিসবাহ্ বুঝতে পারল না। গম্ভীর স্বরে বলল,

-‘হোয়াট!’

-‘না মানে! আমি আপনাকে রিজেক্ট করেছি। তো!’

আর বলতে গিয়ে থেমে গেল আধ্রিকা। ইশ! এটা বলা একদমই উচিত হয়নি বোধ হয়। মিসবাহ্ কেমন করে তাকিয়ে আছে। সে আবারও কথা ঠিক করে বলতে চাইল,

-‘মানে আসলে আমি বলতে চাইছি, আপনার মা কি জানেন না বিয়ে ভাঙার আসল কারণটা?’

মিসবাহ্ আধ্রিকার দিক থেকে চোখ সরালো। আনমনে সামনে তাকিয়ে থেকে জবাব দিল,

-‘না।’

-‘কেন?’

-‘আমার করা অ’স’ভ্যতার জন্য বিয়েটা আপনি নাকোচ করেছেন। এটা নিশ্চয়ই খুব গর্বের নয় যে আমি আমার মাকে জানাবো।’

আধ্রিকা খানিকটা রা’গ দেখিয়ে বলল,
-‘তার মানে আপনি বলেননি তাকে?’

-‘বললাম তো না।’

-‘আজব! আপনি জানেন উনি আমার সাথে খুব সুন্দর ভাবে কথা বলেছেন।’

মিসবাহ্ আধ্রিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘এখন কি আপনি চাইছেন অসুন্দর ভাবে কথা বলুক?’

-‘না সেটা নয়। মানে উনি বোধ হয় আসলে আমার মনে হচ্ছে সবাই বোধ হয় পুনরায় চাইছে আমাদের বিয়েটা হোক!’

-‘তাহলে আপনি গিয়ে জানিয়ে দিন আমার মাকে। সে আর দ্বিতীয়বার এই কথা ভাববে না।’

আধ্রিকার মিসবাহ্’র এমন কাটকাট জবাবে রা’গ হয়। সে এভাবে কথা বলছে কেন?

-‘আমি জানাতে চাইছি না।’

-‘ভালো।’

মিসবাহ্ উঠে চলে গেল। আধ্রিকার হঠাৎই খুব কান্না পায়। কেন যেন ভালো লাগছে না। ক’ষ্ট হচ্ছে। কারণটা কী? নিশ্চয়ই ইগো হা’র্ট হয়েছে বলে এমন হচ্ছে। সে তো ছোট থেকেই উপেক্ষা, অবহেলা সইতে পারে না। হয়তো এই কারণেই এমন হচ্ছে। আধ্রিকার আর খেতে ইচ্ছা করল না। সে প্লেটটা রেখে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল। নিজের ভ্যানিটি ব্যাগটা নিয়ে সোজা বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। কেউ দেখল না। রাস্তায় এসে একটা রিকশা নিয়ে নিজের বাসার দিকে রওনা হলো। আর যেতে যেতেই হঠাৎ তার চোখের কোণে অশ্রু জমাট বাঁধল। খুব জলদি সে কেঁদে দিতে পারে!

#চলবে ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে