বাড়িওয়ালার ছেলে পর্ব-০৮

0
766

#বাড়িওয়ালার ছেলে
– ফাহিমা ফাইজা
#পর্ব ৮

এরকম আরও অনেক কথা চলতে থাকলো আমাদের মধ্যে। এর মধ্যে শায়লা এসে বলল ইউসুফ নাকি এক্সি’ডেন্ট করেছে। শায়লার কথা শুনে ভিতরে গিয়ে আমরা টিভি চালিয়ে দেখি সত্যিই ইউসুফ এর এক্সি’ডেন্ট ঘটেছে তখনই যখন আদনানের সাথে ওর মা’রামা’রি হয়েছিল। অর্থাৎ আমরা যখন চলে আসলাম তখন। আদনান খবর দেখে বলল,
– আমার মনে হয় ও বেশি উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিল। আর এজন্য ভালো করে গাড়ি চালাতে পারেনি।
শায়লা আমার কানে কানে বলল,“ তুই কি ওকে দেখতে যাবি?”
– জানি নারে। বুঝতে পারছি না কি করব। তুই কি বলিস?
– আমার তো মনে হয় দেখতে যাওয়া উচিত। আদনানকে না হয় জানানোর দরকার নেই।
– না না কি বলিস। ওর পারমিশন নিয়েই যাব।

এরপর আমি আদনানকে দেখতে যাওয়ার ব্যাপারটা বললে আদনান বলল,
– না দরকার নেই। এই অসময়ে ওর স্ত্রী আর বাচ্চাকে ওর পাশে থাকতে দাও। যাতে ও নিজের ভুলটা বুঝতে পারে।
আমার আদনানের কথাগুলো শুনে খুব ভালো লাগল। আসলেই এখন আমি গেলে ব্যাপারটা কেমন দেখাবে।

আজ সকালে ঢাকায় আব্বুর আসার কথা। আমি স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছি আব্বুর জন্য। আর মনে মনে ভাবছি কি বলব আব্বুকে। কিন্তু কিছুতেই কোনো কথা মেলাতে পারছি না। দেখলাম আব্বু যে ট্রেনের কথা বলেছিলেন সেটি দেখা যাচ্ছে। আমার হার্টবিট বাড়তে থাকল। অবশেষে ট্রেন এসে থামল। আমি আব্বুকে সালাম দিয়ে কেমন আছো জিজ্ঞেস করলাম। আব্বু ট্রেন থেকে নামতে নামতে বলল,
– তোর জন্য আর ভালো থাকি করে বল তুই।
আমি মাথা নিচু করে আব্বুর হাতের ব্যাগটা নিই। যেরকম ভেবেছিলাম আব্বুর চেহারা তার চেয়েও ভয়া’নক লাগছে। আমি স্টেশন থেকে সিএনজি পর্যন্ত আর কোনো কথা বললাম না। সিএনজি ঠিক করার সময় দেখলাম আদনান গাড়ি নিয়ে আসছে। আমার চোখ অজান্তেই বড় হয়ে গেল আর বুক আরও কাপতে শুরু করল। এই ছেলে আবার অঘটন ঘটাবে নাতো? যদিও তার প্রতি আমার বিশ্বাস অনেক। তবুও ভয় হতে লাগল। ভাবতে ভাবতে দেখি আদনান সাহেব কালো প্যান্ট আর ইন করা আকাশি রঙের শার্ট পরে আমাদের দিকেই আসছে। চোখে কালো চশমাও পরেছে। সব মিলিয়ে তাকে সকল মেয়েদের স্বপ্নের পুরুষের মত দেখাচ্ছিল। আমি যেন তার থেকে চোখই ফেরাতে পারছিলাম না। আব্বু তাকে খেয়াল করেননি। তিনি সিএনজির ভাড়া ঠিক করছিলেন। আদনান চশমা খুলে প্রথমে আমার দিকে তাকিয়ে চোখ মা’রল। কিছু বলতে চেয়েও বললাম না। আদনান আবারো চশমা পরে বলতে শুরু করল,
“ আসসালামু আলাইকুম আংকেল। কেমন আছেন? ”
আব্বু ভ্রু কুচকে সালামের জবাব দিলেন।
– ওয়ালাইকুমুস সালাম। তুমি কে?
– আংকেল আপনার মেয়ে যে বাসায় ভাড়া থাকে আমি সে বাসার মালিকের ছেলে।

আব্বু আদনানের পা থেকে মাথা অব্দি পর্যবেক্ষণ করলেন। আমি ভয়ে বারববার জিহবা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিচ্ছি। আব্বু ছোট নি:শ্বাস ফেলে বললেন,
– তা বাবা তোমাকে তো কোথায় যেন দেখেছি বলে মনে হচ্ছে!
আদনান পিছনে ফিরে একবার হেসে চশমা খুলে বলল,
– আংকেল এবার দেখেন তো চিনতে পারেন কিনা।
আব্বু এবার খানিকটা ধমকের স্বরে বলেন,
– আরে তুমি তো সেই ছেলেটা না? যে আমার মেয়ের সাথে ওই ছবিগুলোতে ছিল।

আমার আত্মা এবার কেপে উঠল। আমি আব্বুকে বললাম, “আব্বু সিএনজি কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে.. চল… যাই”

আদনান আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,“ আরে না না! আংকেল এত দূর থেকে এসে সিএনজিতে যাবে কেন? আংকেল আসেন আমার গাড়িতে উঠেন। ”
আব্বু রেগে বললেন, “ না! আমি তোমার গাড়িতে কেন যাব!”
– আংকেল দেখেন আমি জানি আমার উপর আপনার অনেক রাগ। আচ্ছা দাড়ান সিএনজিওয়ালাকে বিদায় করি। মামা আপনি চলে যান। দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না
আব্বু আবারো ধমকের স্বরে বলেন, “ আচ্ছা বেয়া’দব ছেলে তো তুমি! এমনিতেই আমার মেয়ের সাথে প্রে’ম করে আমার মান সম্মান ডুবিয়েছো। এখন আবার আমার সাথে মস্করা করছো!”
– না না আংকেল। আমি এককালে বেয়া’দব ছিলাম। বাট আপনার মেয়ের জন্য এখন ভদ্র হয়ে গেছি। সত্যি বলছি! বিশ্বাস না হলে আয়শাকে জিজ্ঞেস করুন।

আব্বু আদনানের দিকে অগ্নিচোখে তাকিয়ে আছে। আমি রীতিমতো ভয়ে কাপছি আর ঘেমে গিয়েছি। আমি আদনানকে ইশারা দিয়ে থামতে বললাম। আব্বু আমার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আদনান বলল,
– আংকেল, শোনেন, এখানে কথা বলতে আপনার কষ্ট হচ্ছে। এমনিতেই অনেক পথ জার্নি করেছেন। আপনার সাথে আমার অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। আপনি আমার সাথে আমার গাড়িতে উঠুন।
– আমার ইচ্ছা নেই তোমার সাথে কথা বলার। তুমি আমার মেয়ের পিছু ছেড়ে দেও।

আদনান এবার একটু গম্ভীর স্বরে বলল,“ আংকেল,আমি জানি প্রত্যেক বাবা মা তার মেয়েকে ভালো রাখতে চায়। তারা চায় তাদের মেয়ে সুখে থাকুক। কিন্তু তারা কখনো এটা ভাবে না যে তাদের মেয়ে কাকে ভালো’বাসে, কার সাথে সে সারাটা জীবন থাকতে চায়।কিন্তু আপনারা কি করেন সংসার যে করবে তার বিষয়টা না ভেবেই নিজের পছন্দমত ছেলের সাথে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেন। এতে করে ওই মেয়েটার আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয়ে যায়। আর ছেলেরাও সুযোগ পেয়ে সেই মেয়েকে অত্যাচার করতে থাকে। আর তখন আপনারা বুঝতে পারেন নিজের অন্যায়টা।

আদনানের কথা শুনে আব্বু ভ্রু কুচকে মাথা নিচু করে কিছু ভাবতে থাকে। এরপর আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, “ মা রে, তুই কি ওকে ভালো’বাসিস?”
আমি ঢোক গিলে বললাম,“ হ্যা..”
আদনান নরম গলায় বলল,“ আংকেল আমি চাইলে আপনার মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু আমি ভীতু কাপুরুষ নই যে এমনটা করব। আমি ওকে সম্মানের সাথে আমার ঘরের বউ করতে চাই, ওর পাশে সারাজীবন থাকতে চাই।

আব্বু কিছুক্ষণ ভেবে বললেন,“ ঠিকআছে, চল তাহলে। আগে তো বাসায় যাই,বিশ্রাম করি একটু, তারপর ভেবে দেখব। আর তোমার বাবা মা জানে এসব?”
– আমার মা নেই। বাবাকে বলেছি। তিনি বলেছেন আয়শার মত লক্ষ্মী মেয়ে তার বাড়ির বউ হলে তিনি খুব খুশি হবেন।

আব্বু অবশেষে আদনানের গাড়িতে উঠলেন। গাড়িতে বসে আব্বু আর আদনান নানা বিষয়ে গল্প করল। মাঝে মধ্যেতো আদনানের কথায় আব্বু অট্টহাসিতে ফে’টে পড়ল। আমি কিছুটা স্বস্তি অনুভব করলাম।
.

রাতে সোফায় বসে আমি আর আব্বু কথা বলছিলাম। দুজনেই অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলাম। আব্বু শুরু করলেন,
– মা, অনেক ভেবেচিন্তে দেখলাম বুঝলি?
– কি আব্বু?
– তোকে কখনো আমি কোনো কষ্ট পেতে দেইনি। তুই যা চেয়েছিস দিয়েছি।
– আব্বু তুমি কি আমার উপর রাগ করেছো?
– নাতো, রাগ করব কেন! রাগ তো তখন হয়েছিল যখন তোর ছবি দেখেছিলাম। তখন ছেলেটা আমার কাছে অপরিচিত ছিল। আমি জানতাম না যে ও কেমন। আর তাছাড়া সবাই এমনভাবে আমাদের নিয়ে সমা’লো’চনা করছিল; বলতে পারিস সব মিলিয়ে আমার অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে পড়েছিল। তুই কি আমার ব্যাবহারে কষ্ট পেয়েছিস মা?
আমি আব্বুর হাত ধরে বললাম,
– না আব্বু, কি বলছো এসব! আমি তোমার ব্যবহার এ কষ্ট পাইনি। একটুও না।
– আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। আমার উচিত সমাজ থেকে তোকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া।
– না,আব্বু। সন্তানের উপর সব মা বাবারই অধিকার আছে। তারা যা করে সন্তানের ভালোর জন্যই করে। তোমার কোনো দোষ নেই আব্বু।
– হুম, এজন্যই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কাল আদনানের বাবার সাথে কথা বলব।

আমি আব্বুর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বললাম,
– কি বললে,সত্যি আব্বু?
– হ্যা মা সত্যি।

আমি খুশিতে আব্বুকে জড়িয়ে ধরলাম। আর বললাম,
– আমি জানতাম, আমার আব্বু কখনো আমার ইচ্ছার বিরু’দ্ধে যাবে না! তোমাকে অনেক ভালো’বাসি আব্বু!
– আমিও তোকে অনেক ভালো’বাসি মা!

আমি রুমে গিয়ে আদনানকে ফোন করে খবর টা জানিয়ে দেই। আদনান বলল,
– দেখেছো, বলেছিলাম না! তোমার বাবাকে পটিয়ে ছাড়ব।
– সেটাই তো দেখলাম।
– হ্যা, তবে তোমার চেয়ে তোমার বাবা বেশি ভালো।
– কেন?
– তোমার বাবা আমাকে ২ ঘন্টায় চিনে ফেলে আমি কেমন, আর তুমি পুরো ২ বছর সময় নিলে।
আমি বললাম….
( চলবে…)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে