#বাড়িওয়ালার ছেলে
– ফাহিমা ফাইজা
#পর্ব ৭
ইউসুফ নিজেকে সামলে বলল,“ তোর এ প্রতিশোধ আমি নেবই আদনান! তুই আমাকে এখনো চিনিস নাই! ”
আদনানও জোরে চে’চিয়ে বলল,“ নিজের দিকে একবার তাকিয়ে দেখ আগে! তুই একসাথে সব হারিয়েছিস! তোর দিন শেষ। আর প্রতিশোধ? তোর মত রাস’কেল কি প্রতিশোধ নিবে? পারলে দেখিয়ে দিস!”
আদনান আরও কিছু বলত। কিন্তু আমার জোরা’জোরিতে অবশেষে ও থামল। আমি আদনানকে নিয়ে ওখান থেকে চলে আসতে গেলে ইউসুফ আমার হাত ধরে বসে। আর বলে,“ আয়শা তোমার থেকে দূরে যাওয়ার পর আমি আর আগের মত ভালো নেই। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না। তুমি যা বলবে আমি তাই করতে রাজি আছি..”
ইউসুফের কথা শেষ করার আগেই আদনান আমার হাত থেকে ওর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ওর গলা টি’পে ধরে। আর পাগলের মত চিৎকার করে বলে,“ কি! কি বললি তুই? তোর সাহস দেখে তো আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি! আমি তোকে মে’রে ফেলব! এখনি মে’রে ফেলব!”
আমি অনেক চেষ্টার পর আদনানকে থামাতে সক্ষম হই। কিন্তু আমি আর চুপ থাকতে পারি না। আদনানকে গাড়িতে বসিয়ে আমি ইউসুফকে বলি,
“ তোর মত নি’র্ল্লজ্জ বে’হায়া আমি আমার লাইফে দেখিনি! তুই আমাকে একবার ঠকি’য়েছিস,তোর স্ত্রীকে ঠকি’য়েছিস যে কিনা তোকে পাগলের মত ভালো’বাসে! তোর নিষ্পাপ বাচ্চাটার কথা তুই একবারও ভাবলি না? এখন আবার বলছিস তুই আমাকে ছাড়া থাকতে পারবি না? তুই আমার সামনে থেকে চলে যা! আর কখনো এই মুখ দেখাবি না!”
ইউসুফ জোরে হেসে দিয়ে বলল,“ আমি ভেবেছিলাম তুই আমাকে ভালো’বাসতি আয়শা। এখন তো দেখছি আমাকে ছেড়ে তুই অন্য ছেলে নিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছিস,মজা করছিস! এখন আবার বিয়েও করবি।”
– হ্যা করব, তুই বলার কে? তুই কি ভেবেছিস? আমি তোর জন্য,কেদে বুক ভাসাব! আর তুই চেয়ে চেয়ে তামাশা দেখবি? ওসব ভুলে যা! আর মানুষ হ! নিজের পরিবারকে সুখী রাখ। তাদেরতো তুই ধ্বং’স করে দিয়েছিস! ”
ইউসুফ আমার গাল চেপে ধরে বলতে শুরু করল,“ তুই আমাকে এভাবে রেখে কোথায় পালাবি? তোর শেষ আমি দেখে ছাড়ব! তোর সামনে খুব খারাপ দিন আসবে এই বলে রাখলাম!।”
আদনান এসব দেখে গাড়ি থেকে ক্ষি’প্রগতিতে নেমে এসে,ইউসুফকে ধাক্কা মে’রে সরিয়ে দেয়। আমি ভয়ে আদনানকে জড়িয়ে ধরি। আদনান ইউসুফকে বলে,
– তুই কি দেখবি! আমি তোর শেষ দেখে ছাড়ব। আর তোর এত সাহস তুই আয়শার গায়ে হাত দিস! তোর হাত আমি কে’টে দেব!
এতক্ষণ পরিস্থিতির চাপে খেয়ালই করিনি যে আশে পাশে অনেক ভিড় জমে গেছে। বেশির ভাগ মানুষই ফোন দিয়ে ভিডিও করছে। আমার শুরু অন্য টেনশন। এমনিতেই আমার আর আদনানের ছবি ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছে। এখন এই ভিডিও যদি ভাইরাল হয় তবে আমার মান সম্মান আর কিচ্ছু থাকবে না। যদিও এতক্ষণে মনে হয় তা ভাইরাল হয়ে গেছে। আমি দ্রুত আদনানকে নিয়ে গাড়িতে চলে আসি। আদনান এখনো স্থির হতে পারেনি। ও বারবার ইউসুফের কথা বলছিল যে ওর এত সাহস কি করে হয়,ও এখন এমন পাগলামি করছে কেন। আমি ওকে শান্ত হতে বলি। কারণ ও গাড়ি চালাচ্ছিল। তাই আমি অনেক করে বুঝাই যে রিলাক্সে গাড়ি না চালালে বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যাবে৷ আদনান রীতিমতো ঠান্ডা মাথার মানুষ। তাই ও কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বাভাবিক হয়ে গেল। আমিও ওকে দেখে কিছুটা স্বস্তি অনুভব করলাম। কিন্তু ভিডিওর ব্যপারটা নিয়ে চিন্তা কমল না। আবার ইউসুফ এর দেওয়া হুমকিও মাথায় ঘুরতে থাকল। কি করব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আদনানকে এই মুহূর্তে কিছু বললাম না। গাড়িতে যতক্ষণ ছিলাম দুজনই চুপ ছিলাম। বাসায় আসার পর আমি যখন গাড়ি থেকে নামি একবার পিছনে তাকিয়ে আদনানের মলিন মুখটা দেখি। বাসার গেট পর্যন্ত এসে আবারও ওর কাছে ফিরে যাই এবং ওর মলিন মুখে চু’মু খাই। আদনান আমার দিকে তাকিয়ে স্বস্তির হাসি দেয়। আর বলে,
– কি হলো আয়শা?
আমি ক্লান্ত স্বরে বললাম,
– তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারব না!
– তুমি? তুমি করে বললে?
– হুম বললাম!
আদনান জোরে হেসে দিয়ে বলল,
– ঠিকয়াছে আজ তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না। আজ দুজনে মিলে আকাশের ওই পূর্ণিমার চাঁদ দেখব।
আমি খুশিতে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। আদনান আমার এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে দিল।
.
বাসায় ফিরেছিলাম ৪ টার পরে। খাওয়া দাওয়া করে আমি আর আদনান সন্ধ্যায় ছাদে গেলাম। শায়লা টিউশনি করাতে গেছে আর রাফা আর এশা তো সেই অনেক রাতে আসবে। আমার ছাত্র আজ বেড়াতে গিয়েছে। এজন্য আমি যাইনি। আজ সত্যিই পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। আদনানকে বললাম,
– আজকাল চাঁদের খুব খবর রাখো বুঝি?
– হ্যা চাঁদ তো এখন শুধু আমার!
– তাই নাকি? চাঁদকে আমার হিংসা হচ্ছে!
– কেন?
– আমার থেকে ওকে বেশি পছন্দ তোমার তাই না!
আদনান হেসে বলল, “ নাতো কে বলেছে?”
আমি একটু হেসে ভিডিওর কথাটা ওকে বললাম।
– আদনান আমার খুব ভয় হচ্ছে। ভিডিও তো অনেকেই ফেসবুকে পোস্ট করেছে। একেকজন একেক ক্যাপশন দিয়েছে। কেউ লিখেছে এক প্রেমিকার জন্য দুই প্রেমিকের মা’রা’মা’রি। কেউ লিখেছে…
– আরে ধুর বাদ দাও। একবার তো ভাই’রাল হয়েছি। আবার নতুন করে হওয়ার কি আছে। ইদানীং তো আমার ফেসবুকে ফলোয়ার বেড়েই যাচ্ছে।
– আমারো। ইনবক্সেও অবস্থা খারাপ। কোনো সলিউশন কি নেই?
– আছে থাকবে না কেন। তবে আমার মনে হয় এগুলো নিয়ে বাড়াবাড়ি না করাই ভালো। কারণ ফেসবুকে একটা জিনিস অনেকদিন থাকে না। এখানে সবকিছু চেঞ্জ হয়। কয়দিন পরে দেখবে আমাদের এসব ছবি,ভিডিও আর খুজেই পাওয়া যাবে না। বুঝলে?
– হুম, বুঝলাম।
আমি আদনানের কাধে মাথা রেখে বললাম,
– আদনান, তোমার মায়ের কথা তো কখনো বলনি। আজ বলো আমি শুনি।
আমার কথা শুনে আদনান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
– হঠাৎ তার কথা জিজ্ঞেস করলে?
– না এমনিই। তুমি রাগ করলে?
– না, আমি এমনিতেও বলতে চেয়েছিলাম
– তাহলে বল।
– আমার মা একজন সাধারণ ঘরের মেয়ে ছিলেন। বাবা তাকে পছন্দ করে বিয়ে করেছিলেন। এমনকি আমার বাবার পরিবারও তাকে মেনে নিয়েছিল।
আদনান ফোন থেকে ওর মায়ের ছবি দেখালো। দেখে বুঝলাম আদনান ওর বাবার মত হয়েছে। ওর মায়ের চেহারা খুব বেশি সুন্দর না,তবে মায়াবী। চোখ দুটো খুবই সুন্দর। আমি আদনানকে বললাম,
– তোমার মায়ের চোখ অনেক সুন্দর!
– হ্যা,আমার বাবা আদ’র করে তাকে সুনয়না বলতেন।
– আদনান, তোমার মায়ের কি হয়েছিল?
– ব্লা’ড ক্যা’ন্সার।
– উনি চিকিৎসা করাননি?
– করিয়েছিলেন কিন্তু তখন আর কিছু করার ছিল না।
– মানে?
– আমি যখন ক্লাস এইটে পড়ি তখন আমার বাবার ব্যাবসায় বিরাট লস হয়। তখন বাবা হতাশ হয়ে নেশা করা শুরু করেন। এমনকি মাকে মারধরও করতেন। এজন্য ধীরে ধীরে আমার বাবার প্রতি ঘৃণা চলে আসতে শুরু করে। আমার মা সবসময় আমার বাবার পাশে ছিলেন। বলতে পারো সম্পত্তির বেশির ভাগই আমার মায়ের অবদান। কিন্তু…
আদনান এক বুক নি:শ্বাস নিয়ে আবার শুরু করল,
– কিন্তু এক পর্যায়ে মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি বাবাকে কিছুই জানাননি। আমি বারবার বলেছিলাম বাবাকে জানাও। কিন্তু মা বলতেন তোর বাবা এমনিতেই বিজনেসে লস করেছে। তার উপর তোর লেখাপড়ার খরচ। আমার চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা লাগবে। তোর বাবা এত পারবে না। কিন্তু মা যখন তীব্রভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেন তখন বাবা জানতে পেরে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করেন আর আমরা জানতে পারি মায়ের ব্লা’ড ক্যা’ন্সার হয়েছে
আদনান আর কথা বলতে পারে না। ওর চোখ দিয়ে পানি পড়ে। ও আটকানোর চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। আমি খেয়াল করি আমারও চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। আদনান হঠাৎই আমাকে জড়িয়ে ধরে জোরে কান্না করতে শুরু করে। আর বলে,
– আয়শা তুমি আমাকে কথা দাও, তুমি অনেক ভালো ডাক্তার হবে। আর তোমার কোনো রোগীকে এভাবে ছেড়ে চলে যেতে দেবে না!
আমি কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বলি,“ আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব আদনান। তোমার কথা রাখবই।”
আদনান ফুপিয়ে ফুপিয়ে বলে,“ আমার মায়ের খুব ইচ্ছা ছিল আমাকে ডাক্তার বানানোর। কিন্তু আমি পারিনি। আমি ব্যার্থ। কি করব বল, মা চলে যাওয়ার পর আমার কি যে হলো আমি বুঝতে পারি না৷ বাবার প্রতিও আমার ভুল ধারণা জন্মে গিয়েছিল। তাকে সহ্যই করতে পারতাম না। কিন্তু আমি ধীরে ধীরে বুঝতে পারি যে আমার বাবার আসলে কোনো দোষ নেই। তিনি তো চাইলে আরেকটা বিয়েও করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। কারণ তিনি আমার মাকে ভালো’বাসতেন আর আমাকেও।
– তোমার বাবা তোমাকে অনেক ভালো’বাসেন। আমি সবসময় ওনাকে চিন্তিত দেখি শুধু তোমার জন্য।
– এজন্যই তো আমি বদলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।
আদনান স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল আর বলল,
– জানো যেদিন সেলুন থেকে চুল গুলো ছোট করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বাবার অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলাম তখন বাবা যে কয়বার চি’মটি কাট’লেন। খুব হাসি পেয়েছিল আবার রাগও লাগছিল।
আমি মুচকি হেসে বললাম, ” তুমি সবসময় তোমার বাবার কথা শুনবে। তাকে কষ্ট দিবে না।”
– ইনশাআল্লাহ।
এরকম আরও অনেক কথা চলতে থাকলো আমাদের মধ্যে। এর মধ্যে শায়লা এসে বলল ইউসুফ নাকি এক্সি’ডেন্ট করেছে…
(চলবে…)