#বাড়িওয়ালার ছেলে
– ফাহিমা ফাইজা
# পর্ব ৪
আদনান একবার আমার দিকে তাকিয়ে কেবিন থেকে বের হয়ে গেল। আমি ওকে ডাক দিয়ে বললাম,
– কোথায় যাচ্ছেন?
– বাড়ি যাচ্ছি।
– আমাকে রেখে?
আদনান মুচকি হেসে বলল,
– আমি আবার আসব।
আমিও ওর দিকে তাকিয়ে হাসলাম। এরপর বললাম,
“ আপনি আবার আমার আব্বু আম্মুকে ইউসুফের কথা বলে দিয়েন না! উনারা এমনিতেই অসুস্থ।”
আদনান আমার কাছে এসে বলল,“ তারা যে অসুস্থ তারা তোমাকে নিয়ে এত টেনশন করে তাহলে তুমি এমন করলে কেন?”
– কি করেছি?
– কি করনি। বিবাহিত ছেলের সাথে প্রে’ম করেছো, তার উপর এখন এক্সি’ডেন্ট করে বসে আছো। তোমার মা বাবা কত ভরসা করে তোমায় ঢাকায় পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছেন।
আদনানের এমন কণ্ঠ আমি আগে কখনো শুনিনি। ওর কথায় আমি আরও বেশি অনুতপ্ত হতে লাগলাম।
আমি কিছু বলতে চেয়েও আর বললাম না। দেখি আব্বু আম্মু আমার কেবিনে পাগ’লের মত প্রবেশ করছেন। সম্ভবত তারা ডাক্তারের সাথে কথা বলতে গিয়েছিলেন। আম্মু আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকা’টি করতে লাগলেন। আর আব্বু আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছিলেন। এরপর দুজনই আমাকে ব’কাবকি করতে লাগলেন। তাদের ব’কা শুনতেও শান্তি পাচ্ছিলাম।
দু সপ্তাহ পর বাসায় ফিরলাম। আব্বু আম্মু আমাকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু আমি যাইনি কারণ অনেক পড়া জমে গিয়েছে। আর অনেক দিন কলেজে যাওয়া হয়নি যেখানে একদিন কামাই করলে অনেক নোট বাদ পড়ে যায়। আর তার সাথে টিউশনিতেও কামাই গেছে। ছাত্রদের আবার সামনে পরীক্ষা। অনেক কষ্টে আব্বু আম্মুকে বুঝালাম। আব্বু বুঝলেও আম্মু বার বার ব’কা ঝকা করলেন। আমাকে ছাড়া বাড়িতে যেতেই চাইলেন না। আসলে আমরা মধ্যবিত্ত পরিবার, আমাকে নিয়ে আব্বু আম্মুর অনেক স্বপ্ন। তার সাথে অনেক দুশ্চিন্তাও করেন। হঠাৎ আদনানের কথা মনে পড়ল। এ কদিনে তার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। এমনকি সেও আর আসেনি। তাই অজান্তেই হালকা অভিমান হতে লাগল। তার বলা কথাও মনে হতে লাগল। বলেছিল আব্বু আম্মু আমার প্রতি কত ভরসা করে,কিন্তু আমি হয়ত সে ভরসার যোগ্য না।
তো অনেক কষ্টে আম্মুকে বোঝানোর পর তারা বাড়ি চলে যায়। আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল তাদের বিদায় জানাতে। বললাম, যেদিন ডাক্টার হয়ে যাব সেদিন তোমাদের কাছেই থাকব, আর কোথাও যাব না।
আম্মু চোখ মুছতে মুছতে বলল,“ ওরে বোকা মেয়ে, মেয়েরা কি সারাজীবন মায়ের কাছে থাকতে পারে? ”
তখন আমি বুঝতে পারলাম আম্মু কিসের কথা বলছে। আসলে ডাক্তার হোক বা ইঞ্জিনিয়ার হোক মেয়েদের তো ডেস্টিনেশন তার স্বামির বাড়ি।
.
আব্বু আম্মু যাওয়ার পর থেকে মন অনেক খারাপ ছিল। তবে নিশ্চিন্ত ছিলাম যে তারা ইউসুফ সম্পর্কে কিছু জানতে পারেনি। শায়লা আমার মন খারাপ দেখে বলল, “ চল আজ তাহলে ভিন্ন কোনো রেসিপি রান্না করি। মনও ভালো থাকবে, মজাও হবে”
–ভালো বুদ্ধি দিয়েছিস। আচ্ছা চল। কিন্তু কি রান্না করবি?
– পিজ্জা বানাবি? সেদিন আদনান ভাইয়ের পিজ্জাটা জোস ছিল।
– ওহ ভালো কথা, আদনানের খবর কি?
শায়লা চোখ বড় করে আমার দিকে হেসে বলল,
– কি ব্যাপার? তুই তার কথা জিজ্ঞেস করছিস যে?
– কেন জিজ্ঞেস করলে কি সমস্যা?
– না মানে তুই তো তার কথা সহ্যই করতে পারতি না আগে।
– আসলে..কি যে বলব.. এখন…
– হয়েছে, বুঝেছি। ওহ তোকে তো বলাই হয়নি।
– কি?
– তুই যে এক্স’ডেন্ট টা করলি একবারও জানতে চাইলি না কে তোকে হাসপাতালে নিল?
– আদনান নিয়েছে?
– হুম, তুই যেখানে গিয়েছিলি সেখানে ও একটা কাজে গিয়েছিল। তারপর ওই তোকে নিয়ে আসে।
– ওহ আচ্ছা।
– আরেকটা কথাও তুই জানিস না।
– কি?
– তোর র’ক্তের প্রয়োজন ছিল। আর সেই র’ক্তও আদনান দিয়েছে।
– কি বলছিস? সত্যি?
– হুম। সত্যি।
আমার আদনানের প্রতি দিন দিন এক অজানা অনুভূতি কাজ করছিল। মনে হলো আজ সেই সুপ্ত অনুভূতি ধীরে ধীরে জাগ্রত হচ্ছে। কিন্তু মানুষ কি দ্বিতীয়বার ভালো’বাসতে পারে?
পিজ্জা বানানো শেষে সবাই ঘুমাতে চলে গেলাম। পিজ্জা খেয়ে পেট ভরে গিয়েছিল। তাই আর ভাত খাওয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি। শায়লাকে দেখে মনে হচ্ছিলো ও ঘুমিয়ে গেছে। তবুও জিজ্ঞেস করলাম,
– আচ্ছা শায়লা,মানুষ কি দ্বিতীয়বার ভালো’বাসতে পারে?
– পারে। কেন পারবে না। প্রথম ভালো’বাসা নয়, শেষ ভালোব’াসাই সব। যে তোর হাতটা ধরে সারাজীবন পাশে থাকবে। আর যে বেঈ’মান সেতো বেঈ’মানই, তার জন্য তুই তোর জীবন কেন থামিয়ে রাখবি। তোর ক্ষ’ত বিক্ষ’ত হৃদয় টাকে যে ভালোব’াসা দিয়ে আবার আগের মত করে দেবে সেই তো আসল প্রে’মিক।
ভেবেছিলাম ও ঘুমিয়ে গেছে। কিন্তু ওর উত্তর শুনে আমি অবাক। একটা মানুষের চিন্তা ভাবনা কত সুন্দর। আমি শুধু শায়লাকে একটাই কথা বললাম,
“ তুই আমার জীবনের সবচেয়ে ভালো বন্ধুরে।নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে।”
শায়লা হেসে বলল,“ চেষ্টা করব আজীবন পাশে থাকার।”
কিছুক্ষণ পর শায়লা ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু আমি আর ঘুমাই না। ঘুম আসে না। ঠিক করলাম আদনানকে একটা ফোন দিব। যেই ভাবা সেই কাজ। ফোন দেওয়ার সাথে সাথে ভদ্র ছেলের মত আদনান সালাম দিল। ভেবেছিলাম ও ফোনই ধরবে না।
“ আসসালামু আলাইকুম মিস আয়শা।”
– ওয়ালাইকুমুস সালাম, আদনান সাহেব! আমার কথা কি এখন আর মনে পড়ে না?
– পড়ে তো,কিন্তু কাছে যাওয়ার সাহস পাই না।
– মানে, এর আগে তো কত বেহা’য়ার মত পিছে পিছে ঘুরেছেন।এখন কি হলো?
– জানি না,
– কেন জানেন না?
– আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
– কি সিদ্ধান্ত?
– আমি আমার বাবার বিজনেসে জয়েন করব।
– সিরিয়াসলি?
– হুম, এরকম শিক্ষিত বেকার হয়ে বসে থাকব কেন?
– আচ্ছা, আজ আকাশে কোন দিকে চাঁদ উঠল বলুন তো?
– চাঁদকে নিয়ে ভেবে কি হবে? চাঁদ তো কখনো আমার হবে না।
– চাঁদ আপনার হবে না মানে?
– এই যে আমার ফোনের ওই পাশে যে চাঁদ টা রয়েছে।
– যদি হয়?
– কিভাবে?
– কিভাবে আবার কি? বুঝেন না?
– না বুঝি না, বুঝিয়ে বল।
– আচ্ছা বাদ দেন।
– আয়শা, তোমার এই কাজটা আমার মোটেও পছন্দ না।
– কি কাজ?
– তুমি সবসময় আমার কথার উত্তর শেষ না করে চলে যাও।
– শেষ করব না,কি করবেন?
– কি করব তুমি বল।
– আরও এক গুচ্ছ গোলাপ হলে কেমন হয়?
– খুব ভালো হয়। আর?
– আর কিছু না। আচ্ছা আপনার কি ফুল পছন্দ?
– নীল অপরাজিতা।
– কেন?
– – কারণ এই ফুলে আমি আমার মাকে খুঁজে পাই।
– আচ্ছা,কেন?
– আমার মায়েরও এই ফুল পছন্দ ছিল তাই।
মনে হলো একবার জিজ্ঞেস করি তার মায়ের কি হয়েছিল। কিন্তু সাহস পেলাম না। তাই এ প্রসঙ্গ বাদ দিতে বললাম,
– জানেন আমি ভেবেছিলাম হয়ত আমি একাই জেগে আছি,এখন দেখি আপনিও জেগে আছেন।
– হ্যা, এই ঘুমন্ত শহরে দুটি হৃদয় জাগ্রত…
– আপনি খুব সুন্দর কথা বলেন।
– তাই নাকি, জানতাম না? বেস্ট কম্পলিমেন্ট!
– কেন?
– তুমি এর আগে কখনো আমার প্রসংসা কর নি।
আমি জোরে হেসে উঠলাম। আর ফোন রেখে দিতাম চাইলাম। সে বলল,
– এখনি ঘুমাবে?
– জানিনা, ঘুম তো আসছে না।
– তাহলে ফোন কে’টে কি করবে?
– পড়াশোনা করব ভাবছি। অনেকদিন কামাই করেছি।
– আচ্ছা তুমি আমার একটা কথা রাখবে?
– কি কথা?
আদনান অনেক পরে উত্তর দিল। সে আমার কাছে আবদার করল….
(চলবে..)