#বাঁধিব_তোমায়_বিরহ_ডোরে
#পর্ব_০৭
#রিয়া_জান্নাত
যতবার ইনিয়ার ডায়েরিটা পড়ে,ততবারই চোখে ভিজে জুনায়েদের। ডায়েরিতে এতো যন্ত্রণার কথা লেখা থাকতে পারে জুনায়েদের ভাবনার বাইরে ছিলো। একটা মেয়ে এতো কষ্ট সহ্য করতে পারে, ইনিয়ার ডায়েরি না পড়লে জুনায়েদ জানতেই পারতো না। পৃথিবীতে কত রকমের মানুষ, তাদের মধ্যে কত ধরনের চাপা কষ্ট লুকিয়ে আছে। তা শুধু মাত্র সেই জানে। ইনিয়াকে মিস করছে খুব জুনায়েদ। তাই ইনিয়ার ডায়েরি পড়ে ভাবনার জগতে বিলীন হলো। ডায়েরিতে ইনিয়া তার আম্মুকে যেই কথাগুলো লিখেছিলো সেই কথাগুলোর কিছু অংশ পড়লো।
আমার মা,
তুমি নিশ্চিত পরপারে ভালো আছো? আমি তোমার জন্য দোআ করি মা আল্লাহ তালা তোমাকে জান্নাতের মেহমান হিসাবে কবুল করুক। মা ছয় বছর বয়সে, তুমি আমাকে পৃথিবীতে একা করে চলে গিয়েছো। তখন পৃথিবীর নির্মম নিয়মগুলোর সঙ্গে পরিচয় হয়নি। বুঝতাম কেবল ভালোবাসা খেলাধূলা, তোমার আদর, বকা, শাসন পৃথিবীতে সব। কিন্তু মা তুমি যেদিন মারা গিয়েছো তার পরেরদিন আমার জীবনে কাল নেমে আসলো। বাবা চল্লিশদিন কি? তোমার মৃত্যুর তিনদিন পার না করেই নিয়ে আসলো আরেক মা। আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম জানো, যখন দেখলাম ওই আন্টি মানে বাবার পিয়ে লিমা আন্টিকে আম্মু বলে পরিচয় করে দিলো। জানো মা, সেইদিন আরও কঠিন সত্যির মুখোমুখি হয়েছিলাম। যখন বাবা নিমুকে দেখিয়ে দিয়ে বললো এটা তোমার ছোট বোন নিমু। বয়স তখন তিন বছর হবে নিমুর। অবুঝ বয়স বুঝতাম না কিছুই আমিও তাকে মা হিসাবে আপন করে নেই। আর নিমুকে খেলার সঙ্গী বানিয়ে ফেলি। বেশ খুশিই ছিলাম। কিন্তু দিন যত অতিবাহিত হয় ইনিয়ার কপাল দুভোর্গ নেমে যায়। সৎ মা লিমা রহমান আমাকে মারধর করতো খুব। কথাগুলো বাবাকে বলেছিলাম বাবা লিমাকে বকা দিছে। কিন্তু এর বিনিময়ে পরেরদিন বাবা অফিস গেলে আমার উপর ক্ষোভ প্রকাশ করতো লিমা রহমান। যতই বাবাকে বলি, তারপরেরদিন কষ্ট ততই দ্বিগুণ হতো। বাবা শুধু লিমাকে বকাই দিত কিছু বলতো না। এরপরে থেকে বাবাকে সব বলা বন্ধ করে দিছি। জানো মা কতরাত একা একা কেঁদে বালিশ ভিজিয়েছি কিন্তু আমার খোঁজ বাবা নিতেও আসতো না। ভাত দিত না লিমা রহমান। সারাদিন সংসারে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের বিনিময়ে রাতের বেলা পোড়া ভাত খেতে দিত আমাকে। বাড়িতে কত ভালো ভালো রান্না হতো কিন্তু আমার ভাতে শুধু ডাল, শাক সবজি থাকতো। বয়স যত বাড়লো কষ্ট ততই বাড়তে থাকে। একদিন নিমুর জামা আয়রন করে পুড়িয়ে ফেলায় নিমু আমাকে বেলেন্ডার মেশিন দিয়ে হাত পুড়িয়ে দেয়। এই যন্ত্রণার দাগ পোড়া হয়ে আছে। লিমা রহমান দিতো না ভালো ভালো কাপড় চোপড়, আমার জন্য যদি বাবা কাপড় আনতো সেই কাপড় পরেরদিন নিমু কেড়ে নিত। আমি পড়ে থাকতাম ছেঁড়া ময়লা কাপড়গুলি। এভাবে দিন পার হতো আমার তোমাকে ছাড়া। কিন্তু একদিন লিমা রহমানকে শুনতে বলি তোমার খু’নি এই মহিলা। এই মহিলা তোমার সংসার নিজের দখলে করার জন্য বাবাকে দিয়ে যে খাবার পাঠাতো সেই খাবারে নাকি বি’ষ থাকতো। একটু একটু করে বি’ষ প্রয়োগে মেরেছিলো তোমাকে। অথচ আমি জানতাম তোমার হার্ট ফেলুয়ার হয়ে মারা গিয়েছো। জানিনা তুমি মরার আগে জেনেছিলা কিনা? তোমার স্বামী আমার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছে অন্যত্র তোমাকে বিয়ের দুই বছর পরে। আমি যখন তোমার কোলজুড়ে আলো করে আসলাম তা দেখেও বাবা কিভাবে পারলো দ্বিতীয় সংসার গড়তে। এই দ্বিতীয় সংসারের জন্য আজ আমি এতো দুঃখী। থাক মা অনেক কথা বলে ফেললাম। আমার জন্য দোআ করবে খুব দ্রুত যেনো তোমার সঙ্গে মিট করতে পারি।
ইতি তোমার মেয়ে
ইনিয়া
জুনায়েদের চোখের পানি গালবেয়ে পড়ছে। জুনায়েদ মনে মনে বলে তোমার মায়ের হত্যার প্রতিশোধ নিব আমি। তুমিতো পারবেনা, এরপরে পাতা উল্টাতে উল্টাতে ইনিয়ার সুখের চিঠিখানা দেখলো।
প্রিয় পৃথিবী
বুঝ হওয়ার বয়সে আম্মুকে কেড়ে নিয়েছেন। জীবনে অনেক বছর অপমান লাঞ্ছিত হয়েছি। আমি সিন্ডারেলার গল্প পড়েছি কিন্তু নিজেকে কখনো সিন্ডারেলা ভাবিনি। সত্যিই আমার মতো কুৎসিত মেয়েকে যে কারো ভালো লাগতে পারে ভাবিনি। আমার মন বলছে সেই পুরুষ আমাকে সিন্ডারেলার মতো নতুন জীবন দিবে। কখনো ভাবতে পারেনি নিমুর মতো সুন্দর মেয়েকে রেখে আমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিতে পারে সে। জানি আজকে সৎবোন আর লিমার অনেক মার খাবো। কিন্তু এই মার খাওয়ার মধ্যেই শান্তি পাবো। স্বপ্ন দেখিয়েছে সেই পুরুষ সে নাকি আমাকে বিয়ে করবে। আচ্ছা এটা কি সত্যি, সত্যিই কি তিনি আমাকে নতুন জীবন দিবে? চরম কৃতজ্ঞ থাকবে সেই পুরুষের উপর। আল্লাহ হাফেজ।
ইতি কষ্টের শেষ চিঠি।
এই চিঠিখানা পড়েই জুনায়েদের মনে পড়ে গেলো ইনিয়ার সঙ্গে প্রথম মিটের কথা।
চা নিয়ে এসেছে এক মেয়ে। চা গুলি টি টেবিলে রাখলো। এরপরে পান এনে রাখলো। আমি তাকে বেশ ভালোভাবে লক্ষ্য করলাম। শ্যামবরণ একটি মেয়ে রুপচর্চা না করাতেই শরীরে রঙ এভাবে ছিপকে গেছে। বামগালে একটি বড় তিল। চুলগুলো কোকরানো। হয়তো ভালোভাবে যত্ন করে না নিজের। পরনে একটি মলিন কাপড়। আমি জিজ্ঞেস করলাম আপনি এই বাড়িতে কি কাজ করেন?
“ মেয়েটি ইষৎ হেসে উত্তর করলো, এটা আমার বাড়ি ভালোবেসে কাজ করি টুকটাক। আমি এই বাড়ির বড় মেয়ে। ”
ইনিয়ার কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারলাম না। এই বাড়ির মেয়ে অথচ নিমুর মতো পরিপাটি নয় ক্যান? ব্যবসায়িক সূত্রে নিমুর বাবার সঙ্গে পরিচয়। আস্তে আস্তে বিয়ে অব্দি চলে আছে। কিন্তু এই বাড়িতে বেশ কয়েকবার আসলেও এই মেয়েকে কখনো দেখতে পায়নি আগে।
পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, সেই হৃদয়হরণ করা হাসি আসলেই এই বাড়ির বড় মেয়ে আফজাল রহমানের প্রথম স্ত্রীর মেয়ে ইনিয়া রহমান। তার মুগ্ধ করা হাসি আমার হৃদয় কেঁড়ে নিয়েছিলো। আফজাল রহমানকে প্রস্তাব করে বসি। আমি আপনার ছোট মেয়েকে নয় বড় মেয়েকে বিয়ে করতে চাই। আফজাল সাহেব আমার প্রস্তাব বেশ ভালোভাবেই নেয়। তিনি খুশির ঠ্যালায় কেঁদে ফেলে। জড়িয়ে ধরে আমাকে।
খুব ধুমধামের সহিত আমাদের বিয়ে দেন আফজাল রহমান। আফজাল রহমান ইনিয়াকে আমার হাতে তুলে দিয়ে বলে, বাবা হিসাবে আমি ব্যর্থ। আমার মেয়েকে যত্ন করে মানুষ করতে পারেনি। সবদেখেও না দেখার ভান করে ছিলাম। এইবার এই ইতিম মেয়ের সম্পূর্ণ দায়িত্ব তোমার হাতে তুলে দিলাম। ব্যাচ তক্ষুনি অপমান করে বসে লিমা রহমান তিনি বলে ছোটলোকের সবসময় ছোট নজর থাকবে স্বাভাবিক। তিনি এসব বলেছিলেন কারণ নিমুকে রিজেক্ট করে ইনিয়াকে বিয়ে করেছিলাম বলে। এরপরে থেকে নিমুকে স্বাভাবিকলি নিয়ে নেই আমি ও ইনিয়া। কিন্তু বিয়ের তিনবছর হলেও লিমা রহমান যখনি আসে তখনি অপমান করতে আসতো। আর হুমকি দিয়ে যেতো ইনিয়াকে। কিন্তু ইনিয়া সাদাসিধা মেয়ে এতোকিছু জানার পরেও কোনো প্রতিবাদ করতো না এই খু’নি মহিলার ব্যবহারে আড়ালে চোখের পানি ফেলতো।
জুনায়েদ ডায়েরিটা বন্ধ করে ফেলে। বীরবীর করে বলে ভাগ্যিস তোমার লুকিয়ে রাখা ডায়েরি টা পেয়েছিলাম তাইতো এতকিছু জানতে পারছি। আমি তোমাকে ওই অভিশপ্ত জীবন থেকে নতুন জীবন দিয়েছিলাম। আর আমিই তোমার জীবনের সব কাটা উপড়ে ফেলবো ইনিয়া। তুমি ভাবছো জুনায়েদ খুবই পঁচা লোক? ভাবো ইনিয়া আমি যে তোমার চোখে খুবই খারাপ হতে চাই। এই খারাপ হওয়ার পিছনের কারণটা নাহয় পড়েই জানলে। কিন্তু অভিমান না করে প্লিজ চলে আসো! আমায় কি আমার বাবুকে কোলে দিয়ে বলবেনা এই নাও তোমার ভালোবাসার চিহ্ন। কথাগুলো মনেমনে ভাবতেই জুনায়েদের চোখজোড়া আবার ভিজে যায়। এমন সময় নিমু রুমে আসে। নিমুকে দেখে জুনায়েদ ইনিয়ার ডায়েরিখানা তড়িঘড়ি করে লুকিয়ে ফেলে। রুমাল দিয়ে চোখমুখ মুছে।
“ এই নাও তোমার সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট আয়রন করে আনছি ”
“ ঠিকঠাক মতো ভাজ ফেলতে পারছিস তো? ”
“ জ্বি, তুমিই নাহয় দেখে নাও? ”
জুনায়েদ ভাজ খুলে দেখতে পারে সাদা শার্টের পিঠ বরাবর মাঝ অংশ পুড়িয়ে ফেলছে। জুনায়েদের প্রচন্ড রাগ উঠে। কারণ এই শার্টটা ইনিয়া তার জমানো টাকা দিয়ে ঈদে গিফট করেছিলো। জুনায়েদের মনে পড়লো নিমুর অতীত ইনিয়ার সঙ্গে কি করেছিলো। জুনায়েদ রাগে গিজগিজ করে টেবিল থেকে বেলেন্ডার মেশিন সুইচ অন করে নিমুর হাতে লাগিয়ে দেয়। নিমু চিৎকার করে উঠে
“ কি করছো? আমার হাত যে পুড়ে গেলো! এমন শার্ট আমি কিনে দিতাম। আমি জেনেশুনে পুড়ছি? ”
“ এটা আমার বিশেষ মানুষের দেওয়া উপহার। এরমূল্য টাকা দিয়ে হয়না নিমু। কেমন লাগছে তোর? ”
” জ্বলছে খুব। ”
“ মনে পড়ে অতীতের কর্মকান্ড রিভেঞ্জ নিলাম। যা হাতে বরফ লাগিয়ে নে? ”
নিমু হাত দিয়ে দ্রুত লিমা রহমানের কাছে যায়। নিমু কেঁদে কেঁদে বলে আম্মু আমার হাত জ্বলছে। তোমাদের জামাই আয়রন মেশিন আমার হাত পুড়িয়ে দিছে। এই কথা শোনামাত্রই লিমার মাথায় বাজ পড়ে।
“ এতবড় সাহস ওর আমার মেয়ের হাত পুড়িয়ে দেয়। আজ ওর একদিন কি আমার একদিন? ”
#চলবে