#বাঁধিব_তোমায়_বিরহে_ডোরে
#রিয়া_জান্নাত
#পর্ব_১০
হঠাৎ ঝড় বৃষ্টি শুরু হলো। চৈত্র মাসে কাঠফাটা রোদ, এতদিন মাটি খা খা করছিলো। হঠাৎ বৃষ্টিতে মাটিগুলো তার প্রাণ ফিরে পেলো। পাতাশূন্য গাছগাছালি গুলো বৃষ্টির ফোঁটা পেয়ে কচি ডগা গুলো মেলে উঠলো। ইনিয়ার দুচোখে বিষাদ নেমে এলো। ফ্লোরে বসে হামাগুড়ি দিতে লাগলো। কারণ তার পায়ের শক্তি একদম নুইয়ে গেছে। কিছুতেই উঠার শক্তি পাচ্ছেনা ইনিয়া। ইনিয়া চিৎকার করা শুরু করলো
“ হে আল্লাহ তুমি এই অভাগীকে কোনোদিন কি সুখ দিবেনা। জন্মের পর থেকে কি পাপ করেছিলাম আমি? কিসের জন্য আমাকে এতো যন্ত্রণা দিতে হয় তোমাকে? আর কত পরীক্ষা নিবে তুমি। জন্মের ছয় বছর বয়সে আম্মুকে হারিয়ে নিষ্টুর পৃথিবীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলে। সৎমায়ের জ্বালা যন্ত্রণা সহ্য করেছি ১৪ টি বছর। সৎবোন নিমুর থেকে পেয়েছি লাথি। সবসময় আমার পছন্দের জিনিসগুলো ছিনিয়ে নিতো সে? বাবা থেকেও ছিলো না। অভাগীকে একটু সুখের মুখ দেখাইলেন কুড়ি বছর বয়সে জুনায়েদের মাধ্যমে। তিনবছর পর জুনায়েদের আসল রুপ দেখাইলেন। বরাবর নিমু আমার প্রিয় জিনিস কেড়ে নিতো এবারো ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু কথায় আছে এক হাতে তালি বাজেনা, প্রিয় শখের পুরুষ আমার ছিলো না। সে মরীচিকা ন্যায় আমার জীবনে জ্বারা হয়ে এসেছিলো। সবকষ্ট আমি নিমিষেই ভাগ্য হিসাবে মেনে নিয়েছিলাম। কারণ আমার বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল ছিলো অনাগত সন্তান। তুমি তাঁকেও কেড়ে নিলে। এতই যদি এই অভাগীকে কষ্ট দিবে বলে ঠিক করেছো। তাহলে এই অভাগীকে তোমার কাছে নিয়ে নিলেনা কেনো? আমি কি এতটাই পাপ করেছিলাম যারজন্য এতো শাস্তি আমাকে দিচ্ছো। এই অন্তর আর কোনোকিছু সহ্য করিতে পারছেনা। কথাগুলো আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে বলে দু-চোখ ভর্তি পানি নিয়ে রাহার দিকে তাকায়। এরপরে ইশমামকে বলে আপনি কেনো সেদিন আমাকে রাতে বাঁচিয়েছিলেন? এই দিন দেখার চেয়ে আমার মরে যাওয়া অনেক আনন্দের হতো। এই ভাঙ্গা হৃদয় এতোবড় ধাক্কা সামলাবে কি করে? আমাকে যেহেতু বাঁচিয়েছিলেন আমার আরেকটা উপকার করবেন? ”
“ কি উপকার? ”
ইনিয়ার ভেতর এতো যন্ত্রণা লুকিয়ে রয়েছে ইশমাম জানতো না। নাহলে এভাবে এই কথা বলে যন্ত্রণা আরও বাড়িয়ে দিতো না। ইশমামের চোখের কোণে পানি জমে আছে। ইনিয়ার কষ্টের কথা শুনে, আর চোখের পানি দেখে নিজেকে সামলে নিতে পারছেনা ইশমাম। পোস্টারে ইনিয়ার নিখোঁজ তথ্য দেখে ভেবেছিলো অভিমানী ইনিয়া অভিমান করেই বাড়ি ছেড়েছে। কিন্তু এই ধ্রুব সত্যি বলার আগে ইশমামের মনে ছিলো না ইনিয়া ক্যান তার হাসবেন্ডকে ছেড়ে চলে এসেছিলো। সেই কথা ত আগেই জানিয়েছিলো ইনিয়া।
ইনিয়া কাঁদতে থাকে আর যন্ত্রণার প্রলাপ বকতে থাকে। ইনিয়ার যন্ত্রণার কথা শুনে ইশমাম নিজেকে সামলাতে পারছেনা। ইনিয়াকে ধরে শান্তনাও দিতে পারছেনা। কারণ পরপুরুষ পরনারীকে ছুঁতে পারেনা, তাতে যে পাপ লাগে। অথচ ইনিয়ার মাথায় এখন শান্তনার হাত বড্ড দরকার। ইনিয়া কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। অজ্ঞান হয়ে যায়, ফ্লোরে ধুপ করে শরীর এলিয়ে দেয়। ইশমাম দ্রুত এসে ইনিয়াকে ধরে কোনোকিছুই চিন্তা না করে। এরপরে চোখেমুখে পানি দিয়ে জ্ঞান ফিরানোর চেষ্টা করে কিন্তু জ্ঞান ফিরছেনা কিছুতেই। ইশমাম ঘাবড়ে যায়।
বাইরে প্রচুর ঝড় বৃষ্টি। কি করবে ইশমাম বুঝতে পারছিলো না। ইশমাম ইনিয়ার মুখ দেখে এবার মায়ায় পড়ে যায়। আল্লাহর কাছে কেঁদে কেঁদে বলে,,
“ হে আল্লাহ তুমি আমার কাছ থেকে প্রিয়াকে কেড়ে নিয়েছো, আমি তোমাকে কিছু বলিনি। আজকে যদি তুমি ইনিয়াকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নাও তাহলে তোমার মসজিদে কোনোদিন নামাজ পড়তে ঢুকবো না। হে আল্লাহ আমায় দিয়ে ক্যান ইনিয়াকে কষ্ট দেওয়াইলেন। ইশমাম টুপ করে ফোন বের করে থ্রিপল নাইনে কল করে। এরপরে বলে আমার দেওয়া ঠিকানায় দ্রুত একটা অ্যাম্বুলেন্স পাঠান। ”
ঝড়ের গতি তান্ডব চালাচ্ছে। রাহা একদিকে কান্না করছে। ইনিয়া জ্ঞান হারিয়ে বিছানায় পড়ে রয়েছে। ইশমাম ইনিয়াকে অনেক ডাকছে কিন্তু ইনিয়ার সাড়া নেই। ইনিয়াকে বলে দেখো আমাদের রাহা কান্না করছে তুমি এভাবে পড়ে থাকিও না। উঠে প্লিজ দুধ দাও। কথা দিচ্ছি আমি তোমাকে নতুন জীবন দিবো। আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হবে রাহা। সারাজীবন অনেক কষ্ট করছো ইনিয়া, আমি তোমাকে তোমার হাসবেন্ডের কাছে পাঠিয়ে আর কষ্ট দিতে পারবো না।
ইশমাম দিশেহারা হয়ে উঠে। একদিকে রাহা কান্না করছে। অন্যদিকে ঝড় তার তান্ডব চালাচ্ছে। এমন সময় বজ্রপাতে দুম করে জানালা খুলে যায়। রাহাকে ইশমাম কোলে জড়িয়ে নেয়। অ্যাম্বুলেন্স থেকে ড্রাইভার এসে ইনিয়াকে ধরে ধরে গাড়িতে তুলে। ইশমাম রাহাকে নিয়ে সিটে বসে। ইশমামের দুই উরুর মাঝখানে ইনিয়ার মাথা রাখে। ইশমাম নিষ্ঠুর পৃথিবীর রঙচঙ দেখতে পারছে না। তাই চোখ বন্ধ করে ফেলে। রাহা আপাতত মায়ের দুধ না পেয়ে বাবার কোলে কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে। বাইরে ঝুম ঝড় বৃষ্টি চলতেছে। অ্যাম্বুলেন্স চলছে তার গতিতে, প্রকৃতির ভয়াবহ রুপ ধারণ করছে। বজ্রপাত হচ্ছে রাস্তায়। গাছের ডালপালাগুলি বারি খাচ্ছে।
____
জুনায়েদ ইনিয়াকে খোঁজার কমতি রাখেনি। পুলিশও ইনিয়াকে পাচ্ছে না। জুনায়েদ পুলিশকে কল করে বলে আমাদের বাড়িতে একবার আসুন। দুজন ক্রিমিনালকে অ্যারেস্ট করতে হবে।
“ আরিয়ান এই কথা শোনামাত্রই জুনায়েদকে বলে দেখুন আমার সঙ্গে ঠাট্টা করবেন না। আমরা এমনিতে ব্যস্ত, ক্যান যে নিজের গলা কাটতে এই প্রফেশনে এসেছিলাম। ”
“ দেখুন জুনায়েদ ঠাট্টা করতে পছন্দ করেনা। আমাদের বাড়িতে আসলে ঠিকই বুঝবেন। দুজন ক্রিমিনাল অপরাধ করে কিভাবে মুক্ত পৃথিবীতে ঘুড়ে বেরাইতেছে। ”
“ ঠিক আছে। ”
জুনায়েদ ফোন কেটে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। হঠাৎ করে কাশি শুরু হয়। জুনায়েদ কাশতে কাশতে দ্রুত বেসিনে চলে আসে। বেসিনে পানি ছেড়ে দেয়। মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হয়। জুনায়েদ পিছনের পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছে। এরপরে আয়নাতে নিজের স্বরুপ দেখে। এরপরে দুচোখ বন্ধ করে ইনিয়াকে পাশে কল্পনা করে। ইনিয়া এসে জিজ্ঞেস করে,,
“ জুনায়েদ তুমি নাকি আমাকে ভালোবাসতে তাহলে আমার জায়গা নিমুকে কিভাবে দিতে পারলে? তুমি জানতে না আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন ভূমিষ্ট হতে বেশিদিন ছিলো না। তাহলে এই সময় এক দুঃখী মেয়েকে স্বপ্ন দেখিয়ে মন ভেঙ্গে দিলে ক্যানো? মানছি আমি নিমুর থেকে সুন্দর না! কিন্তু সাড়া পৃথিবীর চোখে অসুন্দর হলেও, আমার শখের পুরুষ তো সেই চোখে দেখতো না। তুমি আমাকে বিয়ে করে স্বপ্ন দেখিয়েছিলে নতুন জীবনের। আর তুমিই ভেঙ্গে দিলে আমার লালিত করা সকল স্বপ্ন। ”
“ আমি এখনো তোমাকে ভালোবাসি ইনিয়া। মৃত্যুর আগ অব্দি তোমাকে ভালোবাসবো! তুমি কোথায় চলে গিয়েছো, শুধু একবার আমার বাবুকে কোলে দাও। তাকে ছুঁয়ে দেখলে মরেও শান্তি পাব। মৃত্যুর আগে শুধু একবার আমার সঙ্গে দেখা করো প্লিজ ইনিয়া। ”
“ দুচরিত্রবান লোকের সঙ্গে ইনিয়া দেখা করতে আসবে না। আর দুচরিত্রবান লোকের স্পর্শ আমার বাচ্চার শরীরে পড়ুক আমি চাইনা। ইনিয়া বাবুকে কোলে নিয়ে চলে যায়। ”
জুনায়েদ ইনিয়া বলে চিৎকার দিয়ে চোখজোড়া খুলে ফেলে। ঘাবড়ে যেয়ে বলে এ আমি কি দেখলাম। আমার ইনিয়া আমাকে এতোটাই ঘৃণা করে? অবশ্য আমিতো এটাই চেয়েছিলাম। আমার হাতে বেশি সময় নেই ইনিয়া। শুনবে আমার কি হয়েছে? আমি বিরাট বড় রোগে আক্রান্ত ইনিয়া। যেদিন জানলাম আমার এতোবড় রোগ, তখন ঠিক করলাম আমি কি করলে তুমি আমাকে ঘৃণা করে চলে যাবে। তাই প্লানমাফিক নিমুর সঙ্গে বিয়ের নাটক করতে হলো ইনিয়া। আমি ভেবেছিলাম তোমার চোখের সামনে নিমুকে নিয়ে নোংরামি করলে তুমি নিশ্চিত ঘৃণা করে চলে যাবে। কিন্তু আমার প্লান যে প্রথমদিনেই সাকসেসফুলি হবে আমি ভাবতে পারিনাই ইনিয়া। এ জীবনে তুমি অনেক কষ্ট পেয়েছো। আর কষ্ট বাড়াতে চাইনাই। তবে মৃত্যুর আগে যদি তোমাকে একবার দেখতে পারতাম, আমাদের বাবুকে একবার দেখতে পারতাম তাহলে মনে হয় মরেও শান্তি পেতাম। কিন্তু এরকম অনুভূতি সত্যিই চাইনা। কারন তুমি ভেঙ্গে পড়বে, কিন্তু মন যে মানেনা। তবে তুমি আর আমাদের বাবু যেখানে থাকোনা কেনো অনেক ভালো যাতে থাকো। আমি জানি তুমি অনেক স্ট্রং মাইন্ডের একটা মেয়ে। তুমি থাকতে আমাদের বাবুর কোনোকিছু হবেনা। সেও সঠিকভাবে মানুষ হবে। ততদিনে তোমার জীবনে এতদিনে যারা দুভোর্গ নেমে নিয়ে এসেছিলো তাদের পথ থেকে সরিয়ে ফেলবো আমি। আমি জানি মরার পরে আমার করা প্রত্যেকটি কাজ জানবে, ততদিনে যেনো তোমার চোখে আমার জন্য ভালোবাসা মরে যায়।
এমন সময় কলিংবেল বাজছিলো। জুনায়েদ আস্তেধীরে এসে সদর দরজা খুলে দেয়। আরিয়ান ও তার ফোর্স নিয়ে জুনায়েদের বাড়িতে আসে। পুলিশ দেখে চমকে যায় লিমা ও নিমু রহমান। তারচেয়েও বেশি অবাক হয় নিমু ও লিমা, কারণ আফজাল রহমান নিজ পায়ে হেঁটে আসছে পুলিশের কাছে। আফজাল সাহেব পুলিশের কাছে এসে বলে অ্যারেস্ট হার স্যার।
“ আরিয়ান বলে অপরাধ ছাড়া আমরাতো আসামীকে তুলতে পারিনা। ”
“ এই মহিলার অনেক অপরাধ শুনতে গেলে একদিন লেগে যাবে। আপাতত এটাই জানুন এই মহিলা আমার স্ত্রীকে বিষ প্রয়োগে মারছে। আমাকে পঙ্গু বানানোর চেষ্টা করেছে। শুধুমাত্র আমার জামাই জুনায়েদ ছিলো বলে আজ এই কয়েকদিনের মাথায় আমি অনেকদিন পর নিজ পায়ে দাঁড়িয়ে আছি। আর আমার মেয়ে নিমু রহমান তার আপার জীবন শেষ করার মতো পাপ করছে তাই তাকেও অ্যারেস্ট করুন। বাকি অপরাধের লিষ্ট কোর্টে জানানো হবে। ”
এইসব কথা শুনে লিমা রহমান বলে ,,
“ ওগো তুমি কি করছো? তোমার নিজ স্ত্রী ও মেয়েকে পুলিশে ধরিয়ে দিচ্ছো? ”
“ চুপ কর কাল নাগিনী। তোর জন্য আমাদের সুন্দর জীবন শেষ হওয়ার পথে। তোকে বাইরে রাখলে আমার মেয়ে ও আমাকে শেষ হতে হবে। তোদের জেলখানায় মানায়। আমি এতদিন অনেককিছু সহ্য করেছি আর না। ”
নিমু বলে উঠে বাবা আমিও তোমার মেয়ে তাহলে আমার সঙ্গে এরকম কিছু করতে পারোনা।
তা শুনে আফজাল হেসে বলে তুমি আমার অবৈধ মেয়ে। তোমার মায়ের কাছে জেনে নিও সে কিরকম কালনাগিনী মহিলা। কিভাবে আমাকে ফাঁসিয়ে বিয়ে করছে। অবশ্য এসব শুনলে তোমার লজ্জা করবে। তারচেয়ে বরং জেলখানায় বসে বসে মায়ের সঙ্গে এসব ব্যাপারে তর্ক করিও। তুমি যদি মানুষের মতো মানুষ হতে পারতে তাহলে তোমাকে এইদিন দেখাতাম না।
নিমু তার বাবার কথা শুনে অবাক চোখে তাকায় লিমার দিকে। লিমা মাথা নিচু করে ফেলে। নিমু বুঝতে পারে বাবা যা বলছে সবই সত্যি। তাই নিমু কিছু না বলে জুনায়েদ কে বলে ওগো আমিতো তোমাকে ভালোবাসি। আমাদের বিয়ে হয়েছে। আমি তোমার সঙ্গে সংসার করতে চাই, জেলখানায় যেতে চাইনা।
জুনায়েদ বলে কিসের সংসার। এই সংসার ইনিয়ার ছিলো, ইনিয়ার থাকবে। আর হাদিস তো জানোনা, তাই এভাবে বলছিস। আমাদের বিয়েটা বৈধ ছিলোনা। তাই অবৈধ সম্পর্কের দাবি করে লাভ নেই। আইন তাতে তোকেই পচাবে।
পুলিশ এসে দুজনের হাতে হাতকড়া পড়ায়। গাড়িতে টেনেটুনে উঠায়। লিমা রহমান চলে যাওয়ার পথে বলে,,
“ এই রহমানের সম্পত্তি আমার ছিলো আমারই থাকবে। জেল থেকেই তোদের ব্যবস্থা করবো। আমিও দেখবো জেলখানা কতদিন আমাদের রাখতে পারে। ”
#চলবে,,,