বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব-৪৫ এবং শেষ পর্ব

0
2581

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_৪৫

পাত্র পক্ষের সামনে বসে থাকাটা হয়তোবা প্রায় মেয়ের কাছেই কিছু টা ভয়ের, কিছু টা বিরক্তের,কিছু টা আতঙ্কের।কিন্তু এই পাত্র পক্ষ টা যদি হয় ভালোবাসা পক্ষ তাহলে পরিস্থিতি হয় একেবারে ই উল্টো টা।তখন পরিস্থিতি হয় কিছু টা জড়তা আর লজ্জামিশ্রিত।ঠিক যেটা এখন আমার হচ্ছে।

নিজেকে বারোহাত শাড়িতে মুড়িয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে গুনে গুনে পাঁচ জন ব্যক্তির সামনে বসে আছি। একজন হলো ফারাবী ভাইয়া, একজন হলো মিথিলা আপু, একজন সজল ভাইয়া, একজন স্বয়ং আলআবি ভাইয়া আর সবশেষে রয়েছেন নাহার মাশরুখ। যিনি আলআবি ভাইয়ার মা।

বাসায় আজকে সাদু,সার্থক ভাইয়া,রাফিদা আপু আর সেই সাথে খালা, খালু এসেছেন।আলআবি ভাইয়ার কারণেই মূলত আসা তাদের।

রাকিব আর মিথুনের গ্যাঙ্গের করা ঘটনার আজ ২ দিন চলছে। ওদের সকলকে পুলিশের হাতে হস্তান্তর করা হয়েছে। ওখানের মেয়ে গুলোকে স্বসম্মানে বাড়িতে পাঠানো হয়েছে।আজকে আলআবি ভাইয়ার পরিবার থেকে আমাকে দেখতে এসেছেন।আলআবি ভাইয়া নাকি আর দেরি করতে চান না।একসপ্তাহ এর মধ্যে নাকি সে আমাকে বিয়ে করতে চান।আর এমন লজ্জা শরমবিহীন কথা যেদিন রাকিব আর মিথুনকে গ্রেফতার করা হয়েছে সেদিন আমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে যাওয়ার সময় সে নিজে বাবাকে বলেছেন।দিন দিন ওনাকে দেখে মনে হচ্ছে নির্লজ্জ বলে কোনো সাবজেক্ট থাকলে তাতেও উনি এ প্লাস পেতেন।

আলআবি ভাইয়ার বাবার মৃত্যুর পর তার মা স্বাভাবিক ভাবে জীবন যাপন করতে পারেননি।তার মা কারো সাথে কথা বলতে বলতে হঠাৎ করেই ভুলে যাবে সে কার সাথে কথা বলছেন।সকালে বলতে পারবে না গতরাতে সে কি খেয়েছেন।২ বা ১ দিন আগে কারো সাথে কথা দেখা হলে তা ভুলে যাবেন।এমন ছোট ছোট অনেক জিনিস ই নাকি ভুলে যান।মিথিলা আপুর থেকেই এসব জানতে পেরেছি।তার সাথে সবসময় শ্যামলি নামের একটা মেয়ে থাকে।

কথাবার্তার একপর্যায়ে মিথিলা আপু বাবা কে বলে উঠলো,,,

–আঙ্কেল আলআবি আর জুইঁকে যদি একটু আলাদা ভাবে কথা বলার সুযোগ দেয়া হয় তাতে আপনার কি কোনো আপত্তি আছে?

–না আপত্তি থাকবে কেন?জুইঁ আলআবি কে নিয়ে ছাঁদ থেকে ঘুরে আসো।(বাবা)

এমনিই খুব লজ্জা লাগছিল সবার সামনে বসে থাকতে। তারউপর বাবার কথায় আরো লজ্জা লাগছে।হঠাৎ যে কি হলো আল্লাহ ই ভালো জানে।এতো লজ্জা লাগার কারণ কি?

আলআবি ভাইয়া অনুরোধ করার মতো করে বলে উঠলেন,,,

–জুইঁ চলো।

আমি ধীর পায়ে তার সঙ্গে ছাঁদে আসলাম। ছাদে বসার জন্য কোন ব্যবস্থা নেই। দুজন রেলিংয়ের গা ঘেঁষে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছি। ক্ষণে ক্ষণে মৃদু মাত্রায় ঠান্ডা হাওয়া বইছে। আমার রেলিংয়ের ওপর রাখা হাতের উপর আলআবি ভাইয়া তার হাত রাখলেন। তার দিকে দৃষ্টি দিতেই লক্ষ্য করলাম উনি আশেপাশের মেঘ বিহীন নিলাভ আকাশে উড়তে থাকা ঘুড়ির দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি তার দিকে তাকানোর পরেও তিনি আমার দিকে তাকালেন না। একভাবেই রয়েছেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে হঠাৎ করেই তিনি চুপ হয়ে গেছেন। বিগত দুই দিনে মাত্র একবার আমাদের ফোনে কথা হয়েছে। তাকে যখন নিবিড় ভাবে আমি পর্যবেক্ষণ করছিলাম তখন কন্ঠে কিছুটা গম্ভীরতা টেনে বললেন,,,

–তোমার কি কখনো জানতে ইচ্ছে করেনি গত দেড় বছর আগে হঠাৎ করে ই কেন আমি তোমার জীবন থেকে উধাও হয়ে গেলাম?

তার কথায় আমি আমার হাতের উপর থেকে তার হাতটা উঠিয়ে আলতো করে চেপে ধরলাম। তারপর বললাম,,,

–ভালোবাসার মানুষটার কাছ থেকে কখনো কোন কথা লুকিয়ে শান্তিতে জীবন যাপন করা যায় না। দৈনন্দিন জীবনের একেবারে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর কথা গুলো ও ভালবাসার মানুষটার কাছে ব্যক্ত করতে চাই আমরা। কারণ প্রিয় মানুষটার কাছে যখন আমরা একটা খোলা বই-এর রূপ ধারণ করি তখন মস্তিষ্ক আমাদের একটা তৃপ্তির অনুভূতি প্রেরণ করে। আমি জানতাম আপনি আপনার সময় হলে একদিন ঠিকই আমাকে বলবেন। আর আমি এখন পুরোপুরি ভাবে বুঝে গিয়েছি আপনি কি বলতে চান।

কথাগুলো আমি এক দৃষ্টিতে আলআবি ভাইয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম। কথাগুলো যখন তার দিকে তাকিয়ে বলছিলাম তখন মনের মধ্যে অসম্ভব রকমের ভালোলাগা কাজ করছিল। প্রিয়তমের চোখে চোখ রেখে কথা বলার অনুভুতি চকলেটের চেয়েও অধিক মিষ্ট,আইসক্রিমের চেয়েও অধিক শীতল আর ফুচকা খাওয়ার চেয়েও অধিক মজার।কাব্যিক ভুবনে ঘুরতে গিয়েও সম্পূর্ণ ঘোরা হয়ে উঠলো না। কারণ তখন আলআবি ভাইয়া বলে উঠলেন,,,

–তোমার কাছ থেকে আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা লুকানো হয়েছে।

আমি আলআবি ভাইয়ার দিকে হালকা ভ্রু কুঁচকে একটু প্রশ্নসূচক ভাবে তাকালাম।উনি আবার বললেন,,,

— আমার আব্বুর কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। তাকে খুন করা হয়েছে।

হঠাৎ করে এমন একটা কথা কানে ভেসে আসতে আমার বুক কেঁপে উঠলো। হতবাক হয়ে আমি তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আলআবি ভাইয়া আমার দিকে একবার তাকিয়ে আবার আকাশের দিকে মুখ ঘোরালেন আর বলতে লাগলেন,,,

— সেদিন ছিল তোমার জন্মদিন। কথা ছিল সেদিনই তোমাকে দেখতে আসবো।আব্বুর জরুরী একটা কাজ পড়ে যায় বলে সেদিন আর পরিবার নিয়ে আসা হয় নি তোমাদের বাসায়। আমি একাই আসি সজলকে নিয়ে। যেহেতু মা বাবাকে আনতে পারেনি তাই তোমার সামনে আসার পুরো প্ল্যান টাই চেঞ্জ করে ফেলি। চিন্তা করি তোমাকে ছাদে নিয়ে এসে সারপ্রাইজ দিব।

উনি ইশারায় ছাঁদ দেখিয়ে বললেন,,,

–তোমার জন্য যখন ঠিক এইখানে, এই জায়গায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম তখন আমার ফোনে একটা ফোন আসে। ফোনটা করেছিল শাফিনের আব্বা মিজান মামা।মিজান মামা আব্বুর অনেক পুরানো আর বিশ্বস্ত লোক ছিলেন। বলতে গেলে খুব ভালো বন্ধুর মতো ছিলেন তারা। মিজান মামা সেদিন আহত কন্ঠে বলেছিল,,,

— আলআবি ওরা তোমার আব্বুকে মেরে ফেলছে। তুমি তাড়াতাড়ি আমার দেয়া ঠিকানায় চলে আসো।

কল কেটে কোন দিক চিন্তা না করে দৌড়াতে থাকি। তখন ভুলবশত আমার অজান্তে তোমার সাথে ধাক্কা লেগে যায়। তখন আমি আব্বু কে ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারছিলাম না। আমি এটাও বুঝতে পারিনি যে আমার সঙ্গে কারো ধাক্কা
লেগেছে। মিজান মামার দেয়া ঠিকানা মত যেতে যেতে রাত ১২ টা বেজে যায়। গিয়ে দেখি একটা সরু গলি তে ঢোকার আগে আব্বুর গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে আর গলির শেষ মাথায় দুজন মানুষ রক্তাক্ত অবস্থায় আছে। একজন মিজান মামা আর একজন আমার নিজের জন্মদাতা পিতা। মিজান মামার কোলে আব্বুর মাথা রাখা। তাদের দেখতে পেয়ে দ্রুত দৌড়ে তাঁদের কাছে গেলাম। গিয়ে দেখি আমার আব্বুর গলা থেকে গড়গড়িয়ে টকটকে লাল রক্ত পড়ে রাস্তার কিছু অংশ ভিজে গেছে।আব্বুকে মিজান আঙ্কেল এর থেকে সরিয়ে নিয়ে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলাম। আমাকে দেখে আব্বুর বয়সী মিজান মামাও হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগলেন।জীবনের সবচেয়ে কাছের ব্যক্তির প্রাণহীন নিথর শরীরটা আমার কোলে নিতে বুকটা ফেটে যাচ্ছিল।অথচ ওই শরীরটার ই এক হাত সকালে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিল।ওই শরীর টার সাথেই রাতে অনেক গল্প করেছিলাম।একসাথে এক টেবিলে বসে খাবার খেয়েছিলাম।

খেয়াল করলাম আলআবি ভাইয়ার কণ্ঠ কথা বলার সময় বারবার কেঁপে উঠছে। তার চোখে অশ্রুকণা চিকচিক করছে। তখন আবারও আলআবি ভাইয়া বলতে লাগলেন,,,

–আব্বুকে তৎক্ষণাৎ হসপিটালে নিয়ে যাই। কিন্তু সেদিন হসপিটালে নেয়াতে কোন লাভ হয়নি। হসপিটালে বসে মিজান মামার কাছে জানতে চাই আমার আব্বুর সাথে এরকম টা কেমন হলো? কিসের জন্য হলো এমন? তখন মিজান মামা বলতে থাকেন।

তার ভাষ্যমতে, আব্বু আর মিজান মামা ঢাকা থেকে কাজ শেষ করে গাজীপুর ব্যাক করছিলেন। গাজীপুর ঢোকার ওই রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে টং দোকানে বসে মিজান মামা আর আব্বু চা খাচ্ছিলেন।রাস্তায় তখন একটা দুইটা করে দ্রুতগামী দূরপাল্লার ট্রাক চলাচল করছিল। মাঝে মাঝে দু একটা প্রাইভেট কার ও আসা যাওয়া করেছিল। যখন দোকানে তারা চা খাচ্ছিল তখন দোকানদার সহ আরো দুজন ব্যক্তি উপস্থিত ছিল ওখানে। হঠাৎ করে টং এর পেছনে কয়েকজনের মৃদু স্বরের চিৎকার শুনে দোকানে থাকা দুজন লোক আব্বু আর মিজান মামা সরু গলিটার দিকে একটু এগিয়ে যায়।সেখানে ৮-৯ জন ছেলে মিলে একটা মেয়েকে জোরজবরদস্তি করে টেনে-হিঁচড়ে কোথাও নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। এরূপ পরিস্থিতি দেখে ওই দু’জন লোক আগেভাগেই ওখান থেকে চলে যায়। আব্বু আর মিজান মামা ধীরে ধীরে ছেলেগুলোর কাছে যেতেই দেখতে পায় মেয়েটাকে জোর করে ড্রাগস নেয়ার জন্য বাধ্য করা হচ্ছিল।আব্বু আর মিজান মামা ওখানে যেতেই ছেলেগুলো একটু ভড়কে কে যায়। সেই সুযোগে তখন মেয়েটা এক দৌড়ে গলি থেকে বের হয়ে মেইন রোডে আসতেই দ্রুতগামী একটা ট্রাকের সাথে ধাক্কা খায় আর সাথে সাথে ই স্পট ডেড। তখন ওদের মধ্যে থেকে একজন এসে আব্বুর গলায় ছুরি বসিয়ে দেয়। মিজান মামা বাধা দিতে গেলে তাকেও আহত করে ওরা।এরপর ওই মেয়েটার মৃত দেহটাকে নিয়ে ই একটা মাইক্রোতে করে চলে যায়। ছেলেগুলো অন্য কেউ ছিল না। ছিল মিথুন আর রাকিবের দলবল। তবে মিথুন বা রাকিব দুজনের কেউই আব্বুকে মারেনি। মেরেছে ওদের আরেক ফ্রেন্ড তিতাস। আর মেয়ে টা ছিল আফসানা। গরীব ঘরের মেয়ে ছিল।

আব্বুর দাফন-কাফনের পরে নিয়াজের কাছ থেকে তোমার কথা শুনতে পাই। একেতো আব্বুর সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা তার উপর আবার তোমার এই অবস্থা। সব মিলিয়ে আমি দিশেহারা হয়ে যাই। হসপিটালে তুমি প্রায় তিন দিনের মতো অচেতন অবস্থায় ছিলে। তোমার জ্ঞান থাকা অবস্থায় তোমার সামনে দাঁড়ানোর মত সাহস আমার ছিল না। তোমার অচেতন অবস্থার সুযোগ নিয়ে তোমাকে দেখে আসতাম। জ্ঞান ফেরার পর আর তোমার সামনে কখনো যাইনি।এর মাঝে শুরু হয়ে যায় আম্মুর পাগলামি। সে কোনভাবেই বুঝতে চাই তো না যে আব্বু আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে। নিয়াজকে বলেছিলাম আব্বুর এই ঘটনা যেন কাউকে না বলে। আত্মীয়-স্বজন ছাড়া বাইরের মানুষ আব্বুর ঘটনাটা জানে না। সবদিক মিলিয়ে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। ভেবে নেই যারা আব্বুকে এই দুনিয়ায় থাকতে দেয়নি তাদের চরম শাস্তি দেবো।

রাকিব, মিথুন আর তিতাসের ফ্রেন্ডসার্কেল নিয়ে রিসার্চ করি। সর্বপ্রথম যা পাই তা হলো, ওরা সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো বখে যাওয়া সন্তান। প্রত্যেকেই রাজনীতির সাথে গভীরভাবে জড়িত। এর মধ্যে সবচেয়ে বেপরোয়া হচ্ছে তিতাস। ওর নামে খারাপ রেকর্ডের শেষ নেই। মেয়েদের বিক্রি থেকে শুরু করে খুন করা পর্যন্ত ওর রেকর্ডে আছে। যখন ওদের নামে কমপ্লেন করতে যাই তখন ওদের বিরুদ্ধে অভিযোগ কেউ নিতে চায়নি।

অনেক ঘোরাঘুরি করেও যখন ওদের নামে কোন অভিযোগ করতে পারলাম না আর তার ওপর আবার কোন প্রমাণ নেই তখন অন্যায় ভাবে পুলিশকে টাকাও অফার করি।কিন্তু ওরা টাকা নিতে রাজী হয়না। উল্টো আমাকে শাসিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। কারণ আমি তিতাসের মত সঙ্গে করে বন্দুক নিয়ে ঘুরি না, ওদের মতো দিন দুপুরে খুন করি না, আমার নামের পিছনে কোন ভাইয়ের ট্যাগ লাগানো নেই। এক থেকে দেড় মাসের মতো একা একাই আত্মগোপন করে লড়ে যাই। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। তখন হঠাৎ একদিন নিয়াজ আর সজল কিভাবে যেন আমার সন্ধান পেয়ে যায।এরপর নিয়াজ আমি আর সজল মিলে সার্থক আর সার্থক এর বাবা ও চাচার সাহায্য নিয়ে তিতাসের ছয় জন ফ্রেন্ড কে জেলে ঢোকাতে পারি। কিন্তু এতে কোনো লাভ হয়নি। কয়েকদিন পরেই তিতাস ওর ফ্রেন্ডদের জেল থেকে বের করে নেয়। বুঝতে পারি ওদের সঙ্গে এভাবে হবেনা। নিজেকেও তখন রাজনীতিতে জড়িয়ে ফেলি।আমার নামের পাশে বড় ভাই নামের ট্যাগ লাগিয়ে নেই। তবে ওদের মতন খারাপ কাজে লিপ্ত না হয় ভাল কাজ করে সকলের বড় ভাই হয়ে উঠি।

সবচেয়ে খুশির সংবাদ পাই সেদিন যেদিন শুনতে পাই় তিতাস মারা গিয়েছে। আল্লাহ নিজে ওকে পৃথিবী থেকেই শাস্তি দিয়ে মৃত্যু দিয়েছেন। তিতাস বহুদিন ধরে নেশা করতে করতে এক পর্যায়ে ওর ভিতরের সকল অঙ্গ প্রত্যঙ্গ গুলো পঁচে যায়। আর ও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তিতাসের মৃত্যুর পরে রাকিব আর মিথুন বিদেশে পাড়ি জমায়। তার কারণ হলো আমার হাত থেকে একমাত্র তিতাসই ওদের বাঁচাতে পারত। এখন যেহেতু তিতাস নেই তাই ওরা বিদেশে গিয়ে আত্মগোপন করে।

দেড় বছরেও তোমার সামনে যাওয়ার সাহস পাইনি। কারন আমার জন্য তোমার লাইফে অনেক ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ভার্সিটিতে সেদিন অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তোমার সামনে আসতে হয়। অনেকদিন পরে আমার #বর্ষণ_সঙ্গিনীকে দেখে নিজেকে আর লুকিয়ে রাখতে পারিনি। ভার্সিটিতে দেখার পর প্রতিদিন তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করতো আবার অন্যদিকে অপরাধবোধ ও কাজ করতো। তখন নিয়াজ আমাকে অনেক কিছু বোঝানোর পড়ে ধীরে ধীরে তোমার সামনে আসি আর সেই থেকে আজ এ পর্যন্ত আসা। এখন যদি তুমি আমাকে শাস্তি দিতে চাও তাহলে আমি বিনা বাক্যে তা মেনে নিতে রাজি আছি।

এতক্ষণ তার কথা শুনে নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছিলাম। শাস্তির কথা বলতে ই আমি তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বললাম,,,

–আর কোনদিনও আমার থেকে দূরে যেতে পারবেন না। এটা আপনার শাস্তি। সারা জীবন আপনাকে আমার সাথে বেঁধে রাখবো। যেতে চাইলেও যেতে দিব না।একেবারে আঁচলে বেধে রাখব।ছাড়ব না কোনো দিন।

মোমবাতির কালচে হলদেটে আলোয় ফুলেসজ্জিত শুভ্র রঙা বিছানায় বসে আছি।আগে ভালো লাগা কাজ করলেও এখন ভয় করছে অনেক।কারণ পেটে প্রচুর ব্যাথা হচ্ছে। কিসের ব্যাথা তা বুঝতে কোনো সমস্যা হলো না।ভারি শাড়ী টা খুলে ফেলতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু এখনও উনি আসছেন না।তাই শাড়ীটাও খুলতে পারবো না।কারণ হলো আজ আমাদের পবিত্র বন্ধনের প্রথম রাত।যাকে বলে বাসর।তিন কবুল বলে একটু আগেই ভালোবাসার ব্যক্তিকে সারাজীবনের জন্য নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়েছি।

হঠাৎ করেই দরজা খোলার শব্দে একটু নড়েচড়ে বসলাম। আলআবি ভাইয়া রুমে ঢুকতেই সালাম দিলাম তাকে।সেও সালামের জবাব দিলেন।আমার কাছে এসে আমাকে বললেন,,,

–যাও শাড়ীটা চেঞ্জ করে নরমাল জামা পড়ে ফ্রেশ হয়ে আসো।

তার কথা মতো আমি ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতেই উনি আবার বললেন,,,

–শোনো!

আমি পিছনে তার দিকে তাকাতােই বললেন,,,

–একসাথে ওযু ও করে এসো।নামাজ পড়ব দুজন।

আমি তাকে মুচকি হাসি উপহার দিয়ে বললাম,,,

–আচ্ছা।

তাকে মুখে তো বলে দিলাম আচ্ছা কিন্তু নামাজ পড়তে পারব কিনা সেটা নিয়ে ভয় হচ্ছে এখন। ড্রেস চেঞ্জ করতে গিয়ে বুঝতে পারলাম এখন আর একসাথে আমরা নামায পড়তে পারব না। তলপেটের সূক্ষ্ম চিনচিনে ব্যাথাটা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এখন কি করবো ভেবে পাচ্ছিনা। কারণ প্রয়োজনীয় জিনিস সাথে করে নিয়ে আসিনি। এভাবে অনেক সময় ধরে ওয়াশ রুমে বসে আছি। হঠাৎ করে আলআবি ভাইয়া ওয়াশরুমের দরজায় নক করলেন। দুই তিনবার নক করার পর দরজা খুলে বের হয়ে আসলাম। বের হয়ে বেডের এক কোনায় জবুথবু অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইলাম। পেট ব্যথায় বারবার কপাল কুঁচকে আসছে।আলআবি ভাইয়া হুট করে আমার অনেক কাছে এসে আমার দুই হাত তার দুই হাতের মধ্যে নিয়ে নরম সুরে জিজ্ঞেস করলেন,,,

— কোন সমস্যা?

এই মুহূর্তে প্রচুর পরিমাণে জড়তা কাজ করছে আমার মধ্যে। কিছু বলতে পারছিনা। তখন আলআবি ভাইয়া আবার আগের মতন করেই জিজ্ঞেস করলেন,,,

— কি সমস্যা? বল আমাকে।

আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমতা আমতা করে বললাম,,,

–আসলে নামাজটা পড়তে পারবো না।

আলআবি ভাইয়া তৎক্ষণাৎ আমার হাত ছেড়ে কাবার্ডের কাছে চলে গেলেন।তারপর আমার কাছে এসে একটা ব্যাগ হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,,,

–তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী আর আমি তোমার অর্ধাঙ্গ। যার মানে হল এখন থেকে অর্ধেক তুমি আমার আর অর্ধেক আমি তোমার। আমার অর্ধেক দায়িত্ব তোমার আর তোমার অর্ধেক দায়িত্ব আমার। তাই দায়িত্ব যখন নিয়েছি সেটা সবদিক থেকেই পালন করার চেষ্টা করব। যাও এবার ওয়াশরুমে যাও।

ওয়াশ রুমে এসে দেখি আমার সকল প্রয়োজনীয় জিনিস ব্যাক টাতে রয়েছে মুহূর্তের মধ্যেই মুখে হাসি ফুটে উঠল। যে হাসি ছিল আমার বিজয়ের হাসি।

আজ আমাদের বিয়ের বয়স একসপ্তাহে পা দিয়েছে এই বাসায় মানিয়ে নিতে খুব একটা কষ্ট হয়নি। আম্মুর সাথে আর মিথিলা ভাবির সাথে খুব ভালোভাবেই দিন কেটে যায়। এখন রাত প্রায় ন’টা বাজে। আমি আমাদের রুম থেকে কেবল বের হচ্ছিলাম ঠিক তখনই কলিং বেল বেজে উঠলো। আমি ড্রইংরুমে আসতেই দেখি শ্যামলী দরজা খুলে দিয়েছে তখন ড্রইংরুমে মিথিলা ভাবি আর ফারাবী ভাইয়া বসে টিভি দেখছিল। দেখলাম আলআবি ভাইয়া এসেছেন। সবাই যেহেতু টিভি দেখছিলা তাই আমি দরজার দিকে আর না গিয়ে সোজা সোফায় বসে পড়লাম। আলআবি ভাইয়া রুমে গিয়ে আবার ড্রয়িংরুমে এসে সকলের সামনেই আমাকে বললেন,,,

–জুইঁ একটু এদিকে আসো তো।

মিথিলা ভাবি তখন আলআবি ভাইয়াকে কে উদ্দেশ্য করে দুষ্টুমির সুরে বলে উঠলো,,,

–এখন বিয়ে করে বউ ছাড়া একদম থাকতে ভালো লাগে না তাই না।

— বিয়ে তো বউকে সাথে রাখার জন্যই করেছি ড্রইংরুমে বসিয়ে রাখার জন্য নাকি।(আলআবি ভাইয়া)

–এইতো।আমার বউতো এটাই বোঝে না(ফারাবী ভাইয়া)

–আমার বউ টাও বোঝে না।আমি আমার টাকে একটু বুঝিয়ে নিয়ে আসি।থাকো তোমরা।(আলআবি ভাইয়া)

আলআবি ভাইয়া যে লাগামহীন কথা বার্তা বলেন তা আগে জানা থাকলেও এরা দুজনও যে কম না তা জানা ছিল না। এদের মাঝে না থেকে রুমে চলে আসলাম। রুমে আসতেই আলআবি ভাইয়া ও পিছু পিছু রকেটের গতিতে এসে পরলেন।এসেই আমাকে জড়িয়ে ধরলেন আর বললেন,,,

–কি বলেছিলাম ভুলে গেছ?

আমি জানি সে কিসের কথা বলছে।তাও বললাম,,,

–কিসের কথা বলছেন।

–আসো দেখাই।

বলেই আমার গালে, কপালে, নাকে আর থুতনিতে তার ঠোঁটের ছোঁয়া দিলেন।তার ছোঁয়ায় কিছুটা কেঁপে উঠলাম।আসলে তার কথা হলো বাসা থেকে বের হওয়ার আগে আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাবে আবার বাসায় এসে সর্বপ্রথম আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাবে। তার এমন অদ্ভুত কাণ্ড এক সপ্তাহ ধরে চলছে। শুধু এতটুকু নয়, রাতে ঘুমানোর সময় একবালিশেই তার মাথার কাছাকাছি আমার মাথা দিয়ে শুতে হবে।

রাতে খাবার খেয়ে রুমে এসে বেডের উপর বসতেই উনি বলে উঠলেন,,,

–কালকে কোথায় যাবো না আমি। তোমাকে নিয়ে একটা জায়গায় যাব। তাই রেডি থেকো সকালবেলা।

আমি উৎসুকভাব বললাম,,,

–কোথায় যাবো আমরা?

–গেলেই দেখতে পাবে।(আলআবি ভাইয়া)

আলআবি ভাইয়া সকালে উঠে নাস্তা করে আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পরলেন।আমাকে নিয়ে সেই কবর স্থান এর সামনে এলেন যেখানে নিশি আপুকে কবর দেয়া হয়েছে। এখানে নিয়ে আশায় যতটা না অবাক হয়েছি তার চেয়ে বেশি অবাক হয়েছি কবর স্থানে জায়েফকে দেখে।আমি বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে আলআবি ভাইয়ার দিকে তাকালাম।উনি ভিতরে গিয়ে জায়েফ কে নিয়ে আসলো। আমার সামনে আসতেই জায়েফ বলে উঠলো,,,

— আই এম সরি জুঁইফুল। তোমার কথা রাখতে পারিনি। যে দেশে নিশি নেই সে দেশে আমি গিয়ে কি করবো বলো। নিশা কে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না। তাই আবার এখানে এসে পড়েছি।

জায়েফের কথার কোন কিছুই আমার বোধগম্য হচ্ছে না। আমি একবার জায়েফের দিকে আরেকবার আলআবি ভাইয়ার দিকে তাকাচ্ছি। আমার এরূপ অবস্থা দেখে জায়েফ বলে উঠলো,,,

— বুঝতে পারছ না কিছু? আসলে ওই যে নিশি যেখানে শুয়ে আছে ওটাই আমার থাকার জায়গা। সারাদিন এখানেই থাকি।ওকে ছাড়া ভালো লাগেনা। মাঝে মাঝে আমরা গল্প ও করি। রাত হলেই ওকে ছেড়ে চলে যেতে হয়। শুধু রাত টুকু বাসায় থেকে আবার ভোরবেলাই় এখানে এসে পড়ি। ওই যে সামনের বিল্ডিং দেখছ না এটার চার তলায় থাকি আমি।

আরো কিছু সময় কথা বলে আমরা দুজন জায়েফের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসে পড়লাম। আলআবি ভাইয়া তখন বললেন,,,

–জায়েফ কিন্তু আরও ছয় মাস আগে বাংলাদেশে এসেছে। গান গাও বাদ দিয়ে দিয়েছে। সারাদিন রাত একখানে পড়ে থাকে।

আমি তার দিকে তাকিয়ে রইলাম একদৃষ্টিতে। বাইকে উঠে আলআবি ভাইয়া কে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে তার পিঠে মাথাটা হালকা এলিয়ে দিয়ে মনে মনে বললাম,,,

–ভালো থাকুক সকল পাওয়া না পাওয়ার ভালোবাসার মানুষ গুলো।

“আর এখানেই সমাপ্ত আলআবির #বর্ষণ_সঙ্গিনীর কল্পকাহিনী”।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে