#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_২০
–ওরে চান্দু! তলে তলে তুমি জাহাজ চালাইয়া ফালাইতাছো আর আমি জানি না কিছু।
হঠাৎ করেই সাদুর গলার আওয়াজ পেয়ে হকচকিয়ে উঠলাম। পিছনে ফিরে দেখি সাদু বিছানার উপর বসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর তাকানো দেখে মনে হচ্ছে ও গোয়েন্দা বিভাগের জন্য কাজ করে একে বারে সব উদ্ধার করে ফেলবে।আমি ওকে বললাম,,,
–জাহাজ চালাইতে পারলে কি আর এই জায়গায় বইসা থাকতাম নাকি?
–আমি তো দেখতাছি তুই এই জায়গায় বইসাই জাহাজ চালাইতাছোস।কিরে কাহিনী কি?
ওকে বলা শুরু করলাম,,,
সকালে ড্রেসিং টেবিলের দিকে চোখ পরতেই দেখি টেবিলের উপরে একটা ছোট বেলিফুলের চারা আর নীচে একটা গোলাপ গাছ।গাছের দুই ডালে দুইটা হালকা হলুদ রঙের ফুল ফুটে আছে।দুইটা ডালেই একটা একটা করে চিরকুটের মতো কাগজ বেঁধে রাখা। একটা খুলে দেখি আমার সেই চেনা হাতের নীল কালিতে লেখা,,,
“গাছ টা তোমার জন্যই।আমি জানি তুমি গাছটাকে আগলে রাখবে। তাই আর বলার প্রয়োজন নেই”।
দ্বিতীয় টায় লেখা,,,
” বেলিফুল আমার #বর্ষণ_সঙ্গিনীর পছন্দের আর এই হলুদ গোলাপ তোমার বর্ষণ সঙ্গির পছন্দের। তাই দুটো একসাথে দিলাম।এখন আপাতত এতটুকু জেনে রাখ”।
–কি?বুঝলি কিছু?(আমি)
— বুঝলাম তোর ও ভালোবাসার মানুষ আইসা পড়ছে। (সাদু)
কথাটা বলেই সাদু ফ্রেশ হতে চলে গেল। সাদুর কথা শুনে আমি দুই হাতে দুইটা চিরকুট নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। সত্যিই কি আমাকে কেউ ভালবাসে? আমি ও কি বেলা শেষে একটা ভালোবাসার হাত পাব? লোকটা যদি আমাকে সত্যিই ভালোবেসে থাকে তাহলে আমার সামনে আসে না কেন? ভালোবাসার মানুষকে কি না দেখে থাকা যায়? ধুর! কি যে চিন্তাভাবনা করছি।লোকটা আমাকে কেন ভালোবাসবে? সে তো আর আমাকে বলেনি সে আমাকে ভালোবাসে।
সকালে হালকা-পাতলা নাস্তা করে ব্যাগ পত্র গুছিয়ে অটোতে উঠাচ্ছিল নিয়াজ ভাইয়া। বাড়ি থেকে দশ পনেরো মিনিটের রাস্তা আমরা অটো করে যাব। মেইন রোডে আমাদের ভাড়া করা মাইক্রো আসবে। আমার ব্যাগের পাশে নিয়াজ ভাইয়া গাছ দুটো দেখে বলল,,,
–এই গাছপালা নিয়ে যাবি নাকি?
আমি বললাম,,,
— হ্যাঁ।
ভাইয়া কপালটা একটু কুঁচকে আবার আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করল,,,
— এই দুইটা কোথায় পেলি?
ভাইয়ার প্রশ্নে আমি অনেকটা ঘাবড়ে গেলাম। হুট করেই সাদু বলে উঠল,,,
— আরে ভাইয়া এগুলোতো ওকে সুমনা আপু দিছে।
আমি সাদুর দিকে তাকাতেই আমাকে একটা চোখ মেরে পুনরায় ভাইয়া কে বলল,,,
— আমাদের জুঁইফুলের বেলিফুল খুব পছন্দের। এই জন্যইতো সুমনা আপু ওরে বেলিফুল দিছে।সাথে গোলাপ ফুলও এক্সট্রা ফ্রী দিল।
ভাইয়া “ওহ আচ্ছা ” বলে গাছ দুইটা উঠিয়ে নিল। আসলে গাছ দুইটা পেয়ে আমিও মনে মনে একটু খুশি হয়েছি।
গাড়ির সামনে এসে খেয়াল করলাম এটা আগের তুলনায় একটু বড়। আর মানুষও আমরা আগের তুলনায় ৩-৪ জন বেশি। গাড়িতে ওঠার সময় সাদু বলল,,,
–সজল ভাইয়া আমি তোমার পাশে বসব।
–ওই সজল ভাইয়ার সাথে বসবি কেন?(আমি)
–বিয়ার সব পিক নিতে হইব না?(সাদু)
–আগে কি করছিলি? (আমি)
–পিক তুলছি।(সাদু)
–সাদমান ভাই জানে তার বউ সজল সজল করে।(আমি)
–ওই তো কইছে সজল ভাইর থিকা আমার বিয়ার সুন্দর সুন্দর পিক নিয়া যেন ওরে দেই।(সাদু)
–তোর আবার বিয়া হইলো কবে?(আমি)
–আরে বা* তোর ভাইর বিয়াতে আমি যেই পিক তুলছি ওগুলি চাইছে।বুঝছোস নাকি আরও কইতে হইব?(সাদু)
–ওহ্।ভালো কইরা কবি না।(আমি)
গাড়িতে আমার পাশে আলআবি ভাইয়া বসে। তার পাশে সজল ভাইয়া আর তার পরে বসে সাদু। রাতে সাদুর সাথে ঘুমানোর কারণে ভালোভাবে ঘুম হয়নি। কারন ও আমার উপর একটু পর পর হাত পা উঠিয়ে দিয়েছিল। তাই এখন একটু ঘুম ঘুম ভাব আসছে। অনেক চেষ্টা করেও চোখটাকে মেলে রাখতে পারছি না। চোখটার সাথে অনেক সময় যুদ্ধ করতে করতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। মাথায় কারো স্পর্শ পেয়ে হঠাৎ করে চোখ মেলে তাকালাম। দেখি আলআবি ভাইয়া তার ডান হাতে আমার হিজাব পরিহিত মাথাটার একপাশ চেপে ধরে আছেন।আরেকটু হলেই তার কাধে গিয়ে আমার মাথা ঠেকতো। এমন অবস্থা দেখে তাড়াতাড়ি করে নিজেকে সামলে নিলাম। তারপর সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আমাদের এমন অবস্থা কেউ দেখেনি। সজল ভাইয়া সিটে মাথা হেলিয়ে দিয়ে মুখটা হা করে ঘুমাচ্ছে। সাদু কানে ইয়ারফোন গুঁজে দিয়ে মাথাটা জানালায় ঠেকিয়ে চোখ বুজে আছে।ঘুমাচ্ছে কিনা তা বুঝা মুশকিল। এবার আলাবি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখি উনি মোবাইলে কিছু একটা করছেন। তাই আমি আর কিছু না বলেই বাইরের দৃশ্যের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। তখনই আলআবি ভাইয়া আস্তে করে বলে উঠলেন,,,
— ম্যানার্স ভুলে গেলে?
তার কথার মানে বুঝতে পেরে আমিও আস্তে করেই তাকে বললাম,,,
— সরি।
বলে আবারো বাইরের দিকে তাকালাম। কারণ বাইরের এই দৃশ্য টাকে মিস করতে চাইনা। অন্যদিকে ঘাড় ঘোরানোর সাথে সাথে আবার আলআবি ভইয়া বলে উঠলেন,,,
–ধন্যবাদ কে বলবে?
তার এমন ভাব দেখে মনে হচ্ছে তাকে এক্ষুনি ধাক্কা মেরে গাড়ি থেকে ফেলে দেই। একটুখানি মাথা ধরে ভাব এমন করছে যেন পুরো দেশকে করোনা মুক্ত করে ফেলেছে। তাকে আস্তে করে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললাম,,,
— আমি কি বলেছিলাম আপনাকে আমার মাথা ধরে বসে থাকেন?
–আমিও তো বলিনি বারবার আমার কাধের উপর এসে ঢোলে পড়ো।(আলআবি ভাইয়া)
–আমার মাথা আমার ইচ্ছে।আমি ঢোলে পড়বো না হলে লাফিয়ে পড়বো তাতে আপনার কি?(আমি)
–অবশ্যই আমার কিছু। আমার গায়ে পড়বে কেন তুমি?(আলআবি ভাইয়া)
–আমি ইচ্ছা করে কি পড়েছি নাকি?(আমি)
–সেটা তুমিই ভালো জানো।(আলআবি ভাইয়া)
–কথা কম বললেও ঝগড়া তো কম পারেন না।(আমি)
— সামনে তোমার মত একটা ঝগড়াটে মেয়ে থাকলে সবাই এসে এসে একটু করে ঝগড়া করে যাবে।(আলআবি ভাইয়া)
আমি এবার আর না পেরে চেঁচিয়ে বলে উঠলাম,,,
–আমি ঝগড়াটে মেয়ে?
গাড়ির সবার দৃষ্টি এখন আমার দিকে। সাথে সাথে সাদু বলে উঠলো,,,
–এতদিন পরে বুঝলি?
ওর দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাতেই নিয়াজ ভাইয়া বলে উঠলো,,,
–হঠাৎ করে তোর নিজের পরিচয় দিতে ইচ্ছা হল কেন?
এমনভাবে যে ফেঁসে যাবো তা বুঝতেই পারিনি। নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছে এখন।আলআবি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখি উনি আরাম করে ফেসবুকে নিউজ ফিড স্ক্রল করেছেন। কাউকে আর কোন কিছু না বলে সোজা বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনে হচ্ছে ঘুম নামক কোন বস্তু যদি আমার সামনে পেতাম তাহলে তার সাথে এখন বক্সিং খেলতাম।
বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমাদের সাড়ে তিনটার মতো বেঁজে যায়। আজকে অবশ্য রাস্তায় জ্যাম একটু বেশি ছিল। বাসায় আসার সময় নিয়াজ ভাইয়া বিরিয়ানি কিনে নিয়ে আসে। আমরা সবাই ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করে যে যে যার যার রুমে চলে আসি। রুমে এসেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। একটা জিনিস ভেবে খুবই ভালো লাগছে যে এখন বাসায় আমাদের একজন সদস্য বেড়ে গেল। এখন বাসায় তাসফি আপুও থাকবে। আমার গল্প করার জন্য খুব ভালো একজন পার্টনার পেয়ে গেলাম। ধীরে ধীরে নিয়াজ ভাইয়া আর বাবার সম্পর্কটা ও স্বাভাবিক হচ্ছে। এখন আমার একটা হ্যাপি ফ্যামিলি হবে। এই হ্যাপি ফ্যামিলি তে যদি আম্মু থাকতো তাহলে আরো অনেক বেশি ভালো হতো। এসব ভেবেই মনে অনেকটা প্রশান্তি পেলাম।
কারো ডাকে আমার ঘুম ভাঙলো। চোখটা মেলে দেখি আমার সামনে তাসফি আপু বসে আছে আর আমাকে ডাকছে। তাসফি আপুর ডাকের সাথে চারপাশে থেকে আজানের ধ্বনি কানে এসে লাগছে। আমার সামনে তাসফি আপু কে দেখে উঠে বসলাম। আপু বলল,,,
— মাগরিবের আজান দিচ্ছে? এখনো ঘুমাচ্ছ? তাড়াতাড়ি ওঠ।
আপুকে এভাবে ডাকতে দেখে কতটা যে ভালো লাগলো তা বলে বোঝানোর মত নয়। বিছানায় বসেই আপুর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। তখন আপু বলে উঠলো,,,
–কি দেখছ? নামাজ পড়বে না?
আপুর দিকে তাকিয়েই বললাম,,,
— জানো ছোটবেলায় বাবা ডেকে ঘুম থেকে উঠাতো।বড় হওয়ার পরে ফোনের এলার্ম শুনে শুনে উঠতে হয়। অনেক কয়েক বছর পর এই প্রথম আমাকে কেউ এভাবে ডেকে তুলেছে।তোমার এভাবে ডেকে তোলায় আমার যে কতটা ভালো লেগেছে তোমাকে বলে বুঝাতে পারব না।
–এখন থেকে আরও অনেক কিছইু ভালো লাগবে।এই পিচ্চি মেয়েটাকে আমিই দেখে শুনে রাখব এখন থেকে।
বলেই আমার গালটা একটু টেনে দিল।তারপর আবার বলল,,,
–এবার ওঠ তাড়াতাড়ি। মাগরিবের আযানও শেষ হয়ে গিয়েছে।
আপু রুম থেকে বের হতেই উঠে অযু করে নামাজ পড়ে জায়নামাজ টা ভাজ করছিলাম তখন তাসফি আপু আবার এসে হাজির। আমার সামনে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল,,,
— বাসায় তো তুমিই রান্না করতে তাইনা?
আমি বললাম,,,
— হ্যাঁ। মাঝে মাঝে কমলা আন্টি করে দিত। কেন?
–আসলে কিচেনে গিয়ে কিছুই খুঁজে পাচ্ছিলাম না ভালো ভাবে। তাই তোমার কাছে জানতে আসলাম কোথায় কি রাখা হয়।একটু আসো আমার সাথে।(তাসফি আপু)
–এসেই রান্নাঘরে পাকনামো শুরু করে দিয়েছো?(আমি)
–আরে বেশি কিছু না একটু কফিই শুধু বানাতে যাচ্ছিলাম। নিজের হাতে কফি তৈরি করে নিজের শশুর়কে, হাসবেন্ডকে আর এই পিচ্চি মেয়েটাকে খাওয়াতে চাই। বুঝেছ?(তাসফি আপু)
–জ্বি বুঝেছি ম্যাডাম(আমি)
আমার কথা শুনে তাসফি আপু হেসে দিল। তারপর বলল,,,
–দুই ভাইবোন তো দেখি একই ধাঁচের।
আমি বললাম,,,
–কিভাবে জানো?
–তুমি যে ভঙ্গিতে আমাকে ম্যাডাম বললে তোমার ভাইয়া ও মাঝে মাঝে এভাবে আমাকে বলে।(তাসফি আপু)
— প্লিজ! প্লিজ! প্লিজ! তোমাদের লাভ স্টোরি কিন্তু শোনাবে আমাকে। (আমি)
–আচ্ছা চলো কফি খেতে খেতে শোনাবো(তাসফি আপু)
কফি বানিয়ে তার সাথে ফ্রিজে রাখা সিঙ্গারা ভেজে আমি আর তাসফি আপু ভাইয়া আর বাবাকে ড্রইংরুমে দিয়ে আসলাম। তাসফি আপুকে নিয়ে আমার বারান্দায় এসে টুল ছাড়াই ফ্লোরে বসে পড়লাম আমরা। কফির মগে একবার চুমু দিয়ে তাসফি আপুর দিকে তাকালাম। তারপর বললাম,,,
–এবার কিন্তু বলতে হবে। শুরু করো।
তখন আপু একটু মুচকি হেসে বলল,,,
— আচ্ছা বলছি তাহলে শোনো।
চলবে……..……
[বিঃদ্রঃ গল্পটি সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক। অনুগ্রহ করে বাস্তবিক অর্থ খুজতে গিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না আর লেখিকা কে ও বিভ্রান্ত করবেন না]