বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব-১১

0
1742

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_১১

–নিজের জামাই মরলেও তো এমনে কান্দে না কেউ।

অনেকটা বিরক্তি নিয়ে কিছুটা ঝাঁঝালো কণ্ঠে ই সাদুকে কথাটা বললাম।অযথাই কথাগুলো ওকে বলি নি।ওর ফেচ ফেচানি কান্নার শব্দ আমার একদম সহ্য হচ্ছে না এখন।কিসের জন্য যে ওকে বাসায় আনার ভুত মাথায় চেপেছিল।

আজকে ভার্সিটি থেকে বাসায় আসার সময় সাদু কে সঙ্গে করে আমাদের বাসায় নিয়ে আসি। আন্টিকে ফোন করে বলে দিয়েছিলাম। প্রথমে আন্টি ওকে আমাদের বাসায় দিতে রাজি হয়নি। কারণ আজকে আমাদের বাসায় থাকবে। কালকে ভার্সিটিতে ক্লাস করে সাদু বাসায় যাবে। আমার অনেকবার বলার পরে ওকে দিতে রাজি হয়েছে।

নিয়াজ ভাইয়ার বিয়ের আর অল্প কয়েকদিন বাকি। আজকে ভাইয়া বিয়ের কার্ডের স্যাম্পল রাতে অফিস থেকে আসার সময় নিয়ে আসবে। তাই সাদুকে আমাদের বাসায় আজ রাত থাকার জন্য নিয়ে এসেছি। ওর পছন্দ আবার অনেক ভালো। তার ওপর ও আমাদের সাথে শপিং-এ যায় নি। শপিং দেখানোর উদ্দেশ্যেও ওকে আজ বাসায় নিয়ে এসেছি।

ভার্সিটি থেকে আমরা দুজন বাসায় ফিরে লাঞ্চ করে একটু রেস্ট নিয়ে বিকেলের দিকে বারান্দায় মুভি দেখতে বসে ছিলাম। আবহাওয়া টা ভালই ছিল। এখন প্রায় দিন ই বিকেলের দিকে আকাশে মেঘের দলেরা হানা দেয়। আজকেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।সাদু আর আমি একটা তামিল মুভি দেখছিলাম। মুভির থিমটা কিছুটা এমন ছিল–” গল্পের নায়ক নায়িকা তখন টিন এজের ছিল। দুজন একই স্কুলে পড়তো। তাদের বন্ডিংটাও খুব ভাল ছিল।তাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কটা ধীরে ধীরে ভালোবাসার বন্ধনে রূপ নেয়। কিন্তু কেউ কাউকে বলতে পারেনি তাদের ভালোবাসার কথা। তারা যখন কলেজ লাইফে ওঠে দুইজন দুই দিকে চলে যায়। আর সেখান থেকে তাদের দূরত্ব বাড়তে থাকে। তারপর যখন তারা আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে একপর্যায়ে তাদের কোন যোগাযোগই থাকেনা। এর মাঝে নায়ক একদিন তাদের সেই পুরোনো স্কুলে যায়। সেখানে তার পুরোনো বন্ধুদের কথা মনে পড়ে। আর এরপর একটা রিইউনিয়নে নায়ক নায়িকাদের আবার দেখা হয়। কিন্তু ততদিনে নায়িকার জীবনেও অন্য একজন এসে পড়ে। মানে নায়িকার বিয়ে হয়ে যায়। নায়ক-নায়িকার দেখা হয়, তাদের পুরনো স্মৃতির কথাও তাদের দুজনের মনে পড়ে, দুজনে খুব ইমোশনাল হয়ে পড়ে এবং নায়িকাটা অনেক কান্না করে। এরপর নায়িকাকে তার নিজের স্বামীর কাছে আবার চলে যেতে হয়।”

এখন সেই নায়িকার শোকে আমার প্রাণ প্রিয় বান্ধবী ও শোকাহত। অবশ্য আমারও খারাপ লেগেছে। চোখে পানি একটু ছল ছল করছিল। কিন্তু ওর মতন মরা কান্না জুড়ে দেই নি। ওকে আমি আবারো জোর গলায় বলে উঠলাম,,,

–প্রেম পিরিতি তো জীবনেও করছ নাই। এত কান্না আসে কই থেকে তোর?

— এইসবের জন্যে কি প্রেম পিরিতি করা লাগে। দেখলেই তো কষ্ট লাগে। ক্যামনে মাইয়াডা কানতাছে।(সাদু)

— ওই নায়িকা কান্দে তার নায়কের জন্যে। তুই কোন নায়ক এর জন্যে কান্দোছ।(আমি)

–যা সর।তুই বুঝবি না এগুলা।(সাদু)

–আচ্ছা আমারে একটু সত্যি কইরা কতো কার প্রেমে পড়েছোস?(আমি)

–আমি আবার কার প্রেমে পড়তে যামু?(সাদু)

— আমার মনে হইতাছে তুই কারো প্রেমে পড়ছোস। কারণ তোর মধ্যে গুন্ডি গুন্ডি ভাবটা দেখতাছি দিন দিন লোপ পাইতাছে।(আমি)

–তোর মাথা পাইতাছে।(সাদু)

এরপর সাধু দ্বিগুণ উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলো,,,

–ওই তোর চিঠি প্রেমিক কি আর কোনো চিঠি দেয় নাই? আমার কিন্তু চিঠিটা পড়তে অনেক ভালো লাগছে।(সাদু)

–ভালো লাগলে বইসা বইসা ওই চিঠি গুইলা খা তুই।(আমি)

–আরে বা* কছ না।আর চিঠি দেয় নাই?(সাদু)

–হ।কালকে বিকালে বই পড়তে ছিলাম তখন একটা মেসেজ দিছিল-

“প্লিজ চুলগুলো একটু বেঁধে নাও। না হলে আমি আর পারছিনা। তোমার খোলা এলোমেলো চুলগুলো ছুঁয়ে দিতে এতটা ইচ্ছে করছে যা তোমাকে বলে বুঝাতে পারব না।

তোমার বর্ষণ সঙ্গী”

সাদু অনেক টা ভাবুক হয়ে বললো,,,

–ও মা সব রাইখা তোর চুল ধরতে মন চাইলো কে?

–কেন আমারে জড়াইয়া ধরতে চাইলে কি খুশি হইতি বেশি?(আমি)

— আরে ধুর। আমি তো তোর কয়ডা কালা চুল ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাইনা। ওই ব্যাডায় কি দেখল তোর চুলে?(সাদু)

–আমারে জিজ্ঞেস করছ কেন?আমি জানি?আর তুই ওই লোকরে নিয়া পইরা আছোস কে?কিরে এমন ছিলি না তো।হইলো কি তোর?(আমি)

–হয় নাই হইবো।একটা পোলা একটা মাইয়া।(সাদু)

–ওওও তলে তলে এতো দূর।(আমি)

রাতে ভাইয়া কার্ড নিয়ে আসে আমাদের আপন আত্মীয়-স্বজন কম হলেও আশে পাশের মামাতো,চাচাতো আত্মীয়-স্বজনের অভাব নেই। আমাদের গ্রামের বাড়িটা মফস্বল শহর আর গাছপালায় ঘেরা গ্রামের মাঝামাঝি। অর্থাৎ একেবারে গ্রামের ভিতরেও না আবার মফস্বল শহরে ও না। তবে তাসফি আপুদের বাড়ি মফস্বল শহরে। ওখানে মফস্বল শহরে একটা কমিউনিটি সেন্টার আছে। সেখানেই মূলত নিয়াজ ভাইয়ার বিয়েটা হবে। আমরা বসে বসে কার্ড গুলো দেখছিলাম। তখন সাদু বলে উঠলো,,,

–নিয়াজ ভাইয়া? তাসফি আপুকে একটা ভিডিও কল দিলে কেমন হয়? তাসফি আপুরো কিন্তু একটা পছন্দের ব্যাপার আছে।

একথা শুনে আমিও বলে উঠলাম,,,

–হ্যাঁ ভাইয়া।তাসফি আপু কে ভিডিও কল দেও।

–আচ্ছা দাঁড়া মোবাইলটা নিয়ে আসি।( নিয়াজ ভাইয়া)

ভাইয়া ভিডিও কলে কথা বলতে বলতে আমাদের কাছে আসলো। আপুর পরীক্ষা বলে বেশি সময় কথা বললাম না আমরা। শুধু তাসফি আপুকে কার্ড গুলো দেখালাম। আপু বলল আমাদের যেটা পছন্দ হয় সেটাই যেন ছাপাই।

কার্ড পছন্দ করে আরও কিছু সময় আমরা কথাবার্তা বলে ডিনার করে ঘুমাতে চলে আসলাম। ঘুমানোর সময় হল আরেক সমস্যা। আমার খাট খুব বেশি একটা বড় না। দুজন মানুষ ঘুমানো যায়। তবে ঘুমাতে গেলে একজনের সাথে আরেকজনের স্পর্শ লাগবে।

— ওই তোর এইটুকুন খাটে আবার তোর জামাইরে আনছোস কেন?(সাদু)

–কি?(আমি)

— মানে কোলবালিশ দিসছ কেন মাঝখানে?(সাদু)

— কেন তুই মনে হয় জানছ না ঘুমানোর সময় কারো হাত পা আমার গায়ে লাগলে আমার ঘুম হয় না।(আমি)

— তোর জামাইয়ের কাছে কইয়া দেখিছ। তোরে ফুটবলের মত লাথি মাইরা ফালায় দিবো ঘরের থেকা। (সাদু)

— জামাই বানাইলে তো ফালাইবো।(আমি)

–যা এখন এই তুলার বস্তা সরা।(সাদু)

–আমি জানি তোর ঘুমাইতে ঘুমাইতে মানুষের শরীরে উইঠা যাওয়ার রোগ আছে।তাই এমনেই ঘুমাবি(আমি)

–জীবনেও না।(সাদু)

–জীবনেও হ(আমি)

–না না না (সাদু)

–হ হ হ(আমি)

এমন যুদ্ধ করতে করতে শেষ মেশ সাদু আর না পেরে ওভাবেই শুয়ে পরলো। আমিও সুন্দর করে মাঝখানে কোলবালিশ দিয়ে শুয়ে পড়লাম।

সকালে উঠে দেখি আমার কোলবালিশ বারান্দার দরজার সামনে। আর আমি কোলবালিশের জায়গায়। সাদুর বাম পা খাটের নিচে অর্থাৎ ফ্লোরে। ডান পা টা খাটের উপর এবং দুহাত দুদিকে ছড়ানো। মূলত ওর একটা হাত আমার মাথার কাছে এসে লাগার ফলে ঘুমটা ভেঙে গিয়েছে। উঠে পুরো বাসায় একটু হাটাহাটি করলাম। তখন হঠাৎ ভাইয়া দরজা খুলে এসে সোফায় বসে পরলো। আমাকে দেখে বলল একটু তাড়াতাড়ি বের হবে। আজ একটা মিটিং আছে। আমি রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে সাদুকে উঠানোর জন্য গুঁতোগুঁতি শুরু করলাম। ও আমার সাথে থাকলে আমরা সারাদিন ঝগড়া করি। কিন্তু সাথে থেকেও যদি ঝগড়া না করতে পারি তাহলে ভালো লাগেনা। তাই ওকে উঠানোর জন্য ওর হাত পা ধরে টানাটানি করছি। অনেক টা বিরক্তি নিয়ে সাদু ঘুম থেকে উঠলো। ওকে ঠেলে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দিলাম। এমন সময় দরজায় কলিং বেল বেজে উঠলো। খুলে দেখি কমলা আন্টি এসেছে। সচরাচর আন্টি এত সকালে আসে না। আরেকটু পরে আসে। আন্টি এসে প্রতিদিন না করা সত্ত্বেও ঘর মুছে দিয়ে যাবে। মাঝে মাঝে নাস্তাও বানিয়ে দিয়ে যায়।

আমি নাস্তা বানাচ্ছিলাম আর কমলা আন্টি ঘর মুচ্ছিল। তখন সাদু আমার ফোনটা নিয়ে দৌড়ে আমার কাছে আসলো। এমন দৌড় দিয়েছে যে মনে হয় ওকে অলিম্পিকে দিলেও এতো স্পিডে ও দৌড় দিতো না।ও রান্না ঘরে এসে বলল,,,

–এই দেখ তোর চিঠি প্রেমিক হাজির।

ওর থেকে মোবাইল নিয়ে দেখলাম একটা মেসেজ এসেছে –

“তোমার বাবার বারান্দায় একটু আসো। কয়েক দিন একটু বিজি থাকব। তাই আমার বর্ষণ সঙ্গিনীকে দেখতে পাবো না। আর আমি জানি তোমার বাবা এখন ঘরে নেই তিনি বাইরে হাঁটতে বের হয়েছেন। তাই এখন একটু আসো।

তোমার বর্ষণ সঙ্গী”

এরকম একটা মেসেজ দেখে আর আমার সামনে সাদুর বত্রিশ পাটি দাঁত এর হাসি দেখে মোবাইলের ভলিউম বাড়ানোর মত আমার রাগও তরতর করে বেড়ে গেল। সামনেই চোখে পরলো কমলা আন্টি উইপার দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘর মুচ্ছে। পাশেই ঘর মোছা ময়লা পানির বালতি। আর এক মুহূর্ত দেরি না করে বালতি টা পানিসহ হাতে নিয়ে ছুটলাম বাবার রুমে। আমার পিছনে পিছনে সাদুও আসলো। বাবার বারান্দায় যেতেই দেখলাম বান্দা বরাবর নিচে কেউ একজন কালো স্যুট প্যান্ট পড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাথাটা নিচু করে মোবাইলে কিছু একটা করছে। তার চেহারা দেখা যাচ্ছে না। দেরি না করে বালতি টা উঁচু করে সব পানি গুলো দিলাম ফেলে। পানি ফেলে মনের মধ্যে যে এত আনন্দ হচ্ছে তা বলে বোঝানোর মতো না।মুখে চওড়া একটা হাসি নিয়ে সাদুর দিকে তাকালাম। ঠিক তখনই নিচ থেকে কেউ চেঁচিয়ে বলে উঠলো,,,

–ইডিয়েট! স্টুপিড! এই মেয়ে এই!

চলবে…………..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে