#বর্ষণের সেই রাতে- ২
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
৫০.
অনিমার বাবা তার পরের দিন সকালেই আদ্রিয়ানদের বাড়ি থেকে ওকে নিয়ে চলে গেছে। যাওয়ার সময় অনিমা আদ্রিয়ানের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু আদ্রিয়ান ঐ মুহূর্তে নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখেছে। হাসি মুখেই বিদায় দিয়েছে নিজের মায়াবিনীকে। কিন্তু অনিমার মোটেও ভালো লাগছিল না। নিজের বাড়িতে, বাবার কাছে ফিরে যাওয়ার আনন্দের সাথে আদ্রিয়ানকে ছেড়ে থাকার কষ্টটা মিশে এখন দুটো অনুভূতি-ই ফিকে হয়ে গেছে। সারা রাস্তাই মন খারাপ করে বসে ছিল ও। আদ্রিয়ান এমন একটা মানুষ যার সাথে অনিমা ভীষণভাবে জড়িয়ে গেছে। যে স্মৃতি থেকে মুছে গেলেও মন থেকে কোনদিনও মুছবে না।
হাসান কোতয়াল গম্ভীরমুখে বসে আছেন। তার আশরাফ মৃধা, রাহেলা আর ওনাদের ছেলে অর্ক। ওনারা তিনজনই অনিমার বাবার বাড়িতেই থাকছেন। হাসান কোতয়ালকে দেখে তিনজনই ভুত দেখার মত চমকে গেছিল। স্বাভাবিক! পাঁচবছর আগে যেই মানুষটা মারা গেছে সে ফিরে এলে যে কেউ চমকাবে। তারওপর অনিমাকে দেখে আরও অবাক হয়েছে। এই মেয়ে হুট করে আবার কোন গর্ত থেকে উঠে এলো? ওনারা তো ভেবেই নিয়েছিল যে বাপের সাথে সাথে ওও বিদায় হয়েছে। হাসান কোতয়াল পরে ওনাদের বুঝিয়েছেন যে লাশটা ওনার ছিলোনা। বেশ অনেকটা সময় পর ওনারা শান্ত হয়েছে। ওরা দুজন ফিরে আসাতে যে ওনারা কতটা খুশি, সেটাই নানারকম মনোভাব প্রকাশ করে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। রাহেলা অনিমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
” এতোদিন কোথায় ছিলি মা? এভাবে হুট করে চলে যায় কেউ?”
আশরাফ মৃধা বললেন,
” কোথায় কোথায় না খুঁজেছি তোকে? মামার কথা তো একবার ভাববি? কেমন আছিস?”
অনিমা ওনাদের দুজনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ধীর কন্ঠে বলল,
” যতটা এক্সপেক্ট করেছিলে তারচেয়ে অনেক বেশি ভালো আছি।”
অনিমার উত্তর শুনে দুজনেই একটু হকচকিয়ে গেছিল। অর্ক একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল। অনিমা অর্কর দিকে তাকিয়ে শুধু হেসেছিল হালকা। যেটাকে তাচ্ছিল্যের হাসি বলে। দীর্ঘ সময়ের নিরবতা ভেঙ্গে হাসান কোতয়াল বললেন,
” আমার সবসময়ই একটা ভরসা ছিল যে আমার কিছু হয়ে গেলেও আমার চিন্তা নেই। আমার মেয়ের মামা-মামী ওকে দেখে রাখবে। অথচ আজ পাঁচ বছর পর ফিরে এসে আমাকে আমার মেয়েকে অন্যকারো বাড়ি থেকে নিয়ে আসতে হল। তাও সেই ছেলেটা ওকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়েছিল। অথচ আপনারা আমারই বাড়িতে বসে বসে আমারই টাকায় আয়েশ করছেন। এটাকে আমি কী বলব?”
আশরাফ একবার নিজের স্ত্রীর দিকে তাকালেন। তারপর খুব দুঃখী গলায় বললেন,
” হাসান, আমরা তোমার মেয়েকে বেড় করে দেইনি। ও নিজেই উধাও হয়ে গেছিল কোথাও। ঐ ইন্ডিয়ান একটা মেয়ে ছিল। কী যেন নাম হ্যাঁ, আর্জু ছিল হয়তো। ওর সাথেই কোথাও একটা বেড়িয়েছিল। কিন্তু আর ফি
ফেরেনি। আমরা অনেক খোঁজ করেছিলাম ওর, কিন্তু পাইনি।”
আর্জুর কথা উঠতেই অনিমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। ওর ছোট্ট একটা ভুলের জন্যে সেদিন কী ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছিলো। সেই রক্তপাত, সেই চিৎকার, বাঁচতে চাওয়ার আকুতি সব যেন চোখে ভাসছে। মাথা ভার হয়ে আসছে। অনিমা দু-হাতে মুখ চেপে ধরল নিজেকে স্বাভাবিক করার জন্যে। হাসান কোতয়াল দুই হাত একত্রিত করে একটু ঝুঁকে বললেন,
” কোথায় কোথায় খোঁজ করেছিলেন আশরাফ ভাই?”
আশরাফ মৃধা আর রাহেলা দুজনেই এবার আমতা আমতা করতে শুরু করলেন। হাসান কোতয়াল বলল,
” যাক, যা হওয়ার হয়েছে। এতদিন আমার অফিস সামলেছেন তার জন্যে ধন্যবাদ। এবার আমার কাজ আমি করতে পারব। কাল থেকে আমি অফিসে বসছি।”
তারপর হাসান কোতয়াল অনিমার দিকে তাকিয়ে দেখল অনিমা মাথা চেপে ধরে বসে আছে। হাসান কোতয়াল বললেন,
” মামনী? অসুস্থ লাগছে? চল রুমে গিয়ে রেস্ট করবে।”
রাহেলা আল্লাদি কন্ঠে বলল,
” হ্যাঁ হ্যাঁ। দেখেই মনে হচ্ছে ও অসুস্থ। ওপরের ওর রুম পরিষ্কার করিয়ে রেখেছি একটু আগে। যা মা গিয়ে বিশ্রাম নে।”
অনিমা ভাবছে সত্যিই মানুষ স্বার্থের পাগল। আজ ওর বাবা ফিরে এসছে বলে এখন ওর প্রতি কত দরদ। অথচ ওর বাবা যখন ছিলোনা তখন জ্বর, সর্দি, আরও সবরকম অসুস্থতা নিয়েও কাজের লোকের মত বাড়ির সব কাজ করেছে ও। হাসান কোতয়াল অনিমাকে নিয়ে দাঁড়াতেই আশরাফ মৃধা বলে উঠলেন,
” অ্ আমরা কী চলে যাবো? এখান থেকে?”
হাসান কোতয়াল ভ্রু কুচকে বললেন,
” যদি থাকতে ইচ্ছে হয় থাকো কয়েকদিন। শত হোক তোমার বোনের বাড়ি এটা। সে বেঁচে নেই বলে যে বাড়িটা তার নেই এরকম ভাবার কারণ নেই।”
বলে অনিমাকে নিয়ে ওপরে চলে গেল। অর্ক ঝুড়ি থেকে একটা আপেল নিয়ে সিটি বাজাতে বাজাতে বাইরে চলে গেল। এদিকে আশরাফ মৃধা আর রাহেলা ভাবছেন যে হঠাৎ করে দুটোই একসঙ্গে উদয় হলে কোথা থেকে? সবকিছু হাতে এসেও আসলোনা, হাতছাড়া হয়ে গেল। তাই আড়ামে থাকতে হলে বাকি জীবন হাসান কোতয়ালকে তেল মেরেই চলতে হবে।
__________
বেশ রাত হয়েছে। মেঘলা আকাশ তাই চারপাশটা আরও ঘুটঘুটে অন্ধকার। হালকা শো শো বাতাস বইছে। যেকোন সময় বৃষ্টি হতে পারে। বাড়ির ছাদের এক কোণায় বসে আছে রিক। অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশের দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওর জীবটাও এখন এই আকাশের মতই মেঘ আর অন্ধকারে আচ্ছন্ন। নিজের ওপরেই একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে মদের বোতলে চুমুক দিতে গেলেই স্নিগ্ধা এসে আটকে নিলো। রিক ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলল,
” তুই এখানে কী করছিস?”
স্নিগ্ধা বোতলটা টেনে নিয়ে বলল,
” জানতাম এখানে বসে এসব ছাইপাস গিলছো। একজন ডক্টর তুমি। তারপরেও?”
” এসব প্যাচাল পারতে এসছিস এখানে? দে ওটা দে।”
স্নিগ্ধা দূরে সরিয়ে নিল বোতলটা। তারপর রিকের হাতে হাত রেখে বলল,
” ও বাড়ি থেকে আসার পর থেকে নিজেকে ঘরবন্দী করে নিয়েছ। ঠিকমতো খাচ্ছোনা, ঘুমাচ্ছোনা, বাড়ির কারো সাথে কথাও বলছোনা। এমনকি মামার সাথেও কথা বলছোনা তেমন। ওদের করা কাজের জন্যে তুমি নিজেকে শাস্তি কেন দিচ্ছো?”
রিক বিরক্তি নিয়ে বলল,
” এখান থেকে যা আর আমাকে একা থাকতে দে।”
বলে বোতলটা টেনে নিয়ে গিয়ে তাতে চুমুক দিতে গেলেই স্নিগ্ধা বলে উঠল,
” অনি কিন্তু ড্রিংক করা মোটেও পছন্দ করেনা রিকদা। ও তোমাকে নিজের খুব ভালো বন্ধু ভাবে। তোমার নীলপরী যেটাকে অপছন্দ করে সেটা তুমি করছ প্রতিনিয়ত। একজন বন্ধু হিসেবে ও কিন্তু কষ্ট পাবে।”
রিক থেমে গেল। কিছুক্ষণ বসে রইল ওভাবে। বেশ অনেকটা সময় পর বোতলটা পাশে ছুড়ে ফেলে দিয়ে আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। স্নিগ্ধাও কিছু না বলে রিকের পাশেই চুপচাপ বসে রইল। হঠাৎ রিক করুণ কন্ঠে বলে উঠল,
” আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। একটু ঘুমোতে চাই। তোর কোলে মাথা রাখতে দিবি?”
স্নিগ্ধা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রিকের দিকে। রিকের বলা কথাটা ওর বিশ্বাসই হচ্ছেনা। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। রিক কিছু না বলে স্নিগ্ধার কোলে মাথা রেখে শুয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। কিন্তু স্নিগ্ধার মনের মধ্যে ঝড় চলছে। এমন অনুভূতি হচ্ছে কেন ওর? মনে হচ্ছে এই মানুষটার জন্যে সবকিছু বিসর্জন দিয়ে দেওয়া যায়। এর আগেতো এমন হতোনা! এসব ভাবতে ভাবতে রিকের মাথায় হাত চলে যায় ওর। আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে রিকের মাথায়।
___________
দেখতে দেখতে তিনটা দিন কেটে গেছে। এই তিনদিনে অনিমা আদ্রিয়ানের ফোনে ফোনেই কথা হয়েছে শুধু। তাও খুব কম। ইদানীং আদ্রিয়ান রেকর্ডিং, স্টেজ শো, ইন্টারভিউ এসব নিয়ে বেশ ব্যস্ত হয়ে আছে। একটার পর একটা কাজ লেগেই আছে। সারাদিনের খাটাখাটনির পর রাতে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে ঘুমানোর আগে একটু কথা বলে ফোনে একটু কথা বলতে পারে অনিমার সাথে। কিন্তু সারাদিন দুজনেই দুজনের জন্যে ভেতরে ভেতরে ছটফট করে বেড়ায়। এই নিয়ে বেশ চলছে এদের বিরহ পর্ব।
ক্লাস করে কলেজের ক্যান্টিনের পাশের পুকুরপারে বসে আছে অনিমা, তীব্র আর অরুমিতা। তিনজনই আপাতত চুপ আছে। তিনজনেরই তিন কারণে মন খারাপ। অনিমা ঢিল ছুড়ছে শুধু পুকুরের পানিতে। অরুমিতা গালে হাত দিয়ে বসে আছে। আর তীব্র দেবদাস স্টাইলে সিঁড়িতে হেলান দিয়ে বসে আছে। অনিমা আড়চোখে তীব্রর দিকে তাকিয়ে বলল,
” কীরে দেবদাস? তোর ‘পারো’ আজ আবার তোকে কোন ছ্যাকা দিল?”
তীব্র বরাবরেই মতোই হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
” কালকে খেলা দেখছিলাম তাই ফোনের দিকে খেয়াল ছিলোনা। মহারানি পাঁচ বার কল করেছিল দেখিনি, তাই ধরিনি। এরপর আমি পঞ্চাশবার কল করেছিলাম কিন্তু সে আর ধরেনি।”
অনিমা হেসে দিয়ে বলল,
” ঠিক হয়েছে! কীসের এতো খেলা হ্যাঁ? আগে গার্লফ্রেন্ড তারপর খেলা। এবার বোঝ ঠ্যালা।”
তীব্র দুঃখী দুঃখী কন্ঠে বলল,
” আগে যদি জানতাম গো বন্ধু! এ জীবনে প্রেম করতাম না।”
অনিমা খিলখিলিয়ে হেসে দিল। অরুমিতা এতক্ষণ চুপ করে থাকলেও ওও এবার হেসে ফেলল। এরমধ্যেই স্নেহা চলে এসে অনিমার পাশে বসে তীব্রই দিকে তাকিয়ে একটা ভেংচি কেটে মুখ ঘুরিয়ে নিল। অনিমা বলল,
” তোর দেবদাস তোর বিরহে উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে।”
স্নেহা বিরক্তি নিয়ে বলল,
” এই পানিতে ডুবে মরতে বল।”
তীব্র গলা ঝেড়ে ঠিকঠাক হয়ে বসল। অনিমা অরুমিতার দিকে তাকিয়ে বলল,
” কীরে? তোর মুড অফ কেন?”
অরুমিতা কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে লম্বা এক শ্বাস ফেলে বলল,
” অয়ন স্যারের ব্যাপারটা আসলেই ভালো লাগছেনা আমার। কোথা থেকে নম্বর জোগাড় করেছে কে জানে? কাল রাতে কল করেছিল।”
অনিমা হেসে দিয়ে বলল,
” সেটাতো তোদের ভাইয়া অনেক আগেই বলেছে আমাকে। স্যার মানুষ হিসেবে তো ভালোই মনে হয়। সমস্যা কোথায়?”
অরুমিতা কিছুই বলল না। চুপ করে রইল। ওদের কীকরে বোঝাবে যে ওর মনের অনেকটা অংশ জুড়ে এখনো আশিস-ই আছে। চেষ্টা করেও সেই জায়গাটা এখনো অন্যকাউকে দিতে পারছেনা ও। স্নেহা অনিমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
” এইযে মিসেস, তোমার মনের খবর নিচ্ছেন এবার আপনার কথা বলুন। কেমন কাটছে আপনাদের দিন? আদ্রিয়ান ভাই সুস্থ আছেতো তোকে ছাড়া?”
তীব্রও হেসে দিয়ে বলল,
” সেইতো! তিন তিনটে দিন হয়ে গেছে। নো দেখা সাক্ষাৎ! ভাবা যায়! ভাই যে এখনো সুস্থ আছে এটাই অনেক।”
অনিমা মুখ ফুলিয়ে বলল,
” লেগপুল করবিনা তো একদম। রাগ লাগছে আমার এখন! লোকটা একটু বেশিই ব্যস্ত! সারাদিনে একটু ফোন করেনা। করে সেই রাতে গিয়ে। তাও বেশিক্ষণ কথাই বলতে পারেনা”
অরুমিতা হেসে বলল,
” ব্যাপারটা কিন্তু মজার। বিবাহিত দম্পতি হয়েও এখন কলেজ লাইফের প্রেমিক-প্রেমিকার মত অবস্থা এদের। প্রেম একেবারে মাখো, মাখো। আহা!”
সবাই ওরা বেশ অপেক্ষণ হাসাহাসি করল এটা নিয়ে। অনিমাও হাসল। এটা ঠিক আদ্রিয়ান ফোনে বেশ পাগলামি করে। মাঝেমাজে কীসব বাচ্চাদের মত উদ্ভট কথাও বলে। যে কেউ তখন তখন ওর কথা শুনে বলবে আস্ত বউ পাগল।
___________
রাতে ডিনার করে এসে শুয়ে শুয়ে বেশ অনেক্ষণ পর্যন্ত আদ্রিয়ানের ফোনের অপেক্ষা করল অনিমা কিন্তু আদ্রিয়ান ফোন করেনি। এরপর অনিমা ট্রায় করেছিল কিন্তু বন্ধ বলছে। তাই মন খারাপ করে শুয়ে শুয়ে আদ্রিয়ানের ফোনের অপেক্ষা করতে করতে চোখ লেগে আসতেই ওর ফোন বেজে উঠল। অনিমা দ্রুত চোখ খুলে ফেলল। ফোন হাতে নিয়ে দেখল আদ্রিয়ান। ওর মুখে স্বস্তির হাসি ফুটে উঠল। তাড়াতাড়ি ফোনটা রিসিভ করে বলল,
” আজ এতো দেরী করে ফোন করলেন যে?”
ওপাশ থেকে ক্লান্ত কন্ঠে আদ্রিয়ান বলল,
” খুব ব্যস্ত ছিলাম। একটু আগে একটা শো শেষ করলাম। একটু ব্যালকনিতে আসবে?”
অনিমা চোখ বড়বড় করে ফেলল। ও ঝট করে উঠে বসে বলল,
” মানে? কোথায় আপনি?”
” তোমার বাড়ির পাশের রোডে।”
অনিমা অবাকের শেষ পর্যায়ে চলে গেল। এতো রাতে আদ্রিয়ান চলে এসছে এখানে? যদিও এই পাগলের দ্বারা সব সম্ভব। ও উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
” আপনি দাঁড়ান আমি আসছি।”
আদ্রিয়ান দ্রুত বলে উঠল,
” না, তোমাকে নিচে আসতে হবেনা। আমি থাকতে পারবোনা। এখনই চলে যেতে হবে। একটু ব্যালকনিতে আসবে জানপাখি? জাস্ট দু মিনিট নেব।”
আদ্রিয়ান কথা শেষ করার আগেই অনিমা দৌড়ে ব্যলকনিতে চলে গেল। গিয়ে দেখে সামনের বড় রাস্তাটায় গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে আদ্রিয়ান দাঁড়িয়ে আছে। খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে ওকে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। গায়ের জ্যাকেকটা খুলে হাতে নিয়েছে। পরনে সাদা টিশার্ট। আদ্রিয়ান অনিমার দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বলল,
” উফফ! এতক্ষণে কলিজা একটু হলেও ঠান্ডা হল। তেরাশি ঘন্টা, ছাব্বিশ মিনিট পর তোমাকে দেখলাম। আরেকটু হলে নির্ঘাত মরে যেতাম। বাঁচিয়ে দিলে।”
অনিমা হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আদ্রিয়ানের দিকে। চোখ ছলছল করে উঠছে ওর। ও কাঁপা গলায় বলল,
” পাগল আপনি?”
আদ্রিয়ান মুচকি হেসে বলল,
” অনেক রাত হয়েছে। ঘুমিয়ে পরেছিলে নিশ্চয়ই? যাও রুমে যাও। আর একটু জেগে থেকো প্লিজ। আমি গিয়ে ফোন করব।”
অনিমা কিছু না বলে শুধু তাকিয়ে রইল আদ্রিয়ানের দিকে। আদ্রিয়ান চলে যাওয়ার পর ও ধীরপায়ে নিজের রুমে গিয়ে বসে রইল। প্রচুর ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু ঘুমালে তো চলবে না? আদ্রিয়ান জেগে থাকতে বলেছে তো। প্রায় দেড় ঘন্টা পর আদ্রিয়ানের ফোন এলো। অনিমা সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ করে ফেলল। আদ্রিয়ান ঘুম ঘুম কন্ঠে বলল,
” সরি জানপাখি, খুব ঘুম পাচ্ছে না?”
অনিমা বুঝল আদ্রিয়ান আজ সারাদিনের ব্যস্ততায় খুব ক্লান্ত। তাই বলল,
” আপনি ঘুমিয়ে পরুন। খুব ক্লান্ত লাগছে আপনাকে।”
আদ্রিয়ান আবারও ঘুম ঘুম কন্ঠে বলল,
” তোমার বাবার প্রতি খুব রাগ হচ্ছে আমার। সেদিন ঠিকই বলেছিলাম। একদম বাংলা সিনেমার ভিলেনের মত কাজ করেছে তোমার আব্বু। তুমি জানো আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। মরে যাচ্ছি আমি। এই কটা মাস কীকরে থাকব? আগে জানলে তোমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করে, এক বাচ্চার বাবা হয়ে তারপর ওনাকে আনতাম। তাহলে এই এক্সট্রা প্যারা নিতে হতোনা আমাকে। তোমাকে খুব জ্বালাচ্ছি তাইনা? ঘুমাও জানপাখি। গুড নাইট!”
এরপর ওপাশ থেকে আর কোন কথার আওয়াজ এলোনা। অনিমা বুঝল আদ্রিয়ান ঘুমিয়ে পরেছে। ও কলটা কেটে মন খারাপ করে শুয়ে রইল। কবে পরীক্ষা আসবে আর কবে শেষ হবে? ওর নিজের কষ্টের চেয়েও এই লোকটার কষ্ট যে ওকে বেশি পোড়ায়, বড্ড বেশি পোড়ায়।
#চলবে…
[রি-চেইক করা হয়নি]
#বর্ষণের সেই রাতে- ২
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
৫১.
আদ্রিয়ান আজ বেশ সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠেছে। অনিমা-ই জাগিয়েছে ফোন করে। আজ ও কক্সবাজার যাবে। ওখানে তিনদিন থাকতে হবে। একটা শো আছে ওর। মন মেজাজ প্রচন্ড খারাপ হয়ে আছে ওর। ভেবেছিল আজ গিয়ে অনিমার সাথে দেখা করবে কিন্তু সেটা হল না। শো পরে গেল। যদিও শো-টা আরও পরে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ইমার্জেন্সি কারণে এগিয়ে আনতে হয়েছে। এখন ওর মনে হচ্ছে শুধু ওর শশুর না, পরিস্থিতিও ওদের একসঙ্গে থাকাটা সহ্য করতে পারছেনা। এসবের মানে হয়? আদ্রিয়ান একেবারে রেডি হয়ে ফোনটা বেড় করে কল করল অনিমার নম্বরে। কিন্তু রিসিভ করলেন হাসান কোতয়াল। তিনি বললেন,
” কী জুনিয়র? এতো সকাল সকাল ফোন করলে কিছু বলবে?”
নিজের শশুরের গলা পেয়ে আদ্রিয়ানের অবাক হল। এমনিতে ওর বউটাকে নিয়ে রেখে দিয়েছে। এখন কী ফোনেও কথা বলতে দেবেনা না-কি? তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে একটু ইতস্তত করে বলল,
” না মানে.. মিস্টার সিনিয়র ভালো আছো?”
” হ্যাঁ আমি ভালো আছি। তোমার কী খবর?”
” হ্যাঁ আছি।”
হাসান কোতয়াল কিছু বলছেন না আদ্রিয়ানও কী বলবে বুঝে উঠতে পারছেনা। অনিমার কথা জিজ্ঞেস করতেও ইতস্তত বোধ করছে। কী বলবে বুঝে উঠতে পারছেনা। নিজের বিয়ে ঈর বউয়ের কথা জিজ্ঞেস করতেও কত হেজিটেড করতে হচ্ছে। একেই বলে কপাল। হাসান কোতয়াল বললেন,
” অনিমা শাওয়ার নিতে গেছে।”
আদ্রিয়ান একটু হকচকিয়ে গেল। তারপর কোনরকমে মুখে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে বলল,
” ও আচ্ছা।”
” হুম রাখি তাহলে?”
” হুঁ? হ্যাঁ রাখো।”
আদ্রিয়ান মুখ ফুলিয়ে ফোন রেখে দিলো। হাসান কোতয়াল ফোনের দিকে তাকিয়ে হেসে দিলেন। বেশ ইনজয় করছেন ব্যাপারটা উনি। ওনাকেও পাঁচবছর নিজের মেয়ের থেকে দূরে রেখেছে আদ্রিয়ান। যদিও তার সেটা ইচ্ছাকৃত না। কিন্তু রেখেছে তো? এবার নিজেও একটু বউ ছাড়া কয়েকমাস থাকুক। তাছাড়াও ওনার স্বপ্ন ছিল যে ধুমধাম করে মেয়ের বিয়ে দিয়ে শশুর বাড়ি পাঠাবেন। মেয়ে শশুরবাড়ি থাকলে সেটাতো আর হবেনা। এরমধ্যেই অনিমা চুল মুছতে মুছতে ওয়াসরুম থেকে বেড়িয়ে এসে ওর বাবাকে দেখে বলল,
” আরে আব্বু! তুমি এখন? কিছু লাগবে?”
হাসান কোতয়াল ফোনটা বিছানায় রেখে বলল,
” না। তুমি ভার্সিটি যাচ্ছো আজকে?”
” হ্যাঁ আব্বু যেতে হবে আজ। তোমার মত ফাঁকিবাজ নই আমি।”
হাসান কোতয়াল হেসে দিলেন। কিন্তু মেয়ের দেওয়া অপবাদের প্রতিবাদ না করে তা সাদরে গ্রহণ করে বললেন,
” শোন আজ আমার ফিরতে লেট হবে। এসে খাওয়া-দাওয়া করে নিও। আর ড্রাইভার আমাকে ছেড়ে দিয়ে তারপর তোমাকে ভার্সিটির জন্যে পিক করতে আসবে, ততক্ষণ অপেক্ষা করো।”
” আচ্ছা। খেয়ে যাবেনা?”
” হ্যাঁ চল। একসঙ্গে খাবো। আর হ্যাঁ আদ্রিয়ান ফোন করেছিল কথা বলে তারপর এসো।”
হাসান কোতয়াল বেড়িয়ে যাওয়ার পর অনিমা দ্রুত ফোন বেড় করে আদ্রিয়ানকে ফোন করল। আদ্রিয়ান তখন নিচে নামার জন্য তৈরী হচ্ছিল। অনিমার ফোন পেয়ে সাথেসাথেই রিসিভ করে বলল,
” উফফ, থ্যাংক গড। বেড় হওয়ার আগে তুমি ফোন করলে।”
অনিমা মুখ গোমড়া করে বলল,
” বেড়িয়ে যাচ্ছেন?”
” হ্যাঁ। ওখানে অনেক বিজি থাকবো। সো যোগাযোগ খুব একটা হবেনা।”
অনিমা এবার বেশ বিরক্ত হয়ে বলল,
” এতো এতো কাজ করতে আপনাকে কে বলে বলুন তো? শো এর পর শো লেগেই থাকে। এতো জায়গায় যেতে কে বলে আপনাকে? এতো খেটে হবেটা কী?”
আদ্রিয়ান হেসে বলল,
” আচ্ছা তিনদিন পর চলে আসবো তো!”
অনিমা কিছুই বলল না। আদ্রিয়ান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
” এই! মন খারাপ করলে?”
অনিমা এবারও কোন উত্তর দিলোনা। আদ্রিয়ান একটু হেসে বলল,
” পাগলী! আচ্ছা শোন, সাবধানে থাকবে। একদম ছটফট করবে না। মনে থাকবে?”
” হুম। সাবধানে যাবেন। পৌঁছে ফোন করবেন।”
” যথা আজ্ঞা মহারাণী। বাই।”
অনিমাও মুচকি হেসে বলল,
” বাই।”
ফোনটা রেখে দিয়ে অাদ্রিয়ান নিচে চলে গেল। নিচে গিয়ে দেখে আদিব আর আশিস অলরেডি চলে এসছে। ওরা ডাইনিং টেবিলে বসে আছে। আদ্রিয়ান গিয়ে চেয়ার টেনে বসল। জাবিন পানির জগ রেখে দিয়ে চলে যেতে নিলে আদ্রিয়ান বলল,
” পুটি, অভ্রকে ডেকে দে তো। লেট হয়ে যাচ্ছে। এতক্ষণ কী করছে?”
জাবিন মাথা নেড়ে চলে গেল ডাকতে। অাদ্রিয়ান আদিব আর আশিসের সাথে হালকা-পাতলা কথা বলছে। কিন্তু ও খেয়াল করল যে আশিস মাঝেমাঝেই অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে। আদ্রিয়ান ভ্রু কুচকে বলল,
” তোর কী হয়েছে? হঠাৎ হঠাৎ কোন রাজ্যে চলে যাস?”
আশিস একটু হকচকিয়ে গেল। এরপর কনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে হেসে বলল,
” ক-কই? তেমন কিছুই না। এমনিই।”
আদ্রিয়ান ওর সেই আড়াআড়ি স্টাইলে ভ্রু বাঁকিয়ে কয়েকসেকেন্ড আশিসের দিকে তাকিয়ে থেকে খাওয়ায় মনোযোগ দিল।
জাবিন অভ্রর দরজার কাছে গিয়ে দেখল দরজা পুরোটাই খোলা। আর অভ্র আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করছে। জাবিন একটু গলা ঝেড়ে বলল,
” আসব?”
অভ্র ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে জাবিনকে দেখে বলল,
” হ্যাঁ আসুন।”
জাবিন ভেতরে এসে অভ্রর দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। এরপর বলল,
” ভাইয়া ডাকছে আপনাকে।”
অভ্র জাবিনের দিকে না তাকিয়েই বলল,
” হুম যাচ্ছি।”
জাবিন এবার সত্যি সত্যি একটু বিরক্ত হল। এতো ভাব কীসের এই ছেলের? একটু ফিরেও তাকাতে চায় না। সবার সাথে কত ফ্রি হয়ে কথা বলে। আথচ ওর বেলাতেই পেটে বোমা ফাটালেও কথা বেড় হতে চাইবেনা এরকম ভাব। জাবিনের সাথে দরকার ছাড়া কোন কথা বললেই যেন কেউ ওর গর্দান নিয়ে নেবে। জাবিন বিরক্তি নিয়ে বলল,
” আপনি কী মেয়েদের সাথে কথা বলতে ভয় পান হ্যাঁ? এতো বেশি ভাব কেন আপনার? মানুষই মনে করেন না আমাকে? দু একটা কথা বললে সমস্যা কী? জানেন আমার কাছে একটু পাত্তা পাওয়ার জন্যে কত ছেলে কতকিছু করে? আর আপনি?”
অভ্র ওর ব্যাগটা হাতে নিয়ে জাবিনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
” তোমার পাত্তা পাওয়া ছাড়াও আমার অনেক বেশি ইম্পর্টেন্ট কাজ আছে। সেগুলো করতে হয় আমাকে। এনিওয়ে, বাই।”
অভ্র যেতে নিলেই জাবিন বলল,
” একটু পাত্তা নিয়ে দেখতে পারেন। হতাশ হবেন না।”
অভ্র একটু দাঁড়িয়ে গিয়ে, এরপর চলে গেল। জাবিন বোকার মত দাঁড়িয়ে রইল ওখানে। কী ভাব! তবে এবার ওর রাগ হলোনা। বরং ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। অভ্রর এই এটিটিউট টা ইদানীং ওর ভালোই লাগে।
__________
অনিমা ভার্সিটি থেকে বাড়ি ফিরে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছে এমন সময় হঠাৎই ওর হাত টেনে ধরল অর্ক। অনিমা প্রথমে চমকে গেলেও অর্ককে দেখে মুখে বিরক্তি ফুটে উঠল। ও হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলল,
” হাত ছাড়ো ভাইয়া!”
অর্ক একটু হেসে বলল,
” এতো হাইপার হচ্ছিস কেন? হাতই তো ধরেছি। এরচেয়ে বেশি কিছুতো করিনি।”
অনিমা কিছু না বলে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। অর্ক বলল,
” বাই দা ওয়ে! এখন আর বাচ্চা নেই, বড় হয়ে গেছিস তুই। আগের চেয়ে অনেকটাই __”
অর্কর এরকম বাজে ইঙ্গিতের কথা শুনে অনিমা হাত ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নিল। ঘৃণার দৃষ্টিতে অর্কর দিকে তাকিয়ে বলল,
” কিছু মানুষকে ঝাটা পেটা করলেও শোধরায় না। যেমন তুমি! তখন আর্জু আপুর দিকেও তোমার খারাপ নজর ছিল। আর এখন_ ছিঃ”
” ওও ভালো কথা মনে করেছিস। তোর সেই আর্জু আপু কই রে? খুব মিস করছি।”
” তোমার না জানলেও চলবে।”
বলে অনিমা চলে আসতেই নিলে অর্ক বলল,
” খুব বেশি কথা বলছিস আজকাল? একেবারে আগের ফর্মে ফিরে গেছিস মনে হচ্ছে?”
অনিমা ঘুরে তাকিয়ে বলল,
” হুম। কারণ আগের সবকিছু ফিরে পেয়েছি। আর তার সাথে তো আমার স্বামীকেও পেয়েছি। আমার সবচেয়ে বড় সাপোর্ট। তুমি এখনো ওনাকে তেমনভাবে চেনোই না। উনি যদি কোনভাবে জানতে পারেন যে তুমি আমার হাত ধরেছ। তোমার ঐ হাতটা তোমার সাথে থাকবে কি-না তার গ্যারান্টি দেওয়া মুসকিল। তাই বলছি সাবধান হয়ে যাও। নিজের বিপদ নিজে ডেকে এনোনা। উনি এমনিতে খুব ঠান্ডা স্বভাবের, কিন্তু আমার গায়ে আচড় লাগলে উনি ঠিক কী করতে পারেন, সেটা অনুমান করা খুব কঠিন।”
অর্ক ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে অনিমার দিকে। অনিমা যেতে নিয়েও থেমে গিয়ে বলল,
” আর হ্যাঁ। যতদিন এখানে আছো ভদ্র হয়ে থাক। আব্বু এসব জানলে ঘাড় ধরে বেড় করে দেবে তোমাদের। এতে শেষমেশ ক্ষতিটা তোমাদের-ই।”
অর্ক একটু ঘাবড়ে গেছে বোঝাই যাচ্ছে। অনিমা আর কথা না বাড়িয়ে রুমে চলে গেল। ও এদের নিয়ে খুব একটা ভাবছে না। এদের দৌড় ওর জানা আছে। এরা স্বার্থপর হলেও ভয়ংকর নয়। সব জায়গায় স্বার্থ খুঁজলেও, কারো ক্ষতি করে দেওয়ার সাহস ওদের নেই।
অর্ক ওর বাবা-মার রুমে গিয়ে দেখে তারা অনিমা আর ওর বাবাকে নিয়েই আলোচনা করছেন। আশরাফ মৃধা অর্কর দিকে তাকিয়ে বলল,
” তুই নিশ্চয়ই জানতি যে অনিমাই ঐ রকস্টারের বউ?”
অর্ক স্বাভাবিকভাবে বসে বলল,
” হুম জানতাম তো। তোমরাও জানতে।”
রাহেলা বললেন,
” এইজন্যই কালকে তুই অবাক হসনি? উল্টে সিটি বাজাতে বাজাতে বেড়িয়ে গেলি। আদ্রিয়ানের বউয়ের নাম অনিমা শুনেছিলাম। আমাদের বলিসনি কেন যে এই অনিই সেই অনি ছিল?”
অর্ক ভ্রু কুচকে বলল,
” এইজন্যই তোমাকে বলি সারাদিন সিরিয়াল না দেখে মাঝেমাঝে খবর-টবর দেখ। আর বাবার সাথেতো বিনোদন পৃষ্ঠার জন্মগত শত্রুতা। অর্ধেক জানা থাকলে এমনই হয়। যাই হোক, যেটা বলতে এলাম আরকি। ওদের বেশি না ঘাটিয়ে চুপচাপ থাকো। এবার কিন্তু ঐ রকস্টারও আছে ওদের সাথে। অনির কথায় বুঝলাম ছেলেটা ডেঞ্জারাস। লাগতে গেলে নিজেরই ক্ষতি। তাই কোন ক্যাচাল না করে ভালোভাবে থাকো। এখন এতেই ভালো।”
রাহেলা বললেন,
” হুম সেটাতো বুঝেছি। হাসান ভাই ভালোর ভালো আর খারাপের যম। তাই চুপ থাকাই ভালো হবে।”
__________
মাঝের তিনটা দিন পার হয়ে গেছে। এরমধ্যে আদ্রিয়ানের সাথে খুব কম কথা হয়েছে অনিমার। আদ্রিয়ান-ই বেশ ব্যস্ত ছিল তাই কথা তেমন হয়নি। অনিমার সারাদিন ভার্সিটিতে, বন্ধুদের সাথে, ওর বাবার সাথে সময় কেটে গেলেও রাতের বেলায় ভীষণ মনে পরে আদ্রিয়ানকে। মাঝে একবার রিক আর স্নিগ্ধার সাথে কথা হয়েছিল। আদ্রিয়ানের ক্ষেত্রেও তাই সারাদিনের প্রচন্ড ব্যস্ততায় কেটে যায় কিন্তু রাতটা কাটে শুধু-ই ওর মায়াবিনীর ভাবনায়।
আজকে সারাদিনে আদ্রিয়ান ফোন করেনি। অনিমা ফোন করেছিল কিন্তু বন্ধ ছিল ফোন। সারাদিনে ততটা না ভাবলেও রাতে বেশ চিন্তায় পরে গেছে অনিমা। যদিও কাল সকালে আদ্রিয়ানের ঢাকায় এসে পৌঁছে যাবার কথা তবুও। আদ্রিয়ানকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে কখন ও ঘুমিয়ে পরেছে নিজেই জানেনা। কিন্তু মাঝরাতে ঘুমের মধ্যেই অনিমা অনুভব করল যে কারো গরম নিশ্বাস পরছে ওর মুখের ওপর, আলতো স্পর্শে কেউ ওর গালে, কানে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। অনিমা ঘুমের ঘোরে প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে বুঝতে পেরে ঝট করে চোখ খুলে তাকাল। তাকিয়ে দেখে কেউ ওর ওপরে আধশোয়া হয়ে আছে। আকষ্মিক এমন ঘটনায় ও চেঁচিয়ে উঠতে নিলেই লোকটা ওর মুখ চেপে ধরে বলল,
” আরে ডাফার আমি! মাঝরাতে মান-সম্মানের ফালুদা বানাবে না-কি?”
অনিমা ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। হ্যাঁ এটা আদ্রিয়ান-ই। আদ্রিয়ান হাত সরিয়ে নিতেই অনিমা অবাক হয়ে বলল,
” আপনি? এখানে কীকরে এলেন?”
” সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে, সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে তারপল এলাম।”
” আমি বলতে চাইছি যে বাড়ির ভেতরে কীকরে এলেন?”
আদ্রিয়ান একটু হেসে বলল,
” জামাল চাচা খুলে দিয়েছে। ওনার নম্বর রেখে দিয়েছিলাম।”
” কিন্তু আপনার তো আজ রাতে রওনা দিয়ে কাল সকালে এসে পৌঁছনোর কথা ছিল তাইনা?”
” হ্যাঁ কিন্তু মিস করছিলাম তোমাকে খুব। আজ কোন কাজ ছিলোনা শুধু রাতে একটা পার্টি ছিল। আমি সেটা জয়েন না করে দুপুরের দিকে বেড়িয়ে পরেছি। জানপাখি, কতদিন পর তোমার কাছে আসতে পারলাম আর তুমি প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছো! নট ফেয়ার।”
বলে অনিমাকে নিজের সাথে একদম মিশিয়ে ধরল। অনিমাও এতোদিন পর আদ্রিয়ানের শরীরের উষ্ণতা পেয়ে গুটিয়ে গেল আদ্রিয়ানের বুকে। আদ্রিয়ান অনিমার চুলে আঙুল নাড়তে নাড়তে বলল,
” জানো কতটা মিস করেছি তোমাকে? একশ বাহাত্তর ঘন্টা, মানে দশহাজার তিনশ বাইশ মিনিট, মানে ছয় লক্ষ উনিশ হাজার দুইশ সেকেন্ড পর তোমাকে ছুঁতে পারলাম। মনে হচ্ছে এতোদিন আমার শ্বাস কেউ আটকে রেখে দিয়েছিল। এতক্ষণে শান্তির নিঃশ্বাস নিলাম।”
অনিমাও শক্ত করে আকড়ে ধরল আদ্রিয়ানকে তারপর বলল,
” আমিও খুব মিস করছিলাম আপনাকে।”
” অনেক রাতে হয়েছে। এবার ঘুমাও। কাল সকালে উঠে কথা হবে।”
অনিমা কিছু না বলে আদ্রিয়ানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইল। কতদিন পর আদ্রিয়ানের বুকে মাথা রাখতে পারল। আপাতত একটা শান্তির ঘুম দিতে চায় ও।
____________
সকালবেলা দরজায় টোকা পরাতে অনিমা-আদ্রিয়ান দুজনেরই ঘুম ভাঙল। ওপাশ থেকে হাসান কোতয়াল ডাকছে ওদের। অনিমা দ্রুত আদ্রিয়ানের বুক থেকে উঠে বসে বলল,
” এবার কী হবে? আব্বুকে কী বলব?”
আদ্রিয়ান একটা হাই তুলে উঠে বসে বলল,
” কী হবে? নিজের বউয়ের সাথেই তো ঘুমিয়েছি। কোন ক্রাইম করেছি না-কি?”
” তবুও! আমাদের তো এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে হয়নি। ব্যাপারটা কেমন দেখায় না।”
” কিছুই দেখায় না। তুমি খোল।”
অনিমা উঠে গিয়ে অনেক অস্বস্তি নিয়েই দরজা খুলল। হাসান কোতয়াল বললেন,
” কী ব্যাপার আজ উঠতে এতো দেরী হল যে? খাবে না?”
কথাটা বলতে বলতে ভেতরে এসে আদ্রিয়ানকে দেখে একটু অবাক হলেন। আদ্রিয়ান তখন গেঞ্জি পরছে। ওনাকে দেখে ও মেকী হেসে সালাম দিল। সালামের জবাব দিয়ে উনি বললেন,
” তুমি কখন এলে?”
আদ্রিয়ান খুব স্বাভাবিকভাবে বলল,
” কাল রাতেই এসছি। আসলে বউকে ভীষণ মিস করছিলাম। এক সপ্তাহ হয়ে গেল বউকে ঠিকভাবে দেখতেও পাইনা। তাই কক্সবাজার থেকে সোজা এখানে।”
অনিমা গোল গোল চোখে তাকাল আদ্রিয়ানের দিকে। আদ্রিয়ানের এমন কথায় আর কিছুই বললেন না হাসান কোতয়াল। ওদের ফ্রেশ হয়ে নিচে আসতে বলে চলে গেলেন। আদ্রিয়ান অনিমার দিকে তাকিয়ে চোখ মেরে ওয়াসরুমে চলে গেল। অনিমা শুধু তাকিয়ে রইল বোকার মত।
খাওয়ার টেবিলে অনিমার মামা-মামি আর অর্কর সাথেও পরিচয় করিয়ে দিল আদ্রিয়ানের। ওনারাও হাসিমুখে পরিচিত হলেন। খাওয়ার মাঝে হাসান কোতয়াল আদ্রিয়ানকে বলল,
” তো? কখন যাচ্ছো?”
আদ্রিয়ান অবাক হয়ে বলল,
” মানে?”
” মানে, বাড়ি ফিরবে না? বউকে দেখাতো হয়ে গেছে। এখন যাবে না-কি লাঞ্চ করে যাবে?”
আদ্রিয়ান মুখ ছোট করে বলল,
” লাঞ্চ করে যাই?”
হাসান খেতে খেতে বলল,
” হুম, গুড।’
আদ্রিয়ান কিছু একটা ভেবে হাসান কোতয়ালের দিকে একটু ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলল,
” মিস্টার সিনিয়র? কোনভাবে তুমি আমার ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছো না তো?”
হাসান কোতয়াল ফিসফিসিয়ে একই ভঙ্গিতে বললেন,
” আমি প্রতিশোধ নিতে গেলেতো তোমাকে পাঁচবছর ওয়েট করতে হবে, জুনিয়র। নেবো?”
আদ্রিয়ানের মুখ কাচুমাচু হয়ে গেল। ও একটা শুকনো ঢোক গিলে বলল,
” না থাক। আমি এভাবেই ঠিক আছি।”
#চলবে…
[ রি-চেইক করা হয়নি। ]