#বন্দিনী
#শেষ_পর্ব
#মেহা_মেহনাজ
.
.
.
শাওন সহ উপস্থিত প্রায় সকলেই অবাক চোখে চেয়ে রইলো। ওয়েটিং লাউঞ্জে ছোটোখাটো একটা জটলা বেঁধে গিয়েছে ইতিমধ্যে। অনেক রোগী- যারা হুইল চেয়ারে বসে অপেক্ষা করছিল ডাক্তারের চেম্বারে ঢোকার জন্য, তারাও ব্যথার কাইকুই ভুলে মুখ বাড়িয়ে চেয়ে রইলো। দুইজন ওয়ার্ড বয় এগিয়ে এলো হৈ হৈ করতে করতে।
‘কি হচ্ছে এখানে! এত হট্টগোল কেন?’
পরমুহূর্তেই অফিসারদের দেখে ওরা একটু নত হলো। গলার স্বর নরম করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
‘এনি প্রবলেম? আমাদের বলুন, আমরা হেল্প করছি।’
একজন অফিসার এগিয়ে এলেন।
‘আসামী ধরতে এসেছি।’
‘আসামী!’
ওয়ার্ড বয় দুইজন একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। অফিসার স্মিত হেসে মাথা দোলালেন। শাওনের চাপা গলায় এবার অনুনয়ের সুর বেজে ওঠে। সে বলল,
‘তুমি কি করছো এসব শর্মী? আমার ভুল হয়েছে, আমি মানছি। আমাকে কি মাফ করা যায় না? প্লিজ! আমি হাতজোড় করছি সবার সামনে…’
‘ভুল? কোনটা ভুল আর কোনটা অপরাধ- এইটুকু বোঝার বোধটুকুও নেই দেখছি!’
‘শর্মী প্লিজ..’
‘এটা একটা হাসপাতাল। এখানে বেশিরভাগ মানুষ বিপন্ন পরিস্থিতিতে আছে। তবুও এখানে এসে আমাকে যথেষ্ট নাটক করতে হয়েছে তোমার জন্য৷ আর নাটক চাই না।’
শর্মী ফাইলটা একজন অফিসারের হাতে তুলে দিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। ওর পিছু পিছু শাওন আসতে নিলে দুইজন অফিসার ওর ঘাড়ে শক্ত হাত রাখল। শাওন বুঝল, ওরা ওকে নিয়ে যাবে!
শাওন ভেতরে ভেতরে কেঁপে গেলেও উপর থেকে নিজের দৃঢ় আবরণ বজায় রাখার চেষ্টা করল। গলায় সামান্য কাঠিন্য যোগ করে বলল,
‘আমার ওয়াইফ আমাকে ডিভোর্স দিয়েছে। কিন্তু আমাকে গ্রেফতার কেন করা হচ্ছে! কি অদ্ভুত! ওয়ারেন্ট ছাড়া…’
একজন অফিসার ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল,
‘সেটা থানায় চলুন, সব দেখতে পারবেন। ধরে ধরে বউ কেলানো, না? সব বের করব! মেয়েদের একদম নরম আর দুর্বল পাইছো মিয়া?’
কেউ এগিয়ে এলো না।
শাওনকে একপ্রকার বগলদাবা করে নিয়ে যাওয়া হলো। ফয়সালের দিকে বার কয়েক তাকিয়েও লাভ হলো না। ফয়সাল সরে দাঁড়াল একদম পেছনে…কেন যেন সেও মারাত্মক ভয় পেয়ে গেছে। ওরা চলে যেতেই শর্মী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চিত্রা এগিয়ে এলো এই পর্যায়ে…
‘আপনি ঠিক আছেন?’
শর্মী শুকনো মুখখানা উপর-নিচ দোলালো,
‘হুম।’
‘বসুন।’
একটা চেয়ার দেখিয়ে বলল চিত্রা। শর্মী চুপচাপ বসেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
‘জোনাকির কি অবস্থা?’
‘এখনো ভেতর থেকে কেউ বের হয়নি। তাই জানিও না!’
ওরা দু’জনেই এরপর বেশ অনেকক্ষণ নিরব হয়ে রইলো। মা একটু পর পর থেমে থেমে কাঁদছেন। চিত্রা বিরক্ত মুখে সেদিকে তাকাতেই শর্মী বলে উঠল,
‘মায়ের মন! আপনি আমি বুঝব না। আমাদের উপর দিয়ে যা যাচ্ছে, এর চাইতে শতগুণ বেশি যাচ্ছে তার উপর দিয়ে।’
চিত্রা আর কিছু বলল না। একবার চোখ ঘুরিয়ে ফয়সালকে খুঁজল, সে নেই। কোথায় হাওয়া হয়েছে কে জানে! নাকি তার সাগরিদ শাওনের কাছে ছুটে গেছে ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করতে, কে জানে! যা মন চায় করুক, মরুক ও! চিত্রার আর কিচ্ছু যায় আসে না। অন্যের বাড়িতে খেটে খাবে, তবুও মানসিক শান্তিতে থাকবে৷ কারো পায়ের তলায় প্রতিমুহূর্তে পিষে ম*রবে না…
শর্মী ডাকল,
‘কি ভাবছেন?’
চিত্রা তাকাল,
‘না, কিছু না।’
‘ভাববেন না, জোনাকি সুস্থ হয়ে উঠবে।’
‘ওর বাঁচাটাই…’
‘অমন বলবেন না। ওর মনের জোর অনেক! যে নিজের জীবন দিয়ে দেয় আরেকজনের ভালো করতে, তার মনের জোর কম নয়!’
শর্মীর কথার অর্থ না বুঝতে পেরে তাকাল চিত্রা।
শর্মীই বলল,
‘শাওনের সঙ্গে আমার বিবাহিত জীবন প্রায় পাঁচ বছরের। আমি ভালোবাসা ছাড়া তাকে কিচ্ছু দেইনি। সে অবহেলা ছাড়া আর কিচ্ছু দেয়নি! তারপরও আমি মেনে নিয়ে চলছিলাম। কিন্তু এই পৃথিবীতে এমন কি কোনো নারী আছে যে নিজের ভালোবাসার ভাগ আরেকজন কে দেবে? যখন শুনলাম শাওন দ্বিতীয় বিয়ে করতে চাচ্ছে, আমি ঠিক থাকতে পারিনি। ভেবেছিলাম, জোনাকির নিশ্চয়ই হাত আছে। সব জেনেই সে শাওনকে আমার থেকে কেড়ে নিচ্ছে। তাই অনেক কষ্ট করে শাওনের ফোন থেকে লুকিয়ে ওর নাম্বার টা নেই এবং যোগাযোগ করে দেখা করি। তখন তাকে উল্টাপাল্টা অনেক কিছু বললেও পরে আস্তে আস্তে বুঝেছি, আসলে জোনাকির এখানে কোনো দোষ নেই। সবকিছুর নষ্টের মূল শাওন নিজেই! তাই অহেতুক একটা মেয়েকে দোষারোপ করে কি করব? স্বামীই যেখানে ভালো না… আমি তাই মেনে নিয়েছিলাম। ভাবলাম, আসুক, বিয়ে করে আনুক, সংসার করুক, ভালো থাকুক, আমি আমার সবটুকু দুঃখ নিয়ে খারাপই থাকবো নাহয়! কিন্তু আজ সকালে যখন দেখলাম, শাওন বাড়ি ফিরে আমাকে জহুরি ভাবে প্রশ্ন করল, আমার কেমন যেন খটকা লাগল। মনে হলো,অবশ্যই কিছু একটা হয়েছে। নইলে ওর এমন আচরণ করার কথা না। গোসলের সময় কেউ একজন কল করেছিল ওকে। তখন কথা শুনলাম শাওনের, জোনাকি সু*ইসাইড করেছে। শাওন একবারও জিজ্ঞেস করল না, ও বাঁচবে কীনা! বারবার ভয় পাচ্ছিল, পুলিশ কেস না হয়ে যায়। ঠিক তখনই আমি বুঝে যাই, জোনাকি ওর মোহ, ভালোবাসা নয়! আমার মতো আরও একটা মেয়ের জীবন নষ্ট হতে চলেছে। আর টিকতে পারলাম না এরপর। শাওন বেরোনোর পর অনেক ভেবে আমি এই স্টেপ নিয়ে নিলাম। আমাদের বিল্ডিং-এই একজন উকিল থাকেন। উনি অনেক আগে থেকেই আমার সাংসারিক জীবন সম্পর্কে জানতেন। তিনি আমাকে হেল্প করলেন। তারপর এইতো!’
শর্মী থামলো। এক দমে অনেক গুলো কথা বলার কারণে ও হাঁপিয়ে গেছেন। মা হা করে সবটা শুনছিলেন। এতক্ষণে উনি বুঝলেন, কেন শাওন কে বিয়ে করতে চাচ্ছিল না জোনাকি! কোথাও না কোথাও, প্রমাণ না পাওয়া সত্ত্বেও জোনাকির অবচেতন মন বারবার ভয় পাচ্ছিল, সত্যিই না কারো সংসার ভাঙার কারণ হিসেবে ওকে সমাজে বেঁচে থাকতে হয় একদিন! এতবড় লজ্জিত অন্যায়ের চেয়ে ওর কাছে মৃত্যু সহজ মনে হয়েছে। তাই নিজেকে বলি দিতে ভাবেনি খুব একটা..
শর্মী পুনরায় বলতে শুরু করল,
‘একটা মেয়ে আমার জন্য নিজেকে শেষ করে দেওয়ার কথা ভাবল, আর আমি ওর জন্য কিচ্ছু করব না? আমার মনুষ্যত্ব কোথায় তাহলে? তাই সব শেষ করে লম্পট টাকে পুলিশে দিয়ে দিলাম। এবার কেস হবে। কেস লড়বো আমি। তাতে যত বাঁধা আসে আসুক। শুধু জোনাকি না, ও যেন আর কোনো মেয়ের জীবন নষ্ট করার কথা চিন্তাও না করতে পারে, সেই ব্যবস্থা করব। দুনিয়ার সামনে ওর আসল মুখোশ খুলে দিবো।’
চিত্রা ছলছল চোখে শর্মীর কাঁধে একটি হাত রাখল,
‘সব নারী তোমার পাশে আছে শর্মী!’
মা এগিয়ে এসে শর্মীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে গিয়ে কেঁদে ফেললেন। শর্মী উঠে দাঁড়াল। এমন মুহূর্তে কেবিনের ভেতর থেকে ডাক্তার বেরোলেন। তিনজনই চোখের জল মুছে এগিয়ে গেল।
ডাক্তার বললেন,
‘গুড লাক ফর হার। এবারের যাত্রায় আশা করি বেঁচে যাবেন উনি। সুস্থ হতে দীর্ঘ দিন সময় লাগবে। শরীরের বাম অংশের নার্ভ সিস্টেমে বেশি চোট লাগায় হয়তো আংশিক প্যারালাইজড হতে পারেন। তবে নিয়মিত ব্যায়াম এবং ট্রিটমেন্ট উনাকে একদিন সুস্থ করে দিবেন ইনশা আল্লাহ।’
‘আমি কি একবার ওকে দেখতে পারি ডাক্তার সাহেব?’
‘একজন আসুন!’
শর্মীই গেল সবার প্রথমে।
বিছানাবন্দী জোনাকি, মুখটা শুকিয়ে এইটুকুন হয়ে গেছে। ঠোঁটের এক পাশ ব্যান্ডেজ, মাথা ব্যান্ডেজ, হাতের কিছু জায়গায় ব্যান্ডেজ। শর্মীর বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। ও ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে নেতিয়ে থাকা একটা হাত তুলে নিলো নিজের মুঠোয়। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। এরপর ভীষণ আস্তে আস্তে, যেন জোনাকি শুনছে- এমন ভঙ্গিতে বলল,
‘আমরা সবাই বন্দী! কেউ সম্পর্কের জালে বন্দী, কেউ কোনো দায়িত্বের শিকড়ে বন্দী। কেউবা ওয়াদা দিয়ে বন্দী। কোথাও না কোথাও, কোনো না কোনো ভাবে আমরা সবাই একটা বন্দীদশায় বসবাস করি। এই জন্যেই আমাদের এত আফসোস, এত হতাশা! যদি জীবনটাকে খোলা পাখির মতো যাপন করতে পারতাম, তবে বুঝি বুকে আর আফসোস রইতো না। জোনাকি, দ্রুত সুস্থ হও। তুমি আমি- আমরা- আমরা পাখি হবো! এতবড় আকাশে আর দুটো পাখি বাড়তি উড়ার চেষ্টা করলে ক্ষতি কি?’
(সমাপ্ত)