#বন্দিনী
#পর্ব_৩
#মেহা_মেহনাজ
.
.
.
জোনাকির মন মেজাজ ভালো। বাহির থেকে এসেই শাওয়ার নিয়ে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে নিজেকে পরিপাটি করল। সময়টা সন্ধ্যের পর। এই সময়ে এক কাপ চা খাওয়া ওর দীর্ঘদিনের অভ্যেস। বরাবরই নিজের চা নিজে বানিয়ে খেলেও আজ মা-ই এলো ঘরে।
জোনাকি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। মা’কে ঢুকতে দেখে পেছন ফিরে মিষ্টি করে হাসল।
‘তুমি এলে কেন! আমিই বানাতে যেতাম।’
মা চায়ের কাপটা বাড়িয়ে দিলেন।
‘মন ভালো লাগছে তোর?’
‘হ্যাঁ!’
‘শাওনের সঙ্গে সব ঠিকঠাক?’
জোনাকি উত্তরে হাসি ছুঁড়ে দিয়ে চায়ে চুমুক দিলো।
‘চিনি ক’চামচ দিয়েছো বলো তো!’
‘তুই যদ্দুর খাস। দু চা’মচ।’
‘তবুও মিষ্টি আজ বেশি লাগছে মা।’
‘মন ভালো থাকলে সব বেশি বেশি ভালো লাগে।’
জোনাকি পুনরায় জবাবের বদলে হাসল। তারপর বলল,
‘মা এসো, বসো। তোমাকে একটা কথা বলি।’
মা বসলেন, জোনাকি কাপ রেখে দিলো। তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখ রেখেই বলল,
‘মা, আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর এটা তুমি দুলাভাইকে জানিয়ে দিবে। এবং এই বিষয়ে উনি যেন আমার কাছে কোনোপ্রকার কৈফিয়ত চাইতে না আসে, সেই দিকেও লক্ষ্য রাখবে। কেমন?’
মা ভ্রু কুঁচকালেন।
‘হেয়ালি করিস না। কিসের সিদ্ধান্ত?’
‘আমার বিয়ে বিষয়ক।’
‘বল?’
‘মা, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি এই বিয়েটা করব না!’
মা স্তব্ধ হয়ে গেলেন সঙ্গে সঙ্গে। যেন শুনতে পাননি এমন ভঙ্গি করে বললেন,
‘হ্যাঁ, কি বললি?’
‘বললাম, আমি এই বিয়েটা করব না। এবার শুনেছ? নাকি আরেকবার বলব?’
‘বিয়ে করবি না মানে! কিছু হয়েছে? শাওন কিছু বলেছে? আমাকে বল..’
‘কিচ্ছু হয়নি মা। এটা আমার একার সিদ্ধান্ত।’
‘ফট করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেই হয় বুঝি? কিছু না হলে তুই কেন বিয়ে করবি না?’
‘বললাম তো মা কিচ্ছুটি হয়নি। আমার ভালো লাগছে না তাই বিয়ে করব না।’
‘ভালো না লাগার কি আছে? ওমন রাজপুত্রের মতো দেখতে, ভালো চাকরি করে, বেতনটাও নিশ্চয়ই ভালো।’
‘ওখানেই তো সমস্যা মা। রাজপুত্র দেখেই বিয়ে করব না।’
‘একটা চড় দেবো। আমি তোর কথার আগামাথা কিচ্ছু বুঝছি না জনু!’
‘মা…’
জোনাকি মায়ের দু’খানা হাত চেপে ধরল শক্ত করে।
‘মা আমি সাধারণ মানুষ। আমার সাধারণ একজনই জীবন সঙ্গী হিসেবে চাই। কোনো রাজপুত্রের প্রয়োজন নেই। অতিরিক্ত মিষ্টি আমার সহ্য হয় না, জানো নিশ্চয়ই।’
‘জোনাকি এটা জীবন! জীবন নিয়ে ছেলেখেলা করিস না। ওর সাথে বিয়েটা হলে তুই খুব ভালো থাকবি। ও তোকে খুব পছন্দ করে।’
‘পছন্দ করে বলেই আমি তার সাথে খুব ভালো থাকবো এমন একটা গ্যারান্টি তুমি কোথায় পেয়েছো আমাকে দেখাও!’
‘জনু…’
‘মা! প্লিজ আর কথা না। আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি এবং এটাই ফাইনাল। দুলাভাইকে যা বলার বলে দিও। আমি তার ঘ্যানঘ্যানানি সহ্য করতে পারব না।’
মা শক্ত কণ্ঠে বললেন,
‘তোর কি কাউকে পছন্দ রে? কই, আমাকে তো কোনোদিন কিছু বলিসনি!’
জোনাকির ঠোঁটের হাসি দীর্ঘ হলো।
‘জানতাম তুমি এমনটাই বলবে। না মা, আমার কাউকে পছন্দ নেই, আমার কোনো লুকোনো প্রেম নেই। আমি যখন যা করেছি, সব তোমাকে জানিয়েছি এবং জানাবো আগামীতেও। আমি শুধু এইটুকু বলতে চাইছি আমি এক্ষুনি কোনো বিয়েশাদিতে যেতে চাই না তাতে যত সুপাত্র আসুক! আর হ্যাঁ, আমি একটা চাকরি খোঁজার চেষ্টা করছি।’
‘তোর মাথাটা সত্যি গেছে জোনাকি। তোর ভাইয়া জানলে…’
‘কিচ্ছু বলার সাহস করবে না যদি না আমি-তুমি তাকে সুযোগ দেই! আমরা আমাদের জীবনে তাকে হস্তক্ষেপ করার রাস্তা তৈরি করে দিয়েছি বলেই…’
‘এসব তুই কি বলছিস! ছেলেটা আমাদের জন্য কি না করেছে? তুই সব ভুলে গেছিস?’
‘না মা, ভুলে যাইনি। কতটা ভালো করেছে আর কতটা খারাপ, আমার সব মনে আছে। একদম অক্ষরে অক্ষরে মনে আছে। আর মা কাউকে সাহায্য করা মানে তার জীবনের দখলদারি করা নয়!’
মা উঠে দাঁড়ালেন।
‘আমি কাউকে কিচ্ছু বলতে পারব না। তোর যার যাকে যা বলার বলে দিস।’
মা চলে গেলে জোনাকি ছোট্ট একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। জীবনের অলিগলি কত গভীর!
★
শর্মীর ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছে। সেই গতকাল খেয়েছিল দুপুরের দিকে, এখন প্রায় সন্ধ্যে, এর ভেতর পেটে কিচ্ছুটি পড়েনি। কিন্তু বেডরুমের দরজা বাহির থেকে বন্ধ। শাওন না চাওয়া পর্যন্ত এই ঘর থেকে শর্মী বেরোতে পারবে না৷ ঘরে কোনো খাবারও নেই। শর্মী দুর্বল পায়ে উঠে বেড সাইড টেবিলে থাকা পানি খেলো। এরপর কি ভেবে যেন একবার দরজার কাছে গিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করতেই সেটি খুলে গেল। এর মানে শাওন লাগিয়ে রেখে যায়নি! শর্মী দ্রুততার সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে এলো। আশেপাশে তাকিয়ে কোত্থাও শাওন কে দেখতে না পেয়ে তার শিরদাঁড়া বেয়ে কিছু একটার শিহরণ বয়ে চলল। শর্মী চপল পায়ে মেইন ডোরের দিকে এগোতেই কিচেন থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
‘কোথায় যাওয়া হচ্ছে?’
শর্মী ঝটপট থমকে দাঁড়াল। ভয়ার্ত চোখে পেছন ফিরে দেখল, কিচেনের দরজায় আয়েশী ভঙ্গিতে শাওন হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে, তার ঠোঁট জুড়ে কটাক্ষের হাসি। শর্মী মিনমিনে স্বরে বলতে লাগল,
‘ন..না না, ক…কোথায় যা…ব? মেইন ডোর খোলা না বন্ধ তা দেখতে…তুমি তো আ..আমাকে আঁটকে রেখে যাও…’
‘তাই বুঝি?’
শর্মী ঘাড় কাত করল। ওর দিকে হাসিমুখে এগিয়ে এলো শাওন। এক হাত গলিয়ে শর্মীর কোমরখানা চেপে ধরতেই ও শিউরে উঠল। শাওনের নখের আঁচড় সুগভীর হয়ে কেটে বসছে চামড়ার উপর। লাগছে খুব। শর্মী দাঁতে দাঁত পিষে ব্যথা সহ্য করে শাওনের দিকে তাকাল। শাওন মুখখানা নামিয়ে শর্মীর কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল,
‘আমার জোনাকপোকা এ বাড়িতে না এলে আমি বাড়ি সহ তোমাকে উড়িয়ে দিবো। তুমি নিশ্চয়ই জানো, আমি এক কথার মানুষ।’
শর্মী স্তব্ধ হয়ে শুনল, কিচ্ছুটি বলতে পারল না। শাওন ওকে ধপ করে ছেড়ে দিয়ে যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিমায় স্বাভাবিক কণ্ঠে জানতে চাইলো,
‘ক্ষিদে লেগেছে?’
ক্ষিদেটা ম*রে গেছে। তবুও শর্মী হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।
‘বসো টেবিলে। ম্যাগী করেছি। চলবে?’
শর্মী পুনরায় হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। ওর মুখে জবাব নেই। অবশ্য যা হচ্ছে তাতে জবাব বেরোনোর কথাও নয়। শাওন পুনরায় কিচেনের দিকে পা বাড়ালো।
★
বোমা ফাটলো রাত্রিবেলা। আজ একটু দেড়ি করেই খেতে বসেছে জোনাকি। সবে এক লোকমা মুখে তুলেছে ওমনি ফয়সাল এসে ওর পাশের চেয়ারটা টেনে খাবার প্লেট সামনে থেকে সরিয়ে নিলো। জোনাকি অগ্নি চোখে ফয়সালের দিকে তাকাতেই ফয়সাল গাঁকগাঁক করে চেঁচিয়ে উঠল।
‘কি? চোখ দিয়ে খেয়ে ফেলবি? খেয়ে ফেল। খেয়ে শান্ত হ। আমাকে আর এত অশান্তি দিস না।’
জোনাকি শান্ত সুরে বলল,
‘আমি তোমাকে কিভাবে অশান্তি দিলাম!’
‘তা নয়তো কি? আমি এত কষ্ট করে একটা সুপাত্র আনলাম তোর জন্য আর তুই কিনা বিয়ে করবি না বলছিস। কেন রে? আমাদের জ্বালা যন্ত্রণা আর না বাড়ালে চলছে না?’
‘আমাকে নিয়ে এত জ্বালা হলে ভেবো না। আমাকে আমার মতো ছেড়ে দাও।’
‘খুব সহজ? তোর আপা পরে আমার কান ঝালাপালা করে ছাড়বে। আমাকে একটা প্রশ্নের উত্তর দে, তোকে কি সুখে থাকতে ভূতে কামড়াচ্ছে?’
‘আমাকে কেউ কামড়াচ্ছে না। ভাইয়া, জীবন সেহেতু আমার, সেহেতু সব সিদ্ধান্ত নেওয়াও আমার একান্ত ব্যক্তিগত হওয়া উচিত!’
ফয়সাল চোখ বড় বড় করে তাকাল,
‘এখন ব্যক্তিগত ব্যাপারও বুঝিস!’
‘এই বিষয়টা নিয়ে আমাকে জোরাজুরি করো না। এটাই আমার একমাত্র সিদ্ধান্ত।’
জোনাকি উঠে যাচ্ছিল, ফয়সাল ওকে থামিয়ে দিলো।
‘তাহলে আমারও একমাত্র সিদ্ধান্ত শুনে যা। তুই যদি এই বিয়েটা না করিস তাহলে এই বিয়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও একটা সম্পর্ক ভাঙবে। সেটা তোর আপার সাথে আমার সম্পর্ক। এমনিতেই দিনের পর দিন একটা বাঞ্জা মহিলাকে নিয়ে সংসার করতে করতে আমি ক্লান্ত! এখন এই ছুতোয় আমিও তাহলে মুক্তি নেই…’
‘ভাইয়া!’
‘শুনেছিস নিশ্চয়ই যা বলেছি। এবার সিদ্ধান্ত নে বসে বসে। আমি ওকে ছেড়ে দিলে চিত্রার আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। সি লাভ মি, ম্যাডলি… ইউ নো দ্যাট?’
জোনাকি হা মুখ করে তাকিয়ে রইলো। এরকম একটা কথা কি করে বলতে পারল ফয়সাল? আপার সাথে উনার বিয়েটা প্রেমের বিবাহ ছিল! কত ভালো ভালো ঘর ফিরিয়ে দিয়েছিল আপা! কত মা*র খেয়েও, কত দুঃসময় পার করেও ভাইয়ার জন্য অপেক্ষা করে গেল! সেই ভাইয়া আজ এমন একটা কথা বলে ফেলল! আপা তো ইচ্ছে করে মা হওয়ার যোগ্যতা হারায়নি। একটা রোগে…
জোনাকির বুক ফেটে কান্নারা উথলে উঠে। মানুষের রূপ এত বৈচিত্র্যময় কেন? ফয়সাল সালাদের বোল থেকে এক স্লাইস শসা খেতে খেতে উঠে দাঁড়াল।
‘আমি চললাম। কাল আবার আসব। সিদ্ধান্ত পাল্টালে ভালো, নইলে ডিভোর্সের কাগজ করতে আমার এক সপ্তাহও লাগবে না। মনে রাখিস।’
(চলবে)