বন্দিনী পর্ব-০২

0
918

#বন্দিনী
#পর্ব_২
#মেহা_মেহনাজ
.
.
.
মেইন গেইটে দাঁড়িয়ে আছে জোনাকি। হাতঘড়িটায় সময় জানান দিচ্ছে, দুইটা বেজে বত্রিশ মিনিট। জোনাকি আরেকবার হাতঘড়িটা দেখল। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফোঁটা। বেশ গরম পড়েছে। এই গরমে শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে থাকা কষ্টকর। একটু একটু রাগ হচ্ছে তার। শাওন সেই কখন ম্যাসেজ করে জানাল, নিচে নামো। জোনাকিও এসে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু শাওনের দেখা নেই। জোনাকি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এমনই সময় কালো গাড়িটা এলো, একদম শাঁই করে, সামনে এসে ঝট করে থেমে গেল। কালো কাঁচ আস্তে আস্তে নামতেই শাওনের হাসি হাসি অপরাধী মুখখানা উঁকি দেয়। শাওন বলল,

‘বেশি দেড়ি করে ফেলেছি?’

জোনাকি মনে মনে একটা ভয়ানক গালি দিলেও বাহির থেকে রইলো নিশ্চুপ। শাওন উত্তর না পেয়ে অল্প একটু হাসল। ডোর আনলক করতে করতে বলল,

‘উঠে এসো।’

জোনাকি বিনাবাক্য ব্যয়ে চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসল। শাওন ড্রাইভ করা শুরু করল।
পরিবেশ ভারী, নিস্তব্ধ। জোনাকি কিচ্ছুটি বলছে না। এদিক ওদিক তাকাচ্ছেও না। কেমন জড়সড় হয়ে কপাল ভাঁজ করে সামনে তাকিয়ে আছে। যেন এই মুহূর্তে সামনে রাস্তায় বড় গুরুত্বপূর্ণ জিনিস দেখানো হচ্ছে। শাওন ঠোঁটের হাসি দীর্ঘ করে নিজেই নিরবতা ভাঙতে বলে উঠল,

‘ম্যাডাম কি রাগ করেছেন?’

জোনাকি এই প্রশ্নের ধার দিয়েও গেল না। বরং প্রশ্নের জবাবে সে পালটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো তৎক্ষনাৎ। সন্দিহান গলায় জানতে চাইলো,

‘আপনার বেতন কত?’

‘হ্যাঁ?’

‘আপনার বেতন…কত?’

শাওন ভ্রু কুঁচকে হাসি হাসি মুখ করে উত্তর জানালো,

‘ম্যাডামের সব ধরনের আবদার পূরণ করতে যথেষ্ট।’

জোনাকি শক্ত কণ্ঠে বলল,

‘হেয়ালি করবেন না। আপনার বেতন কত?’

‘আশি হাজার।’

জোনাকি এক মুহূর্ত চুপ করে কিছু একটার হিসেব মেলাতে লাগল। তারপর পুনরায় জানতে চাইলো,

‘এই গাড়িটা আপনার কত বছরের সেভিংস দিয়ে কিনেছেন?’

শাওন ওর ইশারা বুঝতে পেরে এবার হেসেই ফেলল খটখট করে।

‘আমার সেভিংস দিয়েই কিনেছি, এই কথা কে বলল?’

‘তবে?’

শাওন এক চোখ চেপে বলল,

‘ধরে নাও শ্বশুর বাড়ি থেকে দিয়েছে।’

জোনাকি গলায় কাঠিন্য যোগ করে বলে উঠল,

‘এর মানে আপনি বিবাহিত!’

‘তুমি মজাও বোঝো না! কেমন সিরিয়াস হয়ে গেলে। বিবাহিত হলে তোমাকে বিয়ে করতে চাইবো কেন? আমি কি চরিত্রহীন নাকি?’

‘আপনি খুব সাধু পুরুষ?’

‘একদম! আমার মতো ইনোসেন্ট ছেলে একটাও নেই। যদি খুঁজে এনে দেখাতে পারো, এই গাড়ি তোমার নামে লিখে দিবো, বাজি?’

জোনাকি মুখ বেঁকিয়ে বলল,

‘আপনি আমাকে একটা কথার সত্যি সত্যি উত্তর দিবেন?’

ঝট করে হার্ড ব্রেক কষলো শাওন। জোনাকি আরেকটু হলে সামনে বারি খাচ্ছিল। নিজেকে ধাতস্থ করে সে খিটমিট চোখে শাওনের দিকে তাকাতেই শাওন সাবধানী কণ্ঠে বলে উঠল,

‘রেস্টুরেন্ট পার করে যাচ্ছিলাম কথায় কথায়। আর সিটবেল্ট না বাঁধলে সেটা নিশ্চয়ই আমার দোষ না!’

জোনাকি বাইরে তাকাল। ওরা একটা রেস্টুরেন্টের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। নামতে হবে। আসল কথার সময় যত ঝামেলা! জোনাকি কিচ্ছুটি না বলে গাড়ি থেকে দ্রুততার সঙ্গে নেমে দাঁড়াল।

‘কি খাবে?’

প্রশ্ন করল শাওন। জোনাকি পাশ ফিরে জানালার কাঁচ ভেদ করে ব্যস্ত শহরের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘কিছু না।’

‘তবে এলে কেন?’

শাওনের কণ্ঠ এবার খানিকটা রুক্ষ শোনালো। জোনাকি ওর দিকে তাকাল তাই। উত্তর দেওয়ার আগে শাওন নিজের শক্ত খোলস ছুঁড়ে ফেলে নরম কণ্ঠে বলে উঠল পুনরায়,

‘আমায় দেখতে এলে বুঝি? তা আমায় দেখলে পেট ভরবে ম্যাডামের? আমার কিন্তু তোমায় দেখলে একদম পেট ভরবে না। বড্ড ক্ষিদে পেয়েছে। সাদা ভাত অর্ডার করি? খাসীর মাংস দিয়ে? আর বিশ রকমের ভর্তা। এ জায়গাটা ভর্তার জন্য স্পেশাল। এখানের আরেকটা স্পেশালিটি কি জানো? ওরা খাবার সার্ভ করে কলাপাতায় করে। কলাপাতায় খেয়েছো কখনো? কি দারুণ যে লাগে..’

‘আপনি এক মিনিট চুপ করবেন?’

শাওন থতমত খেয়ে হাসল।

‘আচ্ছা, করলাম চুপ। ম্যাডাম কি বলতে চায়, শুনি..’

জোনাকি ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলল। ওর সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে। শাওন কে দেখে মনেই হয় না, এই ছেলে ঠগবাজ ক্যাটাগরির হতে পারে! হতে পারে, ওই মেয়েটাই ঠগ.. শাওনকে পছন্দ করে। শাওন তাকে না চেয়ে জোনাকিকে বিয়ে করতে চেয়েছে শুনে এসে উল্টাপাল্টা অনেক কথা বলে দিয়েছে গুবলেট করার জন্য! কেন যেন জোনাকি মনে মনে প্রার্থনা করে এমনটাই যেন হয়। কিন্তু কেন করে ও এরম দোয়া? তবে কি ওর মনের কোথাও না কোথাও মানুষ টা জায়গা করে নিয়েছে? এত দ্রুত কাউকে হৃদয়ে জায়গা দেওয়া সম্ভব?

হঠাৎ চুটকির শব্দে জোনাকির ধ্যান ভাঙলো। শাওন এক ভ্রু নাচিয়ে বলে উঠল,

‘কি ম্যাডাম? ওমন ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে কি দেখছেন? আর কিইবা ভাবছেন বলুন দেখি। আমার কিন্তু লজ্জা লজ্জা লাগছে।’

কথা শেষ করে শাওন এমন ভঙ্গিমা করল, জোনাকির হাসি পেয়ে গেল। এক চিলতে হাসি ঠোঁট ছিটকে বেরিয়েও এলো। শাওন সঙ্গে সঙ্গে বলল,

‘এত সুন্দর হাসিটাকে লুকিয়ে রাখো কেন?’

জোনাকি চুপ হয়ে গেল। না, মানুষটার সঙ্গে একটা সুন্দর সম্পর্ক ওর হতে পারে, যদি ওই মেয়েটার বলা সব কথা মিথ্যে হয়। আর যদি সত্যি হয় তবে…জোনাকি ভেবে পায় না!

পুনরায় জোনাকিকে ভাবনার সমুদ্রে ডুবে যেতে দেখে শাওন খানিক সিরিয়াস হলো। হাত বাড়িয়ে জোনাকির একটা হাত বিনা অনুমতিতে ধরে ফেলল, যেন কত জনম ধরে ওরা একে অপরের পরিচিত, কাছাকাছি! জোনাকি শিউরে ওঠে ভাবনার জগত থেকে ছিটকে পড়ল।

শাওন বলল,

‘তুমি কি নিয়ে ভাবছো এত? বলো দেখি! সেই আসা থেকে দেখছি, তুমি চুপচাপ।’

জোনাকি মৃদু স্বরে বলল,

‘আমি কি খুব বেশি চঞ্চল নাকি?’

‘তা না, কিন্তু এতোটাও গম্ভীর নও! কিছু একটা যে হয়েছে তা আমি একশোতে একশো শিউর। এখন চট করে বলে ফেলো ঘটনা কি।’

‘না বললে?’

‘না শোনা অবধি তোমায় ছাড়ছি না।’

শাওনের হাতের মুঠোয় থাকা জোনাকির হাতটা আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে রইলো ও। জোনাকি গুমোট কণ্ঠে বলতে শুরু করল তাই,

‘আজ সকালে আমি একটু বেরিয়েছিলাম।’

‘আচ্ছা, তারপর?’

‘একজনের সঙ্গে দেখা করতে।’

‘কে?’

‘শর্মী।’

এইটুকু বলে শাওনের দিকে সরু দৃষ্টিপাত করল জোনাকি। দেখল নামটা শোনামাত্র ওর কপালে ঈষৎ ভাঁজ পড়তে শুরু করে দিয়েছে। জোনাকির বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় কেটে উঠল।

‘গতকাল মাঝরাতে আমায় ম্যাসেজ দিয়েছিল মেয়েটা। খুব আর্জেন্ট দেখা করতে চায়। পরে সকালে আমি নাম্বারে কল করি এবং মেয়েটার রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করে দেখা করে আসি।’

‘মেয়েটা কে? তোমার পরিচিত?’

জোনাকি আকাশ থেকে পড়ল এইবার। উত্তেজিত হয়ে শাওনের হাত থেকে নিজের হাতখানা ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলল,

‘আপনার পরিচিত কেউ নয়?’

শাওন ঠোঁট কামড়ে এদিক ওদিক মাথা নাড়লো,

‘না তো! নামটাই তো প্রথম শুনলাম।’

‘মিথ্যে বলছেন? প্লিজ সত্যিটা বলুন! ও কিন্তু আমাকে সব বলে দিয়েছে।’

‘অদ্ভুত! মিথ্যে বলতে যাব কেন? আর কি বলেছে শুনি?’

‘বলেছে যে আপনি ওর…ওর হাজবেন্ড! আপনি ম্যারিড। কিন্তু আমাকে দেখার পর আপনি পাগল হয়ে গেছেন। আমাকেও বিয়ে করতে চাচ্ছেন। ও আমাকে স্বাগতম জানিয়ে গেছে ওর সংসারে। আর বলেছে, আমাকে কোনোদিন ক্ষমা করবে না।’

‘হোয়াট!’

শাওনের ভ্রু যুগল অদ্ভুত রকম কুঁচকে গেল।

‘হোয়াট রাবিশ! এইগুলো কোন ধরনের কথা! একটা মেয়ে যাকে আমি চিনি না, জানি না, নামই শুনলাম প্রথম, সে এসব কেন বলতে যাবে?’

‘আমি কিভাবে বলব? আপনার ব্যাপারে বলেছে, আপনিই নিশ্চয়ই ভালো জানেন।’

‘ওর ছবি টবি আছে? দেখলে হয়তো চিনতে পারতাম!’

‘নেই।’

‘ঠিকানা?’

‘জানি না!’

‘নাম্বার?’

জোনাকি দ্রুত নিজের ফোন ঘেটে নাম্বারটা দিলো। ওর সামনেই শাওন নাম্বারটায় ডায়াল করল নিজের ফোন থেকে এবং নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া গেল। শাওন জোনাকির দিকে তাকিয়ে বলল,

‘কেউ নিশ্চয়ই ফাজলামো করেছে। দেখো, ফোন বন্ধ!’

জোনাকি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। ওর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে সবকিছু। ও নিজেও নিজের ফোন থেকে শর্মীর নাম্বারে ফোন করার চেষ্টা চালালো কিন্তু বারবারই নাম্বারটি বন্ধ বলল। জোনাকি মৃদু শ্বাস ফেলে টেবিলের উপর হাত রাখতেই শাওন ওর হাতজোড়া নিজের হাতের মুঠোয় চেপে ধরে বলল,

‘তুমি চাইলে আমার বাসায় চলো। দেখো সেখানে আমি একা থাকি নাকি বউ বাচ্চা সহ! আমার বাবা-মা নেই জোনাকি। থাকলে তাদের সাথে কথা বলিয়ে দিতাম। বিশ্বাস করো, আমি বিবাহিত নই! আমি এতবড় ঘৃণিত কাজ করার কথা কল্পনাও করতে পারি না।’

জোনাকি কি বলবে ভেবে পেল না। শাওনকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করল আবার মনের ঘরে দোনোমোনো অবস্থারও সৃষ্টি হলো। ও চুপ করে রইলো দেখে শাওন গোমড়া মুখ করে ফের বলল,

‘ঠিক আছে। এক্ষুনি বিশ্বাস করতে হবে না। খোঁজখবর নাও। নিয়ে দেখো। যদি সবটা মিথ্যে প্রমাণিত হয়, তবেই আমরা বিয়ে করব। নইলে এখানেই সব ক্লোজড। এবার একটু রিল্যাক্স হও! প্লিজ।’

শাওনকে অবিশ্বাস করার মতো এরপর আর কিছু খুঁজে পেল না ও। কেউ মিথ্যে বললে নিশ্চয়ই এভাবে খোঁজখবর নেওয়ার ব্যাপারে এত আগ্রহের সাথে বলত না। বরং আরও ব্যাপারটা ঢাকতে এটা ওটা নানান গল্প পাততো। জোনাকি জোরপূর্বক একটু হাসার চেষ্টা করে বলল,

‘ডিম ভর্তা থাকবে তো মেন্যুতে?’

শাওনের মুখেও হাসি ফুঁটে উঠে। যাক, অবশেষে মেয়েটা ওকে বিশ্বাস করেছে!

ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজে দরজাটা খুললো। এরপর টিক করে একটা আওয়াজ হলো। সম্পূর্ণ ঘরে ছড়িয়ে পড়ল আলো। ধবধবে সাদা আলো। চোখ ধাঁধিয়ে উঠল শর্মীর। ও সঙ্গে সঙ্গে দু’হাত এক করে চোখ চেপে ধরল। কানে ভেসে এলো চিবানো কথাবার্তা,

‘আমার হাতে খু*ন হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলি?’

শর্মী হাত সরিয়ে পিটপিট করে তাকাল। শাওন এক হাতে রড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর সমস্ত শরীর তীব্র ভয়ে-আতংকে থরথর করে কেঁপে উঠে। রড টেনে টেনে আস্তে করে এগিয়ে এলো শাওন। রড টানার শব্দে শর্মীর দু’চোখের বাঁধ ভাঙে। ও হাতজোড় করে শাওনের পায়ের তলায় পড়ল। মিনতির স্বরে বলল,

‘তোমাকে ভালোবাসার এতবড় শাস্তি আমাকে দিও না।’

শাওন হাসল, কটাক্ষ মিশ্রিত হাসি। নিচু হয়ে এক হাতে শর্মীর দুই গাল চেপে ধরে কিড়মিড় করে বলল,

‘তাহলে ভালোবাসার মানুষকে ভালো থাকতে দেস না কেন?’

‘ও-ই মেয়েকে বিয়ে করলে তুমি ভালো থাকবে শাওন?’

‘হ্যাঁ, থাকব! ওকে আমার চাই। ও আমার নেশা…ও আমার নেশা…’

শর্মীর বুক ভাঙা কষ্ট হলো। অসহায়ের সুরে বলল,

‘ঠিক আছে। বিয়ে করে নিয়ে এসো। আমি ওকে সাদরে বরণ করলাম।’

‘সত্যি? সত্যি বলছিস?’

শর্মী ঠোঁট কামড়ে মাথা দোলালো। শাওন ওকে টেনে নিয়ে কপালে চুমু এঁকে দিলো সঙ্গে সঙ্গে।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে