বউ পর্ব – ০১

0
3199

#বউ
#পর্ব-০১
#তাহরীমা

“মেয়ের খাবার নেয়ার জন্য তাড়াহুড়া করে যেতেই একটা লোকের কাছে ধাক্কা খেলো মেহু।এদিকে মেয়েকে একা ই বসিয়ে রেখে এসেছে,তাই মুখ তুলে তাকিয়ে লোকটিকে বলল-“আই আম সরি ভাইয়া”!

সাধারণত এরকম ধাক্কা খেলে যেকেউ রুড বিহেভ করে কিন্তু লোকটি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকে বলে উঠলো-“তুমি?কেমন আছো?”

এমন প্রশ্ন আশা করা যায় না ভেবে মেহু অবাক হলো।সে লোকটিকে বলল–“সরি ভাইয়া,আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না?”

নিজের চোখের সামনে প্রাক্তনকে দেখে একদফা অবাক হলো মেঘ।আরো অবাক হলো তাকে অচেনা বানিয়ে দেয়ার কারণে।তবে কি অভিমান থেকেই অভিনয় করে অচেনা বলছে?

মেঘ আবারো বলে–“তুমি আমাকে চিনতেছো না?”

মেহু মাথা নাড়িয়ে না বলে।
তারপর খাবার টেবিলে চলে যায়।একটা প্লেটে অল্প ভাত আর শসা নিয়ে মেয়ের কাছে ফিরে যায়।

মেঘ মেহুকে ফলো করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে সব দেখে।

মেহু একটা বাচ্চা মেয়েকে কবিতা বলে বলে খাইয়ে দিচ্ছে।
মেঘের খারাপ লাগা শুরু হলো।হ্যা এই মেয়েটিকে সে এত ভালবেসেছিল।এই মেয়েটিকে একসময় চাকরির জন্য ছাড়তে হয়েছিলো।

মেহু মেয়েকে হাসিমুখে খাবার খাইয়ে মেয়েকে কোলে নিলো।
–“মাম্মাম তুমি ভাত খাবে না?”

মেহু মেঘতাকে কাকে দিবে ভাবছে?এই বিয়েতে চেনাজানা কেউ নেই।আর বাচ্চা কোলে নিয়েও খাবার খাওয়া যায় না।

বিয়েটা হচ্ছে মেহুর বান্ধবীর।মেহু উপায়ন্তর না পেয়ে বউ সেজে থাকা তার বান্ধবীর কাছে ই যায়।
-রিয়া?(বান্ধবী)
-কিরে খেয়েছিস?
-নাহ।
-তুই মেঘতাকে আমাকে দে?আমি দেখে রাখবো।

মেহু হাসিমুখে মেঘতাকে রিয়ার পাশে বসিয়ে ভাত খেতে যায়।মেঘ আড়াল থেকে সব দেখে।
তার প্রাক্তনের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল,তাহলে তার হাজবেন্ড কোথায়?আর শশুড় বাড়ি থেকে কেউ ই আসেনি একা এভাবে আসতে দিয়েছে?যার জন্য বাচ্চাকে কোলে নেয়ার কেউ নেই?

এসব প্রশ্ন মেঘের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।মেঘ ও এসেছে বন্ধুর বিয়েতে।মানে রিয়ার হাজবেন্ড তার বন্ধু।রিয়া মেঘকে কে ভালভাবে ই চিনে বন্ধুর হাজবেন্ড হিসেবে।

মেঘ রিয়ার সামনে গিয়ে মেঘতাকে আদর করে তারপর রিয়াকে বলে-বাচ্চাটা কার?
-আমার এক ফ্রেন্ড এর!
-ও আচ্ছা।খুব কিউট বাচ্চাটা।
-হ্যা।
-আচ্ছা একটা প্রশ্ন করি?
-হ্যা।অবশ্যই?
-তোমার ফ্রেন্ড কি একাই এসেছে।হাজবেন্ড অথবা শশুড় বাড়ির কেউ আসেনি?
-নাহ।

তখন মেঘতা চট করে উঠে দাঁড়ায়।
রিয়া বলে-কই যাও মেঘু?
-মাম্মামের কাছে।

মেঘ তখন মেঘতাকে কোলে নেয়।একদম ই তার প্রাক্তনের মতো দেখতে হয়েছে।
-কি নাম তোমার?

মেঘতা ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে।এরকম পুরুষ মানুষ ছোট থেকে সে কম দেখেছে।একটু ভয় ও লাগছে।বারবার এদিক সেদিক মেহুকে খুঁজছে।মেঘ আবারো জিজ্ঞেস করে-“কি নাম তোমার?”

মেঘতা বলে-‘মেঘতা’।

মেঘের বুকটা ধক করে উঠে।অতীত মনে পড়ে চোখ ছলছল করে উঠে।হ্যা বহুবছর আগে এই নাম টায় সে সিলেক্ট করেছিলো নিজের মেয়ের জন্য।মেঘের নামের সাথে মেঘতা।তার প্রাক্তন তাহলে তাকে ভুলেনি।তাহলে তাকে না চেনা সব অভিনয় ই করছে।

মেঘ ভাবছে মেঘতার থেকে জিজ্ঞেস করবে তার বাবার কথা।এরকম একটা বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে একাই বা আসলো কেন?
মেঘ তখন মেঘতার দিকে তাকিয়ে বলে
–“তোমার বাবাই কোথায়?”

মেঘতা তখন হেসে বলে–“মাম্মাম বলেছে আকাশে বেড়াতে গেছে।আমি বড় হলে তারপর আসবে।”

মেঘতার কথায় মেঘ অবাক হলো।তারপর রিয়ার কাছে থেকে জানতে পারলো এক্সিডেন্ট এ মারা গেছে।

মেঘের বুক ধক করে উঠলো।হ্যা সে এখনো মানুষ টাকে ভালবাসে।কিন্তু সে কখনো চাইনি যে এভাবে তার সংসার ভেঙ্গে যাক।
মেহু এসে রিয়ার সামনে দাঁড়ায়।মেঘতা মেঘের কোল থেকে নেমে যায়।

–“আজ আসি রে।”
–“গ্রামে চলে যাবি?”
-“হ্যা।”

মেহু একপলক মেঘের দিকে তাকিয়ে চলে যায়।মেহুর এমন ব্যবহারে মেঘ অবাক হয়।মেয়েটার এতই রাগ অভিমান যে তাকে চেনার প্রয়োজন মনে করছেনা।এই পাচ বছরে ভুলে ই গেলো?

রিয়া মেঘকে ভাবতে দেখে বলল–“কি ভাবছেন ভাইয়া?”

–“আচ্ছা অই মেয়েটি শশুড় বাড়ি যাচ্ছে?”
–“আরে নাহ।ওর শশুড়বাড়ি কেমনে হবে?স্বামী ই নেই।ও যাচ্ছে ওদের গ্রামের বাড়িতে।”

মেঘ একটু হাসার অভিনয় করে।মেহুর পিছন পিছন গেলো।কিন্তু ততক্ষনে মেহু গাড়িতে উঠে গেছে।মেঘ আবারো রিয়ার কাছে এসে জানতে চাইলো–“অই মেয়েটির গ্রামের বাড়ি কোথায়?”

রিয়া অবাক হয়ে ঠিকানা দিলো।আর মেঘকে এভাবে অস্থির হতে দেখে থমকে চেয়ে থাকলো।মেঘ দ্রুত বের হলো উদ্দেশ্য নিজের বাড়ি।
______________

বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে মেঘ।কয়েকবছর আগেও তারা মধ্যবিত্ত ছিল।তবে এখন তার বড় ব্যবসা রয়েছে।মেঘের মা অনেক চেষ্ঠা করেছে ঘরে বউ আনার জন্য।কিন্তু মেঘ কিছুতেই তার ভালবাসা ভুলতে পারছিল না।আর যতদিন সে মনে থাকবে ততদিন কিছুতেই অন্য কাউকে মনে জায়গা দিতে পারবেনা।

কলিংবেল চাপতেই মেঘের মা দরজা খুলে দিলো।মেঘ ভেতরে ডুকে যেতে যেতে বলল–“আমি গ্রামে যাব আম্মু।”

ছেলের মুখে এমন কথা শুনে তিনি অবাক ই হলেন।
–“কারণ?”
–“আমি আজ ওকে দেখেছি।”

মেঘের মায়ের বুঝতে বাকি রইলো না কার কথা বলছে।

মেঘ মাকে নিয়ে নিজের রুমে গেলো।মাকে বিছানায় বসিয়ে নিজে ফ্লোরে বসে হাত মুঠো করলো।
–“এইবার যদি আম্মু আমি তাকে হারিয়ে ফেলি আমি মরেই যাবো।”
–“কিন্তু তারা তো শহরে থাকতো?”
–“এখন সবাই গ্রামে থাকে।”

–“মেঘ!সে এখন বিবাহিত,তুই তার সাথে আর সম্পর্ক রাখতে পারিস না।”
–“আম্মু তুমি জানোনা যে,ওর হাজবেন্ড মারা গেছে।একটা মেয়ে ও আছে।আমি জানি ও ভাল নেই।আমি আবারো ওকে বিয়ে করতে চাই?”

মেঘের মা এবার আরো অবাক হলেন একমাত্র ছেলের বউ তাও বিবাহিত বাচ্চা মেয়ে ও আছে?এটা কিছুতেই মানা যায় না।

–“তুই কি পাগল হয়েছিস?”
–“যদি পাগল ভাবতে না চাও তবে আমি যা বলব তাই হবে।একবার ওকে ছেড়েছি আর ছাড়বো না।আমি গ্রামে গিয়ে সরাসরি ওর বাবাকে রাজি করাবো।”

এই বলে রাগ করে উঠে কাপড় গুজগাজ করতে চলে গেলো।

মেঘের মায়ের কপালে ভাজ পড়লো।তবে ভাল হয়েছে ছেলে যেভাবে ভাল থাকে এতেই তার শান্তি।কিন্তু মনে মনে একটায় সমস্যা সে অন্যের বউ ছিলো!
________________

মেহু মেয়েকে কোলে নিয়ে বাসের সিটে জানালার ধারে বসে আছে।মেঘতা তখন ঘুম।মেয়ের কপালে চুমু দেয়।আর কেঁদে উঠে।পুরোনো স্মৃতি মনে পড়ে সে কেঁদে উঠে।

মেহু বর্তমানে বাবা মার একমাত্র মেয়ে।মেহুরা দুইবোন ছিল।আগে এই শহরে থাকলেও এখন সে বাবা মাকে নিয়ে গ্রামেই থাকে।এই শহরের বিষাক্ত স্মৃতি থেকে মুক্তি পেতে চায় সে।

এখন সে স্কুলের শিক্ষিকা।বাবা মা মেয়ে নিয়ে সে ভালই আছে।

গ্রামের রাস্তা আসতেই বাস থেমে যায়।মেহু মেয়েকে নিয়ে বিলের ধারে হেটে যায়।বোরকাটা এক হাতে ধরে আরেকহাতে মেয়েকে ধরে।দূর থেকে মেহুর বাবাকে দেখা যায়।বিয়েতে মেহুকে পৌছে দিতে চেয়েছিল,মেহু আসা যাওয়ায় অভ্যস্থ বলে তিনি আর এগিয়ে দেন নি।

-আব্বু?
-কই আমার নাত্নি ঘুম?

মেঘতা চোখ খুলে।
-নানাভাই!
-এই তো জেগে গেছে।
-ইসস মাম্মাম কে কষ্ট দিয়ে এখন নানাভাই কে ভালবাসা দেয়া হচ্ছে?

বাবা মেয়ে হেসে উঠে।আর মেঘতা চোখ পিটপিট করে তাকায়……

গ্রামে রাস্তা দিয়ে হাটলে বাড়িতে যেতে দূর লাগে।কিন্তু বিল দিয়ে বাড়ি একদম কাছাকাছি তাই মেহু ও সেই পথ ধরলো।বাবার সাথে টুকটাক কথা বলছে আর হাসছে।

গ্রামের লোকেরা মেহুর বাবাকে খুব সম্মান করে।পাশাপাশি মেহু শিক্ষিকা হওয়ায় সবার পরিচিত মুখ।মেহু গ্রামের ছেলেমেয়েদের বিনামূল্য প্রাইভেট পড়ায়।তবে যারা উচ্চবিত্ত তারা জোর করে টাকা দিয়ে যায়।

মেঘতাকেও গ্রামের সবাই পছন্দ করে।মেহুকে দেখে অনেকে সালাম দেয়।মেহু ও মুরুব্বি দেখলে সালাম দেয়।
বিলের পথ শেষ হলেই তারা আবারো রাস্তায় উঠে।দূর থেকে বাড়ি দেখা যাচ্ছে।

পথেই বাবার বয়সী চাচাদের সাথে দেখে হয়।মেহুর বাবা টুকটাক কথা বলে।
তাদের মধ্যে এক চাচা বলে উঠে–“এবার মেহুকে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করো?আজকাল টাকা ছাড়লে পাত্রের অভাব হয়না।”

মেহু এটা শুনে চুপ থাকতে পারেনা।গ্রামের মানুষ দের সমস্যা কি?

মেহুকে তার বাবা মা বিয়ে দেয়ার অনেক চেষ্টা করেছিল কিন্তু মেয়ের জন্য সে বিয়েতে রাজি নয় তাছাড়া তেমন পাত্র ও আসেনি যে মেয়ে সহ কাউকে বিয়ে করবে।

মেহু দুঃখ মন নিয়ে বলে–“আমাকে যে বিয়ে করবে সে হাজারে একজন।আর সে যদি মেয়েসহ মেনে বিয়ে করে তবেই সেদিন আমার বিয়ে হবে।”

মেহুর রাগ দেখে গ্রামের চাচারা আর কিছুই বলেনা।মেহুর বাবা চুপচাপ সব দেখলেন।তবে কিছুই বললেন না।

মেহুদের বাড়ির উঠোন টা অনেক বড়।মেহুদের মতো উঠোন গ্রামের আর কারোর নেই।গ্রামের মানুষ রা বিভিন্ন চাষ করেই সংসার চালায়।সেক্ষেত্রে ধান গম এসব চাষ করে রোদে শোকাতে হলে গ্রামের প্রত্যেকে এসে মেহুদের উঠোনে ভীড় জমায়।

মেহুর বাবা সরল হওয়ায় গ্রামের সবাইকে সাহায্য করে।মেহু বাড়ির উঠানে যেতেই সবাই প্রশ্ন করে-” কোথায় গেছে?”
মেহু হেসে জবাব দেয়-” বান্ধবীর বিয়েতে শহরে গেছে।’

কেউ কেউ ভাল হয়েছে বলে আবারো যে যার কাজে মন দেয়।মেঘতা লোভাতুর দৃষ্টিতে ধানের দিকে চেয়ে থাকে।তার ইচ্ছে করছে এক্ষুনি ধানগুলো হাতের মুঠোয় নিয়ে ধরতে।এগুলোর উপর বসে খেলতে।

মেঘতা মেহুর দিকে তাকায়।মা কে সে ভয় ও পায় আবার ভাল ও লাগে।
নানার মুখের দিকে তাকিয়ে মেহুকে বলে-মাম্মাম?
–“পা মাটিতে রাখলে ভাল হবেনা।ঘরে আসো?”

মেঘতা মন খারাপ করে।মেহু মুচকি হাসে।বাচ্চামানুষ ধান যদি আবার নাকে মুখে ডুকিয়ে দেয় তো সমস্যা!এসব জিনিস বাচ্চাদের থেকে সাবধান সাবধান।

চলবে………….?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে