বইছে আবার চৈতী হাওয়া
১৯.
ক্যাফেটোরিয়ায় ঢুকে মিরা চমকে গেল। আজ শুক্রবার। দুপুরবেলা আশিক ফোন করে জানিয়েছে নেক্সট প্রোগ্রামের মিটিং আছে। চারটার সময় চলে আসতে কিন্তু এখানে আশিকের সঙ্গে শুভও থাকবে এটা ও আশা করেনি। সেদিনের পর শুভর সঙ্গে আর যোগাযোগ করেনি মীরা। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে শুভ নিজেও যোগাযোগের চেষ্টা করেনি। এবং তার চাইতেও অদ্ভুত ব্যপার এজন্য যে মীরার খুব মন খারাপ লাগছে তাও নয়। শুভর কাছ থেকে এরকম ব্যবহারই কাম্য । মীরা জানে ওর সমস্যাটা কোথায়। শুভ এক ধরনের কমপ্লেক্সে ভুগছে। যে প্রতিবাদটা ওর করা উচিত ছিল সেটা অন্য একজন করেছে। শুভ সেটা নিতে পারছেনা। মীরা কখনোই চায়নি যে, শুভ ওই ছেলেগুলোর সঙ্গে মারামারি করুক। কিংবা কোন ধরনের প্রতিবাদ করুক। শুধু চেয়েছিল শুভ একটু ওর পাশে থাকুক। ওর মানসিক অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করুক। কিন্তু শুভ সেটা করেনি। চোরের মত পালিয়ে গেছে। আর এখন অকারনে নিজেকে আশিকের সঙ্গে তুলনা করছে। মীরা জানে আশিক যেটা করেছে সেটা ওর স্বভাবগত কারণেই করেছে। মিরার জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও হয়তো তাই করতো।
গেটে দাঁড়িয়ে একবার ভাবলো চলে যাবে কিন্তু ততক্ষণ আশিক দেখে ফেলেছে। হাত নাড়িয়ে বলল মীরা এইদিকে এসো। মিরা গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেল। আশিক কোনরকম ভূমিকা না করেই বলল
– মীরা , শুভ সেদিন আমার একটা ভুলের কারণে তোমরা এভাবে অভিমান করে দূরে সরে থাকলে আমার খুব খারাপ লাগবে
মীরার একবার বলতে ইচ্ছা হল আপনি কোন ভুল করেননি। তবে কি একটা ভেবে ও কিছু বলল না। আশিক আবারো বলল
– নাও, এবার ভাব করে নাও।
মীরা ভাবলেশহীন গলায় বলল
– আমাদের মধ্যে তো ঝগড়া হয়নি আশিক ভাই, যে ভাব করব
শুভ কিছু বলছে না। মাথা নিচু করে আছে
আশিক উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল
– ঠিক আছে। তোমরা কথা বলো, আমি যাচ্ছি।
আশিক গেটের কাছে যেয়ে একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে হাসলো আপনমনে। এতদিন ধরে একটা অপরাধবোধ মনের মধ্যে খচখচ করছিল। যাক, আজ সেটা দূর হলো।
আশিক চলে যাবার পর মীরা আর শুভ ও বসলো না ওখানে। শুভ যেটা কখনোই করেনা সেটাই করল। মিরাকে নিয়ে একটা শপিং কমপ্লেক্সে চলে গেল, তারপর ওর আপত্তি সত্ত্বেও বেশ দামী একটা শাড়ি কিনে দিল সঙ্গে কিছু কসমেটিক্স। মীরা শুরুতে মানা করেছিল কিন্তু পরবর্তীতে ওর ভালই লাগলো। শুভ সাধারণত ওর জন্য কোন উপহার কেনে না।
শুভ ওকে সরি বলেছে। বলেছে সেদিন ওর খুব খারাপ লাগছিল। কি করবে বুঝতে পারছিল না। তাই সেভাবে চলে গেছিল। মীরা কোন জবাব দেয়নি। আশ্চর্যজনকভাবে শুভর প্রতি ওর প্রত্যাশা দিন দিন কমে যাচ্ছে। আজকাল একটা অদৃশ্য দূরত্ব টের পায় দুজনের মাঝে। কি করলে, কি উপায়ে এই দূরত্ব অতিক্রম করা যায়, মীরা ভেবে পায় না। আর শুভর বোধহয় ভাবার সময়ই নেই।
২০.
জানুয়ারি প্রায় শেষ। সামনেই বইমেলা শুরু হবে। আশিকের খুব ইচ্ছা ছিল এই বইমেলায় ওর একটা বই বের করার কিন্তু গুছিয়ে উঠতে পারেনি। তাছাড়া ফাইনাল পরীক্ষার আর বেশি বাকি নেই। তাই এখন এসবে বিশেষ একটা মনোযোগ দিতে চাইছে না। আগামী বই মেলার আগেই অনার্স ফাইনাল শেষ হয়ে যাবে, তখন ধীরেসুস্থে বই বের করলেই ভালো। আপাতত একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে ফোকাস করতে হবে। আগের অনুষ্ঠান ভালো হওয়াতে শিক্ষকদের প্রত্যাশা বেড়ে গেছে। এটা একটা বাড়তি চাপ। এবারের অনুষ্ঠান আরো ভালো করতে হবে। আশিক টেক্সট করে গ্রুপ মেম্বারদের জানিয়ে দিল সোমবার বিকেল পাঁচটায় মিটিং। সবাইকে টিএসসিতে উপস্থিত থাকতে।
সবার দায়িত্ব প্রাথমিকভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হলো। যেহেতু স্টেজের ব্যাপারটা আগে ফাইনাল করতে হবে কাজেই পরের দিন মিরার সঙ্গে বসতে হবে। আশিক টেক্সট করে জানিয়েছে বিকেল পাঁচটায় লাইব্রেরীতে আসতে।
মীরা লাইব্রেরী পৌঁছে দেখলো আশিক আগেই চলে এসেছে। মীরাকে বলেছিল স্টেজের একটা রাফ স্ট্রাকচার তৈরি করে নিয়ে আসতে। মীরা তিনটা ডিজাইন করেছে। এই সপ্তাহে ওর ল্যাব না থাকায় বেশ কিছুটা সময় পেয়েছে। ডিজাইনগুলো মাথাতেই ছিল শুধু কাগজে নামিয়ে নিয়েছে। আশিক ডিজাইন গুলো দেখে মুগ্ধ হল। তিনটাই খুব ভালো হয়েছে। এখন দেখতে হবে কোনটাতে খরচ কম এবং অনুষ্ঠানের থিমের সঙ্গে যায়। আশিক বলল
-আমি সিডিটা একটু শহীদ মিনার আদলে করতে চাচ্ছি
– করা যাবে। কতগুলো স্টেপ করতে চাচ্ছেন?
– এই ধরো, দশটা থেকে বারোটা
– আচ্ছা। এটা করলে অডিয়েন্সকে একটু পিছিয়ে দিতে হবে। সেক্ষেত্রে স্টেজের ব্যাকগ্রাউন্ড স্বাভাবিকের চাইতে একটু বড় করলে ভালো।
– আচ্ছা
– আমি এর আগে দুবার সিঁড়ি নিয়ে কাজ করেছি। আমার কাছে ছবি আছে। আপনাকে দেখাচ্ছি। একটা গায়ে হলুদের আর অন্যটা একটা কালচারাল প্রোগ্রামের।
মীরা মোবাইল বের করে ছবি দেখালো। আশিক ছবিগুলো দেখলো। বেশ সুন্দর কাজ। গায়ে হলুদের সিঁড়িটা বেশ সুন্দর হয়েছে। কলস দিয়ে করা হয়েছে তার উপরে আলপনা আঁকা।
-এটা তোমার করা?
– জি
– তোমার কাজ তো খুব ভালো। তুমি কি আরো কোন ক্রিয়েটিভ ওয়ার্কের সঙ্গে জড়িত?
মিরা একটু আরক্ত হলো। লজ্জিত কন্ঠে বলল
– আমি হ্যান্ডমেড জুয়েলারি বানাই
-সিঁড়ি দেখানোর সময় যে জুয়েলারির ছবিগুলো দেখলাম সেগুলি তোমার করা?
– জি
– তোমার কাজ তো বেশ প্রফেশনাল। কোন দোকানে দিচ্ছ?
-এখনো কোথাও দেইনি
– তাহলে সেল করো কি করে? ফেসবুক পেইজে?
– না আমার ফেসবুক পেজ নেই। মানে, এখনো ওপেন করা হয়নি
– বল কি? কতদিন ধরে কাজ করছো?
– অনেকদিন, প্রায় বছর দুয়েক
– আর এখনো ফেসবুক পেজ ওপেন করনি?
– আসলে ঠিক জানি না কিভাবে করতে হয়
আশিক বেশ অবাক হলো মেয়েটা এতদিন ধরে এত সুন্দর কাজ করছে। আশ্চর্য! শুভকে বললে তো এটা খুব সহজেই হয়ে যেত। আশিক এই প্রসঙ্গে আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। বললো
-আমি তোমাকে একটা ফেসবুক পেজ ওপেন করতে সাহায্য করতে পারি
– সত্যি! মীরা ঝলমলে কণ্ঠে বললো
– তুমি চাইলে এখনি করে দিতে পারি
– এখনই? আপনার সমস্যা হবে নাতো?
– আরে ধুর! এটা তো দশ মিনিটের কাজ।
লাইব্রেরীতে বসায় সুবিধা হয়েছে। কম্পিউটার হাতের কাছেই ছিল। আশিক মিরাকে একটা ফেসবুক পেজ ওপেন করে দিল, তারপর খুব ভালো করে বুঝিয়ে দিল কি করে কি করতে হবে। কেমন করে প্রোডাক্ট এর ছবি আপলোড করবে, কি করে ফলোয়ার বাড়াতে হবে ফেসবুক লাইভ করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। সব শেষে বলল
– তুমি একটা কাজ কর ,সামনে একটা ইভেন্টকে বেস করে কিছু প্রোডাক্ট এর ছবি আপলোড করে দাও
মীরা উৎসাহিত বোধ করছে। এভাবে কখনো এগুলো নিয়ে কারো সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি। খুশি খুশি গলায় বলল
-ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইটের উপর কিছু কাজ করা আছে। একুশে ফেব্রুয়ারি বেজ করে করব?
– সেটা করতেই পারো, তবে আমি বলব তার আগে আছে ভ্যালেন্টাইনস ডে। এর উপর বেস করে করলে বেশ কিছু অর্ডার পাওয়ার সম্ভবনা আছে
মীরা আশ্চর্য হয়ে গেল। এটাতো ও ভেবেই দেখেনি
কাজ শেষ করে বেরোতে বেরোতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। আশিক মিরাকে হল অবধি নামিয়ে দিল । নতুন পেজের আনন্দে মীরা খুব এক্সাইটেড ছিল। সারা পথ বকবক করল। ওকে বাচ্চাদের মতন খুশি হচ্ছে দেখে ভালো লাগলো আশিকের। গত কয়েকটা দিন খুব মন খারাপ করে ছিল মেয়েটা।
মীরাকে নামিয়ে আশিক রিকশা ছেড়ে দিল। মীরা হলের ভেতর ঢোকার আগে দেখল আশিক সিগারেট ধরিয়েছে। গেটের উল্টো দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মিরা আবার ফিরে এসে বলল
-আপনি কি কারো জন্য অপেক্ষা করছেন? আশিক চমকে তাকাল। তারপর একটু অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল
-কই নাতো।
মিরা আর কিছু বলবো না। বিদায় নিয়ে চলে গেল।
রুমে ঢুকে প্রথমেই ও নিজের ফেসবুক পেইজে গেল। এখনো কোনো ফলোয়ার নেই। ছবিগুলো দ্রুতই আপলোড করে ফেলতে হবে।
এক ফাঁকে মীরা একবার আশিকের পেজ থেকেও ঘুরে এলো। এইমাত্র একটা কবিতা আপলোড করা হয়েছে
আবার একদিন ঠিকই দেখা হয়ে যাবে
কখনও, কোথাও।
পাঁচ বছর, দশ বছর, পঞ্চাশ বছর,
কিংবা শতাব্দী পেরিয়ে
একদিন কোথাও।
দেখা হবে, একদিন আবার ঠিকই দেখা হয়ে যাবে।
না জানুক অন্যেরা সে -কথা, আমি জানি।
কবিতাটা পড়ে একটু অদ্ভুত লাগলো মীরার। আশিক ভাই কি তাহলে কারো জন্য অপেক্ষা করে?
চলবে………
আজকে যে কবিতাটা দেয়া হয়েছে তার নাম “দেখা হবে” লিখেছেন
___নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী