বইছে আবার চৈতী হাওয়া
১৬.
মীরা ঠিক করেছে আজ শাড়ি পরে যাবে। শুভ না আসলে হয়ত পরতো না। একটু বোধহয় অস্বস্তি হত। গ্রুপে যেহেতু আর কোনো মেয়ে নেই, আর ছেলেরাও সব ওর সিনিয়র তাই শুভ না আসলে ওর একটু সমস্যাই হত। মীরা মনেমনে আশিকের প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করল।
আজ তেমন একটা ঠান্ডা নেই। কুয়াশাও পড়েনি তেমন। মীরা ব্যাগে একটা চাদর নিয়ে নিয়েছে। ইচ্ছে করেই এপ্লিকের শাড়ি পড়েছে। গাঢ় বেগুনির উপর সবুজ আর সাদা কাজ। ডিজাইনটা ওর নিজের করা।
তৈরি হয়ে পৌঁছতে পৌঁছাতেই পাঁচটা বেজে গেল। মীরা পৌঁছে দেখলে সবাই ততক্ষণে চলে এসেছে। কিছু একটা নিয়ে সবার মধ্যে বেশ আলোচনা চলছে। আশিক হাত নেড়ে সবাইকে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছে। শুভই ওকে সবার আগে দেখল। কাছে এসে বলল
-চলে এসেছ? তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।
মীরা লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নিল। তারপর আস্তে আস্তে বলল,
-থ্যাঙ্ক ইউ।
মীরা আর শুভ বাকিদের কাছে ফিরে গেল। মারুফ আগ বাড়িয়ে বলল,
মীরা চলে এসেছো? ভালই হয়েছে, এতক্ষণ ধরে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না।
– কিসের সিদ্ধান্ত?
– এই কোথায় খেতে যাব তাই আর কি।
– ও, সেটা আপনারা যেটা ঠিক করবেন, সেখানেই যাব।
শুভ বলল দেখেছিস, বলেছিলাম না? আমারা শুধু শুধু এতক্ষণ সময় নষ্ট করলাম।
-না তা কেন? গ্রুপ মেম্বারদের সবারই একটা মতামত থাকা উচিত। মীরা তুমি বলো চাইনিজ না কন্টিনেন্টাল?
-সবাই যেটা চাইবে। আমার একটা হলেই হবে।
– ওকে তাহলে চাইনিজই থাকুক। মেজরিটি বলে কথা। চল তার আগে চা খেয়ে নেই।
আজকে আর কেউ ভেতরের ক্যাফেটেরিয়াতে বসলো না। টিএসসি থেকে বের হয়ে উল্টো দিকে ডাসে চলে গেল।
আশিক চায়ের অর্ডার দিচ্ছে। দূর থেকেই জানতে চাইল, ‘রেগুলার চিনি মীরা’? মীরা পাশে রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। একটু হেসে মাথা নাড়ল। হালকা হালকা বাতাস দিচ্ছে। কেমন একটা বসন্তের আমেজ। মীরা আশে পাশে তাকিয়ে শাড়ির আঁচল গুছিয়ে ভালো করে দাঁড়ালো। দলের বাকিরা একটু দূরে, অন্যপাশে গিয়ে সিগারেট ধরিয়েছে।
মীরা ওর ফোনটা বের করে মেসেজ চেক করছিল। অনেকদিন বাসায় যোগাযোগ হয় না। হলে ফিরে ফোন দিতে হবে। হঠাৎই পেছনে একটা কণ্ঠস্বর শুনে ওর সারা শরীর জমে গেল। কেমন একটা ফ্যাসফেসে গলায় একজন বলছে,
– মালটা জোস রে।
– মনে ধরছে নাকি বস?
– পিছে থেকে দেখেই তো ভালো লাগতাছে। সামনে দেখলে তো…
ছেলেটা কথা শেষ করল না, কেমন অশ্লীল ভঙ্গিতে হাসতে লাগলো।
অন্য আরেকটা কন্ঠস্বর বলল,
-ক্যাম্পাসের মাল না বাইরের?
-জানিনা। তবে বসের যখন মনে ধরছে একটু খবর নেওয়া লাগে।
মীরার চোখে পানি এসে গেল। আশেপাশে আর কোন মেয়ে নেই। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, ওকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। চা চলে এসেছে। শুভ চায়ের কাপটা হাতে দিয়ে মাথা নিচু করেই আস্তে করে বলল,
– আমাদের কাছে এসে দাঁড়াও।
তারমানে এই আলোচনা শুভর কানেও গেছে। শুভ আর দাঁড়ালো না, আবার দলের বাকিদের কাছে ফিরে গেল। মীরা উঠে দাঁড়িয়েছে। পা দুটো অসম্ভব ভারী মনে হচ্ছে। এক পা এগোতে যাবে, ঠিক তখনই কোত্থেকে তিনটা ছেলে সামনে এসে দাঁড়ালো। মীরা হতবাক হয়ে গেল। ছেলেগুলো বয়সে ওর সমান বা ওর থেকেও ছোট হবে। সামনের ছেলেটার পরণে ঘিয়া রংয়ের পাঞ্জাবি। মনে হচ্ছে সেই দলের লিডার। ছেলেটা মুখে একটা কুৎসিত হাসি ঝুলিয়ে বলল,
– রেট কত?
এই শীতের রাতেও মীরা ঘামতে আরম্ভ করল। ছেলেটা এক পা, এক পা করে এগিয়ে আসছে। মীরার পা অসার হয়ে আসছে। খুব ইচ্ছা করছে ছুটে শুভদের কাছে চলে যেতে, কিন্তু পা নাড়াতে পারছে না। ছেলেটা আরেকটা পা আগাতেই হঠাৎ করে কোত্থেকে আশিক ওদের দুজনের মাঝখানে চলে এলো। আচমকা ছেলেটার পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরে বলল,
-কি বললি তুই?
পাশে থেকে চ্যাংরা মত একটা ছেলে বলল,
-বুইঝা শুইনা গায়ে হাত দিয়েন।
আশিক ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে বলল,
-তোর সাহস কেমনে হয় আমার ক্যাম্পাসে দাঁড়ায় আমার ডিপার্টমেন্টের মেয়ের সাথে এইভাবে কথা বলস?
ছেলেটা এতক্ষণে সম্বিত ফিরে পেয়েছে। খুব সম্ভবত এভাবে তার সঙ্গে এর আগে কেউ কথা বলেনি। ছেলেটা নিজের কলার থেকে আশিকের হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বলল,
-আপনি সিনিয়র বলে কিছু বলতাছি না।
– সিনিয়ার না হলে কি করতি ? বল কি করতি?
রাসেল আর মারুফ আশিকের দুই পাশ থেকে এসে দাঁড়ালো। ঘাড়ে হাত রেখে বলল,
-দোস্ত কথা বারাইস না।
চ্যাংরা মতন ছেলেটা আবার বলল,
-আপনে মনে হয় জানেন না ও কে।
আশিক ঘৃণা ভরা কন্ঠে বলল,
-জানব না কেন? ও একটা নর্দমার কীট।
ছেলেটা বোধহয় এবার আর নিতে পারল না। একটা হাত তুলে আশিককে মারতে নিল। আশিক তড়িৎ গতিতে ওর হাতটা ধরে ফেলল; তারপর চোয়াল বরাবর একটা ঘুসি মারল। ছেলেটা ছিটকে দূরে গিয়ে পরল এবং অনেকক্ষণ পর্যন্ত ওই ভাবেই বসে রইল। ওর সহচর দুইজন পাশ থেকে এসে ওকে ধরে তোলার চেষ্টা করছে। ছেলেটা অবাক দৃষ্টিতে আশিকের দিকে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টিতে কোন ক্রোধ, প্রতিহিংসা কিংবা জিঘাংসা নেই। আছে শুধু এক অপার বিস্ময়।
চলবে……
বইছে আবার চৈতী হাওয়া
১৭.
মীরা হলে ফিরল অনেক রাত করে। ভেবেছিল রুমে গিয়ে দেখবে সবাই ঘুমিয়ে পরেছে, কিন্তু আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করল বৈশাখী ছাড়া সবাই জেগে আছে। মিরার রুমটা দোতালায়। ও ছাড়া আরও তিনজন থাকে এই রুমে। সেকেন্ড ইয়ার বলে এখনো সিঙ্গেল রুম পায়নি, তবু ভালো ফার্স্ট ইয়ারে থাকতেতো কমনরুমে থাকতে হতো। এখন চারজন একসঙ্গে থাকে। ঘরের মধ্যে চারটা খাট। মিরার খাটটা জানালার পাশে। ঘরেই অ্যাটাচ বাথরুম, সামনে পেছনে টানা বারান্দা। বেশ লাগে মিরার। ওর সঙ্গে সয়েল সাইন্সের মারিয়া, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মহুয়া আর বৈশাখী থাকে। মহুয়া ঘুমাতে যাবার আয়োজন করছিল, ওকে দেখে বলল
-কেমন হলো তোদের প্রোগ্রাম?
-ভালো
-কি খেলি?
– চা
মারিয়া বিছানায় হেলান দিয়ে একটা বই পড়ছিল। ওর দিকে না তাকিয়েই বলল
– তোকে কে পৌঁছে দিল? তোর বয়ফ্রেন্ড?
– না, সিনিয়ার একজন
– কে, আশিক ভাই?
মীরা একটু চমকালো। অবাক কন্ঠে বলল
-তুই কিভাবে চিনিস?
-তোদের ডিপার্টমেন্টের প্রোগ্রামে দেখেছিলাম। আমি অবশ্য আগে থেকেই চিনি।
মীরা এবার যথেষ্টই অবাক হলো। মুখে কিছু বলল না। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মারিয়া কিছু বলছে না, হাসছে মিটিমিটি। মিরা একটু বিরক্ত হয়ে বলল
-বললি না কিভাবে চিনিস?
-আমি ওনার একজন ভক্ত। পেইজের ফলোয়ার।
মীরা এবার সত্যিকার অর্থেই অবাক হল। আশিক ভাইয়ের পেজ আছে? আশ্চর্য তো! ও জানতোই না। মীরা আর কথা বাড়ালো না। চেঞ্জ করতে চলে গেল।
শীতের রাত। তবু মীরা সময় নিয়ে স্নান করল। আজকের ঘটনাটার পর কেমন একটা গা ঘিন ঘিনে অনুভূতি হচ্ছিল। ছেলেগুলো কি কুৎসিত ভাষায়…। সে যাক। আশিক ভাইয়ের ব্যবহারে খুব অবাক হয়েছে মীরা। অবশ্য আশিক ভাইয়ের চেয়েও শুভর ব্যবহারে বেশি অবাক হয়েছে। ছেলেগুলোর সঙ্গে যখন আশিক ভাইয়ের হাতাহাতি চলছিল ঠিক সেই সময় শুভ মিরার কাছে এসে বলেছিল
– মিরা তুমি ওকে আটকাও না। তোমার জন্যই তো সব হচ্ছে।
মীরা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। ও কি করে আশিককে আটকাবে বুঝতে পারছিল না। তবু এগিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তার আগেই আশিক ছেলেটাকে ধরাশায়ী করে ফেলেছে। ছেলেগুলো যাওয়ার আগে শাসিয়ে গেছে, দেখে নেবে বলে।
ওরা চলে যাবার পর পাশের কাঠের বেঞ্চিটাতে ধপ করে বসে পড়েছিল মীরা। কেন যেন আর নিতে পারছিল না। আশিকের একটু সময় লেগেছিল ধাতস্থ হতে , তারপর মীরার কাছে এসে বলেছিল
– সরি মীরা
মিরা অবাক হয়ে বলল
-আপনি কেন সরি বলছেন? বরং আমার আপনাদেরকে সরি বলা উচিত। আমি না আসলে এই ঝামেলাগুলো হত না।
আশিক একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল
-আসলে এটাই হচ্ছে আমাদের সমস্যা। যে অন্যায় করে আমরা তার দোষটা দেখি না। সবাই, এমনকি ভিকটিম নিজেও তার দোষটাই খুঁজে বেড়ায়। এখানে তোমার কোন দোষ নেই।
বাকীরা কেউ কিছু বলল না। কিছুক্ষণ পর আশিক নিজে থেকেই বলল
– আজকের প্রোগ্রামটা বরং থাক
শুভ অনেকক্ষণ ধরে কিছু বলছিল না। আশিকের কথার প্রেক্ষিতে হঠাৎ করে কাছে এগিয়ে এসে বলল
– হ্যাঁ সেটাই ভালো। আমি তাহলে আজকে যাই। তারপর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেল। মীরা যতটা না অবাক হল, তার থেকেও বেশি অবাক হল দলের বাকিরা। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই একটু থমকে গেল। সবার প্রথম কথা বলল রাসেল
– আমি বরং মিরাকে এগিয়ে দিয়ে আসি
– না তুই থাক। আমি যাচ্ছি
মীরা হাফ ছেড়ে বাচল। আশিক কথাটা বলায়। রাসেলের সঙ্গে যেতে ওর ভীষণ অস্বস্তি হতো। আশিক সিগারেট হাত বদল করে বলল
-মারুফ, তোরা দেখে শুনে আরেকটা ডেট ঠিক কর। চলো মিরা।
মীরা স্লথ পায়ে আগালো। ওর অবস্থা বুঝতে পেরে একটা রিক্সা নিয়ে নিল আশিক। টিএসসি থেকে রোকেয়া হল যেতে দু মিনিটও লাগার কথা নয়, তবু রিক্সা ধীর গতিতে আগাচ্ছে। বয়স্ক রিক্সাচালক বলে আশিক আর কিছু বলল না। রোকেয়া হল পার হওয়ার পর রিক্সাচালক জানতে চাইল কোন দিকে যাবে। আশিক কিছু বলার আগেই মীরা হুট করে বলল
– ডানদিকে যান
আশিক আর কিছু বলল না। ডানদিকে ফুলার রোড। আলো আধারির মধ্যে দিয়ে রিকশা এগিয়ে যাচ্ছে। দুজনের কেউই কোনো কথা বলছে না। আশিকের ভীষণ সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে, কিন্তু মীরা বসেছে ওর বাম পাশে। পকেট থেকে সিগারেট বের করতে গেলে অহেতুক গায়ে হাত লাগবে। আশিক সেটা চাইছে না। রিক্সা যখন প্রায় ফুলার রোডের শেষ মাথায়, মীরা হঠাৎ করে বলল
-আপনার কি সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে? আপনি খেতে পারেন। আমি কিছু মনে করব না।
আশিক একটু চমকালো। পরমুহূর্তেই মনে হল হয়তো শুভর সংগে এমন ভাবে রিক্সা করে যাওয়ার সময় এমনটা হয়। কিন্তু শুভ তো সিগারেট খায় না। যাইহোক এত কিছু ভাবার সময় নেই। আশিক সাবধানে পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরালো। রিকশা ততক্ষণে চানখারপুলে উঠেছে।
-চা খাবে মীরা? এখানে পুরনো ঢাকায় একটা বিখ্যাত চায়ের জায়গা আছে। আমরা মাঝে মাঝে যাই
-চলেন যাই
আশিক রিকশাওয়ালাকে বলল
-মামা, আগামাসি লেন দিয়া যান
চায়ের দোকানের সামনে এসে মীরা অবাক হয়ে গেল। ছোট একটা দোকান কিন্তু তার সামনে এত ভিড়! এই এত রাতের বেলাও লোকজন এত চা খায়? আশিক নামলো না। চা আর পুরি নিয়ে নিল, তারপর রিক্সা ঘুরাতে বলল। পথে টুকটাক কথা হলো, আহামরি কিছু না, তবু মীরার খুব ভালো লাগলো। মনের মধ্যে যে মেঘটা জমে ছিল, সেটা কেটে গেল। আসলে এটার খুব দরকার ছিল। কি অদ্ভুত ! এই জিনিসটা তো শুভও করতে পারতো। মিরাকে নামানোর আগে আশিক খুব অদ্ভুত একটা কথা বলল। খুব আস্তে আস্তে বলল
-শুভর উপর রাগ করোনা মীরা। ও খুব নরম টাইপের ছেলে। এসব ভায়োলেন্স ঠিক নিতে পারেনা
মীরার ভীষণ হাসি পেল। আশিক ভাই শুভকে ডিফেন্ড করছে। আশ্চর্য তো!
বাথরুম থেকে বের হয়ে মিরা দেখল সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। রুমের লাইট নেভানো। কাউকে বিরক্ত না করে, গায়ে একটা সোয়েটার চাপিয়ে বারান্দায় চলে গেল ও। এখন একটু শীত পড়েছে। ভেজা চুলটা মুছে বারান্দার রেলিংয়ে তোয়ালেটা মেলতে মেলতে বাইরের দিকে তাকালো মিরা। আজ কুয়াশা নেই। আকাশ বেশ পরিষ্কার। মীরা বারান্দার মোড়ায় বসলো চুল ছড়িয়ে। ফেসবুক ওপেন করে আশিকের প্রোফাইলে ঢুকলো। এইতো প্রোফাইলেই পেজের লিংক দেয়া। আগে কখনো দেখা হয়নি তো। পেজে ঢুকে আশ্চর্য হয়ে গেল। এত কবিতা? অথচ ও আগে দেখেনি। শেষ কবিতাটা পোস্ট করা হয়েছে তিন দিন আগে
তোমাকে দেখেছি পৌষের রাতে, আধো আলো আধো ছায়াতে
জানিনা কে তুমি, তবুও মোহিত করেছ তোমার মায়াতে
রাত ভোর হয়, আবার রাতের পোশাকে আধার নামে
তোমাকে দেখার বাসনা লুকাই, হৃদয়ের নীল খামে
মীরা মুগ্ধ হয়ে যায় কবিতা পড়ে। আনমনে ভাবে, কি সৌভাগ্যবতী হবে সেই মেয়েটা যাকে আশিক ভাই ভালবাসবে।
চলবে….
বইছে আবার চৈতী হাওয়া
১৮.
আশিক বাড়ি ফিরেই বুঝল বাড়ির পরিবেশ ঠিক স্বাভাবিক নেই। আরিফ সাহেব হলরুমে পায়চারি করছেন। আফসিন মুখ ভোঁতা করে ডাইনিং টেবিলে বসে আছে। বাবার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে দীর্ঘ বক্তৃতার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন।
আশিক এক পলকে সবার দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো। আরিফ সাহেব পেছন থেকেই ডাক দিলেন
– কোথায় যাচ্ছ?
আশিক জবাব দিল না, তবে থমকে পেছন ফিরে তাকালো। আরিফ সাহেব কথা শুরু করলেন
-এটাই শুধু বাকি ছিল। মদ গাঁজা তো খেতেই , এখন মারামারিও শুরু করেছে। তুমি জানো যার গায়ে হাত দিয়েছে সে কে?
– না জানি না। জানার প্রয়োজনও বোধ করি না।
– তা করবে কেন? যে ছেলের গায়ে তুমি হাত দিয়েছো তার বাবা একজন প্রতিমন্ত্রী। এ খবর জানা আছে তোমার?
– প্রতিমন্ত্রীর ছেলে হলেই কি সে মেয়েদের সঙ্গে অসভ্যতামি করা লাইসেন্স পেয়ে যায়?
আরিফ সাহেব একটু থমকালেন। বিষয় তাহলে এই। তবে দমলেন না। বললেন
-ঠিক আছে মানলাম সেই ছেলে অসভ্য আচরণ করেছে। কুকুরের কাজ কুকুর করেছে। তাই বলে তুমি কুকুরের পায়ে কামড়াবে? এই প্রবাদ কি তুমি শোনোনি?
-আমি এই প্রবাদ শুনেছি কিন্তু আপনি মনে হয় ওই প্রবাদটা শুনেননি, যে যেমন কুকুর তেমন মুগুর। আমি কুকুরের পায়ে কামড় দেই না কিন্তু মুগুর দিয়ে পিটিয়ে কুকুর শায়েস্তা করতে জানি।
আরিফ সাহেব তাকিয়ে আছেন। তার রাগ হওয়া উচিত ছেলে মুখে মুখে তর্ক করছে। অপমানিত বোধ করা উচিত। তিনি তর্কে হেরে গেছেন। কিন্তু তার মধ্যে রাগ অপমান বোধ কিছুই হচ্ছে না, বরং ছেলের যুক্তি শুনে তিনি মুগ্ধ হয়ে গেলেন। এই ছেলে কি বুঝে সাহিত্য নিয়ে পড়ে আছে? তার তো উচিত ছিল ওকালতি পড়া। প্রতিপক্ষের উকিলকে ধরাশায়ী করে দেবার জন্য ওর উপস্থিত বুদ্ধিই যথেষ্ট। তবে ছেলেটার মাথা গরম। এই নিয়ে একদিন ওর সঙ্গে বসতে হবে।
আরিফ সাহেব আর একটা কথাও বললেন না। ধীরে ধীরে টেলিফোনের দিকে এগিয়ে গেলেন ছেলেকে তিনি খুব ভালো করেই চেনেন। আশিক মিথ্যা বলে না। ছোটবেলায় অনেক অপকর্ম করেছে স্কুলে। ভাঙচুর মারামারি করে এসেছে। ঘাড়তেড়ামি করে সত্য কথা বলেছে এবং বাড়িতেও মার খেয়েছে। তবু মিথ্যে বলেনি। এই শিক্ষা সে পেয়েছে তার মায়ের কাছ থেকে। আশিয়া ও এমনই ছিল। আপমান সহ্য করত, কটু কথা শুনত, তবু মিথ্যে বলত না।
আরিফ সাহেব টেলিফোন তুলে ডায়াল করলেন। আফসিন ডাইনিং টেবিল থেকে উঠে এসে ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়েছে। ওর খুব ভয় করছে। বাবা কি পুলিশে ফোন করছে?
আরিফ সাহেব ফোন কানে ঠেকিয়ে আছেন। অপর পাশের রিং বাজছে। একটা ভারি কন্ঠস্বর টেলিফোন তুলে হ্যালো বলতেই আরিফ সাহেব শীতল গলায় বললেন
-আপনার ছেলেকে শিখিয়ে দেবেন কি করে মেয়েদের সঙ্গে বিহেভ করতে হয়। যদি না পারেন তো আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন।
অপর পাসের কথা শোনা যাচ্ছে না। আফসিন চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। আরিফ সাহেব আরো ঠান্ডা গলায় বললেন
-অবশ্যই। আর একটা কথা, যদি আমার ছেলের গায়ে একটা আচরও লাগে তাহলে মনে রাখবেন আপনার ইনকাম ট্যাক্সের কেসটা কিন্তু এখনো আমার হাতেই আছে। আপনি আমার পুরনো ক্লায়েন্ট তাই ভালোভাবে বললাম।
আফসিন খুশিতে ভাইকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। আরিফ সাহেব টেলিফোন রেখে হাক দিলেন
-রোজিনা
রোজিনা এতক্ষন ভয়ে রান্না ঘরের ভিতর ঘাপটি মেরে বসে ছিল। ডাক শুনে উঁকি দিয়ে বলল
-জি খালুজান
টেবিলে ভাত দে। আমরা আজকে একসঙ্গে খেতে বসব।