বইছে আবার চৈতী হাওয়া
৬৩
মোবাইলের স্ক্রিনে জ্বল জ্বল করছে অনেকগুলো মেসেজ। সবগুলোই এসেছে একটা অচেনা নাম্বার থেকে। মীরার শরীরে কেমন কাঁপুনি দিচ্ছে। মনে হচ্ছে গাঁ কাঁপিয়ে জ্বর আসছে। ও কম্বলটা টেনে নিয়ে আবার শুয়ে পরল। কেন যেন খুব কান্না পাচ্ছে। শুভ ইচ্ছে করেই এইসব করছে। যদি এসব জানাজানি হয় তাহলে কি হবে? এই বাড়ীর সবাই ওকে ঘৃণা করবে।
এই বাড়িতে ও এসেছে দুই মাসের কিছু বেশি হবে। কিন্তু বাড়িটা ওর এত আপন লাগে। বিশেষ করে বাড়ীর মানুসগুলো। এসব জানলে নিশ্চই সবাই ওকে অন্য চোখে দেখবে। আর আশিক? ওকি আর আগের মতন ভালোবাসবে ওকে? মীরা একটু কেপে উঠল। এমনটা হলে ও মরে যাবে নির্ঘাত। আশিক ওর কাছ থেকে একটু দূরে থাকলেই কেমন দম বন্ধ হয়ে আসে, আর যদি ওকে ছেড়ে চলে যায় তখন কি হবে?
মীরা এক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে নিজেকে শক্ত করে, তারপর ফোনটা তুলে নেয়। অপর পাশ থেকে একটা আত্নবিশ্বাসী কন্ঠ ভেসে আসে
-মীরা
-জরুরি কথা আছে
-নাম্বার ব্লক করে লাভ হয়নি, তাইতো?
-তুই কিকরে বুঝলি?
-এটাই তো স্বাভাবিক, তাই না ?
-তাই কি?
-হুম। তুই আশিক ভাই কে জানিয়েছিস?
-না
-কেন?
-আমার ভয় করছে। ও যদি রেগে গিয়ে আবার কোন ঝামেলা করে। যদি আবার মারামারি করে।
-ওই শালার একটু মার খাওয়ার দরকার আছে।
-সেটা আমি জানি, কিন্তু আমি ওকে কোন ঝামেলায় দেখতে চাই না। আগের কেসটাই এখনো শেষ হয়েনি। তাছাড়া পরীক্ষা চলছে। এর মধ্যে…
-হুম বুঝলাম। এখন কি নতুন নাম্বার থেকে কল দিচ্ছে?
-হ্যাঁ
-এর পর যদি আশিক ভাইকে ফোন দেয়, তখন কি করবি?
মীরা নিজের অজান্তেই কেপে উঠল। কম্বল সরিয়ে উঠে বসল। ওর সমস্ত শরীর ঘামছে? ও কাঁপা গলায় বলল
-এখন কি করব আমি?
-এত ভয় পাচ্ছিস কেন? তুই তোর নাম্বারটা চেঞ্জ করে ফেল। আর দুই দিন পরেই তো পরীক্ষা শেষ, তখন না বললি তোরা ঢাকার বাইরে যাবি, সে সময় বলে দিস। তবে একটা রিস্ক আছে। নাম্বার চেঞ্জ করলে সে আরো মরিয়া হয়ে উঠতে পারে। সেই ক্ষেত্রে আশিক ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করলে সমস্যা। তুই বরংএকটা চিঠি লেখ, আমি পৌঁছে দিয়ে আসবো। শালাকে একটু ধুয়ে ও দিয়ে আসবো।
মীরা একটু আশ্বস্ত বোধ করল। বলল
-থ্যঙ্ক ইউ টুম্পা।
-এহ ঢং। হইসে এইবার ফোন রাখ। তোর জন্য এতক্ষন তুষারকে ওয়েটিং এ রাখলাম
-এই যাহ! সত্য? সরি দোস্ত।
-আবার সরি মারাস। যা ফোন রাখ।
মীরার মনটাই কেমন ফুরফুরে হয়ে গেল। নিচে নেমে দেখল রোজিনা রাতের খাবা্রের আয়োজন করছে। আরিফ সাহেব রাতে রুটি খান, আফসিন মিল্ক সিরিয়াল অথবা ফ্রুট কাস্টার্ড এইসব খেয়ে থাকে। মীরার অসম্ভব খিদে পেয়েছে। দুপুরে কেমন বমি বমি পাচ্ছিল তাই বিরিয়ানি খেতে পারেনি, এখনো খেতে ইচ্ছে করছে না । মজার কিছু খেতে ইচ্ছা করছে। মীরা রান্নাঘরে উকি দিয়ে বলল
-আমার জন্য কয়েকটা রুটি বানিয়ে দেবে রোজিনা?
– বিরিয়ানি খাইবেন না ? দিনেও তো খাইতে পারলেন না
-খেতে ইচ্ছা করছে না
– রুটির সঙ্গে কি দিমু
-ডিম ভাজি
-বিরিয়ানির সাথে বোরহানি আর ফিরনি ও দিছিলো। আপনারা দেই?
– দাও
মীরা আয়েশ করে খেলো। সাধারণত রাতে ও এতটা খেতে পারে না। আজ কি যে হয়েছে। রাক্ষসের মতন খিদে পাচ্ছে।
খাওয়া শেষ করে মীরা ঘরে গিয়ে আশিককে ফোন দিল। আশিক সম্ভবত রাস্তায়। প্রচন্ড শব্দ হচ্ছে, তেমন কিছুই শোনা যাচ্ছে না। অনেকক্ষণের চেষ্টায় মীরা বুঝল ওর দেরি হবে। মিরাকে ঘুমিয়ে পড়তে বলছে।
কপালে আলতো একটা স্পর্শে মীরার ঘুম ভাঙলো। আশিকের সদ্যস্নাত মুখটা দেখে মনটাই ভালো হয়ে গেল ওর। আশিক আরো একটু কাছে এগিয়ে এসে বলল
-খেয়েছ রাতে?
-হু, আপনাকে খাবার দেই?
-না, আমি সন্ধ্যায় খেয়েছিলাম একটু, এখন আর খাব না ।
-কিছুই খাবেন না?
আশিক ফিচেল হাসি হেসে বলল, কিছুই খাবোনা সেটা ঠিক না।
************
আজ আশিকের পরীক্ষা শেষ। গত দুটো দিন ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে গেছে। এই পেপারের প্রিপারেশন ভালো ছিল না। দুদিন চোখ মুখ বন্ধ করে পড়তে হয়েছে। সকাল থেকেই অফিসে চলে আসতো। মিরাকে বারণ করে দিয়েছিল আসতে, তবু প্রতিদিন বিকেলেই ও খাবার নিয়ে এসেছে । টুকটাক গল্প করে ফিরে গেছে। এর মধ্যে আশিক ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিল রিপোর্ট দেখাতে কিন্তু ফোন করে জানা গেছে ডাক্তার এক সপ্তাহের জন্য দেশের বাইরে গেছে। ফিরলে তখন দেখাতে হবে।
আশিক পরীক্ষা শেষ করে অফিসে চলে এলো। অফিসের অবস্থা ভয়ংকর হয়ে আছে। চারিদিকে সিগারেটের টুকরো, এলোমেলো কাগজপত্্ টেবিলের উপর বই খাতা ছড়ানো। আশিক এলোমেলো জিনিস একেবারেই সহ্য করতে পারে না, কিন্তু এই দুইদিনে সময় করে উঠতে পারেনি। দ্রুত হাতে সব গোচ গাছ করতে লাগলো ও। কাল রাতের ট্রেনে ওরা সিলেট যাচ্ছে, আর হয়তো এর মধ্যে অফিসে আসা হবে না। একটু গুছিয়ে না গেলে খারাপ লাগবে।
টেবিলের উপর থেকে বইপত্র সরাতে সরাতে হঠাৎই খেয়াল করলো মীরার ডাইরিটা রাখা। কাল এসেছিল যখন সম্ভবত ফেলে গেছে। আশিক একটু কৌতুহলী হয়ে তুলে নল। প্রথম দুই এক পাতায় চোখ বুলালো। বিভিন্ন কবির কবিতা লেখা। হঠাৎ ডায়েরির ফাঁক গলে একটা কাগজ পরল মেঝেতে। আশিক তুলে নিয়ে দেখলো কাগজ নয় একটা চিঠি। একটু অবাক হয়ে ভাঁজ খুলল। কোন সম্বোধন নেই। হয়ত ওর জন্যই লিখেছে, এই জন্যই কি ফেলে গেছে ইচ্ছে করে। আশিক হাসলো একটু আপন মনে , তারপর পড়তে শুরু করল। প্রথম লাইনেই লেখা
তোমাকে কয়েকটা জরুরি কথা বলব ।
মীরা বলেছিল কোন বিশেষ দিনে ওকে তুমি বলবে । আজকে তবে সেই বিশেষ দিন ? আশিক আবারো পড়া শুরু করলো
ভেবেছিলাম সামনাসামনি বলবো কিন্তু সেটা আর ইচ্ছে হলো না। আমি আর এভাবে পারছি না। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। তোমার প্রতি একটা কৃতজ্ঞতা বোধ ছিল তাই এতদিন চুপ করে ছিলাম, কিন্তু আর না। এবার একটা সিদ্ধান্তে আসতেই হবে।
চিঠিটা পড়তে পড়তে আশিকের হাসিটা কেমন মিলিয়ে গেল। একরাশ বিষন্নতা এসে ঘিরে ধরল ওকে । মিরা তাহলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে?
চলবে…………
বইছে আবার চৈতী হাওয়া
৬৪
আজ মীরার মনটা অসম্ভব ভালো। প্রথমত আজ আশিকের পরীক্ষা শেষ হচ্ছে তার উপর কাল রাতে ওরা সিলেট যাচ্ছে। কতদিন ধরে ওর স্বপ্ন ছিল। মীরা ওর ব্যগ বের করে গোছগাছ শুরু করে দিল। কোথাও যাওয়ার আগের প্রস্তুতি টুকুও বেড়ানোর আনন্দের একটা অংশ, অনেকেই সেটা বোঝে না।
যাবার আগে একটা কাজ শেষ করে যেতে হবে । শুভর চঠিটা টুম্পার কাছে পৌঁছে দিয়ে যেতে হবে। চিঠিটা শেষ করা হয়নি। আর লিখতে ইচ্ছা করছে না। যা হয়েছে তাই দিয়ে দেবে। এই ঝামেলা আর ভাল লাগছে না। কোথায় আশিকের সঙ্গে একটু মন খুলে কথা বলবে। সেটাই হচ্ছে না। ওর পরীক্ষার জন্য মীরা এতদিন অপেক্ষা করে ছিল। ডাক্তার বলেছে একটু রিস্ক আছে আপনি আপনার হাসবেন্ড এর সঙ্গে কথা বলুন। আমি দেশে ফিরলে দুজনে মিলে একসঙ্গে আসুন। এই ডাক্তার কে খুব ভাল লেগছে মীরার। বয়সে অনেক বড়, কিন্তু সবাইকে আপনি করে বলে। এমন কি বাচ্চাদেরকেও। তবে কথা বলে এক ধরনের নির্ভরতা জন্মায়। মীরা ঠিক করেছে আজ রাতেই আশিককে সব জানাবে।
আশিক ফিরল বিকেল নাগাদ। মীরা খাবার কথা জিজ্ঞেস করায় জানাল খাবে না। গোসল করে আবার বেরিয়ে গেল। মীরা জানতে চেয়েছিল কখন ফিরবে, জবাব দেয়নি অদ্ভুত ভাবে তাকিয়েছিল। মীরা সারা সন্ধ্যা অপেক্ষা করল। রাত বাড়তে লাগল কিন্তু আশিক ফিরল না।
বেশ রাত করে ফোনটা এল। মীরা নাম্বার বদলে ফেলেছে। এই নাম্বার সবাই জানেনা। এত রাতে কে ফোন করতে পারে? মীরা ফোন ধরার আগেই বন্ধ হয়ে গেল। চেক করে দেখল সুমনা। আবারো বাজছে। মীরা রিসিভ করে একটু অবাক হয়ে বলল
-কিরে কি হয়েছে?
-আপা, মায়ের শরীরটা ভাল নেই
মীরার বুকটা ধক করে উঠল। কদিন ধরে মার কথা খুব মনে পরছিল। ফোন করে কয়েকবার কথা ও বলেছে। রাতের দিকে বুকে ব্যথা হয়। মীরা বলেছিল ডাক্তার দেখাতে। মা আমলে নেয়নি, বলেছে আসিডিটি সেরে যাবে। আজ আবার কি হল। মীরা ভয়ে ভয়ে বলল
-কি হয়েছে রে?
-কদিন ধরে বুকের ব্যথাটা খুর বেড়েছে। একটু আগে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। জ্ঞান ফিরছিল না। আমরা খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
-ডাক্তার দেখাস নি? আমাকে ফোন করলি না কেন?
-মা ই নিষেধ করেছিল অত রাতে ফোন করতে। আমি আর বড়চাচা ডাক্তারের কাছে নিতে চেয়েছিলাম, যেতে চায় না।
-মাকে ফোন দে তো আমি কথা বলি।
-এখন ঘুমাচ্ছে
-আচ্ছা আমি একটু পরে আবার ফোন দিচ্ছি।
মীরা ওর সবচাইতে ভরসার জায়গাটাতে গেল। আরিফ সাহেব জেগেই ছিলেন। সব শুনে গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন কাল সকালেই রওনা হয়ে যেতে। সিলেট কদিন পরে গেলেও ক্ষতি নেই। মীরার মনটা খচ খচ করছিল। ওর অস্বস্তি টের পেয়ে আরিফ সাহেব বললেন
-আশিক এখনো ফেরেনি?
-না বাবা
-ঠিক আছে আমি ওর সঙ্গে কথা বলব। কাল সকাল সকাল চলে যাও। এবার তুমি একাই ঘুরে এস। এখন আশিক গেলে তোমার বাড়ীতে সবাই মিছেমিছি ওকে নিয়ে ব্যস্ত হবে। আমি রফিককে বলে দিচ্ছি। গাড়ি দুদিন তোমার সাথেই রাখো। দরকার লাগতে পারে। যাও ঘুমিয়ে পড়। আমি আশিকের সঙ্গে ফোনে কথা বলছি।
আরিফ সাহেব ফোন করে ছেলেকে পেলেন না। ভাবলেন হয়ত পরীক্ষা শেষ তাই বন্ধুদের নিয়ে আছে।
আশিক ফিরল গভীর রাতে। ভেবেছিল মীরা নিশ্চই ঘুমিয়ে পরবে। মীরা বাতি নিভিয়ে শুয়ে ছিল। আশিক উল্টোদিকে মুখ করে শুয়ে পরল। মীরা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল। তবু ওর দিকে ফিরল না, একটা কথা ও বলল না। মীরার অস্থির লাগছে। ও এমন করছে কেন? ও কি চায় না মীরা এখন যায়? একবার সেটা বললেই পারে। ওর নিজের ও তো যেতে ইচ্ছা করছে না। শুধু মায়ের শরীর খারাপ বলেই না যাচ্ছে। চলেই তো আসবে কদিন পর। এইরকম করলে যেতে ইচ্ছা করে? ফেরার পর থেকে ঠিক মতো কথা ও বলছে না। এখনো অন্য দিকে ফিরে আছে। মীরা একটা হাত ওর পিঠে রেখে বলল
-আমার সঙ্গে কথা বলবেন না?
আশিক অন্য দিকে ফিরেই বলল
-কথা তো বলছি
-একবার আমার দিকে তাকাবেন ও না? আমি কাল চলে যাচ্ছি
আশিকের বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল। মীরা এত স্বাভাবিক ভাবে বলছে কি করে? ওর কি একটু ও কষ্ট হচ্ছে না? মিরা এবার ওর কাধে হাত রাখল। তারপর বলল
-আমার দিকে ফিরুন।
আশিক অনিচ্ছা নিয়ে ফিরল। আবছা অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে মিরার চোখ চিকচিক করছে। মীরা ঠোট কামড়ে কোন মতে বলল
-আমি কি কোন ভুল করেছি?
-ভুল করবে কেন?
-আপনি কি চান না আমি যাই?
আশিক এবার একটু সহজ হল। মাথার হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল
-তুমি চাইছো তো, তাহলেই হবে
মীরার কান্না আরও বাড়লো। দুই হাতে ওকে আকড়ে ধরে বুকের মধ্যে মুখ গুজে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। আশিক খুব অসহায় বোধ করছে। মীরা কে সরিয়ে দিতে চাইছে, কিছুতেই পারছে না। মীরা কাদতে কাদতেই বলল
-আপনি না চাইলে আমি যাব না
আশিক নিজেকে শক্ত করলো। শেষ বেলায় এসে এভাবে দুর্বল হয়ে যাবার কোন মানে হয়েনা। বলল
-শান্ত হও মীরা।
-আপনি আসবেন তো আমার সঙ্গে দেখা করতে?
-আমি ?
আশিক ম্লান একটু হাসলো। জবাব দিল না। মীরা মুখ তুলে কিছুক্ষণ ওর মুখে জবাব খুজল তারপর এগিয়ে এসে ঠোটে ঠোট রাখল। গভীর চুমু খেল অনেকক্ষণ ধরে। আশিক চেষ্টা করেও শরীরের টান এড়িয়ে যেতে পারল না। মীরা কে কাছে টেনে নিল। ঠিক যখন মীরার মনে হতে শুরু করল আর ওদের মাঝে কোন আড়াল নেই আশিক কেমন যেন শীতল হয়ে গেল। ওর মনে হতে লাগল মীরা বোধ হয় ওকে করুণা করছে। শেষ বারের মতো দয়া দেখাচ্ছে। এক আকাশ বিস্ময় নিয়ে মীরা ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল
-কি হয়েছে?
ওর সেই টলটলে চোখ আর মায়াবী মুখের দিকে তাকিয়ে আশিক নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করল। মীরা ঘুমিয়ে পরার পরেও অনেক ক্ষণ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। তার ও অনেক অনেক ক্ষণ পর যখন মীরা ঘুমে অচেতন, আশিক মুখ নামিয়ে ওর চুলের সুগন্ধ নিল। আজো সেইরকম আছে, সেই প্রথম দিনের মতই। ওর চুলের মধ্যে মুখ ডুবিয়েই আনমনে বলল
আমার চোখের মধ্যে যে রূপালি নিঝুম শহর আছে এক
তার অলৌকিক অলিগলি আর হৃদয়ের ধুলো ওড়া পথে
জেগে থাকে তার পদচিহ্ন প্রত্যাশার মতো, হয় না নিশ্চিহ্ন
ঝড় জলে। হাঁসময় সন্ধ্যার আকাশে কবিতার পঙক্তি দোলে,
না কি শাড়ি তার ওড়ে নক্ষত্রমালায়। প্রতীক্ষায় কখন যে
সন্ধ্যার আকাশ ফের ভোরের আকাশ হয়ে যায়, রিক্ত লাগে।
আজকের কবিতার নাম ভালো থেকো সুখে থেকো লিখেছেন শামসুর রহমান
চলবে…………
বইছে আবার চৈতী হাওয়া
৬৫
আশিক বসে আছে একেবারে জলের ধার ঘেঁষে। আকাশে মেঘ করে আছে। চাঁদের দেখা নেই। চারিদিকে কেমন বিষণ্ণ আবছা আঁধার। নাকি ওর মনের মধেই এক আকাশ বিষণ্ণতা, বুঝতে পারল না। ওর থেকে একটু দূরে সাত আটজন ছেলেমেয়ে জটলা বেধে বসে গল্প করছে। মাঝে মাঝেই ওদের উচ্চস্বরে হাসির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। অন্য পাশে একজোড়া ছেলে মেয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে আছে। গল্প করছে একান্তে। আশেপাশের এত সোরগোল ওদের নিবিড় আলোচনায় ব্যঘাত ঘটাতে পারছে না। আশিক দুই এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে নিল। আজ সব ঠিক থাকলে এখানে ওর আর মিরার থাকার কথা ছিল।
আশিক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। রাত বাড়ছে। আশেপাশে কারো মধ্যে কোন তাড়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। সবাই কেমন ঢিলেঢালা আমেজে আছে। মাথা ধরেছে। চা খাওয়া দরকার। মীরার হাতে বানানো চা। কি দারুণ চা করে ও। ধুর! সব কিছুতে কেন যে মীরা এসে যায়? ও বাড়ি ছেড়ে এসেছে দুসপ্তাহ হয়ে গেছে। মীরার ভাবনা থেকে পালাতে এখানে আসা। তবু কি করে যেন সব কিছুতেই মীরাকে মনে পড়ে।
আশিক উঠে দাঁড়াল। হাতের বালি ঝেড়ে সামনে তাকাল। সমুদ্রের সবুজাভ ঢেউ নজরে আসছে। হোটেলে ফিরতে হবে। পরশু রাতে ও সেন্টমারটিন এসে পৌঁছেছে। সেদিন সকালে উঠে কাউকে কিছু না জানিয়ে বেরিয়ে এসেছে। মীরা তখন ঘুমে অচেতন। ভালোই হয়েছে। ওকে বিদায় দেয়া কিংবা ওর থেকে বিদায় নেয়া, দুটোর কোনটাই সম্ভব ছিল না আশিকের পক্ষে।
এখানে ও আগে অনেকবার এসেছে। যায়গাটা দ্রুত বদলে যাচ্ছে। আগের সেই অকৃত্রিমতা আর নেই। ভালো লাগে না। তবু কোথাও একটা তো যেতেই হতো। আগে প্রতি বছরই আসতো বন্ধুদের সাথে। বাধা হোটেল ছিল, সেখানেই উঠত। ম্যনেজার থেকে শুরু করে স্টাফ সবাই ওর চেনা। হুটহাট চলে এলে রুম পেতে সমস্যা হতো না। এবার ও ওখানেই উঠেছে।
হাটতে গিয়ে বোতলটা পায়ে বাঁধল। আশিক তাকিয়ে দেখল একবার। তুলে নিল না। আবার বসে পরল আগের জায়গায়। কাল রাতে এটা দিয়ে গেছে। আগে রাসেল সহ এলে ওই জোগাড় করত। রাতে বিচে বসে খেত সবাই। ছেলেটা বোধ হয় চিনেছে ওকে। কাল জানতে চাইছিল লাগবে কিনা। আশিক দিয়ে যেতে বলেছিল। আজ নিয়ে এসেছিল সঙ্গে করে, খোলা হয়েনি এখনো। আশিক কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল বোতলটার দিকে। এগুলো এখন আর টানে না ওকে। মীরা ওকে অনেকটাই বদলে দিয়েছে। আশিক বোতল খুলে পুরোটা পানীয় বালিতে ঢেলে দিল। তারপর বোতলটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আকাশের দিকে মুখ করে শুয়ে পরল। মেঘ কেটে আকাশ পরিস্কার হয়ে গেছে। মিটি মীটি তারার অস্তিত্ব চোখে পরছে। আশিক চোখ বন্ধ করল তারপর অনুচ্চ স্বরে আবৃত্তি শুরু করল। বলতে বলতে একসময় কেমন নেশা ধরে গেল।
যে আমাকে প্রেম শেখালো
জোৎস্না রাতে ফুলের বনে
সে যেন আজ সুখেই থাকে
সে যেন আজ রানীর মত
ব্যক্তিগত রাজ্যপাটে
পা ছড়িয়ে সবার কাছে
বসতে পারে
বলতে পারে মনের কথা
চোখের তারায়
হাত ইশারায়
ঐ যে দেখ দুঃখি প্রেমিক
যাচ্ছে পুড়ে রোদের ভিতর
ভিক্ষে দিলে ভিক্ষে নেবে
ছিন্ন বাসে শীর্ন দেহে
যাচ্ছে পুড়ে রোদের ভিতর
কিন্তু শোন প্রজাবৃন্দ
দুঃসময়ে সেই তো ছিলো
বুকের কাছে হৃদয় মাঝে
আজকে তারে দেখলে শুধু
ইচ্ছে করে
চোখের পাতায় অধর রাখি
যে আমাকে প্রেম শেখালো
প্রেম শিখিয়ে চিনিয়েছিলো
দুষ্টু গ্রহ অরুন্ধতী
বৃষ্টি ভেজা চতুর্দশী
জোৎস্না রাতের উজ্জ্বলতা
ভোরের বকুল শুভ্র মালা
নগর নাগর ভদ্র ইতর
রাজার বাড়ি
সেই তো আবার বুঝিয়েছিলো
যাওগো চলে আমায় ছেড়ে
যে আমাকে প্রেম শেখালো
জোৎস্না রাতে ফুলের বনে
সে যেন আজ সুখেই থাকে
নিজের দেহে আগুন জ্বেলে
ভেবেছিলাম
নিখাদ সোনা হবোই আমি
শীত বিকেলের টুকরো স্মৃতি
রাখবো ধরে সবার মত
হৃদয় বীণার মোহন তারে
ভুলেই গেলাম
যখন তুমি আমায় ডেকে
বললে শুধু
পথের এখন অনেক বাকি
যাও গো শোভন
যাও গো চলে বহুদুরে
কণ্ঠে আমার অনেক তৃষা
যাও গো চলে আপন পথে
এই না বলেই
হাসলে শুধু করুন ঠোঁটে
বাজলো দুরে শঙ্খ নিনাদ
কাঁদলো আমার বুকের পাথর
কাঁদলো দুরে হাজার তারা
একলা থাকার গভীর রাতে
একলা জাগার তিন প্রহরে
তাইতো বলি সবার কাছে
যে আমাকে দুঃখ দিলো
সে যেন আজ সবার চেয়ে
সুখেই থাকে
যে আমাকে প্রেম শেখালো
প্রেম শিখিয়ে বুকের মাঝে
অনল দিলো
সে যেন আজ সবার চেয়ে
সুখেই থাকে
সুখেই থাকে।।
আশিক চোখ মেলে আশ্চর্য হয়ে গেল। অনেক লোক ঘিরে আছে ওকে চারদিক থেকে। কেউ কেউ ছবি তুলছে, কেউ আবার ভিডিও করছে। চিনেছিস? অই যে কবি, আমি যার পেইজের ফলোয়ার। ওহ! আমার ক্রাশ। এই জাতীয় মন্তব্য ভেসে আসছে আশপাশ থেকে। আশিক তড়িৎ গতিতে উঠে দাড়াল তারপর কোনদিকে না তাকিয়ে হন হন করে হাটা দিল। পেছনে পরে রইল অসংখ্য মুগ্ধ চোখ।
আশিক একটা ঘোরের মধ্যে হাঁটছে। কেন যেন খুব কান্না পাচ্ছে বহুদিন পর। মীরার কথা খুব মনে পড়ছে। ও ভালো আছে তো? ওর শরীরটা ভাল ছিল না। শুভ পারবে তো সবটা সামলে নিতে? মীরা বড় আযত্ন করে নিজের। রিসেপসান থেকে চাবি নেয়ার সময় টের পেল কেউ একজন কাধে হাত রেখেছে। পেছন ফিরে ও চমকে গেল।
চলবে…………
বইছে আবার চৈতী হাওয়া
৬৬
জানালার বাইরে একটা শালিক এসে বসেছে। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসছে। একটু ভয় ও নেই মনে। গ্রিলের অন্নপাশে বটিতে নারকেল মুড়ি রাখা। পাশে চায়ের কাপ। জুরিয়ে গেছে বহু ক্ষণ। মুড়ি গুলো ও নেতিয়ে গেছে।
মীরা কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে পাখিটার দিকে তাকিয়ে রইল তারপর একমুঠো মুড়ি তুলে আস্তে করে ছড়িয়ে দিল জানালার বাইরে। পাখিটা গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এলো। একটু কাছে, আরো একটু, তারপর খেতে লাগলো। এবার ও দূরের রাস্তার দিকে তাকাল। সকাল থেকেই জানালার ধারে বসে আছে। সুমনা কয়েকবার খেতে ডেকেছে। যেতে ইচ্ছা করেনি । পরে চা আর মুড়ি দিয়ে গেছে, সেটাও মুখে দেয়নি।
পাখিটা কি আয়েশ করে খাচ্ছে। আরেক মুঠো তুলে ছড়িয়ে দিল ও। পাশের কার্নিশ থেকে কয়েকটা কাক আর চড়ুই পাখি তাকিয়ে আছে। বোধহয় আসবে কিনা ঠিক করতে পারছে না। মীরা আবার বাটিতে হাত দিল কিন্তু আর তুলতে পারল না, তার আগে কেউ একজন পাশ থেকে বলল
– এই যা। যা এখান থেকে। অলক্ষী পাখি। যা দুর হ।
মীরা চমকে তাকালো। বড় চাচী। চাচি কাছে এসে ওর মাথায় হাত রাখল তারপর বলল
– কিছুই তো খেলিনা। এমন করলে চলবে ? শরীর ঠিক রাখতে হবে তো।
আর ওই অলক্ষনে পাখিটাকে একটুও খাবার দিবি না। জানিস না তুই এক শালিকে দুঃখ হয়।
মিরা জবাব দিল না। আর কি দুঃখ হবে ওর? যা হবার তো হয়েই গেছে। গত দশ দিনে আশিকের সঙ্গে ওর কোনরকম যোগাযোগ হয়নি। এতবার ফোন করেছে, প্রতিবারেই ফোন বন্ধ দেখায়। সেদিন ভোরবেলা উঠে মীরা বিশ্বাসই করতে পারেনি যে আশিক ওকে বিদায় না দিয়ে এভাবে চলে যাবে। গাড়িতে ওঠার আগে ভীষণ কান্না পাচ্ছিল ওর। একটা সময় আর পারেনি, সত্যি সত্যি কাঁদতে শুরু করেছিল। ওর থেকে অবশ্য বেশি কাঁদছিল রোজিনা আর আফসিন। আরিফ সাহেবের গলা ভার হয়ে ছিল। উনি কাছে এসে মীরার মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন
আরে পাগলি মেয়ে, বাপের বাড়ি যাওয়ার আগে কেউ কাঁদে? সবাই তো শ্বশুরবাড়ি আসার আগে কাঁদে।
আফসিন মিরাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল ভাবি তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো। তুমি না থাকলে ভালো লাগেনা
মীরা বারবার এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল। ভেবেছিল হয়তো আশিক আশেপাশেই কোথাও গেছে। ও বেরোনোর আগে ঠিক চলে আসবে। আরিফ সাহেব ও অপ্রস্তুত হচ্ছিলেন । শেষমেষ বললেন
তুমি রওনা দিয়ে দাও। ওই পাগল ছেলের কথা আর বলো না, কাউকে বিদায় দিতে পারেনা। ফোনে কথা বলে নিও।
মীরা ফোন করেছিল । একবার নয় অসংখ্যবার। আশিক ফোন ধরেনি। পরের দিকে ফোনটা বন্ধ দেখাচ্ছিল। বাড়ি ফেরার পর মাকে নিয়ে দুদিন ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে গেছে। এর মধ্যেও ফোন করেছে কয়েকবার। প্রতিবারই ফোন বন্ধ ছিল।
দুদিন হাসপাতালে রেখে মাকে ছেড়ে দিল। তেমন সিরিয়াস কিছু হয়নি। তবে ডাক্তার বলেছে উনি অনেক অযত্ন করেন। প্রেসার অনেক লো, আলসারও ধরা পড়েছে । অনেক যত্নে রাখতে হবে। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করাতে হবে। ফেরার পর থেকে মা কেমন খিটখিটে হয়ে গেছে। শুধু তাই নয় যখন যা মনে আসে তাই বলে। মীরা জবাব দেয় না। এমনিতেই মায়ের মন খারাপ। ওর বিয়ের পর থেকে ভীষণ রকম ইনসিকিউরিটিতে ভুগছে। ব্যাপারটা যে কেউ বোঝে না তা নয়। বড় চাচা মায়ের সঙ্গে কথা বলেছে। বলেছে তার সম্পত্তি তাকে বুঝিয়ে দেবে। সেটাতেও রাজি না আমার কথা শোনাতেও ছাড়ছে না। মীরা আজকাল একটু দূরে দূরেই থাকে। ওকে দেখলেই মা কেমন উত্তেজিত হয়ে যায়। অনেক কথা বলে। প্রথমদিকে আরিফ সাহেব প্রতিদিন ফোন করে খোঁজ নিতেন। গত কদিন ধরে সেটাও করছেন না। এটা নিয়ে ও মায়ের অভিযোগের শেষ নেই। আজ সকালে খেতে ডাকার পর মীরা সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই শুনেছিল মা বলছে
-দুদিন ফুর্তি করে মন ভরে গেছে। আর ভালো লাগবে কেন? যা ঘটানোর তা তো ঘুটিয়েই ফেলেছে। আর রেখে কি করবে? তাই ফেলে রেখে গেছে।
– আহ রেহানা চুপ কর। মেয়েটা শুনতে পাবে
-শুনলে শুনুক। ওর জন্যই তো হয়েছে এইসব। অফিসে গিয়েছিল না? এইসব করতেই তো গিয়েছিল। কেমন? এখন মজাটা বুঝুক। আমারই কপাল খারাপ। মা হয়ে ফেলে তো আর দিতে পারি না।
লজ্জায় মীরার ইচ্ছা করছিল মরে যেতে। আর নিচে যেতে পারে নি ও। উপরে উঠে জানালার ধারে বসে ছিল।
এখানে এসো কাউকে কিছু জানায়নি ও। কিন্তু বড়চাচী কি করে যেন ধরে ফেলল। মকে হাসপাতাল থেকে আনার একদিন পর দুপুড়ে ঘুমিয়ে ছিল মীরা। ঘুম ভেঙে দেখল বড়চাচী চা নিয়ে এসেছে। একটু লজ্জা পেয়েছিল । অবাক ও হয়েছিল। বড়চাচীর সঙ্গে ওর সম্পর্কটা সহজ নয়। বিশেষ করে যখন থেকে সৌরভ এর সাথে বিয়ের ধোয়াটা উঠেছিল। বরাবর অবশ্য এমন ছিল না। ছোটবেলায় ও চাচীর আশেপাশেই ঘুরঘুর করত। কত কি খেতে মন চাইত। চালতার আচাড়, কুমড়ার মোড়ব্বা, বাদামের সরবত। মা এসব করতেই পারত না। সব আবদার ছিল তার কাছে। চাচি মুখ ঝামটা দিত, কথা শোনাত কিন্তু দিন শেষে ঠিকই বানিয়ে দিত।
মীরা উঠে বসল। শরীর ভরা আলস্য। চাচী পাশে বসে বলল
– কিরে ক মাস?
মীরা একটু চমকাল। কথা এড়িয়ে গিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিল। চাচী আবার ও জানতে চাইল।
-কিরে কিছু বলিস না যে। ভুলে যাস না তোরা তিন বোন কিন্তু আমার হাতেই বড় হয়েছিস। তিন বারই আমি তোর মা কে আগলে রেখেছি।
মীরা লুকায়নি, সবই বলেছিল। সঙ্গে এটা ও বলেছিল এখনি কাউকে কিছু না জানাতে। কিছু জটিলতা আছে ঢাকায় ফিরে ডাক্তার দেখিয়ে তারপর সবাইকে জানাবে। চাচী কথা রেখেছিলেন, কাউকে জানাননি, তবে মীরা অবাক হয়ে লক্ষ করেছে এরপর থেকে চাচি ওর প্রতি বিশেষ যত্ন নিচ্ছে। তবে গতকাল শরীর এত খারাপ হয়ে গেল যে আর লুকিয়ে রাখা গেল না।
মীরা আর পারছিল না। এক সপ্তাহের বেশি হয়ে গেছে কোন ভাবেই আশিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না ও নিজে তো ফোন করছেই না মিরা ফোন করলে হয় ধরছে না অথবা ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। বাড়িতেও ফোন করেছিল সেখান থেকে জানতে পেরেছে আশিক কোথায় আছে কেউ জানে না। শেষ বার মীরার সঙ্গে কথা বলে আরিফ সাহেব খুব অপ্রস্তুত হয়েছেন। হয়তো এ কারণেই দুদিন ধরে ফোনও করছেন না। মিরার কিছু ভালো লাগে না খেতে ইচ্ছা করে না, কোন কিছুতে মন বসে না। বিকেলের দিকে ছাদে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল। তারপরই চাচি আর সৌরভ মিলে ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। ডাক্তার অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বলল টেস্ট করতে হবে। টেস্টের রিপোর্টগুলো নিয়ে এসেছিল ও। ডাক্তারকে দেখানোর পর উনি বেশ গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন
আপনার হাসবেন্ড কোথায়?
মীরা জানাল সে ঢাকায়, কদিন পর মীরা ও সেখানে চলে যাবে। কিন্তু এরপর ডাক্তার যা বললেন তা শুনে সবাই চিন্তায় পড়ে গেল। মীরার শরীরে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা অস্বাভাবিক রকমের কম এছাড়াও আরো কিছু জটিলতা আছে। ডাক্তার জানালেন ভেরি রিস্কি প্রেগনেন্সি। আরো কিছু টেস্ট করতে হবে। ঢাকায় থেকে চিকিৎসা করতে পারলেই ভালো।
মীরা জানেনা ওর ঢাকা ফেরা হবে কিনা। আশিক কি সত্যি ওকে ভুলে গেছে? সত্যিই ওর মন ভরে গেছে? এতটাই নড়বড়ে ওদের সম্পর্ক? বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে না। তবে কি হয়েছে? যে ভয়টা ওর মনের ভিতর অতলে কোথাও লুকিয়ে আছে, তবে কি সেরকম কিছু হয়েছে? শুভ কিছু জানিয়েছে ওকে? কিন্তু ওতো মীরার সঙ্গে কথা বলতে পারত। জিজ্ঞেস করতে পারত একবার। এভাবে পালিয়ে যাবার কি অর্থ? নাকি মা যা যা বলছে সেটাই ঠিক? মীরা জানেনা তবে ও প্রতিদিন অপেক্ষা করে। প্রতিদিন ওর মনে হয় এই হয়তো আজ আশিক আসবে।
এই জানালার ধারে বসলে দক্ষিণের রাস্তাটা দেখা যায় । শহর থেকে কেউ ওদের বাড়িতে এলে এদিক দিয়েই আসতে হয়। মীরা সারাক্ষণ প্রতীক্ষায় থাকে। মাঝে মাঝে দেখে দূরে বহু দূরে একটা অস্পষ্ট অবয়ব। তবে যখন সেটা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে তখন বুঝতে পারে, এ অন্য কেউ।
পাখিটা আবারো এসে বসেছে। চাচী , এবার হাত বাড়িয়ে জানালাটা বন্ধ করে দিল তারপর বলল
তোর খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি। সুমনা কেও পাঠিয়ে দিচ্ছি। একদম ঠিক মতন বসে খাবি।
মিরা কিছু বলল না ম্লান একটু হাসল। চাচী চলে গেলে ও আবার জানালাটা খুলে দিল। এক ঝলক দমকা হাওয়া এসে ওর চুল গুলো এলমেলো করে দিয়ে গেল। মীরা চুল সামলে আবার দক্ষিণের রাস্তাটার দিকে তাকাল। দূরে একটা ছায়া পড়েছে। মীরা চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলল এটা যেন আশিক হয়। চোখ মুদেই অপেক্ষা করল দরজায় কড়া নাড়ার। তার ও অনেকক্ষণ পর চোখ মেলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আনমনে বলল
তুমি ফিরবে কোন একদিন
হয়তো নীলিমায় হারানো কোন এক নিষ্প্রভ
বেলায়। নতুবা কোন এক নবীন হেমন্তে,
এক নতুন দিনের নির্মল খোলা হাওয়ায়।
অথবা কোন এক শ্রাবণের দিনে
অহরহ ঝরা ঘন কাল মেঘ বৃষ্টির
মুহু মুহু নির্ঝর খেলায়।
তুমি ফিরবে কোন এক রাতে
পূর্ণিমার ভরা জোছনায়।
তুমি ফিরবে জানি বহুদিন পরে
হয়তো বা হাজার বছর পরে।
কোন এক নিঃস্ব হৃদয়ে,
লক্ষ্য প্রাণের ভিড়ে, তুমি ফিরবে।
বহুরুপে সেই প্রাণে, অনেক নবীনের ভিড়ে,
তোমার আমার গড়া ভালবাসার নীড়ে!
চলবে………