বইছে আবার চৈতী হাওয়া পর্ব-৬০+৬১+৬২

0
696

বইছে আবার চৈতী হাওয়া
৬০

-তুমি আমাকে বারবার ফোন দিচ্ছ কেন শুভ?
-কারন তুমি ফোন কেটে দিচ্ছ। কথা না বললে তো আবার ফোন দিতেই হবে। তাই না?
-কেটে দিচ্ছি তার মানে আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী না, এই সহজ ব্যপারটা বুঝতে পারছ না?
-ও। আমি ভেবেছিলাম হয়ত আশিক আশেপাশে আছে তাই ফোন কেটে দিচ্ছ।

মীরা একটু ক্ষণ চুপ করে রইল। কথাটা একেবারে মিথ্যা ও নয়। যে কবার ও ফোন দিয়েছে আশিক কাছেই ছিল, অবশ্য না থাকলেও ও আর শুভর সঙ্গে কথা বলতে চায় না। মীরাকে চুপ করে থাকতে দেখে শুভ বলল
-আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই
-কেন?
-জরুরী কিছু কথা আছে
-তোমার সঙ্গে আমার কোন কথা নেই।
-তোমার নেই কিন্ত আমার আছে। কথা বলতে চাইছ না কেন? আশিক কি আশে পাশে আছে?
-না
মীরা সত্যি কথাটাই বলল। বাড়িতে কেউই নেই। আশিক ওর অফিসে, আরিফ সাহেব কোর্টে গেছেন। রোজিনা আর আফসিন মিলে কেনাকাটা করতে গেছে। মীরা রান্না বসিয়েছিল এর মধেই ফোনটা এসেছে।
-গুড। না থাকলেই ভাল।
মীরা ভুরু কুচকে বলল
-সমস্যা কি তোমার? কি চাও এতদিন পর?
-আমার সঙ্গে একবার দেখা কর। তুমি সবটা জান না। জানলে এভাবে…
-আমার কিছু জানার দরকার নেই। আমি ফোন রাখছি, আর কখনো আমাকে ফোন করবে না।
-আচ্ছা আচ্ছা, এখন দেখা করতে না চাইলে করো না কিন্তু আমার একটা কথার জবাব দাও
– কি?
-তুমি কেমন আছ?
-হঠাৎ এই প্রশ্ন?
-শুনলাম সেদিন তুমি ক্লাশে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে? আশিক কি তোমার উপর বেশি টর্চার করছে?
মীরার এমন মেজাজ খারাপ হল, মনে হল শুভ হাতের কাছে থাকলে গরম খিচুরির পাতিল ওর মুখে ছুঁড়ে মারত। বহু কষ্টে মাথা ঠান্ডা করে বলল
-সবাই কে নিজের মত ভাব কেন? অবশ্য তোমার কাছ থেকে এরকমটাই আশা করা যায়। একটা কথা খুব ভাল করে শুনে রাখ, ওনার ব্যপারে একটা বাজে কথা ও আমি সহ্য করব না
-উনি টা কে ?
মীরা দতেঁ দাত পিষে বলল
-আশিক ভাই
-এখনো ভাই বল নাকি? যাক ভালই
-মীরার ইচ্ছা হল শুভর গলা টিপে ধরতে। কি যে হয়েছে আজকাল আল্পতেই মেজাজ এত খারাপ হয়ে যায়। মীরাকে চুপ করে থাকতে দেখে শুভ আবার শুরু করল
– শোন, দেখা করে কথা বললে ভাল হতো, কিন্তু তুমি যখন চাইছ না ফোনেই শোন
-কি বিষয়ে?
-সব ওই রাসেল বদমাইশটার জন্য হয়েছে। আমি জেনেছি তোমার আর আশিকের মধ্যে কিছু ছুল না, অ্যান্ড আম শিওর এখনো নেই……
-বাহ, যখন আমাদের মধ্যে কিছু ছিল না তখন তুমি ভাবতে আমাদের মধ্যে সম্পর্ক আছে আর এখন যখন আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে তখন বলছ আমাদের মধ্যে কিছু নেই?
– যদি থাকেও আমার কিছু যায় আসে না।
-মানে?
-তুমি তো আর আশিককে ভালোবাসো না। বিপদে পড়ে বিয়ে করেছিলে। সেদিন আমি যদি রাজি হতাম তাহলে আজকে তুমি আমার কাছে থাকতে।
-তুমি তো রাজি হওনি। আমাকে বিশ্বাস ও করোনি বরং বিচ্ছিরি ভাবে আপমান করেছিলে।কি জানো শুভ, তবু আমি তোমার উপর রাগ করতে পারি না। কেন জান?
-কারন তুমি এখনো আমাকে ভালবাসো
মীরা ম্লান একটু হাসলো, তারপর বলল
-না, কারন আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ। তোমার উপকার আমি কোনদিন ও ভুলব না। সেদিন যদি তুমি তোমার আসল রূপটা না দেখাতে, তাহলে আমি কোনদিন ও উনাকে পেতাম না। কখনো জানতেই পারতাম না ভালবাসা কি।

-শোন মীরা আশিক তোমাকে হিপনোটাইজ করে রেখেছে। তুমি ওর মোহে অন্ধ হয়ে আছো। এইজন্য এসব কথা বলছ। কিন্তু এটা বেশি দিন থাকবে না। তুমি জান না ও সব মেয়েদেরকেই এভাবে……
মীরা ওকে কথা শেষ করতে দিল না, তার আগেই বলল
-তুমি ঠকই বলেছ আমি অন্ধ হয়ে গেছি। ওর ভালবাসায় আমি অন্ধ হয়ে গেছি। এতটাই অন্ধ যে আমার সামনে কেউ ওর ব্যপারে খারাপ কিছু বললে আমি তাকে খুন করে ফেলতে ও দ্বিধা করব না।

শুভ একটু থমকালো। হঠাৎ করে বলার মতো কিছু খুজে পেল না। মীরা থেমে থেমে বলল
-তুমি আর কক্ষনো আমাকে ফোন করবে না কিংবা আমাদের মাঝখানে আসার চেষ্টা করবে না।
– মীরা তুমি বুঝতে পারছো না, একবার দেখা করো আমি তোমার সব ভুল ভঙ্গিয়ে
দেব, আমি…
-শুভ, আমাকে বাধ্য করো না। আমি যদি ওকে জানাই তুমি কি করছো, তারপর তোমার কি হবে তার নিশ্চয়তা আমি দিতে পারবো না।
-মীরা……
-আর একটা কথা ও না। শেষ বার বলছি আর আমাকে ফোন করবে না।

মীরা ফোন রেখে হাপাতে লাগল। মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করছে। চুলা বন্ধ করে দিল ও। খিচুড়ি সেদ্ধ হয়ে গেছে, মাংসটাও বোধহয় তলা দিয়ে ধরে গেছে।

রান্নাঘরে বসার মত কিছু নেই। মীরা আস্তে আস্তে হেটে ডাইনিং রুমে চলে গেল। চেয়ারটা টেনে বসার শক্তি ও নেই। কি যে হয়েছে আজকাল, এত দুর্বল লাগে। হাতের মুঠোয় ফোনটা বেজেই যাচ্ছে। এই ছেলেটার কি কোন সেন্স নেই। এতবার বলার পরেও ফোন করেই যাচ্ছে। মীরা ফোন কানে ঠেকিয়ে বিরক্ত কন্ঠে বলল
-কি ব্যপার? আর কতবার নিষেধ করব ফোন করতে?
-মীরা, কি হয়েছে?
মীরা চমকে উঠে বলল
-আপনি?
-তোমার গলা এমন শোনাচ্ছে কেন? শরীর খারাপ লাগছে?
-না আমি ঠিক আছি।
-খেয়েছ দুপুরে?
-না, ভেবেছিলাম আপনার ওখানে খাবার নিয়ে যাব তখন একসাথে খাব কিন্তু গাড়ি এখনো ফেরেনি।
-তুমি কি বাসাইয় একা?
-হ্যাঁ
-সেকি! আচ্ছা ঠিক আছে আমি চলে আসছি
-না না। কাল তো আপনার পরীক্ষা, একবারে পড়া শেষ করে রাতে আসুন। আমি আসছি খাবার নিয়ে
-একদম না। ডাক্তার তোমাকে রেস্ট নিতে বলেছেন না। তুমি একেবারেই কথা শোন না। তুমি বাসা থেকে বের হবে না। আমি এখনি আসছি।
-না শুনুন…
আশিক শুনল না। ফোন রেখে দিল । ও কেমন অস্থির হয়ে যায়। মীরা ওর পরীক্ষার মধ্যে যেতে চায়নি তবু জোর করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে। দুই ঘন্টা বসে থেকে তবে ডাক্তার দেখাতে পেরেছে। কতটা সময় নস্ট হল পরীক্ষার আগের দিন। তাতেও যদি শেষ হত, ডাক্তার একগাদা টেস্ট দিল। পরদিন আবার ওকে নিয়ে গেল সেগুলির জন্য। মীরার কেন যেন ভাল লাগছিল না। এত টেস্ট কেন করতে হবে? ওর যদি খারাপ কিছু হয় আশিক নিতে পারবে তো।

মীরাকে অবাক করে দিয়ে আশিক পনের মিনিটের মধ্যে বাসায় চলে এল। মীরা তখন সবে গোসল শেষ করে বেরিয়েছে।আশিক ওকে দেখে থমকে গেল। এত ফ্যকাশে লাগছে কেন? মীরা খেতে ও পারল না ঠিকমত। রাতে ছাড়া ছাড়া ঘুম হল। সকালে ঘুম ভেঙে দেখল আশিক বেরিয়ে গেছে। নোটপ্যডে লিখে রেখে গেছে বাসায় থেকে রেস্ট নিতে, ও আসার সময় টেস্ট রিপোর্ট নিয়ে আসবে, রাতে সগুলো নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।

সকাল থেকেই মীরার খুব অস্থির লাগছিল, ভয় ও,করছিল একটু, তাই আর আশিকে্র জন্য অপেক্ষা করল না, দুপুড় নাগাদ রিক্সা নিয়ে হাসপাতালে চলে গেল। একতলা থেকে রিপোর্ট তুলে ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করে ফেলল। ইনি আশিকদের পারিবারিক ডাক্তার। ওর জ্বরের সময় বাড়িতে দেখা হয়েছে। সেদিন আশিকের সঙ্গে এসেও দেখিলে গেছে তাই বেশীক্ষণ বসতেঁ হল না। ডাক্তার রিপোর্ট দেখে যা বললেল মীরা বুঝল না খুশি হবে না ভয় পাবে। শুধু একটা কথাই মনে হল আশিকের সঙ্গে কথা বলতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব কথা বলতে হবে।

চলবে………

বইছে আবার চৈতী হাওয়া
৬১

মীরার নিষেধ করা সত্ত্বেও শুভর ফোন আসা বন্ধ হলো না। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে রিক্সায় উঠতে যাবে তখনি টের পেল ব্যগের মধ্যে ফোন ভাইব্রেট করছে। মীরা ভাবল হয়ত বাড়ী থেকে কেউ, কারন আশিকের এখনো পরীক্ষা শেষ হয়নি। আরো দশ মিনিট বাকী। মীরা রিক্সায় উঠে ফোন কানে ঠেকিয়ে বলল
হ্যলো
মীরা তুমি জান আশিকের কি হয়েছে?
মীরার মনে হল হৃৎপিণ্ডটা গলার কাছে চলে এসেছে। রিক্সার হুডটা শক্ত করে ধরে ও কোনমতে বলল
-কি হয়েছে ওর? ও ঠিক আছে তো?
শুভ বিরক্ত কন্ঠে বলল
-কি আবার হবে? কিছু হয়েনি। বলছিলাম ও কি করেছে জান?
-কি?
-আশিক আজকে নকল করেছে
মীরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
-তুমি কি এই পরীক্ষার ইনভেজিলেটর ?
-না, মানে…
-তুমি দেখেছ ওকে নকল করতে?
-না, কয়েকজন বলছিল
-তুমি টিচারকে বললেই পারতে।
-তুমি আমার কথা বিশ্বাস করোনি। তাইনা?
মীরা তীব্র কন্ঠে বলল
-না
-ওকে এত বিশ্বাস কর?
-হ্য করি। আমার নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করি।
-আশিক এই দুই মাসে কি এমন করেছে যেটা আমি দুই বছরেও করতে পারিনি, যে তুমি এতটা অন্ধ হয়ে গেলে।
-তুমি দুই জন্মেও সেটা করতে পারবে না
-কেন?
কারন তুমি আশিক না। আমি ফোন রাখছি। আর আমাকে বিরক্ত করবে না।
-আমার যেটা বলার, তা না বলা পর্যন্ত আমি ফোন রাখব না
মীরা হাল ছেড়ে দিয়ে বলল
-কি বলবে বল
-আমি তোমাকে আবার ফেরত চাই
মীরা হতভম্ভ হয়ে গেল। চট করে বলার মতো কিছু খুজে পেল না। মিরাকে চুপ করে থাকতে দেখে শুভ আবারো বলল
-তুমি শুনতেঁ পাচ্ছো?
-হ্যাঁ
-কিছু বল। আমি জানি তুমি এখনো আমাকেই ভালবাসো। আমার উপর রাগ করে আশিককে নিয়ে এসব কথা বল
মীরা রাগ করতে গিয়েও হেসে ফেলল।
-আমার বিয়ে হয়ে গেছে শুভ। এখন এসব কথা বলার মানে কি?
-এটা কোন ব্যপার না। বিয়ে হলে ডিভোর্স ও করা যায়।
-তারপর তোমার বাবা মা দোকানদারের ডিভোর্সি মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজী হবে?
-আমি তোমাকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে যাব। আমার স্কলারশিপ হয়ে গেছে। তুমি শুধু একটু কোঅপারেট কর।
-শুভ তুমি আমাকে কোনদিন ও ভালোবাসোনি। আজ ও বাসো না। এখন আশিক কে দেখে তোমার ইগো হার্ট হচ্ছে। নিজেকে পরাজিত মনে হচ্ছে তাই এই রকম শুরু করেছ। একটা কথা খুব ভাল করে শুনে রাখ, আমি মরে গেলেও ওকে ডিভোর্স দেব না কারন আমি ওকে আমার নিজের চাইতেও বেশি ভালোবাসি।
মীরা ফোন কেটে দিয়ে হাপাতে লাগল। আবম্ভব পানির পিপাসা পেয়েছে। মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে পানি না খেলে ও মরে যাবে।
আশিক পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে দেখল শুভ দূরে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে কারো সঙ্গে ফোনে কথা বলছে। খুব হাত নেড়ে নেড়ে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছে। আশিক পাত্তা দিল না, সিডি বেয়ে নেমে গেল। মারুফ আর সুমন কথা বলছে। সুমন খুব করে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছে কিন্ত মারুফের মেজাজ ঠান্ডা হচ্ছে না। আশিক এগিয়ে এসে বলল
-কিরে কি হইল?
সুমন হাল ছেড়ে দেয়া ভঙ্গিতে বলল
-আরে দেখ না কি জানি ভুল করসে এখন চিল্লায়া লাভ আছে?
আশিকের ফোন বাজছে। ও ফোন তুলে বলল
-হ্যাঁ সুমনা বল
-ভাইয়া আমি কার্জন হলে ফর্ম জমা দিতে এসেছিলাম। আপনার পরীক্ষা কি শেষ?
-হ্যাঁ তুমি কোথায়?
-ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের কাছেই
-এই যে ডান দিকে তাকাও
আশিক হাত উচু করল। সুমনা হাসতেঁ হাসতেঁ এগিয়ে এসে বলল
-পরীক্ষা কেমন হল ভাইয়া?
-ভাল। তোমার কি খবর?
– ক ইউনিটের কর্ম জমা দিতে এসেছিলাম। সেই দশটায় এসেছি। এতক্ষনে শেষ হল।
-যাক ভালই হল। চল একসঙ্গে ফেরা যাক।
আশিক হাত তুলে মারুফ আর সুমন থেকে বিদায় নিয়ে এগিয়ে গেল। ওরা একটু দুরেই দাড়িয়ে সিগারেট ধরিয়েছে। সুমন একবার আড়চোখে তাকাল, কাছে এল না। মেয়েটাকে দেখলে কেমন অস্বস্তি লাগে। সেদিন আশিকদের বাসায় পরিচয় হয়েছিল। নাম শুনে সুমন হকচকিয়ে গিয়েছিল। এই নামে সত্যি কোন মেয়ে আছে ও ভাবেনি কখনো। এম্নিতেই সুমন মেয়েদের সঙ্গে একেবারেই সহজ হতে পারে না। এর অবশ্য একটা কারন আছে। একটা নয় দুটো কারন। সেদুটো হল ওর বড় দুই বোন। ওর থেকে পাচ বছরের বড়।জমজ। ওদের দুজনের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য যেন ওর জীবনটাকে আতিশঠ করে তোলা। যতদিন সুমন বাড়িতে ছিল এরা দুজন ওর জীবন নরক বানিয়ে রেখেছিল। ছোটবেলায় কখনো ওর ঘুমন্ত মুখে গোফ একে রাখত আবার কখনো ওর জামার পেছনে নকল লেজ ঝুলিয়ে দিত। আর সারক্ষন শুধু একটা কথা বলেই ক্ষেপাতো সুমন তোর সুমনা কই? ছোটবেলায় সুমন খুব কাঁদত এই কথা শুনে। একটু বড় হবার পর রাগ হত, তার ও পরে বিরক্ত হত, কিন্তু ওই দুইজনের উৎসাহের ঘাটতি কখনো হয়েনি। সেদিন মারুফ যখন পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল সুমন খুব অবাক হয়ে বলেছিল
-আপনার নাম সুমনা?
-জি
-কি করেন আপনি?
মেয়েটা ভুরু কুচকে বলেছিল
-এবার ইন্টার দিলাম।
-ও আচ্ছা। সুমনের অস্বস্তি কিছুতাই কাটছেনা। কি বলবে বুঝতেও পারছেনা। উঠে ও যেতে পারছে না। অস্বস্তি কাটাতে ও বলল
-এখানে কি বেড়াতে এসেছেন?
-জি না। কনফারেন্স এটেন্ড করতে।
সুমন কিছুই বুঝতে পারল না। কিসের কনফারেন্স সেটা জিজ্ঞেস করার সাহস ও হল না। মেয়েটাকে দেখলে ভদ্র শান্ত মনে হয় কিন্তু চোখের দিকে তাকালে বোঝা যায় দুস্টামিতে ভরা। সুমন আর কিছু বলল না। মীরা সবাইকে চা দিচ্ছিল। সুমন চা নিতে গিয়ে প্যন্টে চা ফেলে দিল। পরক্ষনেই তাকিয়ে দেখল মেয়েটা ফিক ফিক করে হাসছে। এখানে হাসির কি আছে ও বুঝতেঁ পারল না। মীরা পাশ ফিরে ধমক দিল। সুমন স্পস্ট দেখল মেয়েটা মুখে হাত চাপা দিয়ে শব্দ করে হাসছে। কি অদ্ভুত! মেয়েগুলো সব বোধহয় একি টাইপ। এদের থেকে এই জীবনে মুক্তি নেই।
আশিক সুমনাকে নিয়ে গেটের কাছে এসে বলল
-কিছু খাবে সুমনা?
-আইসক্রিম খাব
আশিক ওর হাতে আইসক্রিম দিয়ে বলল
-মীরার জন্য কিছু নিয়ে যাই। ওর কি পছন্দ বলতো
-আপার আমড়া খুব প্রিয়। ফুলের মত আমড়া
সামনেই একটা আমড়ার ভ্যন। সুমনা সেদিকে তাকিয়েই কথাটা বলেছে। আশিক গাড়ির সবগুলো আমড়া কিনে ফেলল। সুমনা আশ্চর্য হয়ে বলল
-এতগুলো কেন?
-তুমি না বললে ওর প্রিয়।
সুমনা আর কিছু বলল না। ওর মেডিকেলের পরীক্ষা খুব ভাল হয়েছে। খুব সম্ভবত হয়ে যাবে। মেডিকেলে পড়াটা ওর স্বপ্ন ছিল। চান্স পেলে ও হয়ত ওর এতটা আনন্দ হবে যতটা আশিককে দেখে হয়েছে। মীরার জন্য ঠিক এমন কাউকেই ও চেয়েছিল।
চলবে………………….

বইছে আবার চৈতী হাওয়া
৬২

ছাদে জমজমাট লুডু খেলার আসর বসেছে। দল করে খেলা হচ্ছে, এক দলে মিরা আর আফসিন, আর অন্য দলে আশিক আর সুমনা। কি করে যেন আশিকের দল জিতে যাচ্ছে। মীরা এত ভালো খেলছে এত ভালো দান পরছে তবুও মিরাদের দল কিছুতেই জিততে পারছে না। পাশেই মীরার মোবাইল রাখা একটু পর পর টুং টাং শব্দে মেসেজের আগমন জানান দিচ্ছে। মিরা পাত্তা দিচ্ছে না। একটু পরে আশিক বলল
-মীরা মেসেজ আসছে দেখো
– পরে দেখব
একসঙ্গে টুং টুং করে অনেকগুলো মেসেজ এলো। মিরার ছক্কা পড়েছে, এরপর যদি চার বা তার বেশি আসে তাহলেই ওরা জিতে যাবে। আফসিন উত্তেজিত হয়ে বলল
– ভাবি তাড়াতাড়ি মারো
আবার দুইবার টুং টুং করে শব্দ হলো। মীরা বোর্ডের উপর গুটি ফেলল , চার। আফসিন আর সুমনা ইয়াহু বলে চেঁচিয়ে উঠলো। আশিক অবাক হয়ে বলল – -সুমনা তুমি না আমার দল, তাহলে ওরা জেতায় এত খুশি হচ্ছ কেন? নিশ্চয়ই তুমি ওদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছ। বলো, বলতেই হবে।
মীরার ফোনে আবারো শব্দ হচ্ছে। আশিক বিরক্ত হয়ে বলল
-মীরা দেখো, কেউ বোধহয় জরুরী মেসেজ করছে
মীরা ফোন নিয়ে উঠে গেল। মোট সাতাশটা মেসেজ এসেছে। সবগুলোই শুভর। কেউ দেখে ফেললে কি অবস্থা হতো? শুভ বোধহয় ইচ্ছে করেই এমন করছে। মিরা টুম্পাকে একটা ফোন দিল। ও ঢাকার বাইরে না থাকলে আরো আগেই ওর সঙ্গে কথা বলত। টুম্পা ফোন ধরে ক্লান্ত গলায় বলল
-একটু আগেই ফিরছি দোস্ত। ভীষণ টায়ার্ড
– সরি, খুব জরুরী একটা দরকার ছিল
– বল না। তুই না হয় অন্য কেউ হলে ধরতামই না
– তোকে মেসেজ করেছিলাম না, ওইটাই
– কি হয়েছে? ওই হারামজাদা আবার ঝামেলা করছে ?
– হ্যাঁ
– ব্লক করে দে
– কি করে যেন করে?
– তোকে নিয়ে আর পারিনা। আরো আগেই করা উচিত ছিল
টুম্পা ব্লক করার নিয়ম বলে দিলো। মীরা নাম্বার ব্লক করে, মেসেজগুলো ডিলিট করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। নিচে থেকে খেতে ডাকছে। সুমনারা কাল চলে যাবে। এই উপলক্ষে আরিফ সাহেব বাইরে থেকে কাচ্চি বিরিয়ানি আনিয়েছেন। আরো অনেক ধরনের খাবার আনানো হয়েছে। সুমনার জন্য স্পেশালি ম্যাপল ওয়ালনাট আইসক্রিম এসেছে। এই আইসক্রিম ও আগে কখনো খায়নি, এবারই ঢাকায় এসে প্রথম খেলো এবং ঘোষণা করলো এটা ওর জীবনে খাওয়া সবচাইতে মজার আইসক্রিম। অদ্ভুত ভাবে রাশভারী আরিফ সাহেবের সঙ্গে সুমনার খুব ভাব হয়ে গেল এ কদিনে। সেদিন বিকেলে মীরা আরিফ সাহেবকে কফি দিতে গিয়ে দেখল চেম্বারে বসে দুজন গল্প করছে। সুমনা মাথা নেড়ে নেড়ে বলছে
– চাচা আমি যদি আপনাকে আগে দেখতাম, তাহলে ডাক্তার হবার চিন্তা মাথা থেকে বাদ দিয়ে লইয়ার হতে চাইতাম
– সেটা তুমি চাইলে এখনো হতে পারো
– কিভাবে?
– এটাই মজা বুঝলে, তুমি চাইলেই ডাক্তারের পাশাপাশি ওকালতিও করতে পারো কিন্তু আমি এখন চাইলেই তো মা ডাক্তার হতে পারবো না। তাই অসুখ হলে তোমার কাছেই ছুটতে হবে।
মীরার মনটাই ভালো হয়ে গেল।সুমনা যদি সত্যি সত্যি এখানে এসে পড়াশোনা করে তাহলে খুব ভালো হবে। কাল ও চলে যাবার পর বাসাটা কেমন খালি খালি হয়ে যাবে।
বড় চাচার তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও আরিফ সাহেব উনাকে বাসের টিকিট কাটতে দিলেন না। গাড়ি করে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিলেন। ওনার খুব ইচ্ছা ছিল মীরাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার। মীরার মা অনেকদিন ধরেই ওকে দেখতে চাচ্ছে। আরিফ সাহেব আশ্বস্ত করলেন আশিকের আর একটা পরীক্ষা আছে, এটা শেষ হলেই ওরা ময়মনসিংহ থেকে ঘুরে আসবে। বিয়ে তো হয়েই গেছে, কাজেই রিসেপশনের আগে গেলেও ক্ষতি নেই।
সুমনারা পরদিন সকাল সকালই রওনা হয়ে গেল। আশিক আজকে আর অফিসে গেল না। শেষ পরীক্ষার আরো তিন দিন আছে। পরীক্ষা শেষের দিকে এলে আশিকের।আর পড়তে ইচ্ছা করে না। এবারও তাই হয়েছে, আর পড়াশোনা করতে ভালো লাগছে না। ইচ্ছে করছে দূরে কোথাও পাহাড়, জঙ্গলে ঘুড়ে আসতে। ও ঠিক করে রেখেছে পরীক্ষার পর দিনই বেরিয়ে যাবে। মীরাকেএকবার জিজ্ঞেস করতে হবে ও কোথায় যেতে চায়। সেই হিসেবে টিকিট কাটতে হবে। আশিক ঘরে ঢুকে দেখলো মিরা টেবিলে বসে কিছু একটা লিখছে। ওকে দেখে চট করে কাগজটা ওর খাতার ভেতর লুকিয়ে ফেলল। আশিক একটু অবাক হলেও কিছু বলল না, ভাবলেও হয়তো কবিতা টবিতা কিছু লিখছে, ওকে দেখাতে লজ্জা পাচ্ছে। আশিক কাছে এসে বলল
– ছাদে আবে মিরা?
– চলেন যাই
ভালই হল। মীরা চাইছিল আশিকের সঙ্গে একটু ওর রিপোর্ট নিয়ে কথা বলতে, ঠিক সুযোগ হয়ে উঠছিল না। মীরা বলল
-আপনি যান, আমি চা নিয়ে আসছি
আশিক ওর একটা হাত ধরে থামিয়ে দিয়ে বলল
-চা লাগবে না, আমি কফি বানাচ্ছি
কফির মগ নিয়ে দুজন ছাদে উঠে গেল। রোদের তেজ নেই। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে আছে। বসন্তের মৃদুমন্দ বাতস। কফির মগে চুমুক দিয়ে আশিক মীরার দিকে তাকাল। মিরাকে এমন চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন? নাকি আপসেট? হয়তো সুমনারা চলে গেছে তাই।
– মিরা
– জি
– চল শুক্রবার আমরা কোথাও থেকে ঘুরে আসি
– কোথায়?
– দূরে কোথাও। এই ধরো বান্দরবান, সাজেক বা কক্সবাজার। তোমার কোনটা পছন্দ?
মীরা একটু ভেবে বলল
– আমার খুব চা বাগান দেখার সখ
– তাহলে সিলেট যাই। বাসে যাবে না ট্রেনে?
– বাস জার্নি আমার ভালো লাগেনা
– তাহলে ট্রেনের টিকেট কাটি। কি বলো?
– আচ্ছা। এর পর একটু থেমে বলল, আপনাকে আমার একটা জরুরী কথা বলার ছিল
– হ্যাঁ বলো
মীরা কিছু বলছে না অস্বস্তি নিয়ে চোখ নামিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আশিক একটু অবাক হয়ে বলল
-কি হয়েছে মিরা ?
মীরা জবাব দিল না। ওর ফোন বাজছে। ফোন ও ধরছে না।
-তোমার ফোন বাজছে মীরা
মীরা ফোনের দিকে এক পলক তাকিয়ে সেটা আশিকের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল
-এটা আপনার ফোন। আমারটা বোধহয় ভূল কোরে নিচে ফেলে এসেছি।
আশিক ফোন রিসিভ করে হ্যলো বলে চুপ করে গেল। ভুরু কুচকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল
-আচ্ছা তোরা থাক, আমি আসছি
মীরা কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে। আশিক চিন্তিত মুখে বলল
-রিপন একটা ঝামেলায় পরেছে। আমি একটু বেরুচ্ছি। ফিরতে হয়ত দেরি হবে। আসার সময় তোমার রিপোর্ট নিয়ে আসব।
-রিপোর্ট আমি নিয়ে এসেছি
-কবে?
-গতকাল দুপুরে
-বলনি তো।
-বলতাম। সমস্যা নেই আপনি যান।
-তাহলে কালকে রিপোর্ট দেখাতে যাব সকালে
মীরা আর কিছু বলল না।আশিক বেরিয়ে যাবার পর ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পরল। অবেলার ঘুম ভাঙল সন্ধার পর। আজ হঠাত করে মায়ের অভাব অনুভব করল খুব। কেমন নিঝুম বিষণ্ণ হয়ে আছে বাড়িটা। মা থাকলে বকত। সন্ধ্যা বেলা আলো না জ্বালালে রাগ করত, বেলা অব্ধি ঘুমিয়ে থাকলে ডেকে দিত। মীরা মাকে ফোন দেবে বলে ফোনটা হাতে নিয়ে চমকে গেল।
চলবে………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে