বইছে আবার চৈতী হাওয়া
৫৬
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আশিক থমকে গেলে। ঘরের আলো নেভানো। টেবিলের উপর টেবিল ল্যাম্পটা জ্বলছে শুধু । মীরাকে দেখা যাচ্ছে চেয়ারে বসে আছে। টেবিল ভর্তি বই পত্র ছড়ানো, বোঝাই যাচ্ছে পড়াশোনার চেষ্টা চলছিল। মিরা দুই হাতে মুখ ঢেকে বসে আছে। কান্নার দমকে শরীরটা কেপে কেঁপে উঠছে বারবার। আশিকের বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠলো। মীরাকে আঘাত দেওয়ার কথা ও কল্পনাতেও ভাবেনা কখনো , অথচ আজকে ওর কারণে এতটা কষ্ট পাচ্ছে মীরা।
আজ ভোর রাতে মিরা খুব ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করেছিল
আপনি কোন ঝামেলা করবেন না তো ?
আশিক জবাব দেয়নি। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেছিল “ঘুমিয়ে পড়ো” এর আরও অনেক, অনেকক্ষণ পর মীরা ঘুমিয়ে পড়ার পর আশিক উঠে তৈরি হয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল।
আজ থেকে ওদের গ্রুপ স্টাডি করার কথা জগন্নাথ হলে, রিপনের রুমে। ফাইনাল ইয়ার বলে রিপন আলাদা রুম পেয়েছে। পড়াশোনাটা এখানে ভালই হয়, আড্ডাও হয়। আজ সবারই আসার কথা। ভালই হলো। রাসেলের সঙ্গে বোঝাপড়াটা খুব জরুরী।
রিপনের রুমটা দোতালায়। জানালার পাশে খাট তার পাশে টেবিল, যদিও সবাই বসেছে মেঝেতে। ওদের সবার মধ্যে সবচাইতে ভালো ছাত্র রিপন।নোটপত্র সব ওই তৈরি করে। তবে পড়ায় সুমন। একটু মুখচোরা ধরনের এই ছেলেটা অসম্ভব ভালো বোঝাতে পারে। সবাই চলে এসেছে শুধু রাসেল আসেনি। বিছানার উপর বসে সবাই এক দান তাস খেলে নিচ্ছে আর ঘরের এক কোণে বসে সুমন নোটের পাতা উল্টে যাচ্ছে। সবাইকে বোঝাতে হলে আগে ওর একটু দেখে নিতে হবে। আশিক ঘড়ি দেখলো। সাড়ে নয়টা বাজে। রাসেলের এখনও আসার নাম নেই। আশিক হাতের কার্ডটা নামিয়ে রেখে বলল
– রাসেল এখনো এলোনা? একটা ফোন দে না।
সুমন হাতের কাগজ রেখে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল
– একটু আগে মেসেজ পাঠিয়েছে। প্রায় চলে এসেছে। ও আসলেই শুরু করব
– তোরা বস, আমি ওকে নিয়ে আসছি
– নিয়ে আসার কি আছে?
– আসছি। একটা সিগারেটও খেয়ে আসি
আশিক নেমে গেল। রাসেলকে আজকে ধরতেই হবে। ওকে আজ বলতেই হবে এই কাজটা ও কেন করল। রাসেলকে দূর থেকে হেঁটে আসতে দেখা যাচ্ছে । আশিক এগিয়ে এসে ওর কাঁধে হাত রাখল। আন্তরিক ভঙ্গিতে বলল
– চল বিড়ি খেয়ে আসি
– দুজন গেটের বাইরে বেরিয়ে সিগারেট ধরালো
– চা খাবি?
– না, চল ভেতরে যাই
রাসেল ভেতরে যেতে উদ্যত হল। আশিক ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল
– একটু পরে যাই
রাসেল কেমন একটু মিইয়ে গেল। আসিক সিগারেট ফেলে দিয়ে বলল
– তুই এই কাজটা কেন করলি রাসেল ?
রাসেল একটু কেঁপে উঠলো। মুখে বলল
– কোন কাজটা ?
– তুই জানিস না কোনটা? তুই মিরাকে ফোন করে মিথ্যা কথা কেন বলেছিস? আশিকের শরীর একটু একটু কাঁপছে । রাগটা বাড়ছে। ইচ্ছা করছে ঘুষি মেরে রাসেলের নাক ফাটিয়ে দিবে। রাসেল আড়চোখে একবার আশিককে দেখল। ভয়ে ওর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। ছোটবেলায় এরকম অনেক বার হয়েছে এবং তার ফলও হয়েছে ভয়ঙ্কর। রাসেল এগিয়ে এসে আশিকের হাত ধরল। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল
– আমাকে মাফ করে দে দোস্ত
– এটা আমার প্রশ্নের উত্তর না।
– আমার খুব রাগ হয়েছিল।
– রাগ? কার উপর?
– তোদের দুজনের উপরেই। মীরার কারনে তুই আমার কলারে হাত দিয়েছিলি।
– আর মীরা? ও কি করেছে তোর ?
– মীরা আমাকে দেখলে এমন ভাব করে যেন আমি পথের কুকুর। সবার সঙ্গে ঠিকি কথা বলে। আমি কি এতই খারাপ?
– তাই তুই প্রমান করলি যে তুই কতটা খারাপ?
– তোদেরকে একটা শিক্ষা দিতে চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম তোর ইমেজটা নস্ট হোক।
আর মীরা? ও কি করেছে তোর? ওর এই ক্ষতিটা তুই কেন করলি?
– আমি মানছি শুভকে ফোন করাটা আমার উচিত হয়েনি, দরজা বাইরে থেকে লাগানোটাও বিরাট ভুল হয়েছে, কিন্তু বিশ্বাস কর তোদের কোন ক্ষতি আমি করতে চাইনি।
আশিক অবাক হতেও ভুলে গেল। কোনমতে বলল
– তুই কি বলেছিস শুভকে?
রাসেল ভয়ে ভয়ে বলল
– বলেছি তোর আর মীরার মধ্যে কিছু আছে। ও আগেও তোর অফিসে রাত কাটিয়েছে
আশিক টের পেল ওর সমস্ত শরীর বেয়ে তীব্র ক্রোধের একটা স্রোত বয়ে যাচছে। এতক্ষনের সামলে রাখা বাধটা আচমকাই ভেঙে গেল। ও রাসেলের চোয়াল বরাবর একটা ঘুষি মারল। আচমকা এই আঘাতের জন্য রাসেল প্রস্তুত ছিল না। টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল। আশিক তবু থামল না। পেটের মধ্যে পরপর কয়েকটা লাথি মাড়ল। রাসেল বাধা দিল না। কোঁকাতে কোঁকাতে বলল
– মার, যত ইচছা মার। আমি তোর কাছে অন্যায় করেছি
– তুই মীরার সাথে এটা কেন করলি ? বল কেন করলি হারামজাদা? তোর কারনে ওর সঙ্গে শুভর সম্পর্কটা ভেঙে গেল।
রাসেল পেট চেপে ধরে উঠে দাড়াতে দাড়াতে বলল
– আমি জানি আমি অন্যায় করেছি। কিন্তু শুভ ওকে ভালবাসতো না। নহলে আমার কথা শুনে সম্পর্কটা ভাঙত না। আর তুই আমাকে না বললে কি আমি বুঝি না যে মীরাকে তুই ভাল……।
রাসেল কথা শেষ করতে পারল না তার আগেই আরো একটা ঘুসি এসে পরল ওর নাক বরাবর। নাক বেয়ে গলগল করে রক্ত ঝরতে লাগল। রাসেল নাক চেপে ধরে বলল
তুই আমাকে যত খুশি মার কিন্ত দোহাই লাগে আঙ্কেলকে বল কেসটা তুলে নিতে। বাবা এম্নিতেই অসুস্থ, এসব জানলে মরে যাবে।
আশিক এবার থামল। ও জানে রাসেলের বাবা প্যরালাইজড। ওর মা অনেক কস্ট করে ওদের সংসারটা চালিয়েছেন। ওর একটা ছোট বোন আছে। এখন ওর বিরুদ্ধে কেস হলে পরিবারটা ভেসে যাবে।
আশিক একটা হাত বাড়িয়ে রাসেল কে টেনে তুলল। তারপর বলল
চিন্তা করিস না। আমি বাবার সঙ্গে কথা বলব।
————–
আশিক আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকল। মীরার কাছে আসতেই ও চমকে মুখ তুলে তাকাল। তারপর হড়বড় করে বলল
– কোথায় ছিলেন আপনি? আমি সারাদিনে কত বার ফোন করেছি। বলতে বলতে ওর কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল। আশিক ওকে কাছে টেনে নিল, তারপর দুই হাতে ওর নিটোল মুখটা তুলে ধরে বলল
এইভাবে কাঁদে কেউ? কি অবস্থা করেছ?
মীরার ভোখ ভর্তি জল। ও আশিকের বুকের মধ্যে মুখ গুজে বলল
-কোথায় ছিলেন আপনি? রাসেল ভাইয়ের কাছে তাইনা?
-হু
-কেন? আপনার বিশ্বাস হয়েনি আমার কথা?
-হয়েছে তো?
-তাহলে কেন?
-আমার জানার দরকার ছিল ও এটা কেন করেছে।
-আমার ফোন ও ধরেননি সারাদিন
-আচছা ভুল হয়েছে আমার। সরি
-আমি কত টেনশনে ছিলাম। আপনাকে আমি, আমি কতবার বললাম আমি উনার কথা বিশ্বাস করিনি।
আশিক ওর ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে বলল
-আমি জানি তুমি ওর কথা বিশ্বাস করনি, করলে তুমি আমার এত কাছে আসতে না।
মীরা জবাব দিল না। আশিক ওঁর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল
এখন আর একটু কাছে আসবে?
কাছেই তো আছি। আর কত কাছে আসব?
আশিক ওকে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিতে নিতে বলল
“কাছে আসো আরো কাছে, সহজেই যেন চোখে পড়ে
তোমার সূক্ষ্ম তিল, আঙুলের সামান্য শিশির
যেন দেখি তোমার সজল চোখ, তোমার মদির সলজ্জতা
দূরদৃষ্টি নেই মোটে, কেবল কেবল সন্নিকটে।
তুমি খুব কাছে আসো, খুব কাছে, ঠিকই খুব কাছে
যতোখানি কাছে এলে আর কোনো আড়াল থাকে না”
চলবে…………
বইছে আবার চৈতী হাওয়া
৫৭
– তুমি রাতে কিছু খেয়েছ মীরা?
মীরা মুখ তুলে আশিকের বুকের উপর চিবুক ঠেকিয়ে বলল
– না
– দুপুরে?
মীরা জবাব দিল না ওর বুকের মধে মুখ ডুবিয়ে শুয়ে রইল।
– খাওনি তাই না?
– আপনি ও তো খাননি
আশিক অবাক হয়ে বলল
– তুমি কি করে জানলে?
– আমি জানি
– চলো বাইরে থেকে খেয়ে আসি
মীরা মুখ তুলে বলল
– এখন?
– কেন? সমস্যা কি?
– এখন রাত সাড়ে এগারটা বাজে। এই সময় বাইরে কোথায় যাব? এখন সব দোকান বন্ধ না?
– তোমাকে এমন জায়গায় নিয়ে যাব যেটা সারারাত জমজমাট থাকে।
মীরা এক হাত দিয়ে আশিককে জড়িয়ে ধরে বলল
– আমার এখন কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না
– কেন? মন ভরেনি?
মীরা কিছু বলল না, আগের মতোই ওর বুকের মধে মুখ ডুবিয়ে শুয়ে রইল। আশিক হাসতে হাসতে বলল
– ঠিক আছে ওখান থেকে ফিরে আসি, তারপর……
আশিক কথা শেষ করতে পারল না, মীরা এক হাতে ওর মুখ চেপে ধরে বলল
– এত খারাপ কেন আপনি?
– আরো খারাপ হবার আগেই তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও
মীরা ভয়ে ভয়ে উঠে গেল। এই লোকের কোন ভরসা নেই। কখন কি বলে বসে আগে থেকে বোঝার কোন উপায় নেই। মীরা উঠে আলমারি খুলল
– মীরা
– জি
– তোমার কোন কালো শাড়ি আছে?
– হ্যাঁ, কেন?
– একটা কালো শাড়ি পর তাহলে
– কালো শাড়ি কেন?
আশিক সিগারেটের প্যকেট হাতে বারান্দায় যেতে যেতে বলল
– আমার অমন টুকটুকে বউকে এই রাতের বেলা রঙ্গিন শাড়িতে বাইরে নেই কিকরে?
মীরা থমকে গেল। খুব ইচ্ছে হল দৌড়ে গিয়ে আশিককে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে কিন্তু সাহস হল না, আবার কি থেকে কি বলে বসে।
মীরা খুব যত্ন করে ধূসর পাড়ের কালো একটা সুতির শাড়ি পরল। ঘন করে কাজল দিল চোখে। ছোট্ট একটা কালো টিপ ও পরল। ভেবেছিল আশিক ওকে দেখে সুন্দর কোন মন্তব্য করবে, কিন্তু আশিক ওর দিকে ফিরেও তাকাল না। সাবধানে ওকে নিয়ে সিড়ি দিয়ে নেমে, পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। ছোট একটা গলি পার হলেই বড় রাস্তা। আশিক একটা রিক্সা নিয়ে নিল। রিক্সায় উঠে মীরা বলল
– ভাগ্যিস পেছনের দরজাটা ছিল। বাবা দেখতে পেলে ভীষণ রাগ করতেন।
– সমস্যা নেই। সেই স্কুল লাইফ থেকে আমি এই দরজা দিয়ে বাইরে বের হই। বাবা টের পান না।
– রাতের বেলা কেন বের হতেন?
– আমরা চার বন্ধু মিলে রাস্তায় হাটতাম। আমি, রাসেল, মামুন আর বাবু
– বাকীরা কোথায় এখন?
– মামুন দেশের বাইরে চলে গেছে আর বাবু খুলনা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। মীরা হুট তুলে দেব?
– দিন
– একটা সিগারেট ধরালে কি তোমার কোন সমস্যা হবে?আশিক বাইরের দিকে তাকিয়েই জানতে চাইল।
– না, হবে না।
আশিক সময় নিয়ে সিগারেট ধরাল। তারপর বুক ভরে ধোয়া টেনে বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে বলল
– কালো শাড়িতে তোমাকে এত সুন্দর লাগবে জানলে অন্য রঙ্গের শাড়ি পরতে বলতাম।
মীরা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। এই মানুষটার মধ্যে এত রহস্য কেন?
খাবারের দোকানে গিয়ে মীরা আরেক দফা আবাক হল। এত রাতে এত মানুষ কেন এখানে? মনেই হচ্ছে ন যে রাত। আশিক ওকে অবাক হতে দেখে বলল
– এত অবাক হচ্ছ কেন?
– এটা কোন যায়গা?
– কাজী আলাউদ্দিন রোড । হাজীর বিরিয়ানী । নাম শোননি?
– শুনেছি। কখনো দেখিনি।এত রাতে এখানে এত মানুষ আসে?
– এই পুরানো ঢাকা হল রাতের শহর কায়রোর মতন । রাত যত বাড়ে ততই জমে ওঠে। এখন কি খাবে বল?
খাওয়া দাওয়া শেষ করে ফিরতে ফিরতে প্রায় রাত শেষ হয়ে গেল। ভোরের আগে ওরা বাড়ী পৌছল,সেই পেছনের গেট দিয়েই। ক্লান্তিতে মীরার চোখ বুজে আসছিল। ঘরে ঢুকে ও শাড়ি না পাল্টেই শুয়ে পড়্ল, এবং কিছুখনের মধেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।
মীরার যখন ঘুম ভাঙল ততক্ষনে সূর্য অনেকটাই উপরে উঠে গেছে। ও সময় নিয়ে গোসল করল। নিচে যাবার আগে একবার লাইব্রেরী রুমে উকি দিল। টেবিলের উপর খাতায় কিছু লেখা। এই প্রথম আশিক কবিতা নয় নিজে থেকে কিছু লিখেছে। মীরা খাতাটা তুলে পড়ল।
“ গ্রুপ স্টাডি করতে যাচ্ছি। ফিরতে দেরি হবে। খেয়ে নিও। আমার বিরহে আবার না খেয়ে থেক না।”
মীরা কাগজটা তুলে গালের সঙ্গে ছোঁয়াল। এত খারাপ একটা লোক।
মিরার আজকে ক্লাস নেই। সারাদিন ও ঘর গোছাল, আফসিনের সঙ্গে গল্প করল টুকটুক রান্নাও করল একটু । চিকেন সমুচা আর ডালপুরি বানিয়ে ফেলল। দুপুরে আশিককে ফোন করে খোজ নিল খেয়েছে কিনা। আশিক জানাল হলে ভাত খেয়েছে , এখন ওর অফিসে আছে, পড়াশোনা করছে।
বিকেলের দিকে মীরা চিকেন সমুচা আর ডালপুরি সহ আরো কিছু খাবার ব্যগে ভরে আশিকের অফিসে চলে গেল। মজার ব্যপার হল আশিক ওকে দেখে একটু ও অবাক হল না। হাসতে হাসতে বলল
– তুমি এখানে?
– টেইলারের কাছে কাপড় দিতে এসেছিলাম, ভাবলাম আপনাকে চা বানিয়ে দিয়ে যাই
– কোন টেইলার?
– কাছেই, রাস্তার উল্টোদিকে
– দিয়েছ কাপড়?
– হু
– ও আচ্ছা । বানাও চা, খাই তাহলে
মীরা চায়ের সঙ্গে খাবারগুলো বের করে সামনে দিল। আশিক আয়েশ করে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সমুচা খেতে খেতে বলল
– তোমার টেইলারকে সমুচা না খাইয়ে আমাকে দিয়ে দিচ্ছ যে, টেইলার রাগ করবে না তো?
মীরা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। টের পেল ওর চোখ ভিজে উঠছে। একটা মানুষের প্রত্যেকটা কথা কি করে এত ভাল লাগতে পারে? মীরা উঠে ছাদ বারান্দায় চলে গেল। রেলিঙে ভর দিয়ে দূরে লেকের স্থির জলের দিকে চেয়ে রইল। মীরা টের পেল আশিক ওর পেছনে এসে দাড়িয়েছে। আশিক ওকে ধরল খুব আলতো করে তারপর ওর চুলের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে বলল
– একটা কবিতা শুনবে মীরা?
মীরা সামনে ফিরে বলল
– শোনান
আশিক দুইহাতে ওর মুখটা তুলে ধরে বলল
“আমার যৌবনে তুমি স্পর্ধা এনে দিলে
তোমার দু’চোখে তবু ভীরুতার হিম।
রাত্রিময় আকাশে মিলনান্ত নীলে
ছোট এই পৃথিবীকে করেছো অসীম।
বেদনা-মাধুর্যে গড়া তোমার শরীর
অনুভবে মনে হয় এখনও চিনি না
তুমিই প্রতীক বুঝি এই পৃথিবীর
আবার কখনো ভাবি অপার্থিবা কিনা।
তোমার শরীরে তুমি গেঁথে রাখো গান
রাত্রিকে করেছো তাই ঝঙ্কারমুখর
তোমার ও সান্নিধ্যের অপরূপ ঘ্রাণ
অজান্তে জীবনে রাখো জয়ের সাক্ষর।
যা কিছু বলেছি আমি মধুর অস্ফুটে
অস্থির অবগাহনে তোমারি আলোকে
দিয়েছো উত্তর তার নব-পত্রপুটে
বুদ্ধের মূর্তির মতো শান্ত দুই চোখে।।”
চলবে…………
আজকের কবিতার নাম “তুমি” লিখেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
বইছে আবার চৈতী হাওয়া
৫৮
আশিকের পরীক্ষা শুরু হতে আর দশ দিন বাকী। এখন আর কেউ গ্রুপ স্টাডি করছে না। যে যার মতো পড়ছে। ভোর হতেই ও উঠে অফিসে চলে যায়। মীরা হয়ত তখনো ঘুমে। সকালে ক্লাসে যাবার আগে মীরা একবার আসে, সঙ্গে করে ব্রেকফাস্ট নিয়ে আসে। দুজনে একসঙ্গে নাস্তা খায়। তারপর মীরা চা করে। ছাদ বারান্দায় দাঁড়িয়ে চা খেতে খেতে গল্প হয় কতক্ষণ। মাঝে মাঝে মীরা ক্লাস শেষ করেও আসে। দুজনে একসঙ্গে লাঞ্চ করে। আশিকের মাঝে মাঝে মনে হয় এগুলি সত্যি নয়। পুরোটাই একটা স্বপ্ন। এই হয়ত চোখ খুলে দেখবে ক্যম্পাসের গলি ঘুপছিতে কোথাও পড়ে আছে একদল ছেলের সঙ্গে। সেই ভবঘুড়ে জীবনটার জন্য কখনো আফসোস হয়না আশিকের। সেসময় এক আপার স্বাধীনতা ছিল এটা সত্যি কিন্তু বুকের ভিতর ছিল এক প্রকান্ড শূন্যতার গহবর। মীরা এসে কি করে যেন সেটা একেবারে কানায় কানায় পূর্ণ করে দিয়েছে।
প্রথম পরীক্ষার দিন প্রায় দুমাস পর শুভর সঙ্গে দেখা হল আশিকের। একবার চোখাচোখি হলে ও চোখ ফিরিয়ে নিল। কথা হল না কোন। শুভ অবশ্য কারো সঙ্গেই কথা বলল না। প্রতিদিনই পরীক্ষা শুরু হবার পর হলে ঢোকে, আবার সবার আগে শেষ করে বেরিয়ে যায়। আশিক ইচ্ছা করেই আর ঘাটায় না। শেষ দিন ফোনে ও বলেছিল, মীরা কিংবা আশিকের কোন ব্যপারে ও আর থাকতে চায় না। যতটা নির্লিপ্ত ভাব দেখিয়েছিল ততোটাও বোধহয় হতে পারেনি। কারন ওই ঘটনার পর ও বাবা মায়ের সঙ্গে দেশের বাইরে চলে গিয়েছিল বলে শোনা গেছে। পরীক্ষার জন্য দুদিন আগে ফিরেছে।
আশিকের পরীক্ষা এবার বেশ ভাল হচ্ছে। এমনিতে ও সারাবছর পড়াশোনা করে না। ক্লাস ও মিস করে প্রচুর, তবে গ্রুপ স্টাডিটা ওর খুব কাজে দেয়। এর পর নিজে একটু পড়লেই মোটামটি উৎরে যায়। তাছাড়া আশিকের লেখার হাত ভাল। অনুবাদ নিয়ে কাজ করার দরুন ভাষার উপর দখলটাও পর্যাপ্ত। সবচেয়ে বড় কথা এবার মীরা ওর খুব যত্ন করছে। সাধারনত পরীক্ষা শুরু হবার পর ওর আর পড়াশোনা করতে ইচ্ছা করেনা। একটা পরীক্ষা শেষ করে আর পরেরটার জন্য পড়তে ভাল লাগে না। আগেতো এমন ও হয়েছে পরের পরীক্ষার আগে ও দুদিনের জন্য ঢাকার বাইরে চলে গিয়েছিল। একবারে পরীক্ষার দিন সকালে ফিরেছে। কিন্তু এবার সেসব কিছুই হচ্ছে না। যেদিন পরীক্ষা থাকে মীরা ওকে আর কোথাও যেতে দেয় না। পরদিন সকাল থেকে আবার অফিসে পাঠিয়ে দেয় পড়তে। ফোন করে খোজ নেয়। নিজে আসতে না পারলে বাড়ি থেকে দুপুরের খাবার পাঠিয়ে দেয়।
আশিকের পরীক্ষা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ঠিক হয়েছে পরীক্ষার পর ওদের রিসেপসান হবে। মীরার বড় চাচা অবশ্য বলেছিলেন বিয়ের দুমাস হয়ে গেছে একবার এখান থেকে বেড়িয়ে যেতে। আশিক এখন না পারলে অন্তত মীরা কদিনের জন্য এসে ঘুরে যাক। পরীক্ষার জন্য আশিকের পক্ষে যাওয়া সম্ভব না আর ওকে ফেলে একা যেতে মীরার মন চাইল না। ও জানিয়ে দিল রিসেপসানের পর দুজন এক সঙ্গেই যাবে।
আজ পহেলা বৈশাখ। ডিপার্টমেন্টে বেশ জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান হচ্ছে। আশিকরা পরীক্ষার্থী, তাই নতুন ফাইনাল ইয়ার আয়োজন করছে। মীরার যেতে মন চাইল না। ঘুম থেকে উঠে ও দেখল আশিক বেরিয়ে গেছে। মীরা একবার আফসিনের রুমে উকি দিল। মেয়েটার গলদঘর্ম অবস্থা। একগাদা জামা কাপড় বের করে বিছানার উপর ছড়িয়ে রেখেছে। মিরা ভেতরে ঢুকে বললো
– তুমি প্রোগ্রামে যাচ্ছো আফসিন?
– হ্যাঁ ভাবি
– এতসব ড্রেস বের করেছো কেন?
– কোনটা পরবো বুঝতে পারছি না
– তুমি ড্রেস পড়বে কেন? শাড়ি পড়ে যাও। আজকে তো সবাই শাড়ি পরবে
আফসিন মন খারাপ করা গলায় বলল
– আমি ঠিক মতন শাড়ি পড়তে পারি না। তাছাড়া এক্সেসরিজ ও কিছু রেডি নেই
– আমি পরিয়ে দিচ্ছি। সমস্যা নেই
আলমারি খুলে মীরা অবাক হয়ে গেল। বেশ অনেকগুলো লাল সাদা শাড়ি। এগুলো রেখে বোকা মেয়েটা ড্রেস পরতে যাচ্ছিল। মিরা একটা অফ হোয়াইট আর সাদা মনিপুরী তাতের শাড়ি বের করল। আফসিনকে শাড়ি পরানোর পর ও নিজের ঘর থেকে নিজের বানানো গহনার বাক্সটা নিয়ে এলো। সাদা আর লালের উপর করা একটা সেট ওকে পরিয়ে দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়েও দিল। মেয়েটা দেখতে এত মিষ্টি অথচ ভালো মতো সাজতেই পারেনা। নিজেকে দেখে আফসিন অবাক হয়ে বলল
– আমাকে তো চেনাই যাচ্ছে না
– অনেক সুন্দর লাগছে তোমাকে। তুমি আমাকে আগে বলনি কেন?
আফসিন একটু লজ্জা পেয়ে বলল
– এমনিই। ভাবলাম তুমি ব্যস্ত, তাই
– আরে ধ্যত। আমাকে আগে বললে আমি তোমাকে মেহেদী ও পরিয়ে দিতাম
– তুমি মেহেদী ও পরাতে পারো?
– হু, পারি তো। আজকে রাতে তোমাকে পরিয়ে দেব
– আচ্ছা। এত সব গয়না কার ভাবি?
– আমার। আমার একটা গয়নার পেজ আছে। “পলকা ডট” নাম । ওখান থেকেই সেল করি
– বল কি? আমি তো জানতামই না। তোমার পেজ এর লিঙ্ক দিও। আমার ফ্রেন্ডদের দেব।
– আচ্ছা, পাঠিয়ে দেব। তুমি ছাতা আর পানির বোতল নিয়ে যাও। আজকে অনেক গরম
আফসিন মীরাকে জড়িয়ে ধরে বলল
– থ্যঙ্ক ইউ ভাবী।
মীরা কিছু বলল না। হাসলো একটু।
– তুমি কোথাও যাবে না?
– তোমার ভাইয়া এলে বিকেলে একসাথে বের হব।
আফসিন চোখ টিপে দুষ্টামির হাসি হেসে চলে গেল।
আফসিন বেরিয়ে যাবার পর বহুদিন পর মীরা ওর পেইজটা ওপেন করল। বেশ অনেকগুলো ভাল রিভিউ এসেছে। অনেকেই নক করেছিল বৈশাখ অফারের জন্য। অনেকদিন মীরা একেবারেই সময় দেয়নি। শুধু পেজ না বাড়ীতেও আজকাল কথা হয় খুব কম। হঠাত করেই বাড়ীর কথা খুব মনে পড়তে লাগল। ওখানে থাকতে প্রতি বছর ওরা তিন বোন সৌরভের সঙ্গে বৈশাখী মেলায় যেত। আজ সুমনার জন্মদিন। ওকে উইশ ও করা হয়েনি এখন পর্যন্ত। মীরা সুমনাকে একবার ফোন দিল। ধরল না। হয়ত ব্যস্ত। মীরা ফোন রেখে ওর গয়নার ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে গেল।
আশিক আজ একটু তাড়াতাড়িই ফিরল। মিরাকে নিয়ে বাইরে যাবে বলেছে। ঘরের দরজায় পা দিয়ে ও থমকে গেল। মিরা ফোনে কারো সঙ্গে কথা বলছে। একটা শব্দই শুধু আশিকের কানে এলো
“ শুভ “
চলবে……
বইছে আবার চৈতী হাওয়া
৫৯
মীরা তাকিয়ে দেখল আশিক ঘরের ভেতর না ঢুকে বেরিয়ে যাচ্ছে। ও কান থেকে ফোন সরিয়ে বলল
-শুনুন
আশিক ফিরে তাকাল, ঘরে ঢুকল না। মীরা ফোনের উপর হাত চাপা দিয়ে বলল
-আজকে সুমনার জন্মদিন। আপনি ওকে একটু উইশ করে দিন না। ও খুব খুশি হবে।
আশিক কিছুক্ষন বোকার মতন তাকিয়ে রইল। তারপর বলল
-তুমি সুমনার সঙ্গে কথা বলছিলে?
-হ্যাঁ, কেন আপনি কি ভেবেছেন?
-কিছুনা, দাও কথা বলি
আশিক ফোন নিয়ে বারান্দায় চলে গেল।
মীরা ঘর থেকেই দেখল আশিক বারান্দায় হাটতে হাটতে কথা বলছে। হাসছে একটু পরপর। এত কিসের কথা সুমনার সঙ্গে? ওদের তো ঠিক মত পরিচয় ও হয়েনি। এর ও আরো অনেকক্ষণ পর আশিক ভেতরে এসে মীরার হাতে ফোন ফিরিয়ে দিয়ে বলল
-আজকে ওর জন্মদিন আগে বলনি কেন? আমরা কোন উপহার পাঠাতাম। যাক কালকে তো আসছেই তখন দিয়ে দিও। আমি গোসল করতে যাচ্ছি। তোমার কথা শেষ হলে রেডি হয়ে নিও।
মীরা হতভম্ভ হয়ে গেল। সুমনা কাল আসছে? কই ওকে তো একবার ও বলল না।
মীরা ফোন কানে ঠেকিয়ে ঝাঁঝের সঙ্গে বলল
-তোরা কাল আসবি আমাকে একবার ও বললি না তো।
-কি বলব? তুমি শুভ জন্মদিন বলেই, যে তোমার জামাইয়ের গল্প শুরু করলা আর চান্স কোথায় পেলাম।
-কি এত কথা বলছিলি তুই ওনার সঙ্গে?
-এহ! ওনার সঙ্গে? আপা আমি জীবনে অনেক বউ পাগল ছেলে দেখেছি কিন্তু তোমার মতো জামাই পাগলী মায়ে দেখিনি।
-কি সব ফালতু কথা বলছিস?
-মানলাম ভাইয়া একটু বেসিই হ্যন্ডসাম তাই বলে তোমার এই অবস্থা?
-তোর বেশি হাত পা গজিয়েছে সুমনা। আয় তুই এইবার।
-আমার হাত পা আগেই ছিল। তুমি জামাইয়ের প্রেমে অন্ধ তাই দেখতে পাওনি
-বেশি কথা ফুটেছে তাই না? আয় কালকে। চড় মেরে তোর সব দাত আমি খুলে ফেলব।
সুমনা কিছুক্ষণ ফিক ফিক করে হাসল। তারপর দুজন একসঙ্গে শব্দ করে হেসে উঠল। কতদিন পর এভাবে ঝগড়া করল। আগে প্রতিদিন ঝগড়া না করলে দুজনের ভাতই হজম হত না। মীরা আদুরে গলায় বলল
-তুই কার সঙ্গে আসবি রে? সৌরভ ভাইয়ের সাথে ?
-না , বড় চাচার সাথে
মীরার মুখ আনন্দে ঝলমল করে উঠল। কি ভীষণ দেখতে ইচ্ছা করছিল বড় চাচাকে।
-কখন আসবি রে তোরা?
-নয়টার বাসে রওয়ানা দিব। বিকেলে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসব।
মীরা ভুরু কুচকে বলল
-দেখা করতে আসব মানে? তোরা আমার এখানে উঠবি না?
-না, আমরা তো ছোট খালার বাসায় উঠছি।
-কেন? তোরা এখানে না উঠলে বাবা খুব রাগ করবে।
-আমার শশুর
-আপা, তুমি তো একেবারেই এই বাড়ির হয়ে গেছ।
-এই, হয়ে গেছি আবার কিরে? এটা তো আমারই বাড়ি। এখন ফোন রাখ। দেখি তোরা কেমন করে এখানে না উঠিস।
মীরা এক দৌড়ে নিচে চলে গেল। আজ ছুটির দিন বলে আরিফ সাহেব ঘরেই ছিলেন। মীরা দরজায় টোকা দিয়ে বলল
-বাবা আসব?
-হ্যাঁ মীরা এস।
এখন আর মীরার আগের মত আশস্তি হয়েনা। সম্পর্কটা অনেকটাই সহজ হয়ে গেছে।
-কিছু বলবে মা?
-জি বাবা। কাল বড় চাচা আর সুমনা আসবে বাড়ি থেকে
– এতো খুশির কথা। বিয়ের পর এই প্রথম আসছেন। আমি রফিক কে বলে দেব, গাড়ি নিয়ে চলে যাবে।
মীরা মন খারাপ করা গলায় বলল
-বাবা ওনারা এখানে উঠতে চাইছেন না। আমার খালার বাসায় উঠবেন বলেছেন
-সে কি? মেয়ের বাড়ি থাকতে অন্য জায়গায় কেন উঠবেন? ঠিক আছে আমি এজাজ ভাইয়ের সঙ্গে ফোন করে কথা বলব। তুমি চিন্তা করো না।
-থ্যঙ্ক ইউ বাবা। আসলে সামনের সপ্তাহে সুমনার মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষা, এখানে থাকলে ওর পড়াশোনার খুব সুবিধা হত।
-বাহ! ঢাকায় চান্স পেলে এখানে থেকেই পড়তে পারবে। বেশ ভাল হবে।
ব্যপারটা চিন্তা করেই মীরার মনটা ভাল হয়ে গেল।
মীরার হাসি মুখ দেখে আরিফ সাহেবের খুব ভাল লাগল। মেয়েটা আসার পর বাড়িটা কেমন প্রান ফিরে পেয়েছে। মেয়েটা বড় লক্ষ্মী। উনি আবারো বললেন
-আশিক ফিরেছে? তোমরা বাইরে কোথাও যাবে না?
-জি বাবা । একটু পরেই বের হব
-যাও ঘুরে এস। আজকে একটা ভাল দিন
-আপনাকে কফি দেই?
-কফি দেবে? দাও।
মীরা শশুড়কে কফি দিয়ে ফিরে এসে দেখল আশিক তখনো গোসল সেরে বের হয়েনি। ও আলমারি খুলে শাড়ি বাছতে লাগল, এবং কিছুক্ষণ পরেই টের পেল আশিক এসে ওর পেছনে, একেবারে ওর গা ঘেঁসে দাড়িয়েছে। অবচেতন মনে মীরা অনেক কিছু ভেবে ফেলল। কয়েক মুহূর্ত ওই ভাবেই কাটল। মীরাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। মীরার নিশ্বাস ভাড়ী হয়ে ওঠার আগেই আশিক ওর মাথার ওপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে একটা শাড়ি টেনে নিয়ে বলল
-এটা পরলে তোমাকে অনেক সুন্দর লাগবে।
মীরা কিছু বলল না। সামনের দিকে ফিরে আশিকের অনাবৃত বুকে মুখ রাখল। আশিক একটু চমকে গেল। মীরা সচরাচর এমন করে না। ও এক হাতে ওর কপাল গাল ছুঁয়ে বলল
-তোমার শরীর এত গরম কেন মীরা? তোমার কি জ্বর এসেছে?
মীরা জবাব দিল না। দুই হাতে ওকে জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে বুক ভরে শ্বাস নিল। মাঝে মাঝে ওর মনে হয় আশিকের বুকের মধ্যে একটা টলটলে স্বচ্ছ দীঘি আছে। যেখানে অজস্র পদ্ম ফুল ফোটে, যার ধার ঘেঁষে আছে নাম না জানা সব বুনো ফুলের গাছ। মাঝে মাঝেই মীরা সেই ফুলের গন্ধ পায়। ওর খুব ইচ্ছে করে একদিন সেই দীঘির জলে গা ভেজাতে।
আশিক জবাব না পেয়ে বিচলিত কন্ঠে বলল
-তোমার গা ভর্তি জ্বর। চল বিছানায় শোবে
মিরা জড়ানো কন্ঠে বলল
-থাকি না আর একটু। কি ঠান্ডা। খুব আরাম লাগছে।
আশিক কথা শুনল না। দুই হাতে ওকে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। কিরকম পাখির মতো হাল্কা। মীরা কি বরাবরই এমন ছিল, নাকি এখানে এসে ওর এই অবস্থা হয়েছে। আশিকের নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হল। এখানে এসে অবধি মীরা সবার এত যত্ন করছে অথচ ওকে দেখার তো কেউ নেই। মীরার কি খুব কষ্ট হচ্ছে এখানে? কদিন ধরেই ও খেয়াল করেছে মীরার শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। কেমন ক্লান্ত দেখায়।
-ওষুধ খাবে মীরা ?
-না, ইচ্ছা করছে না।
আশিক আবারো ওর কপালে হাত রাখল। হাল্কা গরম, ঠিক জ্বর নয়। ও উঠে ঘরের পর্দা টেনে দিল। দরজা বন্ধ করে কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল
-কষ্ট হচ্ছে মীরা?
-না, ঘুম পাচ্ছে
-তাহলে ঘুমাও
-বাইরে যাবেন না?
-তুমি উঠলে তারপর যাব
মীরা চেষ্টা করেও চোখ খোলা রাখতে পারছে না। এত রাজ্যের ঘুম কোথা থেকে এল ওর চোখে? কিছুতেই ঘুমাতে ইচ্ছা করছে না। কত কি প্ল্যান করে রেখেছিল। আশিকের সঙ্গে এটা ওর প্রথম বৈশাখ। কত কি ভেবে রেখেছিল। সব মাটি হয়ে গেল এই ছাতার ঘুমের জন্য।
মীরার যখন ঘুম ভাঙল তখন সারা ঘর জুড়ে অবছা অন্ধকার। আশিক ওর পাশেই ঘুমাচ্ছে। এক হাতে ধরে আছে আলতো করে। ঘুম হওয়াতে বেশ ঝরঝরে লাগছে। মীরা উঠতে গেলে আশিক ওকে কাছে টেনে নিয়ে বলল
-ঘুম হয়েছে?
-হু, আমি আপনার পুরোটা দিন নস্ট করে দিলাম।
-নস্ট হবে কেন?
-কোথাও যেতে পারলেন না।
-এখন যাব। ভালই তো হয়েছে, দুপুরে অনেক গরম আর ভীড় ছিল। চল কোথাও খেতে যাই। তুমি তো কিছুই খাওনি।
-কে বলল?
-বলতে হবে কেন? আর শোন, কালকে তুমি আমার সঙ্গে ডাক্তারের কাছে যাবে।
-পরশু না আপনার পরীক্ষা? পরীক্ষার পরে যাই?
-না, কালকেই। তুমি ভীষণ অনিয়ম করছো। এইরকম করলে তোমার কঠিন শাস্তি হবে।
-আপনি আমাকে শাস্তি দেবেন?
আশিক এই প্রশ্নের জবাব দিল না। বরং বলল
-আমাকে একটা কথা বলতো। আর কতদিন আমাকে আপনি বলবে?
মীরা একটু লজ্জা পেয়ে গেল
-কেন আপনার খারাপ লাগে?
-হু, মনে হয় তুমি আমাকে অনেক দুরের কেউ ভাবো
-তুমি বললেই কি খুব কাছে আসা যায়?
-হয়ত যায় না, তবু আমি চাই তুমি আমাকে তুমি করে বল। নাম ধরে ডাকো।
-আচ্ছা বলব। একটা বিশেষ দিন থেকে বলব।
-আজ সেই বিশেষ দিন না?
-উহু, আজ না ,তবে খুব তাড়াতাড়ি আসবে।
আশিক হেসে ফেলল। তারপর বলল
-আচ্ছা আমি সেই বিশেষ দিনের অপেক্ষা করব।
-আমি আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
-হু
-আপনি সত্যি আমাকে নিয়ে কবিটা লিখেছেন?
আশিক একটু ক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বলল
“আমি তোমাকে কবিতায় লিখিনা
গানেও লিখি না।
কেনো না আমার গান
আমার সকল কবিতা
তোমার জন্যই লেখা।
আমি তোমার জন্য লিখি কিন্তু
তোমাকে কখনো লিখি না”
মীরাকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাসতে হাসতে বলল
-কি হল?
-এটা আপনি লিখেছেন?
-ধুর বোকা! এটা তো রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর লেখা
-তাহলে আপনার গুলা কখন শোনাবেন?
-শোনাব। পুরো খাতাটাই তোমাকে দিয়ে দেব।এখন উঠে তৈরি হয়ে নাও
-আপনি আগে যান
-আচ্ছা
আশিক উঠে ওয়াশরুমে চলে গেল। মীরার উঠতে ইচ্ছা করছে না। কেমন একটা মায়াবী মিস্টি অনুভুতি হচ্ছে। মীরা আবেশে চোখ বুজে রইল। বালিশের নিচে ফোন বাজছে । ধরতে ইচ্ছা করছে না। মীরা চোখ বুজেই ফোন কানে ঠেকিয়ে বলল
-হ্যালো
-কেমন আছো মীরা?
-কে?
-এখন কি আমার ভয়েস ও চিনতে পারো না?
-না, কে আপনি?
-আমি শুভ
চলবে……